১৯৭১ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলা ক্যালেন্ডারে ফাল্গুন। ইংরেজি মাসের নামে মরিয়ম তেমন আন্দোলিত হয় না। যতটা অনুভব করে বাংলা মাস। মরিয়মের বয়স ১৪ বছর। সে আছে আনন্দ আর অজানা কোনো ভয় নিয়ে। কীসের ভয় বুঝতে পারছে না। তার বান্ধবীদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আশপাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। তবু তারা বাবার বাড়ি আসে সময় মেপে। নাইওরে। তখন তাদের দেখতে কী সুন্দর লাগে! সবাই ঝলমল করে। শ্বশুরবাড়ির গল্প করে। ফিসফিস করে স্বামীর সোহাগের কথা বলে। মরিয়মের শরীরের ভেতর অদ্ভুত অজানা অনুভূতি হয়। তিরতির করে। সামনে অগ্রহায়ণ মাসে মরিয়মের বিয়ে। সে আছে বিপুল লজ্জার ভেতর।
ছোট চাচার বিয়ে হয়েছে মাঘ মাসে। এক মাস হলো নতুন চাচি তাদের বাড়িতে এসেছে। চাচির নাম আলেয়া। চাচি মরিয়মের থেকে বয়সে বছরখানেকের বড়। তবু এ বাড়িতে এসে চাচি মরিয়মের বন্ধু হয়ে গেছে। মরিয়ম বলল, চাচি, আলেয়া ভালো নয়। মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের নদীর ওপারে রাতে আলেয়া দেখা যায়।
চাচির হাসি সুন্দর। সে হাসলে মনে হয় চারপাশে সকালের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চাচি হেসে বলল, মায়া দিয়ে ভরা আমি। সেই মায়ায় ভোলাব তোমাদের।
উঠোনের কোনায় পলাশগাছ। টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা উজ্জ্বল কমলা রঙের পলাশ ফুল পড়ে আছে উঠোনজুড়ে। মরিয়মের পরনে কমলা আর কালোয় মেশানো চেক ডুরে শাড়ি। সে উঠোনের ওপর থেকে পলাশ ফুল কুড়িয়ে কোঁচড়ে রাখছে। রান্নাঘর থেকে ঘরের দিকে যাওয়ার সময় চাচি দেখেছে। চাচি বলল, ফুল কী করবি রে, মৌরি? জামাইয়ের জন্য মালা গাঁথবি?
চাচি মরিয়মকে মৌরি বলে ডাকে। চাচির কথা শুনে মরিয়ম লজ্জা পেয়েছে। পাতলা ঠোঁটে লজ্জার হাসি মিশিয়ে বলল, ততদিনে থাকবে বুঝি মালা। শুকিয়ে যাবে না!
ছুটে এসে চাচি মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, তার মানে তোর ইচ্ছে আছে তার জন্য মালা গাঁথার।
মরিয়ম আরও লজ্জা পেয়েছে। বলল, আহ ছাড়ো।
চাচি বলল, ফুলগুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখ। তা থেকে কমলা রং বেরোবে। সেই রঙে সাদা রুমাল ডুবিয়ে রাখবি। রুমাল হয়ে যাবে কমলা। রোদে শুকিয়ে ভাঁজ করে জামাইয়ের জন্য তুলে রাখবি।
মরিয়ম বলল, রুমালের কোনায় হলুদ আর কমলা সুতো দিয়ে ফুল তুলে রাখি!
চাচি বলল, রাখিস, আর ছোট্ট করে লিখে রাখবি ম। যেন রুমাল হাতে নিলেই তোর জামাই তোকে ছুঁতে পারে।
কোঁচড় সামলিয়ে মরিয়ম উঠোনে উবু হলো। আরেকটা ফুল হাতে নিয়েছে। ফুল কুড়াতে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি লজ্জা আড়াল করতে সে ফুলের দিকে ঝুঁকেছে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আর তার নাম?
