ঢাকা ৫ চৈত্র ১৪৩১, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
English

ধারাবাহিক উপন্যাস মোহিনী

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
মোহিনী
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সপ্তম পর্ব

ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজ খানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ধৈর্য ধরুন। নিশ্চয়ই একটা কিছু হবে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার স্ত্রীর অবশ হয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরাগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা হচ্ছে। তার মস্তিষ্কের সঙ্গে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখতে চিকিৎসক দল বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনাকে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আপনারা একেবারে অন্তিম মুহূর্তে রোগীকে নিয়ে এসেছেন। এ ধরনের রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপরও আস্থা রাখতে হয়। আমি নিজে যদিও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি না। তার পরও বলছি, নীলিমার যদি হায়াত থাকে তাহলে সে বাঁচবে। আর সে যদি বেঁচে যায় তাহলে বলতে হবে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে সে ফিরে এসেছে।

শাহবাজ খান আর কোনো কথা বলতে পারেন না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যে স্ত্রীকে সব সময় তিনি হেলাফেলা করেছেন সে যে তার জীবনে কতভাবে মিশে আছে তা আজ টের পাচ্ছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে, নীলিমার মৃত্যু হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সময় তার ফুপুর জীবনেও এমন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল। তিনি সেই অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। 

শাহবাজ খানের ফুপু শাওলী খানেরও বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল। তার ফুপা সানোয়ার হোসেন বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীর মধ্যে তার নাম ছিল। সানোয়ার হোসেন মধ্য বয়সে এসে এক সুন্দরী টিভি অভিনেত্রীর প্রেমে পড়ে যান। সে কী প্রেম! পরকীয়া প্রেম বুঝি এক ভয়ানক নেশা! এই নেশায় যাকে একবার পায় তাকে আর ফেরানো যায় না! টিভি অভিনেত্রী খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক নারী। সে সানোয়ার হোসেনকে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এ কারণেই হয়তো একেবারে জোকের মতো সানোয়ার হোসেনকে সে আঁকড়ে ধরে। 

অবৈধ সম্পর্ক থেকে সানোয়ার হোসেনকে ফেরানোর জন্য তার ফুপু হেন কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সানোয়ার হোসেনকে ফেরানো গেল না। তারা বিয়ে করতে রাজি হলো না। তারই বা রহস্য কী, তাও তারা কেউ বুঝতে পারলেন না। 

সানোয়ার হোসেন রাতদিন সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গেই কাটাতেন। তাকে নিয়ে বিদেশে যেতেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করতেন। ব্যবসায় তার কোনো মনোযোগ ছিল না। দিনে দিনে তার ব্যবসা মন্দাবস্থা শুরু হলো। সানোয়ার হোসেনকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক হলো। তাকে ফেরানোর জন্য শাহবাজ খানের বাবাও অনেক চেষ্টাচরিত করলেন। কিছুতেই কিছু হলো না। স্বামীর ওপর শাওলী খানের রাগ-ক্ষোভ-অভিমান চরম পর্যায়ে পৌঁছে। অবশেষে তিনি বিষপান করলেন। 

শাওলী খানকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরেই নিয়ে আসা হয়েছিল। টানা সাতান্ন দিন মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা করা হয় তার। কয়েক কোটি টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। সানোয়ার হোসেনের এখন অসহায় অবস্থা। বৈরম খানের দয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। অথচ বৈরম খানও সানোয়ার হোসেনের হাত ধরে ব্যবসা শুরু করছিলেন। 

শাহবাজ খান হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিনি আর কিছুই মনে করতে চান না। কিন্তু সেই ভয়ংকর স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে।   

শাহবাজ খান হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে এসে হাজির হন। আইসিইউর সামনে এসে পা রাখতেই ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনো কথা না বলে তিনি তার কাঁধে হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি ডাক্তার। তাই তাকে অনেক কিছুই সামাল দিতে হয়। অনেক আবেগ সংবরণ করতে হয়। অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা চোখের সামনে দেখতে হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন। সে বাণী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে হয়। 

