ঢাকা ১৩ চৈত্র ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১

বইমেলা দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচিত ২৪ বই

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম
আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৩ পিএম
দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচিত ২৪ বই

প্রতিটি বই একটি পৃথিবী। বই হলো বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। আর বইমেলা হলো জ্ঞানের উৎসব। এই উৎসবে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে শব্দ তৈরিতে, আর লিখিত শব্দগুলো একটি সেতুতে পরিণত হয়। যা আমাদের সাহিত্যযাত্রার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে সংযুক্ত করে। আমাদের জনগণের চেতনা সংরক্ষণ, উদযাপন এবং বিশ্বের সঙ্গে সেতু তৈরি করে বইয়ের পাতা।

‘গরম’ জলবায়ু ও গরম রাজনীতি
ফরিদা আখতার
শ্রেণি: প্রকৃতি, জলবায়ু ও পরিবেশ 
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৮৪; মূল্য: ৫০০ টাকা

গরম জলবায়ু ও গরম রাজনীতি কথার কথা নয়। পৃথিবী ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। জলবায়ু নিয়ে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে রাজনীতি হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে বিশ্বের মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। গরম তো আরও বাড়বেই। প্রতি বছর জাতিসংঘ আয়োজিত কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হাজার হাজার পরিবেশকর্মী এবং সরকারের প্রতিনিধিরা সেখানে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুই অর্জন করা যাচ্ছে না। দেশের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর বিষয় নিয়ে সবাই ভুগলেও মাত্র একটি মন্ত্রণালয় এই বিষয়সংক্রান্ত কার্যকলাপে জড়িত হচ্ছে। তাতে সবার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যেমন- নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, ভূমি সবকিছুই জড়িত অথচ তারা জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় নেই। এই বইতে জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়েই নানা কথা।...

গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী 
এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি
মতিউর রহমান
শ্রেণি: সমাজসেবক ও সংস্কারক 
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৯৬; মূল্য: ৬০০ টাকা

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে লন্ডনে শ্রমিক আন্দোলন ও সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে প্রচার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এক বাঙালি বিপ্লবী। তার পর প্যারিস, বার্লিন, জেনেভা, মস্কো প্রভৃতি ইউরোপীয় শহর ঘুরে খুঁজে ফেরেন ভারতের মুক্তির দিশা। আরও দুই বিপ্লবীর সঙ্গে মিলে ‘ভারত ও বিশ্ববিপ্লব’ থিসিস লিখে পাঠান রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের কাছে। বিয়ে করেন এক ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ও মডেলকে, যার পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন প্রখ্যাত ইতালীয় শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানি। সবশেষে স্থায়ী হন মস্কোয়। গ্রহণ করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং সোভিয়েত নাগরিকত্ব। পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) নানামুখী কাজের সঙ্গে জড়িত হন।... ভারতের স্বাধীনতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা এই বাঙালি বিপ্লবী আর কোনো দিন ফিরতে পারেননি মাতৃভূমিতে।

পেশাওয়ার এক্সপ্রেস ও অন্যান্য গল্প
কৃষণ চন্দর, জ্যোতির্ময় নন্দী (অনুবাদক)
শ্রেণি: অনুবাদ গল্প
প্রকাশনী: বাতিঘর, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৪৪; মূল্য: ৪০০ টাকা

কৃষণ চন্দরকে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, সারা বিশ্বের সেরা কথাশিল্পীদের কাতারে ফেলা যায়। তার সাহিত্য পাঠ করা মানে স্বপ্নীল রোম্যান্টিকতা ও রক্তাক্ত বাস্তবতার এক আশ্চর্য পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। বইয়ের গল্পগুলো পাঠককে সেই আশ্চর্য পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তার রচনায় ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ, বিশেষ করে পাঞ্জাব-বিভক্তির যন্ত্রণা সবচেয়ে গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। তার রচনাবলির একটি বড় অংশ ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভারতবাসীর অংশগ্রহণ, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে।...

গদ্যসংগ্রহ
শহীদ কাদরী
মুহিত হাসান (সম্পাদিত)
শ্রেণি: প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গবেষণা সমগ্র/সংকলন
প্রকাশনী: কবি, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬৮; মূল্য: ৪০০ টাকা

শহীদ কাদরী কবি হিসেবে পাঠকদের কাছে রীতিমতো কিংবদন্তি হলেও তার গদ্যকার-সত্তা সম্বন্ধে অনেকেই অবগত নন। বিষয়ের বৈচিত্র্য, বিশ্লেষণের ধার ও ভাষার স্বাতন্ত্র্যের নিরিখে কাদরীর গদ্য তার কবিতার মতোই বিশিষ্ট, ঋদ্ধ। যেন মনন-সৃজনের বিরল নিখুঁত যুগলবন্দি। ‘গদ্যসংগ্রহ’-এ অপ্রাপ্যতার আড়াল থেকে প্রথমবারের মতো একত্রিত হলো শহীদ কাদরীর প্রায় অর্ধশত দুর্লভ গদ্যরচনা। এই সংকলন আক্ষরিক অর্থেই এক উজ্জ্বল উদ্ধার।...

তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
মহিউদ্দিন আহমদ
শ্রেণি: রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৩২; মূল্য: ৫৮০ টাকা

১৯৪০-এর দশকে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ঢাকার একজন ছাত্র সংগঠক। ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীন হন সাধারণ সম্পাদক। তিনি বরাবরই থেকে গেছেন মুজিবের ছায়ায়। থেকে গেছেন নেপথ্যে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। তাজউদ্দীন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়াদিল্লি যান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। ওই সময় তিনি যদি এই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। দেশ মুক্ত হওয়ার পর তিনি সরকার ও দলের মধ্যে ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের নায়ক ছিলেন তাজউদ্দীন।...