চাচি হেসে ফেলেছে। বলল, তাহলে রুমালে দুটো অক্ষর লিখিস। ম যোগ ত। ছেলের নাম তাহির।
মরিয়ম লজ্জায় আরও বেশি নুয়ে মাটির কাছাকাছি চলে এল।
মরিয়মের বাবা বেঁচে নেই। চৈত্র মাসের এক মধ্যদুপুরে ঠাঠা রোদে বাড়িতে এসে বলল, শরীর খারাপ লাগছে। যে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে সেটা ধানের গোলার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখেছে। ঘরে বসে গায়ের জামা নিজেই খুলে বলল, পানি খাব।
মরিয়মের মা পানি এনে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিল। বাবা পানি খেতে পারেনি। কাত হয়ে পড়ে গেছে। তার পর কবিরাজ এসে জানাল বাবা মারা গেছে। তখন মরিয়মের বয়স বারো বছর।
বাড়ির সবকিছু দাদা দেখাশোনা করেন। দাদার নাম আজিবর বিশ্বাস। অগ্রহায়ণ মাসে মরিয়মের বিয়ে তিনি ঠিক করেছেন। গেরস্থ বাড়ির ছেলে। লেখাপড়া জানা। আইএ পাস করে এখন বিএ ক্লাসে পড়ছে। ছেলে দাদার পছন্দ হয়েছে। দাদা বললেন, মরিয়ম, শুধু ছেলে দেখে তোমার বিয়ে সেই বাড়িতে ঠিক করি নাই। তাদের ধানের চারখানা গোলা দেখেও না। বিয়ে ঠিক করেছি তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি দেখে। তারা অতি ভালো মানুষ। তুমি সেখানে গিয়ে বাপ-মায়ের অভাব বোধ করবে না।
সিদ্ধান্ত দাদা নেবেন। মরিয়মের কিছু বলার নেই। দাদা মরিয়মের বিয়ের জন্য সোনার গহনার ব্যবস্থা করেছেন। মরিয়মের দাদির দুটো কানের দুল ভেঙে গঞ্জে গিয়ে নতুন ডিজাইনের কানপাশা বানিয়ে এনেছেন। হাতের বালা, গলার চেইন, সিঁথির টিকলি বানানো হয়েছে। পায়ের ছয়দানা মল বানানোর ইচ্ছে আছে।
চৈত্র মাসে দেশের অবস্থা বদলে গেল। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বাড়ি থেকে জোয়ান ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন করছে। গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
আজিবর বিশ্বাস এসেছেন রসুনদি। মরিয়মের সঙ্গে যে ছেলের বিয়ের কথা হয়েছে তাদের বাড়ি। ছেলের বাবার নাম এনায়েত মণ্ডল। আজিবর বিশ্বাস বললেন, বিয়ে কি বাবা তাহলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে এগিয়ে নিয়ে আসব? আমার প্রস্তুতি শেষ। যতখানি স্বর্ণ দিয়ে ছেলের বউ ঘরে এনেছি তার চেয়ে বেশি স্বর্ণ দিয়ে মরিয়মকে তোমার বাড়িতে দিয়ে যাব। দেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিয়ে দিয়ে যদি মেয়েকে এদিকে নিয়ে আসো, ভালো হতো। বলা তো যায় না কখন কী হয়!
এনায়েত মণ্ডল চুপ করে আছে। কিছু বলেনি। তার চোখে চিন্তার গভীর ভাঁজ। কিছু ভাবছে। আজিবর বিশ্বাস বললেন, আমাদের দিকের বউ-ঝিয়েরা বলতে গেলে বাড়িছাড়া। সারাক্ষণ আতঙ্ক, ভয়, দৌড়াদৌড়ির মাঝে থাকতে হয়।
এনায়েত মণ্ডল গম্ভীর গলায় বলল, ছেলে বাড়ি নেই। তাহির যুদ্ধে গেছে।
আজিবর বিশ্বাস রসুনদি থেকে ফিরে এলেন। তবে তাকে এনায়েত মণ্ডল খালি হাতে বিদায় দেয়নি। আসার সময় গাছের চারটা নারকেল আর ঝোলাভর্তি আম দিয়ে দিয়েছে।
দাদার বাড়িতে মরিয়মের থাকার মতো অবস্থা থাকল না। পাশের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। প্রতিদিন শোনা যাচ্ছে তারা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। আজিবর বিশ্বাস একরাতে ছেলে, ছেলের বউ, মরিয়মের মা আর মরিয়মকে নিয়ে মরিয়মের নানার গ্রামে চলে গেলেন। মরিয়মের দাদি বাড়িতে থাকলেন। দাদা তাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবেন।
মরিয়মের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কেউ নেই। বাড়ি খাঁখাঁ করছে। যা করার রাতের ভেতরেই করতে হবে। ভোরে আলো দেখা দিলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। আজিবর বিশ্বাস মরিয়মের মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। মরিয়মের ছোট চাচা আলেয়া আর মরিয়মকে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়ি।
আলেয়ার বাবার বাড়ি। সেখানে আলেয়া আর মরিয়ম থেকে গেল। চাচা বলল, জান দেব তবু মান দেব না। শিগগিরই ফিরে আসব। দেশ স্বাধীন করেই ফিরব।
আলেয়ার বাবা বললেন, নিজ ভাগ্য কেউ বদলাতে পারে না। যার যেখানে মৃত্যু আছে সেখানেই হবে। থাক তোমরা এখানে। যদি মরণ আসে একসঙ্গে মরব।