ডাক্তার চ্যাঙ জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। তিনি অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করেছেন। কেউ ভালো হয়েছেন। আবার কেউ চলে গেছেন ওপারে। সবাই যে ভালো হবে তার তো কোনো গ্যারান্টি কোনো ডাক্তার দিতে পারেন না। ডাক্তার চেষ্টা করতে পারেন মাত্র। কিন্তু নীলিমার চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। রোগীকে বাঁচাতে হবে, এটাই ছিল তার ব্রত। শেষ পর্যন্ত পারলেন না। এই না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনি নিজেই নীলিমার মৃত্যু মানতে পারছেন না। তার স্বামী কী করে মানবেন! 

ডাক্তার চ্যাঙ কীভাবে শাহবাজকে খবরটা দেবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। বড়ই সংকোচ বোধ করছেন তিনি। কিন্তু তার পরও তাকে খবরটা দিতে হবে। কীভাবে শুরু করবেন তা নিয়ে ভাবেন। সময় নেন।

ডাক্তারের অবস্থা দেখে শাহবাজ আঁচ করতে পারেন, তার জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। তিনি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। আর ডাক্তার কী বলবেন তা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। এর মধ্যেই ডাক্তার চ্যাঙ নরম গলায় বললেন, শাহবাজ আমি কীভাবে কথাটা বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি নিজেই তো দেখেছেন! আমরা আটজন ডাক্তার কীভাবে চেষ্টা করেছি। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, রাত নেই দিন নেই। 

শাহবাজ খান কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন। তিনি ডাক্তারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার চ্যাঙ আবারও শাহবাজের কাঁধে হাত রাখেন। তার পর বলেন, শাহবাজ মনটাকে শক্ত করুন। আমি আগেই বলেছি, যেকোনো খবরের জন্য আপনার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। আমি আশা করছি, আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শেষপর্যন্ত আমরা আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না। 

শাহবাজ খান এসব কী শুনছেন! তিনি তো এই সংবাদ শোনার জন্য আসেননি। তিনি একটা সুসংবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেন এই সংবাদ দিচ্ছেন ডাক্তার! না না! এটা হতে পারে না! নীলিমা মরতে পারে না! নীলিমা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না! কিছুতেই না! কিছুতেই না!

শাহবাজ খান আচমকা নীলিমা বলে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তার পর পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। 

চলবে...

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-

পর্ব-১

পর্ব-২

পর্ব-৩

পর্ব-৪

পর্ব-৫

পর্ব-৬

বই আলোচনা অদৃশ অভিঘাতের এক অনন্য সৃষ্টি

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৬ পিএম
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম
অদৃশ অভিঘাতের এক অনন্য সৃষ্টি

বিষাদ বসুধা
লেখক
মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ
নিয়াজ চৌধুরী তুলি
সময় প্রকাশন
প্রকাশকাল
ফেব্রুয়ারি বইমেলা 
২০২৫

বিশ্বযুদ্ধের পর গত এক শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্তকর ঘটনা কোভিড-১৯ মহামারির  প্রাদুর্ভাব। সংক্ষেপে আমরা যাকে করোনাভাইরাস বলি। এই করোনার প্রভাব ছিল যেমন বহুমুখী, তেমনি সর্বব্যাপী। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক থেকে শুরু করে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ-কাঠামো এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এর ধ্বংসের ছোঁয়া লাগেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এত বড় একটা ঘটনার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক-বয়ান সৃষ্টি হয়নি। যেমনটি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে। করোনা নিয়ে যা কিছু হয়েছে তা নিছক বিচ্ছিন্ন কিছু গল্প-কবিতায় সীমাবদ্ধ। বড় ক্যানভাসে কোনো চলচ্চিত্রও চোখে পড়ে না। তবে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, সতর্কবাণী প্রচার করা হয়েছে, প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। যত যাই-ই হোক না কেন সাহিত্যিক-ন্যারেটিভের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবেদনের বর্ণনা আর ঘটনার ভেতর দিয়ে যাত্রা করা চরিত্রের পরিবেদনা কখনো একরকম হবে না। বিগত সময়ের হাজারো ইতিহাস বোঝার জন্য আমরা এখনো সাহিত্যের দ্বারস্থ হই। ফিকশন হয়ে ওঠে ঘটনার মানবিক দিক খোঁজার বড় একটা উৎস। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ঠিক এই জায়গা বেছে নিয়েছেন করোনা ভাইরাসের বিপর্যস্তকর ন্যারেটিভ নির্মাণে। বিষাদ বসুধা নামীয় উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে তার শিল্পীত ক্ষেত্র।
একটি অদৃশ্য উপাদান কীভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলে দিল, সমাজ ও রাষ্ট্রের কত কী তছনছ করল, আলোড়িত করল, বিপর্যস্ত করল- সেই অভিঘাতের সাহিত্যিক-উৎস হয়ে উঠেছে বিষাদ বসুধা।

