
সপ্তম পর্ব
ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজ খানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ধৈর্য ধরুন। নিশ্চয়ই একটা কিছু হবে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার স্ত্রীর অবশ হয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরাগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা হচ্ছে। তার মস্তিষ্কের সঙ্গে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখতে চিকিৎসক দল বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনাকে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আপনারা একেবারে অন্তিম মুহূর্তে রোগীকে নিয়ে এসেছেন। এ ধরনের রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপরও আস্থা রাখতে হয়। আমি নিজে যদিও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি না। তার পরও বলছি, নীলিমার যদি হায়াত থাকে তাহলে সে বাঁচবে। আর সে যদি বেঁচে যায় তাহলে বলতে হবে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে সে ফিরে এসেছে।
শাহবাজ খান আর কোনো কথা বলতে পারেন না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যে স্ত্রীকে সব সময় তিনি হেলাফেলা করেছেন সে যে তার জীবনে কতভাবে মিশে আছে তা আজ টের পাচ্ছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে, নীলিমার মৃত্যু হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সময় তার ফুপুর জীবনেও এমন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছিল। তিনি সেই অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন।
শাহবাজ খানের ফুপু শাওলী খানেরও বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল। তার ফুপা সানোয়ার হোসেন বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীর মধ্যে তার নাম ছিল। সানোয়ার হোসেন মধ্য বয়সে এসে এক সুন্দরী টিভি অভিনেত্রীর প্রেমে পড়ে যান। সে কী প্রেম! পরকীয়া প্রেম বুঝি এক ভয়ানক নেশা! এই নেশায় যাকে একবার পায় তাকে আর ফেরানো যায় না! টিভি অভিনেত্রী খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক নারী। সে সানোয়ার হোসেনকে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এ কারণেই হয়তো একেবারে জোকের মতো সানোয়ার হোসেনকে সে আঁকড়ে ধরে।
অবৈধ সম্পর্ক থেকে সানোয়ার হোসেনকে ফেরানোর জন্য তার ফুপু হেন কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সানোয়ার হোসেনকে ফেরানো গেল না। তারা বিয়ে করতে রাজি হলো না। তারই বা রহস্য কী, তাও তারা কেউ বুঝতে পারলেন না।
সানোয়ার হোসেন রাতদিন সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গেই কাটাতেন। তাকে নিয়ে বিদেশে যেতেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করতেন। ব্যবসায় তার কোনো মনোযোগ ছিল না। দিনে দিনে তার ব্যবসা মন্দাবস্থা শুরু হলো। সানোয়ার হোসেনকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠক হলো। তাকে ফেরানোর জন্য শাহবাজ খানের বাবাও অনেক চেষ্টাচরিত করলেন। কিছুতেই কিছু হলো না। স্বামীর ওপর শাওলী খানের রাগ-ক্ষোভ-অভিমান চরম পর্যায়ে পৌঁছে। অবশেষে তিনি বিষপান করলেন।
শাওলী খানকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরেই নিয়ে আসা হয়েছিল। টানা সাতান্ন দিন মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা করা হয় তার। কয়েক কোটি টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। সানোয়ার হোসেনের এখন অসহায় অবস্থা। বৈরম খানের দয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। অথচ বৈরম খানও সানোয়ার হোসেনের হাত ধরে ব্যবসা শুরু করছিলেন।
শাহবাজ খান হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিনি আর কিছুই মনে করতে চান না। কিন্তু সেই ভয়ংকর স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে।
শাহবাজ খান হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে এসে হাজির হন। আইসিইউর সামনে এসে পা রাখতেই ডাক্তার চ্যাঙ শাহবাজের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনো কথা না বলে তিনি তার কাঁধে হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি ডাক্তার। তাই তাকে অনেক কিছুই সামাল দিতে হয়। অনেক আবেগ সংবরণ করতে হয়। অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা চোখের সামনে দেখতে হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন। সে বাণী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে হয়।
ডাক্তার চ্যাঙ জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। তিনি অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করেছেন। কেউ ভালো হয়েছেন। আবার কেউ চলে গেছেন ওপারে। সবাই যে ভালো হবে তার তো কোনো গ্যারান্টি কোনো ডাক্তার দিতে পারেন না। ডাক্তার চেষ্টা করতে পারেন মাত্র। কিন্তু নীলিমার চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। রোগীকে বাঁচাতে হবে, এটাই ছিল তার ব্রত। শেষ পর্যন্ত পারলেন না। এই না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনি নিজেই নীলিমার মৃত্যু মানতে পারছেন না। তার স্বামী কী করে মানবেন!
ডাক্তার চ্যাঙ কীভাবে শাহবাজকে খবরটা দেবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। বড়ই সংকোচ বোধ করছেন তিনি। কিন্তু তার পরও তাকে খবরটা দিতে হবে। কীভাবে শুরু করবেন তা নিয়ে ভাবেন। সময় নেন।
ডাক্তারের অবস্থা দেখে শাহবাজ আঁচ করতে পারেন, তার জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। তিনি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। আর ডাক্তার কী বলবেন তা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। এর মধ্যেই ডাক্তার চ্যাঙ নরম গলায় বললেন, শাহবাজ আমি কীভাবে কথাটা বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি নিজেই তো দেখেছেন! আমরা আটজন ডাক্তার কীভাবে চেষ্টা করেছি। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, রাত নেই দিন নেই।
শাহবাজ খান কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন। তিনি ডাক্তারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার চ্যাঙ আবারও শাহবাজের কাঁধে হাত রাখেন। তার পর বলেন, শাহবাজ মনটাকে শক্ত করুন। আমি আগেই বলেছি, যেকোনো খবরের জন্য আপনার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। আমি আশা করছি, আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শেষপর্যন্ত আমরা আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না।
শাহবাজ খান এসব কী শুনছেন! তিনি তো এই সংবাদ শোনার জন্য আসেননি। তিনি একটা সুসংবাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেন এই সংবাদ দিচ্ছেন ডাক্তার! না না! এটা হতে পারে না! নীলিমা মরতে পারে না! নীলিমা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না! কিছুতেই না! কিছুতেই না!
শাহবাজ খান আচমকা নীলিমা বলে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তার পর পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
চলবে...
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-