সেই গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারির উৎপাত শুরু হলো। পিলপিল করে গ্রামে ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি মিলিটারি। তাদের সঙ্গে আসে গ্রামের পরিচিত লোক। তারা রাজাকার। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহায়তা করে। বাড়ি থেকে ছাগল ধরে নিয়ে যায়। মেয়েদের টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আটকে রাখে।
আলেয়ার বাবা ঘরের ভেতর বড় গর্ত খুড়লেন। পাকিস্তানি মিলিটারি বাড়িতে এলে মেয়েরা সেই গর্তে ঢুকে পড়ে। পুরুষরা কেউ বাড়ি থাকে না।
সেদিন আচমকা পাকিস্তানি মিলিটারি বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারা সংখ্যায় ২০ থেকে ২৫ জন। সঙ্গে দুজন রাজাকার। পুরুষরা কেউ বাড়িতে নেই। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে আলেয়া আর মরিয়ম হতভম্ব হয়ে গেছে। আলেয়া দৌড়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে। তার পেছনে দুজন পাকিস্তানি মিলিটারি দৌড়াচ্ছে। আলেয়া ঝট করে শুধু বলতে পারল, মৌরি পালা।
মরিয়ম কোথায় পালাবে! তার অবস্থা হয়ে গেছে দিশেহারা। মরিয়ম দিশা না পেয়ে বাড়ির কুয়ার ভেতর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।
কুয়ার পানি থেকে মাথা তুলে থমকে গেছে মরিয়ম। সাপ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সাপ মরিয়ম চেনে না। সে ওপরের দিকে তাকাল। কেউ নিশ্চয় তাকে বাঁচাবে। অমনি সাপ ছোবল মারল তার কাঁধে।
বাড়িতে কাউকে না পেয়ে রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারিরা ফিরে গেল। আলেয়া দেখেছিল মরিয়ম কুয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মরিয়মকে কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। সে আছে অচেতন অবস্থায়।
সাপের বিষ নামাতে হবে মরিয়মের শরীর থেকে। তাকে সাপুড়ের কাছে নিতে হবে। সাপুড়ে বা কবিরাজকে ডেকে আনতে সময় লাগবে। ততক্ষণ মরিয়ম বেঁচে নাও থাকতে পারে।
যুবতী মেয়ে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। রাজাকারের নজর আছে। মরিয়ম আরও নাজুক হয়ে আসছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। মরিয়মকে বস্তার ভেতর ঢোকানো হয়েছে। বস্তার মুখ বেঁধে তাকে আনা হয়েছে সাপুড়ের বাড়িতে। সাপুড়ে বলল, তার অবস্থা খুব খারাপ। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সাপের বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমার কাছে রেখে গেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
মরিয়মকে সাপুড়ের কাছে রেখে আসা হলো। বেঁচে উঠেছে মরিয়ম। তবে সুস্থ হতে সময় নিয়েছে। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে।
পরের বছর ফাল্গুন মাস। সে বছরও গাছ ঝেপে পলাশ ফুল ফুটেছে। উঠোন থেকে পলাশ ফুল কুড়িয়ে কোঁচড়ে রাখতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেছে মরিয়ম। উঠোনে অসম্ভব সুদর্শন এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। অচেনা একজন।
মিহি গলায় তরুণ বলল, আমার নাম তাহির। তোমাকে আমি বিয়ে করব, সেই কথা জানাতে এসেছি।
থরথর করে কেঁপে উঠেছে মরিয়ম। তার কোঁচড় থেকে একরাশ পলাশ ছড়িয়ে পড়ল উঠোনে।
গল্প শেষ হতে পারত তাহিরের সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে দিয়ে। ঘটনা সেরকম ঘটেনি। ঘটনাকে নতুনভাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা লেখকের আছে। লেখক সেই ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। আজিবর বিশ্বাস রসুনদি গ্রামে গিয়েছিলেন বিয়ের নতুন দিন ঠিক করতে। ছেলের বাবা, ছেলে কেউ এ বিয়েতে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমাদের কাছে খবর আছে মরিয়ম পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। সে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর বাবার বয়সী একজনের সঙ্গে মরিয়মের বিয়ে হয়েছে। মরিয়ম তখন মানসিকভাবে অসুস্থ। সময় যায়। মরিয়ম আটকে থাকে ১৯৭১ সালের বসন্তে- এক অন্ধকার কুয়ায়।