সংবাদ বা প্রতিবেদন তো পেশাগত ব্যাপার। সাহিত্য কিন্তু অন্যকিছু। সেখানে যা উঠে আসে তা সংবাদ বা প্রতিবেদন থেকে অন্যতর সৃজনশীল কিছু। কেউ পেশাগত দায় থেকে এ কাজ করেন না। করেন শিল্পের দায় থেকে। এ দায়ের জন্য কেউ কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় না। একজন সংবেদনশীল সৃজনমুখর লেখকই স্বেচ্ছায় এই দায় নিজ কাঁধে তুলে নেন। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এই কাজটিই করেছেন।

উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে মোহিনী ভালোবেসে বিয়ে করে সহপাঠী আরেফিনকে। যে মেধাবী হলেও গ্রামের হতদরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কেন জানি আরেফিনের সঙ্গে সংসারে সুর ওঠে না মোহিনীর। মোহিনী তার আচরণে কখনো উচ্চবিত্তীয় ভাবধারা প্রদর্শন না করলেও আরেফিনের ভেতরে এক ধরনের হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। এভাবে বিত্তীয় ব্যবধান তাদের ভেতরে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে আর মেধাভিত্তিক নিবেদনে একনিষ্ঠ হওয়ার জন্য চীনের উহানে কয়েক মাসের ট্রেনিংয়ের সুযোগ পায় আরেফিন। এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে মোহিনীর সঙ্গে চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয় আরেফিনের। মোহিনীর অমত সত্ত্বেও আরেফিন চলে যায় চীনে। একদিন খবর আসে সে মারা গেছে করোনাভাইরাসে। ততদিনে বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে মরণঘাতী এই ভাইরাস। এবং এর ফলে বদলে গেছে পুরো বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ও কাঠামো।

সংকটে না পড়লে আসল চিত্র ভেসে ওঠে না। বাংলাদেশেও তাই হলো। এতে কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের আসল চেহারা বের হয়ে এল। আরেফিন তো চলেই গেল না ফেরার দেশে। করোনাজনিত কারণে দুজনের বিচ্ছেদই শেষ কথা নয়। জীবন তো বহতা নদীর মতো। মোহিনীর জীবনও চলতে চলতে বাঁক ফেরে। সেই বাঁকে মোহিনীর সঙ্গে সন্নিবেশ ঘটল আরও অনেক চরিত্রের। অফিসে মোহিনীর কার্যক্রম দেখা গেল, অধীনস্ত কলিগদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জানা গেল, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু আসিফ আহমেদের আদর্শ ও কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল, কলেজে প্রেম নিবেদন করা শিল্পপতি বন্ধু শাহবাজ খান যিনি কি না আবার সম্পাদক বন্ধুর পত্রিকার মালিক- তার নীতি-নৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি সম্পর্কে জানা হলো এবং তা থেকে তার মুক্তির অপকৌশলও, জানা হলো শাহেদ করিমের মতো করোনা-ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। অবধারিতভাবেই উপন্যাসের ডালপালা মেলে গেল। ধীরে ধীরে বের হয়ে এল কিছু মানুষের মহৎ বৈশিষ্ট্য আর কিছু মানুষের দানবিক দিক।