রক্তে লেখা বিপ্লব
ওয়াসি আহমেদ (সম্পাদিত)
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: বলাকা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৭২০; মূল্য: ১৫০০ টাকা

এই সংকলনটি প্রয়োজনীয়, কারণ আমাদের স্মৃতি বিশ্বাসঘাতক। দৈনন্দিন জীবন আমাদের ওপর অবিরাম এবং নির্দয়ভাবে অধিকার খাটায়। ইতিহাসকে বিলাসিতায় পর্যবসিত করতে চায়। কিন্তু অতীতের অস্তিত্ব অস্বীকার করে যে বর্তমান, সে বর্তমান বেজন্মা। দৈনন্দিন সমস্যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আজ আমরা যে বাজার এবং বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ পাচ্ছি, তা পেয়েছি তরুণ রক্তের বিনিময়ে। আমাদের যাদের জীবন বা অঙ্গ আন্দোলনে হারাতে হয়নি, তাদের জন্য আন্দোলনকে এখনই দূরের অতীত মনে হতে পারে। আধুনিক জীবনের ব্যতিব্যস্ততায় কয়েক মাসকে কয়েক বছর মনে হতেই পারে। এ জন্যই সংকলনটি প্রয়োজনীয়। এখানের লেখাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে কেন সমগ্ৰ বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে একস্বরে স্লোগান দিচ্ছিল। কেন রাস্তা ছিল তাজা রক্তে মাখামাখি, কেন প্রতি ঘরে প্রতিটি মানুষের শ্বাসরোধ করছিল তথ্যের অমানিশা এবং চাপা উৎকণ্ঠা, কেন সারা দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে চলেছিল রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা
সরদার আবদুর রহমান
শ্রেণি: বাংলাদেশের রাজনীতি
প্রকাশনী: ঐতিহ্য, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৩২০; মূল্য: ৭০০ টাকা

একটি দেশের গণতন্ত্র কতটা বিকশিত ও দৃঢ়মূল হতে পারছে সেটি প্রধানত তার নির্বাচনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ও স্বচ্ছতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তার বিকাশে ও স্থিতিশীলতায় নির্বাচনিব্যবস্থার সর্বাধিক অবদান থাকার কথা ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার হীন বাসনায় কী জাতীয় নির্বাচন আর কী স্থানীয়- সব ব্যবস্থাকেই প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়। শীর্ষ থেকে শিকড় পর্যন্ত এক নির্বিচার পীড়নযজ্ঞ চলে মানুষের ভোটাধিকারের ওপর। স্বাধীনভাবে প্রার্থী হতে না পারা এবং মুক্তমনে ভোট দিতে না পারার, বেদনায় জর্জরিত হতে থাকে নাগরিক মন।...

সময় বহিয়া গেল
আনোয়ারা সৈয়দ হক
শ্রেণি: ঐতিহাসিক উপন্যাস
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬৮; মূল্য: ৪৫০ টাকা
পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বাঙালি ডাক্তার সানজিদা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যথারীতি কর্মস্থলে যায়, রোগী দেখে। তার সহকর্মীরা একে একে গোপনে যুদ্ধে চলে যায়, কিন্তু সে কোথাও যেতে পারে না। এক রাতে জরুরি রোগী দেখার কথা বলে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে নারকীয় বিভীষিকা। সানজিদা ডাক্তারি পাস করে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগ দেয়। স্বামী, বাচ্চা ও মাকে নিয়ে তার সংসার। প্রশিক্ষণ নিতে রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে সে জানতে পারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা, একই দেশের অংশ হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা।... সানজিদা প্রমাদ গোনে: এ কোথায় আনা হলো তাকে! কী অপেক্ষা করছে তার নিজের জন্য?

বাংলা বাঙালি বাংলাদেশ
মজিবর রহমান
শ্রেণি: ইতিহাস- প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
প্রকাশনী: বিভাস, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৭৬; মূল্য: ৩০০ টাকা

মজিবর রহমান ‘বাংলা বাঙালি বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন: অনেকদিন থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম বাংলাদেশের জন্মকথা আরও পেছন থেকে শুরু করে পরিবেশন করার। আমরা যে বাঙালি জাতিসত্তার কথা বলি তার উদ্ভব কীভাবে, যে ভাষায় আমরা কথা বলি সেটি সুসংহত হলো কেমন করে, যে সমাজ-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা তার বিবর্তনের ধারা কীরূপ, যে জনপদটি আজকের বাংলাদেশ নামে খ্যাত তার ভূ-প্রাকৃতিক ধরন কেমন ছিল- ক্ষুদ্র পরিসরে সেসব জানান দিতে। বলা প্রাসঙ্গিক যে এমন বিশালত্বকে সংকীর্ণ অবয়ব দিয়ে সন্নিবন্ধ করার মতো মেখা ও বিশেষায়িত জ্ঞান আমার নেই। তার পরও এ কাজে হাত দেওয়ার স্পর্ধা পোষণ করি নিজের শেকড়সন্ধানী প্রবণতা ও সাধারণ্যের কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি লক্ষ্যে।...

বাংলাদেশের সংবিধান ইতিহাসের পুনর্পাঠ
কাজী জাহেদ ইকবাল
শ্রেণি: সংবিধান ও সংবিধান প্রসঙ্গ
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৩১২; মূল্য: ৬০০ টাকা

বাংলাদেশের সংবিধান নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। যুদ্ধে সফল হয়ে আপন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাওয়ার পর সেই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ নেয়। এর নেপথ্যে আছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। খুঁজলে যার শেকড় মিলবে প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত শাসননীতিতে। তার পর মধ্যযুগ, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তানি জামানার শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে তবেই বাংলাদেশের সাংবিধানিক সত্তা নিজস্বতা অর্জন করেছিল। বাংলাদেশ তার প্রথম পৃথক মৌলিক সাংবিধানিক পদক্ষেপ নেয় স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে। স্বাধীনতা অর্জনের পর সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ইতিহাসের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়। নানা কারণে গত ৫০ বছরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুরা
ড. মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম
শ্রেণি: বিদেশিদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৪৮৪; মূল্য: ১৮০০ টাকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট সদস্য, কূটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলের নেতা, লেখক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্ণধার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রমুখ স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি পক্ষাবলম্বন করেছেন, সমর্থন দিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন; উপরন্তু গণহত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের মানুষের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন- তাদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে। এ ছাড়া গণহত্যা, নির্যাতন, দমন, নিপীড়ন ও শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে যেসব বিদেশি বন্ধু সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন- তাদের ভূমিকাও আলোচিত হয়েছে।

ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক
হাসান ফেরদৌস
শ্রেণি: মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও দর্শন
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০২৪, বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৬০; মূল্য: ৪২০ টাকা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি বিরাট রাজনৈতিক ঘটনা। সে ঘটনার তাৎপর্য আবিষ্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই যুদ্ধের ঘটনাস্থল যদিও বাংলাদেশে, তবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল নানা বিদেশি শক্তি, বিশেষত সেই সময়ের দুই প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। জড়িত ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক ব্যক্তিও। কেউ আমাদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন, কেউ ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। এই গ্রন্থে যেমন আমাদের পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রিচার্ড নিক্সন ও তার সহযোগী হেনরি কিসিঞ্জারের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে, তেমনি পরিচয় হয় প্রায় অপরিচিত মার্কিন নৌসেনা চার্লস র‌্যাডফোর্ড ও সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের সঙ্গে। আরও রয়েছে বিজয়ের প্রাক্কালে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীবাহিনীর অবতরণের নাটকীয় ঘটনার পুনর্নির্মাণ এবং ১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় প্রকাশ্যে ‘তওবা’ উচ্চারণের স্বল্পপরিচিত ঘটনা। 

