
ষাটের দশক ছিল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তা দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করি না কেন। ছেচল্লিশের মন্বন্তর পেরিয়ে, দেশভাগ হয়ে পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রেক্ষিতে দানা বেঁধে ওঠা স্বাধিকার আন্দোলন তখন বিকাশ লাভ করছে। গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রাণিধাকারের স্বপ্ন। অন্যদিকে এই অঞ্চলের বাইরে কী ঘটছে? ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হয়েছে, সাদা-কালোর বিভেদ চরম আকার ধারণ করেছে, তৃতীয় বিশ্বে পুঁজিবাদের ধাক্কা লাগা শুরু হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের নীরব প্রতিযোগিতা পুঞ্জীভূত হচ্ছে, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হয়েছে, ব্রিটিশদের একের পর এক উপনিবেশ গুটিয়ে আনার পরে নতুন শাসনব্যবস্থার প্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারের আবহমান কাঠামো, কমিউনিস্ট-শাসিত দেশগুলোতে একের পর এক অদ্ভুতরকম আইন পাস হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ওইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ। সবগুলো ঘটনার কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও উপনিবেশ (নব্য, পরোক্ষ ও বিশেষায়িত )-এর নিয়ন্ত্রণ।
কেন্দ্রীভূত এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ- অস্বীকার। বিশ্বব্যাপী তরুণদের প্রধান লক্ষ্যণও ছিল তাই। প্রথমে অস্বীকার, এর পর প্রতিবাদ। বিট জেনারেশন, অ্যাংরি জেনারেশন, হাংরি জেনারেশন- এরকম নানা নামে ডাকলেও তাদের কেন্দ্রে ছিল ওই বীজ- অস্বীকার করো। তার পর করো প্রতিবাদ। তার পর প্রাপ্য বুঝিয়ে নাও। তার পর নিয়ন্ত্রণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠা করো সাম্য ও মানবিক মর্যাদা।
কবি রফিক আজাদ ঠিক ওই সময়ের সন্তান। বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের যে লক্ষ্যণ ও বৈশিষ্ট্য ওই সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল- বাংলা ভাষার কবি রফিক আজাদের মধ্যে সেসবের পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি ছিল। না হলে কীভাবে তিনি বলতে পারেন ‘এটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই- আমি/ ধ্বংস ও শন্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না/... ভিতর-মহল জেঁকে বসে আছে লাল বর্ণমালা’।
ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে বিশাল দূরত্ব তিনি মানেন না। এই না-মানার মধ্যে রয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। যদিও তা সহজ নয়। কারণ ‘দেয়ালে দেয়ালে অনীবার্য অন্ধকার’। সেই অন্ধকারের স্বরূপ উন্মোচন করে করেই-না এগোতে হয়। কিন্তু তার ভেতরে তো বীভৎস্য সত্যের আচ্ছাদন! সেখানে মানুষের মৌলিক উপলব্ধির গভীর জগৎ। সেই গভীর জগতের ভেতরে যে সত্য সেই সত্য একসময় তাকে বলতে বাধ্য করে, ‘আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।/ ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবো।’ প্রচলিত মুক্তির গভীরে তিনি চোখ ফেলেছেন। ভৌগলিক স্বাধীনতার পর প্রকৃত মুক্তি যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা তাই-ই তিনি ইঙ্গিত করেন। ইঙ্গিত করেন বীভৎস্য রূপে।
তবে বীভৎস্য রূপের ভেতরে যে রাগ ও ক্ষোভ বিদ্যমান তাই-ই তার সামগ্রিক রূপ নয়। বাহ্যিক ও প্রকাশ্য এই রূপের অভ্যন্তরে রয়েছে জীবনকে উল্টে-পাল্টে দেখার নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষা তাকে দিয়েছে এক জীবনে বহু জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা- ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগভ্রান্ত পথিক’। এই ‘দিগভ্রান্ত পথিক’ আদতে এক শিল্পপথ-প্রাপ্ত কবি। কখনো কখনো তিনি শিশু। কখনো বালক- ‘বালক ভুল করে নেমেছে/ ভুল জলে/ বালক পড়েছে ভুল বই/ পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই’। জীবন নিয়ে নিরীক্ষা করলেই-না কবি ‘বালক’ হয়ে ‘ভুল জলে’ নেমে পড়তে পারেন। হিসেবি আমরা, স্বার্থপর আমরা ক’জন ওই ‘ভুল জলে’ নেমে পড়ার সাহস দেখাতে পারি?
পারি না। পারি না বলেই আমরা সাধারণ। পারেন বলেই তিনি রফিক আজাদ। তাই তো তিনিই বলতে পারেন, ‘একটি চুমুর বিনিময়ে একটি কবিতা উৎসর্গ হবে।’ শুধু কি তাই? ভালোবাসা পেলে শুধরে নেবেন তিনি ‘জীবনের ভুলগুলি।’ ‘ব্যকরণ’ না-পড়া, ‘মূল বই’ না-পড়া বালক যদি ‘জীবনের ভুলগুলি’ শুধরে নেন তাহলেই কি বন্ধ হয়ে যাবে ‘সময়ের উদরে অনীবার্য বসবাস?’
না, যাবে না। তবুও চুনিয়া তার কাছে আর্কেডিয়া, ‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে/ নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।/ চুনিয়া বিশ্বাস করে: শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে/ পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’
এই তো আশার কথা। সবকিছু অস্বীকার করা তরুণ যখন প্রতিবাদের পর, পরিবর্তনের পর, জীবনের বহুপথ হেঁটে এসে আশার কথা বলেন তখনই তো তার শিল্পযাত্রা সফল হয়ে ওঠে। দৃশ্য থেকে কবি যখন অভিজ্ঞতা তুলে এনে দ্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখন জগতের সবগুলো ফুল হেসে ওঠে। সেই হাসির ঝলকে যে সুবাস ছড়ায় তাই-ই তো কবির দেওয়া শ্রেষ্ঠ অর্ঘ।
আমাদের আত্মপরিচয়ের সিঁড়িগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সিঁড়িগুলো নেমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। সিঁড়ি ভেঙে রক্ত গলে গলে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাংলার পবিত্র মাটি। তবুও আমাদের হৃদয় জাগছে না। কারণ ভুল মোহর চেপে ধরে রেখেছে প্রকৃত বেদি। ‘ভুল বই’ পড়া কোনো এক রফিক আজাদ আত্মগত সততা নিয়ে যখন বলে ওঠেন, ‘নিপাট বাঙালি কবি/ আমি একবিংশ শতাব্দীর’ তখন ভাবতে ভালো লাগে ষাটের প্রতিবাদী তারুণ্য নিয়ে যিনি দৃশ্য ধারণ করেছিলেন, তিনি পতনের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে নেমে সাধারণ হয়ে যাননি। শিল্পকে ধারণ করে ‘ভুল ব্যাকরণের’ শুদ্ধ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনি যে শেষ পর্যন্ত কবিই ছিলেন।