করোনার অভিঘাতে সামাজিক আচারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদনেও ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। বন্ধ হয়ে গেল উৎপাদন। এই অভিঘাতের ক্ষতি পুষতে পুষতে পত্রিকার মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কর্মী ছাঁটাইয়ের। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে গেল সম্পাদক ও মালিকপক্ষের। সম্পাদক চান না কর্মী ছাঁটাই। মালিক পক্ষ অনড়। একপর্যায়ে সম্পাদক নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন।  

অন্যদিকে মোহিনী কোনো কর্মী ছাঁটাই তো দূরের কথা যথাসাধ্য সাহায্য করতে থাকল গরির ও সীমিত আয়ের মানুষদের। এবং এটা নিয়ে তার ব্যবসায়ী বন্ধু শাহবাজ খানের সঙ্গে আদর্শিক দ্বন্দ্বও প্রকাশ্য হয়ে উঠল।  যদিও তা প্রকটরূপ ধারণ করে সম্পর্কের ইতি ঘটাল না। যে যার মতো ভূমিকা রেখেও একদা প্রেমিক শাহবাজ খানের প্রেমসত্তার কাছে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকল মোহিনী।

সম্পাদক ও মালিকের যে দ্বন্দ্ব তা মানবিকতা বনাম দানবিকতার। এই দ্বন্দ্বে দানবিকতা আপাত জয়লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে জিতে যান সম্পাদক নিজে তার মানবিক আচরণ ও প্রতিবাদ সত্তার জন্য।

বিষাদ বসুধা এভাবে হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ সময়ের মানবিকতা বনাম দানবিকতার দ্বন্দ্বের শিল্পীত বয়ান।

বসুধা তো বসুধাই। বিষাদ ছুঁয়েছে তাকে। বসুধা যখন মোহিনীর প্রতীক- তাকেও ছুঁয়েছে। যখন আরেফিনের প্রতীক তখন তাকেও ছুঁয়েছে। বিষাদ ছুঁয়েছে সম্পাদক ও মালিকের মানবিকতা বনাম দানবিকতার দ্বন্দ্বকেও। একটি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন মোহিনী সেই পত্রিকার মালিক ও শিল্পপতির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার দিকে যায় তখনো কোথাও কোনো এক শুভসত্তায় বিষাদ ছুঁয়ে যায়। করোনার প্রভাব এভাবে বিষাদকে বিস্তৃত করতে করতে পুরো বসুধাকেই বিষাদাক্ত করে ফেলে।

উপন্যাসের শেষে জানা যায় প্রথম পর্ব সমাপ্ত। তার মানে পরবর্তী পর্বে জানা যাবে মোস্তফা কামাল-অঙ্কিত বহুমাত্রিক বিষাদের আরও নানারকম রূপ। সেই বিষাদ এই বসুধার আর কোথায় কোথায় স্পর্শ করবে তা জানার জন্য আমাদের অপার কৌতূহল। আপাতত অপেক্ষা।

মরিয়মের বিয়ে

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:২৯ পিএম
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:২৯ পিএম
মরিয়মের বিয়ে
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

১৯৭১ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলা ক্যালেন্ডারে ফাল্গুন। ইংরেজি মাসের নামে মরিয়ম তেমন আন্দোলিত হয় না। যতটা অনুভব করে বাংলা মাস। মরিয়মের বয়স ১৪ বছর। সে আছে আনন্দ আর অজানা কোনো ভয় নিয়ে। কীসের ভয় বুঝতে পারছে না। তার বান্ধবীদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আশপাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। তবু তারা বাবার বাড়ি আসে সময় মেপে। নাইওরে। তখন তাদের দেখতে কী সুন্দর লাগে! সবাই ঝলমল করে। শ্বশুরবাড়ির গল্প করে। ফিসফিস করে স্বামীর সোহাগের কথা বলে। মরিয়মের শরীরের ভেতর অদ্ভুত অজানা অনুভূতি হয়। তিরতির করে। সামনে অগ্রহায়ণ মাসে মরিয়মের বিয়ে। সে আছে বিপুল লজ্জার ভেতর। 