চেতনায় নজরুল
আবদুল লতিফ
শ্রেণি: সাহিত্য ও সাহিত্যিকবিষয়ক প্রবন্ধ
প্রকাশনী: আগামী, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৯৬; মূল্য: ৩০০ টাকা

লেখালেখির জগতে আবদুল লতিফের বহুমুখী বিচরণ। তিনি গল্প, কবিতা, রম্যরচনা আর ভ্রমণকাহিনির পাশাপাশি মনীষীদের জীবনকাহিনি লিখে থাকেন। গত বছর তার লেখা বই সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসিত হওয়ার পর নজরুল জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে তিনি লিখেছেন চেতনায় নজরুল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের নানা দিক নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তার অন্য সব বইয়ের মতো এই বইটিও পাঠকনন্দিত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।...

কবি ও একজন নর্তকী
মোস্তফা কামাল
শ্রেণি: উপন্যাস
প্রকাশনী: অনন্যা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৮৬; মূল্য: ২৫০ টাকা

রাতের আঁধারে এক সুন্দরী নারী ঢোকে মাহমুদুল হকের বাড়িতে। তিনি একজন চিরকুমার কবি। মুখাবয়বে বয়সের ছাপ। কিন্তু সুন্দরী নারী দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। সুন্দরীকে পেয়ে কবির আবেগ-ভালোবাসা যেন উথলে ওঠে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে অন্যত্র। মেয়েটি কবির বাড়িতে এসেই মানসিক ভারসাম্য হারায়। ভুলে যায় সে নিজের নাম-পরিচয়। এতে মহাবিপাকে পড়েন কবি। তার পরও এক মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই মেয়েটির গর্ভে আসে নতুন অতিথি। কিন্তু হায়! সেই সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই আত্মহননের পথ বেছে নেয় মেয়েটি। কিন্তু কেন? কী ঘটেছিল তার জীবনে?

কুষ্টিয়ার জমিদার
ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন ও ড. সারিয়া সুলতানা
শ্রেণি: আঞ্চলিক ইতিহাস
প্রকাশনী: কণ্ঠধ্বনি, কুষ্টিয়া
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৯২; মূল্য: ৬০০ টাকা

মুঘল সাম্রাজ্যের সময় জোতদার, জমিদাররা আভিজাত্যের প্রতীক ছিল এবং শাসক শ্রেণি গঠন করত। বাঙালি সমাজের রূপান্তর ঘটেছিল বিদেশি স্বার্থে। একশ্রেণির হিন্দু-মুসলমান বাঙালি, শাসকের অনুগত হয়ে বিত্ত সঞ্চয় করে আভিজাত্যের তকমা লাগিয়ে সমাজ-প্রভু হয়ে ওঠে। বিত্তের গদিতে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে তারা রাজা, রায়বাহাদুর খেতাবে বিভূষিত হতে থাকে। বেশির ভাগ বাঙালি সহায়সম্পদ হারিয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল। জমিদাররা ইংরেজ শাসনের ভিত পাকাপোক্ত করেছিল- তাদের স্বার্থেই দরিদ্র গ্রামবাসীকে ব্যস্তুচ্যুত করেছিল, দারিদ্র্যের শেষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছিল। এই গ্রামবাসীর পনেরো আনাই ছিল কৃষক। হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে যে জমিদার গোষ্ঠীর সৃষ্টি, তাদের নিষ্ঠুরতার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার অন্যতম হলো দুর্ভিক্ষ। বিদেশি বণিক যখন এ দেশে প্রভু হয়ে বসে, তখন তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক স্বার্থে পরিচালিত করে। সেজন্য তাদের প্রয়োজন হয়েছিল জমিদারশ্রেণির মতো এক গোষ্ঠীর।...

পানি সংকট প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
সৈয়দা বদরুন নেসা
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: বলাকা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৮৪; মূল্য: ৬৫০ টাকা

‘পানি সংকট প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’- শুধু একটি বই নয়, সময়ের আহ্বানে লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল। যা একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা। বইটিতে বাংলাদেশের পানি সংকটের বহুমুখী দিক তুলে ধরা এ এর কার্যকর সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা আছে।

কাটামুণ্ডু রহস্য
মোস্তফা কামাল
শ্রেণি: থ্রিলার
প্রকাশনী: সময়, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৯৬; মূল্য: ২২০ টাকা

জয়নালের মনের মধ্যে ভয় আর শঙ্কা। রিকশায় চটের বস্তা দেখে সে চমকে ওঠে। বস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে আবার ফিরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বস্তা খোলার জন্য এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে বস্তা খোলে। বস্তার ভেতরের দিকে নজর পড়তেই লাফিয়ে ওঠে জয়নাল! বস্তা ফেলে দূরে সরে যায়। ভয়ে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আচমকা বলে ওঠে, ও আল্লাহ! এ কী সর্বনাইশ্যা কাণ্ড! এই রক্তাক্ত কাটামুণ্ডু কার! জয়নাল মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এই কাটা মাথা সে কী করবে! কোথায় নিয়ে ফেলবে! এটা গ্যারেজে রাখা নিরাপদ না। পুলিশ টের পেলে আর রক্ষা নেই। জয়নালকে তো জেলে যেতেই হবে; সঙ্গে গ্যারেজ মালিককেও! কাটামুণ্ডু ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়নাল! কিন্তু সেখানেও ঘটে বিপত্তি! চারদিক থেকে কেবল বিপদের হাতছানি! 
কাটামুণ্ডু রহস্য এক রোমহর্ষক কাহিনি।

বখতিয়ারের বানরগুলি 
নাসরীন জাহান
শ্রেণি: সমকালীন গল্প
প্রকাশনী: বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৭২; মূল্য: ২৪০ টাকা

দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে নাসরীন জাহানের নতুন গল্পের বই বেরোল। নাসরীন নিজের গল্পের মাধ্যমকে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করেন। ‘সিগনেচার লেখা’ বলা যায়, এমন বেশকিছু গল্প আছে তার যা আলোচিত হয়, দেশে, দেশের বাইরে। জাদুবাস্তবতার ফর্মে তৈরি আগের গল্পগুলো নিষ্পেষিত জীবনের। এই বইয়ের গল্পগুলো সেসব গল্প থেকে আলাদা। বেশির ভাগ গল্প আকারে ছোট। সহজাত জীবন এবং বোধের ছন্দে লিখে গেছেন তিনি। তার নিজের একটা তৈরি গদ্যভাষা আছে। সেই ভাষা ডিঙিয়ে এবার জমিয়ে গল্প লেখার কথা ভেবেছেন তিনি। যা ধরে রাখে, শেষ অব্দি।...

নিঃসঙ্গ নটী
দীপু মাহমুদ
শ্রেণি: ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস
প্রকাশনী: সময় প্রকাশন
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৪৪; মূল্য: ৩৪০.০০ টাকা

অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর নামে থিয়েটারের নাম হওয়ার কথা ছিল বিনোদিনী থিয়েটার। তা হয়নি। থিয়েটারের নাম হয়েছে স্টার থিয়েটার। প্রশ্ন করেছেন নটী বিনোদিনী, কীসের ক্ষোভ ছিল আমার ওপর? নাকি ভয়! একজন নারী, সে আবার বারনারী, দখল করে নিচ্ছে কলকাতার থিয়েটার সাম্রাজ্য। যা আপনারা কয়েকজন পুরুষ আপনাদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে জ্ঞান করেন!... সত্য ঘটনা নিয়ে বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে লেখা সাহস আর সংগ্রামের পরম বাস্তবতার অজানা কাহিনি নিঃসঙ্গ নটী। প্রেম, স্পর্ধা, হাহাকার, প্রতারিত হওয়া আর মানুষের মর্যাদার পক্ষে লড়ে যাওয়ার একজন নারীর না-বলা বিস্ময়কর উপাখ্যান।

প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর
শাহনাজ মুন্নী
শ্রেণি: সমকালীন গল্প
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২০৮; মূল্য: ৪০০ টাকা

নির্লিপ্ত বর্ণনায় হরেক চরিত্রের সাবলীল চলাফেরা শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পের বৈশিষ্ট্য। ছোটো ছোটো সংলাপ, কথা বলা কি না-বলা, অথচ যেন অনেক কিছু বলা! বয়ানের দক্ষতায় অলীক কাহিনি যখন চোখের সামনে ঘোর বাস্তব হয়ে ওঠে, তখন পাঠক প্রত্যাশিত আবেশে গা না-ভাসিয়ে পারেন না। চিরাচরিত জীবন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বিষয়-দুইয়ের মেলবন্ধন যেন শাহ্নাজ মুন্নী গল্প। আর গল্প যে কেবল কাহিনি নয়, মানানসই শব্দ-বাক্যেরও সমাহার, তা মুন্নীর গল্প পড়লেই জানা যায়। কাব্যিক চলনে দৃশ্যের পর দৃশ্য যেন একেকটি গল্পই নয় কেবল, একেকটি ক্যানভাস! 


 
মোগল শাহজাদিদের কান্না
খাজা হাসান নিজামী, আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু (অনুবাদক)
শ্রেণি: ঐতিহাসিক উপন্যাস
প্রকাশনী: ঐতিহ্য, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৪০; মূল্য: ১৮০ টাকা
ব্রিটিশরা সাগর পাড়ি দিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতের দক্ষিণ অংশে পৌঁছায় এবং মোগল সম্রাট ও শাহজাদাদের কাছে ধরনা দেয় বাণিজ্যসুবিধা লাভের আশায়। ভারতবর্ষে বিরাজমান তখনকার নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি ইংরেজদের উদ্দেশ্য সাধনের অনুকূলে ছিল। বণিক থেকে ক্রমান্বয়ে ভারতের শাসক হিসেবে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায় মোগল সম্রাটের প্রতি ব্রিটিশের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষে মোগল শাসনের শেষ নিশানাটুকুও বিলীন হয়ে যায়। মোগল রাজপরিবারের অনেক সদস্য ইংরেজদের নিগ্রহ এড়াতে পরিচয় লুকিয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। মোগল পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহিলাদের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে করুণ।

 

তিতাসের বুনো হাঁস 
মাসউদ আহমাদ
শ্রেণি: জীবনীভিত্তিক উপন্যাস
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৭৬; মূল্য: ৪৭০ টাকা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাটে মালো পরিবারে জন্মেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। ভদ্রলোকেরা ‘গাবরপাড়া’ বলে তাচ্ছিল্য করতেন। শৈশবেই মা-বাবাকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েন। ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় পাড়ি দেন। ত্রিপুরা পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি; ক্রমশ নবশক্তি, মোহাম্মদী, কৃষক ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় কাজ করেন। আচমকা যক্ষ্মারোগ ধরা পড়লে কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েও তিনি পালিয়ে যান; লেখার কাজ ও মালো সম্প্রদায়ের মানুষের টানে। কেমন ছিল তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই আর মানসরাজ্য? সময়ের জলছাপে তার নামটি মুছে গেলেও তিতাস একটি নদীর নাম স্বমহিমায় ভাস্বর। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহই ছিল জীবনের আরাধনা। তিতাসের বুনো হাঁস উপন্যাসে মন কেমন করা সেই গল্পই ধরা পড়েছে।

দি হোয়াইট বুক
হান ক্যাং
আসাদুল লতিফ (অনুবাদক)
শ্রেণি: অনুবাদ উপন্যাস 
প্রকাশনী: অন্যধারা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ৬৪; মূল্য: ১৪০ টাকা

জীবন, মৃত্যু আর শোক নিয়ে ভাবনা জাগানো হান ক্যাং-এর কাব্যিক ধ্যানের উপন্যাস ‘দি হোয়াইট বুক’। তুষার, লবণ, শিশুর প্রথম আচ্ছাদন কিংবা সাদা ফুলের শুভ্রতা নিয়ে গড়ে উঠেছে এর একেকটি আখ্যান। এই চিহ্নগুলোর ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে কাছের মানুষ হারানোর গল্প, হোক সেটা লেখকের একান্ত কিংবা অন্য কারও। অনেকটা দূর থেকে দেখা স্মৃতি, আত্মপরিচয় আর অস্তিত্বের অনিত্যতার ভাবনাগুলো গদ্য আর চিত্রকল্পের মিশেলে এই বইয়ে চিত্রিত হয়েছে এক গভীর আত্মদর্শনে।... স্মৃতি আর বিষাদে ছেয়ে থাকা আপাত খাপছাড়া এই লেখাগুলো সংবেদী পাঠকের ইতিহাস আর রাজনীতির ভাবনায়ও আলোড়ন জোগাবে।

একটি বিষণ্ন রাইফেল
রায়হান রাইন
শ্রেণি: থ্রিলার
প্রকাশনী: প্রথমা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫
পৃষ্ঠা: ২৪৮; মূল্য: ৫৫০ টাকা