ছোট চাচার বিয়ে হয়েছে মাঘ মাসে। এক মাস হলো নতুন চাচি তাদের বাড়িতে এসেছে। চাচির নাম আলেয়া। চাচি মরিয়মের থেকে বয়সে বছরখানেকের বড়। তবু এ বাড়িতে এসে চাচি মরিয়মের বন্ধু হয়ে গেছে। মরিয়ম বলল, চাচি, আলেয়া ভালো নয়। মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের নদীর ওপারে রাতে আলেয়া দেখা যায়।

চাচির হাসি সুন্দর। সে হাসলে মনে হয় চারপাশে সকালের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চাচি হেসে বলল, মায়া দিয়ে ভরা আমি। সেই মায়ায় ভোলাব তোমাদের।

উঠোনের কোনায় পলাশগাছ। টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা উজ্জ্বল কমলা রঙের পলাশ ফুল পড়ে আছে উঠোনজুড়ে। মরিয়মের পরনে কমলা আর কালোয় মেশানো চেক ডুরে শাড়ি। সে উঠোনের ওপর থেকে পলাশ ফুল কুড়িয়ে কোঁচড়ে রাখছে। রান্নাঘর থেকে ঘরের দিকে যাওয়ার সময় চাচি দেখেছে। চাচি বলল, ফুল কী করবি রে, মৌরি? জামাইয়ের জন্য মালা গাঁথবি?

চাচি মরিয়মকে মৌরি বলে ডাকে। চাচির কথা শুনে মরিয়ম লজ্জা পেয়েছে। পাতলা ঠোঁটে লজ্জার হাসি মিশিয়ে বলল, ততদিনে থাকবে বুঝি মালা। শুকিয়ে যাবে না!

ছুটে এসে চাচি মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, তার মানে তোর ইচ্ছে আছে তার জন্য মালা গাঁথার। 
মরিয়ম আরও লজ্জা পেয়েছে। বলল, আহ ছাড়ো। 

চাচি বলল, ফুলগুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখ। তা থেকে কমলা রং বেরোবে। সেই রঙে সাদা রুমাল ডুবিয়ে রাখবি। রুমাল হয়ে যাবে কমলা। রোদে শুকিয়ে ভাঁজ করে জামাইয়ের জন্য তুলে রাখবি।

মরিয়ম বলল, রুমালের কোনায় হলুদ আর কমলা সুতো দিয়ে ফুল তুলে রাখি!
চাচি বলল, রাখিস, আর ছোট্ট করে লিখে রাখবি ম। যেন রুমাল হাতে নিলেই তোর জামাই তোকে ছুঁতে পারে।
কোঁচড় সামলিয়ে মরিয়ম উঠোনে উবু হলো। আরেকটা ফুল হাতে নিয়েছে। ফুল কুড়াতে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি লজ্জা আড়াল করতে সে ফুলের দিকে ঝুঁকেছে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আর তার নাম?
চাচি হেসে ফেলেছে। বলল, তাহলে রুমালে দুটো অক্ষর লিখিস। ম যোগ ত। ছেলের নাম তাহির।
মরিয়ম লজ্জায় আরও বেশি নুয়ে মাটির কাছাকাছি চলে এল। 

মরিয়মের বাবা বেঁচে নেই। চৈত্র মাসের এক মধ্যদুপুরে ঠাঠা রোদে বাড়িতে এসে বলল, শরীর খারাপ লাগছে। যে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে সেটা ধানের গোলার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখেছে। ঘরে বসে গায়ের জামা নিজেই খুলে বলল, পানি খাব।
মরিয়মের মা পানি এনে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিল। বাবা পানি খেতে পারেনি। কাত হয়ে পড়ে গেছে। তার পর কবিরাজ এসে জানাল বাবা মারা গেছে। তখন মরিয়মের বয়স বারো বছর। 