এক জোছনারাতে অপহরণকারীরা শাফায়েত কবিরকে ফেলে রেখে যায় পাহাড়ি রাস্তার ধারে। জেরা করার সময় একজন বলেছিল, ‘খেয়াল কইরেন শাফায়েত সাহেব, একটা গরু কীভাবে বাঁচে।’ কিন্তু শাফায়েত গরুর মতো বাঁচতে চায়নি। সে কারণে নজরদারি শুরু হয়ে যায়। একের পর এক অচেনা আগন্তুক আসতে শুরু করে তার বাসায়। তারা শাফায়েতকে এক ভয়ংকর খেলায় নামতে বাধ্য করে এবং একজন বলে, ‘এই খেলায় আপনি আউট হয়ে যাবেন- আউট মানে ডেথ।’ মায়ের প্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, শাফায়েতের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনিও কি শাফায়েতকে অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন?... রাষ্ট্রখেলা শাফায়েতকে সবকিছু থেকে উৎখাত করে, এমনকি নিজের পরিচয় ও ‘দেহ’ থেকেও। তনুজা শারমিনের চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে শাফায়েত তার সেই বদলে যাওয়া ‘প্রতিকৃতি’ দেখতে পায়।...

গ্রন্থনা: ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন

কবিতার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৪:২১ পিএম
কবিতার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

জীবনানন্দোত্তর বাংলা কবিতার প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। পিতা রামনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা কমলা দেবী। কর্মজীবনে কবি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় ব্যবসা, পরবর্তীতে শিক্ষকতা, তার পর মোটর কোম্পানিতে চাকরি এবং শেষবার ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম, হে নৈশব্দ’ (১৯৬১); প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’ (১৯৬১)। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার’ (১৯৭৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৮৩)-সহ একাধিক পুরস্কার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম- এরকম লাইন আমি লিখেছি, কিন্তু নিজের কাছে এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি, অন্য দিকে চলে গেছি। এই লাইনটি বরং শক্তির ক্ষেত্রে সত্যি। ভয়ংকর খাদের কিনারা ধরে হেঁটে যাওয়া।…

ভাষা ও স্বাধীনতা হলো জাতির অস্তিত্ব ও মুক্তি

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
ভাষা ও স্বাধীনতা হলো জাতির অস্তিত্ব ও মুক্তি

‘ভাষা’ ও ‘স্বাধীনতা’ কবিতার অন্ত্যমিলের মতোই পাশাপাশি দুটি অন্তর্নিহিত শক্তিশালী শব্দ। ভাষা হলো একটি জাতির অস্তিত্ব আর স্বাধীনতা হলো জাতির মুক্তি। বাঙালিরা এই দুটি শব্দের জন্য সংগ্রাম করেছে এবং জীবন দিয়ে। প্রথমেই আসা যাক, কীভাবে ভাষা একটি জাতির অস্তিত্ব বা পরিচয়? ধরুন একটি নদী, কলস্রোতা নদী, ধীরে ধীরে সেই নদীটি পানি হারাচ্ছে, একসময় সেই নদীটি মরে গেল। আসলে পানি ছাড়া নদী বাঁচে না, ভাষাও পানির মতো, জাতির ভাষা হারিয়ে গেলে, সেই জাতি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কীভাবে হারিয়ে যায়? চলুন সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমরা জানি, বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশে ৭ হাজার ৯৯টি ভাষা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ কোনো কোনো দেশে একাধিক ভাষা আছে, খুব কাছে থেকে উদাহরণ দিচ্ছি- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪২ জন এবং তাদের ২৮টি অঙ্গরাজ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃত ২২টি ভাষা রয়েছে (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)। 

১৯৯৪ সালে লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় তার কলকাতার বাসায় আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দেখো পৃথিবীতে তোমরাই একমাত্র সংগ্রামী ও গৌরবান্বিত জাতি, যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছ, সুতরাং ভাষার মর্যাদা যে জাতি দেয়, সে জাতি পৃথিবীতে ভাস্বর হয়ে থাকে’ কথাটি বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষার প্রচলন থাকবে কি না, এই প্রসঙ্গে। কারণ হিসেবে বলেছেন যে, ‘কখনো কখনো একটি ভাষা অন্য একটি ভাষাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে। যেমন হিন্দির যে প্রভাব ও বিস্তার ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, তাতে আশঙ্কা করছি এখানে বাংলা ভাষা ৫০ বছর বিলুপ্ত হয়ে যায় কি না।’ এই যে বাংলা ভাষার কথা তিনি বললেন, সেটির ত্যাগ ও মহিমার কথা একবার চিন্তা করুন সবাই। 

আমরা সবাই জানি, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ: পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার পুরো পাকিস্তানের সব ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ মাতৃভাষা বাংলার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহিদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন, শহিদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়’। 

এখন আমাদের করণীয় কী? করণীয় হলো- সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। শুদ্ধ বাংলা চর্চা করা, কথনে, পঠনে ও লিখনে বাংলাকে সুন্দর করে যত্ন করা। এই যত্নে অবহেলা করা যাবে না। কারণ মনে রাখতে দুটি কথা- ১. এই ভাষা প্রতিষ্ঠা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে ও ২. ভাষার মর্যাদা না দিলে, চর্চা না করলে, মায়ের মলিন মুখের মতোই হয়ে যাবে, জলবিহীন নদীর মতোই ধীরে ধীরে মরে যাবে। মনে রাখতে হবে ভাষা জাতির আত্মা। আমরা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভাষা ব্যবহার করব, তবে তা মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে বা অপমান করে নয়। হাজার বছরের লালিত নিজস্ব পরিচয়ের শক্তি ভাষাকে পাশ কাটালে, নিজেকেই ঠকানো হবে। শিশুরা যেমন দুধ খেতে মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে, তেমনি ভাষাও শিশুর মতো, তাকে হাতে হাতে পরম্পরায় না রাখলে, সে অভিমান করে, পালিয়ে অগোচরে। ভাষা প্রাণ, ভাষা প্রাণ। তাকে জীবিত রাখতে হয়। ভাষার এই জীবনের নাম আদর। তাই আসুন ভাষাকে আদর করি- ভাষা ও দেশ, মায়ের নন্দিত মুখ। ভালোবাসি দেশ, স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ।

পুরোনো রণক্ষেত্র

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৪ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
পুরোনো রণক্ষেত্র
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ধুলোবালি মাখা বাতাস বইছে। চোখ মেলে তাকানো যায় না। পেছনের রিকশা থেকে গলা বাড়িয়ে শিউলি জিজ্ঞেস করে- আর কয় মাইল হবে আলম ভাই?
মাইল চারেক, কষ্ট হচ্ছে খুব?
না, ঠিক আছে।