বাড়ির সবকিছু দাদা দেখাশোনা করেন। দাদার নাম আজিবর বিশ্বাস। অগ্রহায়ণ মাসে মরিয়মের বিয়ে তিনি ঠিক করেছেন। গেরস্থ বাড়ির ছেলে। লেখাপড়া জানা। আইএ পাস করে এখন বিএ ক্লাসে পড়ছে। ছেলে দাদার পছন্দ হয়েছে। দাদা বললেন, মরিয়ম, শুধু ছেলে দেখে তোমার বিয়ে সেই বাড়িতে ঠিক করি নাই। তাদের ধানের চারখানা গোলা দেখেও না। বিয়ে ঠিক করেছি তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি দেখে। তারা অতি ভালো মানুষ। তুমি সেখানে গিয়ে বাপ-মায়ের অভাব বোধ করবে না।

সিদ্ধান্ত দাদা নেবেন। মরিয়মের কিছু বলার নেই। দাদা মরিয়মের বিয়ের জন্য সোনার গহনার ব্যবস্থা করেছেন। মরিয়মের দাদির দুটো কানের দুল ভেঙে গঞ্জে গিয়ে নতুন ডিজাইনের কানপাশা বানিয়ে এনেছেন। হাতের বালা, গলার চেইন, সিঁথির টিকলি বানানো হয়েছে। পায়ের ছয়দানা মল বানানোর ইচ্ছে আছে।

চৈত্র মাসে দেশের অবস্থা বদলে গেল। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বাড়ি থেকে জোয়ান ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন করছে। গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আজিবর বিশ্বাস এসেছেন রসুনদি। মরিয়মের সঙ্গে যে ছেলের বিয়ের কথা হয়েছে তাদের বাড়ি। ছেলের বাবার নাম এনায়েত মণ্ডল। আজিবর বিশ্বাস বললেন, বিয়ে কি বাবা তাহলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে এগিয়ে নিয়ে আসব? আমার প্রস্তুতি শেষ। যতখানি স্বর্ণ দিয়ে ছেলের বউ ঘরে এনেছি তার চেয়ে বেশি স্বর্ণ দিয়ে মরিয়মকে তোমার বাড়িতে দিয়ে যাব। দেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিয়ে দিয়ে যদি মেয়েকে এদিকে নিয়ে আসো, ভালো হতো। বলা তো যায় না কখন কী হয়!

এনায়েত মণ্ডল চুপ করে আছে। কিছু বলেনি। তার চোখে চিন্তার গভীর ভাঁজ। কিছু ভাবছে। আজিবর বিশ্বাস বললেন, আমাদের দিকের বউ-ঝিয়েরা বলতে গেলে বাড়িছাড়া। সারাক্ষণ আতঙ্ক, ভয়, দৌড়াদৌড়ির মাঝে থাকতে হয়।
এনায়েত মণ্ডল গম্ভীর গলায় বলল, ছেলে বাড়ি নেই। তাহির যুদ্ধে গেছে।

আজিবর বিশ্বাস রসুনদি থেকে ফিরে এলেন। তবে তাকে এনায়েত মণ্ডল খালি হাতে বিদায় দেয়নি। আসার সময় গাছের চারটা নারকেল আর ঝোলাভর্তি আম দিয়ে দিয়েছে। 

দাদার বাড়িতে মরিয়মের থাকার মতো অবস্থা থাকল না। পাশের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। প্রতিদিন শোনা যাচ্ছে তারা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। আজিবর বিশ্বাস একরাতে ছেলে, ছেলের বউ, মরিয়মের মা আর মরিয়মকে নিয়ে মরিয়মের নানার গ্রামে চলে গেলেন। মরিয়মের দাদি বাড়িতে থাকলেন। দাদা তাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবেন।

মরিয়মের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কেউ নেই। বাড়ি খাঁখাঁ করছে। যা করার রাতের ভেতরেই করতে হবে। ভোরে আলো দেখা দিলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। আজিবর বিশ্বাস মরিয়মের মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। মরিয়মের ছোট চাচা আলেয়া আর মরিয়মকে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়ি।

আলেয়ার বাবার বাড়ি। সেখানে আলেয়া আর মরিয়ম থেকে গেল। চাচা বলল, জান দেব তবু মান দেব না। শিগগিরই ফিরে আসব। দেশ স্বাধীন করেই ফিরব।

আলেয়ার বাবা বললেন, নিজ ভাগ্য কেউ বদলাতে পারে না। যার যেখানে মৃত্যু আছে সেখানেই হবে। থাক তোমরা এখানে। যদি মরণ আসে একসঙ্গে মরব।

সেই গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারির উৎপাত শুরু হলো। পিলপিল করে গ্রামে ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি মিলিটারি। তাদের সঙ্গে আসে গ্রামের পরিচিত লোক। তারা রাজাকার। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহায়তা করে। বাড়ি থেকে ছাগল ধরে নিয়ে যায়। মেয়েদের টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আটকে রাখে।

আলেয়ার বাবা ঘরের ভেতর বড় গর্ত খুড়লেন। পাকিস্তানি মিলিটারি বাড়িতে এলে মেয়েরা সেই গর্তে ঢুকে পড়ে। পুরুষরা কেউ বাড়ি থাকে না। 

সেদিন আচমকা পাকিস্তানি মিলিটারি বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারা সংখ্যায় ২০ থেকে ২৫ জন। সঙ্গে দুজন রাজাকার। পুরুষরা কেউ বাড়িতে নেই। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে আলেয়া আর মরিয়ম হতভম্ব হয়ে গেছে। আলেয়া দৌড়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে। তার পেছনে দুজন পাকিস্তানি মিলিটারি দৌড়াচ্ছে। আলেয়া ঝট করে শুধু বলতে পারল, মৌরি পালা।

মরিয়ম কোথায় পালাবে! তার অবস্থা হয়ে গেছে দিশেহারা। মরিয়ম দিশা না পেয়ে বাড়ির কুয়ার ভেতর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। 

কুয়ার পানি থেকে মাথা তুলে থমকে গেছে মরিয়ম। সাপ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সাপ মরিয়ম চেনে না। সে ওপরের দিকে তাকাল। কেউ নিশ্চয় তাকে বাঁচাবে। অমনি সাপ ছোবল মারল তার কাঁধে।

বাড়িতে কাউকে না পেয়ে রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারিরা ফিরে গেল। আলেয়া দেখেছিল মরিয়ম কুয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মরিয়মকে কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। সে আছে অচেতন অবস্থায়। 

সাপের বিষ নামাতে হবে মরিয়মের শরীর থেকে। তাকে সাপুড়ের কাছে নিতে হবে। সাপুড়ে বা কবিরাজকে ডেকে আনতে সময় লাগবে। ততক্ষণ মরিয়ম বেঁচে নাও থাকতে পারে।

যুবতী মেয়ে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। রাজাকারের নজর আছে। মরিয়ম আরও নাজুক হয়ে আসছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। মরিয়মকে বস্তার ভেতর ঢোকানো হয়েছে। বস্তার মুখ বেঁধে তাকে আনা হয়েছে সাপুড়ের বাড়িতে। সাপুড়ে বলল, তার অবস্থা খুব খারাপ। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সাপের বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমার কাছে রেখে গেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

মরিয়মকে সাপুড়ের কাছে রেখে আসা হলো। বেঁচে উঠেছে মরিয়ম। তবে সুস্থ হতে সময় নিয়েছে। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। 

পরের বছর ফাল্গুন মাস। সে বছরও গাছ ঝেপে পলাশ ফুল ফুটেছে। উঠোন থেকে পলাশ ফুল কুড়িয়ে কোঁচড়ে রাখতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেছে মরিয়ম। উঠোনে অসম্ভব সুদর্শন এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। অচেনা একজন।
মিহি গলায় তরুণ বলল, আমার নাম তাহির। তোমাকে আমি বিয়ে করব, সেই কথা জানাতে এসেছি।
থরথর করে কেঁপে উঠেছে মরিয়ম। তার কোঁচড় থেকে একরাশ পলাশ ছড়িয়ে পড়ল উঠোনে।