শাহ আলম মাথা ঘুরিয়ে পেছনের রিকশাটার দিকে তাকায়। পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের শরীরটা আগের মতো নেই বলে সহজেই পাড়ি দেওয়া গেছে। অমসৃণ মেঠো পথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও অনেকদূর আসা গেছে। কংক্রিটের সড়ক হলেও দেশ স্বাধীনের পর খুব একটা মেরামত হয়নি। এমন সড়কে হাঁটা তবু ভালো, রিকশায় চাপলে জান বেরোবার জোগাড় হয়।

শেরপুর পেরোতেই সড়কের চেহারা আরও সঙ্গিন মনে হয়। যত্রতত্র ইঁদুরের গর্ত। ট্রাক ও মহাজনি মোষের গাড়ি চলে খাদ-খন্দকে বেহাল বানিয়েছে সড়ক। অতএব দুজন নারী সহযাত্রীর অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারে শাহ আলম। বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা অনেকটা পথ শক্তি সঞ্চয় করে টিকেছিলেন। ভেবেছিলেন- কষ্ট তো হবেই। কিন্তু আরও মাইল কয়েক চলার পর শরীরটাকে আর সামলে রাখতে পারলেন না তিনি। মেয়ে শিউলির বুকে মাথা রেখে বললেন- আমাকে একটু ধরবি, মা।

ঢাকা থেকে বাসে জামালপুর পৌঁছাতেই পাঁচ ঘণ্টার বেশি লেগেছে। বৃদ্ধার শরীর ভেঙে গেছে তখনি। তবু কিছু বলেননি। কিন্তু খেয়াঘাট পেরিয়ে রিকশাটা চলতেই তিনি কাঁপতে থাকলেন। তার মতো একজনের এরকম ধকল সইবার কথা নয়। কিন্তু শরীর আজ তার কাছে বড় নয়, যে করেই হোক তিনি গন্তব্যে পৌঁছতে চান।

আরও ঘণ্টা খানেক পর সড়কের পাশে বড় একটা আমগাছ দেখতে পায় শাহ আলম। গাছটাকে বেশ চেনা মনে হয়। শাহ আলম রিকশা থেকে নামে। পা দুটো জমে গেছে, রগগুলো টনটন করছে। যতদূর মনে পড়ে, এই গাছটার নিচে অনেকবারই তারা বিশ্রাম নিয়েছে যুদ্ধের সময়। 

গাছটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম। অনেক বছরের ব্যবধানে অনেক বদলে গেছে। আগের শরীর নেই। তবু চেনা যায়। পাশের পুলটি আজও সে রকম, তেমন মেরামত হয়নি। দক্ষিণের বিলটা প্রায় জলশূন্য। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম চিনতে পারে এলাকাটি।

পেছনের রিকশাটা ইতোমধ্যে কাছে আসে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে বলে, মা, নামুন, একটু বিশ্রাম নিন।

বৃদ্ধাকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় শাহ আলম। পা ফেলতেই ধপাস করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েন বৃদ্ধ মহিলা। জিরজিরে শরীরে এমন ধকল সইবার কথা নয়।

ওরা যখন আমগাছের নিচে বসে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিল, ঠিক তখনই গাছটার পাতা কাঁপিয়ে, ডালপালা বেয়ে এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। শিউলি সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে- ইশ কী ঠাণ্ডা, বৃষ্টি হবে নাকি আলম ভাই?
হবে হয়তো, এ সময় তো বৃষ্টি হয়, যা গরম।

ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে শিউলি মুখের ঘাম মুছতে থাকে। ইতোমধ্যে গাছের গোড়ালিতে শরীর ঠেকিয়ে বসে পড়েন বৃদ্ধা। চোখ ঘুরিয়ে জায়গাটা দেখতে থাকেন। আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। কোনোদিন আসতে হবে তাও ভাবেননি, অথচ এসেছেন। কেন, কীসের টানে, অজানা-অচেনা এলাকাটি এত বছর পর এলেন তিনি? সবার অগোচরে আঁচলে চোখ মুছলেন বৃদ্ধা। 

গারো পাহাড়ঘেঁষা জামালপুর - শেরপুর অঞ্চল। ব্রহ্মপুত্র নদ ও বেশ কয়েকটি স্রোতস্বিনী বয়ে গেছে উত্তর জনপদের এলাকাটার মাঝ দিয়ে। পূব দিকে যমুনা, পশ্চিমে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। অনেক বছর হয়ে গেলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি শাহ আলমের। আরও মাইল কয়েক গেলেই তার স্মৃতির রণাঙ্গন। সামনের একটা কংক্রিটের পুল দেখে শিউরে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা। মনে পড়ে - এই পুলটায় অ্যাম্বুশ বসিয়ে একবার সেনা ও রসদ বোঝাই তিনটি পাকিস্তানি ট্রাক উড়িয়ে দিয়েছিল ওদের প্লাটুন। 

অক্টোবরের শেষ। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় সব রণাঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। একদিন ভোর হতে না হতেই সেনাভর্তি জিপ ও ট্রাক আসতে থাকে জেলা শহর থেকে। দুপাশের জঙ্গলে সারা রাত লুকিয়ে থাকে ১৫ জনের একটি গেরিলা দল। নির্ধারিত সময়ে শাহ আলমের হাতে মেশিনগানের ব্যারেল কেঁপে ওঠে। পুলের ওপর গাড়িগুলো উঠতেই বিকট শব্দে মাইন ফাটে। ভোর রাতের বাতাস তোলপাড় হতে থাকে। খেতের ফসল কেঁপে ওঠে। জয় বাংলা বলে একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে সবাই। 
তারপর?

পরের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেন শাহ আলম। নস্টালজিয়া থেকে তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে শিউলি। বলে, জায়গাটা আপনার খুব চেনা - ভাইয়া কি এখানেই? 

শিউলির সহজ প্রশ্ন শাহ আলমকে কাঁপিয়ে তোলে। এত সহজে এ রকম কোনো প্রশ্ন কি করা যায়! কিন্তু সে শান্ত থাকে। বলে, ঠিক বলেছো, এলাকাটা আমার বেশ চেনা - অনেক স্মৃতি আছে এখানে।
আর ভাইয়া? 