গল্প শেষ হতে পারত তাহিরের সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে দিয়ে। ঘটনা সেরকম ঘটেনি। ঘটনাকে নতুনভাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা লেখকের আছে। লেখক সেই ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। আজিবর বিশ্বাস রসুনদি গ্রামে গিয়েছিলেন বিয়ের নতুন দিন ঠিক করতে। ছেলের বাবা, ছেলে কেউ এ বিয়েতে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমাদের কাছে খবর আছে মরিয়ম পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। সে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর বাবার বয়সী একজনের সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে হয়েছে। মরিয়ম তখন মানসিকভাবে অসুস্থ। সময় যায়। মরিয়ম আটকে থাকে ১৯৭১ সালের বসন্তে- এক অন্ধকার কুয়ায়।

স্বাধীনতা

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:১৭ পিএম
স্বাধীনতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ইতিহাস লিখি ইতিহাস মুছি
ইতিহাস ঘুরে যায়
ইতিহাস তবু ফিরে ফিরে আসে
রক্তের ঠিকানায়

হলুদ গোলাপে রক্তের ছিটে
হলুদ জবায় দাগ
আমাদের মনে মিছে বিভাজনে
মৃতের দায়ভাগ

শহরের পথে মৃত‍‍ উধাও
গ্রামেও জেগেছে ভোর
লৌহকপাট ভেঙেচুরে দিল
মুক্ত একাত্তর

মুক্তিযুদ্ধে পাই অমরতা
স্বাধীনতা তার নাম
কাশফুলে আর ঘাসফুলে সেই
বিজয়ের পয়গাম

শব্দ ও মহাকাল

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
শব্দ ও মহাকাল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

শব্দ নিয়ে খেলা করে মহাকাল। 
কিছু শব্দ দাঁড়ায় আড়ালে 
দূরে- অজানা ভঙ্গিতে  
যৎকিঞ্চিৎ শব্দের মহিমা শেখায় আমাদের।  
কিছু শব্দ প্রকৃতিগত বজ্রশেল
মানুষের দীর্ঘ-যাত্রা দীর্ঘ-শ্রমবোধ-
             অক্লান্ত ঘামের মূল্য
        শৌর্যবীর্যগাথা;
সেইসব শব্দমালা তুলে নেয় কালের গুঞ্জন
চিরস্থায়ী মেঘের আস্তিনে 
লিখে রাখে পথরেখা 
আলোর অক্ষরে 
দিগন্তের সীমানা প্রাচীরে কালে কালে।
কিছু শব্দ জেদি খুব- যুদ্ধে ও বিপ্লবে  
      মুক্তি আন্দোলনে সামনে দাঁড়ায় 
নির্ভয়ে কণ্ঠে তোলে সুর 
‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ 
   পেরোনোর স্বপ্ন পোষে বুকে;
সেইসব শব্দমালা বাতাসের রেখা ছুঁয়ে 
মহাকালের সাক্ষী হয়ে থাকে।

দেয়াল

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২:১১ পিএম
দেয়াল
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘দেয়ালের কান আছে’- এমন প্রবাদ
                          আমাদের সকলের জানা    
তবে, ওর-ও যে চোখ-পিঠ থেকে থাকে
                            সে-কথা খুব বিদিত নয়।

তাচ্ছিলে উড়িয়ে দিই দেয়ালের বেদনা-পাহাড়
চোখের জলের দাগ ঢেকে দিই অবজ্ঞার চুন-কালি দিয়ে

দেয়ালের পিঠ- সে তো কেনাদাস নয়-
শব্দহীন সয়ে যাবে অবিরাম বুটের আঘাত
দেয়ালের চোখ- সে তো চিরঅন্ধ নয়-
অশ্রুস্রোতে ঢেলে দেবে প্রাণঘাতী বিষ
 
খাদের কিনারে পৌঁছে, জন্মমৃত্যু এক হয়ে গেলে
দেয়ালের পিঠজুড়ে জন্ম নেয় আগুনের গাছ
                    প্রতিটি তাকানো যেন রুদ্রবজ্রপাত

একাত্তরে আমাদের তা-ই হয়েছিল

প্রতি ইঞ্চি মাটি যেন গর্জে ওঠা দেয়ালের পিঠ
চোখে কোনো অশ্রু নেই- রক্তদ্যুতি, বারুদের ক্রোধ
 
যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা, সত্য হলো বিজয়ের গান