না, সে জায়গাটা এখানে নয় - কামালপুরে - আরও বেশ খানিকটা যেতে হবে আমাদের। 

১৯৭১ সালে শিউলির বয়স অনেক কম। চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঘটনা ঘটে গেলেও ওর মনে তেমন দাগ কাটেনি। শিউলিদের নতুন নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে। পলাতক সময় অতীত ভুলিয়ে দিচ্ছে। শাহ আলম এবং শিউলির আবেগের মাঝে তাই বিস্তর ফারাক।

বুড়ো ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে সামনের একটি বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। বহুমূত্র রোগ তার। ফিরেই বললেন - কামালপুরটা আর কদ্দুর রে বাবা? 

এইতো মা, সামনেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু করার যে কিছু নেই মা। রাস্তাঘাট খুবই খারাপ।

কীসের কষ্ট রে - এসেই তো গেলাম। তুই যা উপকার করলি বাবা, কাজকর্ম ফেলে ছুটলি আমাদের সঙ্গে। তুই বাঁচালি, বাবা, বাঁচালি আমাকে। 

এই বৃদ্ধাকে কী এমন উপকার করেছে শাহ আলম? সন্তানের বধ্যভূমি দেখতে যাবেন মা। গোটা দেশটাই আশা-আকাঙ্ক্ষার আরেক বধ্যভূমি হতে বসেছে। একজন সহযোদ্ধার মাকে না হয় কিছুটা সময়ই দিয়েছে সে - আর বেশি কী! প্রথম দিকে শাহ আলম চেষ্টা করেছিল সহযোদ্ধার মাকে ফেরাতে। বোঝাবার চেষ্টা করেছিল - এত বছর পর হয়তো কোনো চিহ্নই থাকবে না সেখানে - শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? বলেছিল - মা, একটা কথা বলি, শুধু শুধু মনটা খারাপ করে কী লাভ?
কী লাভ জানিনে বাবা, একটি বার তুই নিয়ে চল - শুধু একবার।

ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকাটা শাহ আলমের চেনা। বর্ডারের সামান্য ভেতরে ইপিআরের ক্যাম্প, তাকে ঘিরে শক্ত ঘাটি বানিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বহু সহযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত এলাকা। অনেক স্মৃতি তার এখানে। সেই পুরোনো রণক্ষেত্রের স্মৃতি বুকে ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ফিরে যাচ্ছে আজ সেখানে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে - এমন এক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করছে সে - যেখানে সে ছিল জননন্দিত রাজদ্রোহী - প্রজার রক্ত শোষণ করা রাজাধিরাজের সিংহাসন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হাজারো-লাখো রাজবিদ্রোহী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তখন! সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি! শত্রুকে পরাস্ত করে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় মহান এক রণযাত্রা! রক্ত নদীতে স্নান করে বাঙালির বাঙালি হয়ে বসবাসের মহোৎসব!

কিন্তু আজ কে শত্রু কে মিত্র বোঝা যায় না। সবকিছু পাল্টে গেছে। স্বাধীনতার পতাকা নামিয়ে দিতে আসছে অচেনা মানুষ। শাহ আলমের হাতে আজ রাইফেল নেই। সেদিনের বন্ধুরা কে কোথায় সে খোঁজও জানে না সে। 

রিকশা এগিয়ে চলছে। কড়কড়ে রোদে চালক দুজন ঘেমে অস্থির। একজন বেশ বৃদ্ধ - শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন। তবে চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। শাহ আলম ওদের ঘর্মাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে - পরিবার আর আছে ভাই ?
আল্লায় দিলে আছে কয়েকজন। 
ছেলেমেয়ে?
তাও আছে।

হঠাৎ শাহ আলমের চোখ যায় লোকটার বাঁ হাতের দিকে। লক্ষ করলেই বোঝা যায় শক্ত কোনো আঘাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল কখনো। 

হাতে কী হয়েছিল?
রেজাকারে ধইর‌্যা পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে দিছিল। বাইনট দিয়া খুঁচাইছে, জানে মরি নাই খোদার রহমে।

রিকশাওয়ালার কথায় শাহ আলমের চোখে ৭১ সাল ভেসে ওঠে। প্রাচীন দেখার আরশিতে চোখ রাখে সে। শেরপুর-জামালপুরের মধ্যবর্তী এলাকাটা হঠাৎ সবাক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। স্বচ্ছ মন্ত্র পড়া আয়নায় নাকি দূর অতীতের ছবি দেখা যায়। অনেক জাদুকর নাকি পারেন এমন অসম্ভব সাধন করতে।
তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?

না স্যার, ছোট ছিলাম, মুক্তিগর ক্যাম্পে যাতায়াত করতাম, খবরাখবর দিতাম।
ওরা তো তোমাকে মেরেও ফেলতে পারত? 

কত মানুষই তো মরল বাবা, সব্বনাসী একাত্তর কত মানুষের জান নিল, কত মানুষ শহিদ হইল। কিন্তু আল্লাহ তো শেষ পর্যন্ত বাঁচাইয়া রাখল আমারে। 

পড়ন্ত বিকেলে রণক্ষেত্র কামালপুরের সীমানায় এসে দাঁড়ায় রিকশা দুটি। পুরোনো রণক্ষেত্রে পা রাখতেই দেহটা কেঁপে উঠে শাহ আলমের। না, এখানে আজ কোনো বাংকার নেই। যত্রতত্র পড়ে নেই বুলেট ও মর্টারের খোসা। সেই কামালপুরকে চেনার কোনো উপায় নেই। নতুন ফসলের মাঠ। যত্রতত্র ঘরবাড়ি। ইপিআর ক্যাম্পটির নাম বদলে হয়েছে বিডিআর ক্যাম্প। নবীন বৃক্ষরাজি বেড়ে ওঠে ইতিহাসের কামালপুরকে এক অচেনা জনপদ বানিয়েছে। একাত্তরের ৯ মাসে অসংখ্য জনযোদ্ধা এই মাটিতে প্রাণত্যাগ করেছে, এখানেই স্বাধীনতার জন্য আত্মবলি দিয়েছে অগণিত বাঙালি যুবক। এসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ!

শহিদ সাদেক আহমদের মাকে ধরে রিকশা থেকে নামায় শাহ আলম। মাটিতে পা রেখেই বৃদ্ধা বললেন, একটু পানি পাওয়া যাবে, বাবা, তেষ্টা পেয়েছে।
নিশ্চয়ই মা, আমি পানি আনছি।

বলেই শাহ আলম পানির খোঁজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার শাহ আলম এবং সাদেক আহমদকে একদিন এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ চিনত। ভালোবাসা উজাড় করে দিত। কিন্তু সবকিছুই বদলেছে। গাছ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব বদল হয়েছে। শাহ আলম তবু হাঁটতে থাকে। 

ব্যস্ত মানুষ যার যার কাজে চলেছে। স্কুল থেকে দলবেঁধে ফিরছে একদল বালিকা। ভারত সীমান্তের উঁচু বাঁধটা দেখা যাচ্ছে। ধানুয়া গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে সেই আগের মতো। এক থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত বাংকার ছিল এই গ্রামে। উঁচু একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষে। শাহ আলম দেখল সে গাছটি নেই।

চোখ ছল ছল করে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের। মনে আক্রোশ জমে ওঠে। কেন এই রণক্ষেত্রের সব নরনারী, গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ সবাই আজ ছুটে আসছে না? প্রতিটি দোকানপাট, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি ফসলের খেত থেকে কেন ছুটে আসছে না হাজার কৃতজ্ঞ মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে?

কিন্তু সে আশা পূরণ হয় না। কেউ তাকে চিনতে পারে না। কেউ এগিয়ে আসে না। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় - তোমরা কেউ কি মনে করতে পারো - আমি সেই কমান্ডার শাহ আলম, আর ওই তো সেই মা, যার সন্তান সাদেক আহমদ রক্ত তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

বেশ খানিকক্ষণ পর একটি চা দোকান থেকে এক গ্লাস পানি হাতে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদের মা তখন বিডিআর ক্যাম্পের উপরে জাতীয় পতাকার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ওই তো সেই পতাকা- যার গায়ে তার সন্তানের রক্তের দাগ!
মা, এই যে পানি।

কোনো কথা না বলে স্পষ্ট, সোজাসুজি তাকালেন বৃদ্ধা। হঠাৎ বদলে গেল পরিস্থিতি। শাহ আলম মাথা নিচু করে বলল, মা, এই যে পানি এনেছি আপনার জন্য। 

শিউলি ঠিক তখনি এগিয়ে গেল মায়ের কাছে। বলল - পানি খেতে চাইলেন না আপনি? নিচ্ছেন না যে?

হঠাৎ আকাশ ফাটা আর্তনাদ করে শহিদ সাদেক আহমদের মা ডুকরে উঠলেন। দুই হাত বাড়িয়ে শাহ আলমকে জাপটে ধরলেন। - আমি পানি চাই না বাবা, তুই শুধু বল - কোন জায়গায়, ঠিক কোন জায়গায় আমার বাবাকে ফেলে গেছিস তোরা? একবার বল - কোন জায়গায় - কোন জায়গায়?

উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকলেন শহিদ জননী। বারবার করে ডুকরে উঠলেন - বাবা-বাবারে, জাদুমণি রে। আয় বাবা, আয়। একবার, শুধু একবার বুকে আয়।

কিছুতেই থামালেন না বৃদ্ধা। সে রোদনে গাছের ডালে বসা পাখিরা গান থামিয়ে দিল। গরু-ছাগলগুলো সকরুণ চোখে তাকিয়ে থাকল। শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের হাতের ঝাঁকুনিতে গ্লাসের পানি পুরোনো রণক্ষেত্রের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। পানির রং গাঢ় লাল হয়ে শাহ আলম ও শিউলির শরীর, কাপড় রাঙিয়ে দিল। 

মাটিতে আছড়ে পড়তে থাকলেন শহিদ জননী। কেবলই বলতে থাকলেন - শুধু একবার জায়গাটা দেখিয়ে দে বাবা। বল, আমার সাদেক কোথায় শুয়ে আছে? আমি আমার বাবার কাছে শুয়ে থাকব।

মায়ের রোদনে চোখ ভিজে ওঠে শিউলির। শিশু বয়সের স্মৃতি মনে না পড়লেও চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীর ভেসে ওঠে। দ্রুত খুলে যায় ঢেকে রাখা বিস্মৃতির চাদর। রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটি ওর কাছে তীর্থভূমি মনে হয়। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। 

লোকজন জমে যায় ইতোমধ্যে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে - কে এই বৃদ্ধা, কেন কাঁদছেন তিনি? এমন প্রশ্নে বোবা হয়ে যায় শাহ আলম। জড়ো হওয়া মানুষগুলোর ওপর আক্রোশ বাড়তে থাকে। শহিদের মাকে সে থামাতে চেষ্টা করে না, কাঁদুক, যত পারে কাঁদুক শহিদ সহযোদ্ধার মা।

শাহ আলমের কানে তখন রাইফেল, মর্টার এবং এলএমজির গর্জন ছাড়া কিছুই পৌঁছে না। ১৪ দিন অবরুদ্ধ কামালপুরের শত্রুঘাঁটি। মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছে দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি ক্যাম্প। অবিরত গোলাবর্ষণ চলছে কামালপুর বিওপির ওপর। কোম্পানি কমান্ডার সাদেক আহমদ সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢুকে গেছে শত্রুঘাঁটিতে। রক্তে ভিজে গেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তভূমি। হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পতাকা উড়িয়েছে। জয়বাংলার বিজয় উৎসব চলছে। বাংকার থেকে বেরিয়ে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসছে পরাজিত সেনারা। চোখে-মুখে ওদের পরাজয়ের গ্লানি। 

পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র- গোলাবারুদ এক জায়গায় এনে জড়ো করা হচ্ছে। চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে অনেকেই তখন গান ধরেছে, ..আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।

বিশাল বিজয়ের পর দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরে দুজনকে। চোখ দিয়ে দুজনের নোনা পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। সদ্য শত্রুমুক্ত ঘাটিতে জড়ো হতে থাকে অজস্র মানুষ। জয় বাংলা এবং জয় মুক্তিবাহিনীর স্লোগানে বাতাস আন্দোলিত হয়ে উঠছে। বিজয়ের অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। শাহ আলমের সব মনে পড়ে এখনো।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে রণক্ষেত্র। প্রথমে কেউই বুঝতে পারে না কী ঘটল। শাহ আলম দ্রুত ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করে। দেখে, সাদেক আহমদের বিক্ষত শরীর পড়ে আছে। পাশে পড়ে আছে কাঠিতে বাঁধা একটি জাতীয় পতাকা এবং কমান্ডারের পরিত্যক্ত স্টেনগান। ছিন্নভিন্ন শরীরের নিচের অংশটি উড়ে গেছে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনে।

অনেক বছর আগের কথা - শাহ আলম নিজেও ভুলতে বসেছিল। কিন্তু রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাখা স্মৃতি তাকে কঠিন করে তোলে। নতুন ক্রোধ, নতুন ঘৃণা, নতুন এক প্রত্যয় দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরে। এক প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করতে থাকে শাহ আলম। সে প্রচণ্ড বেগে ছুটতে চায়, একটি ঝড় কামনা করে, নতুন একটি ঝড়। 

শিউলির ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ জননীর বিলাপ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। উৎসুক মানুষের ভিড় কমতে শুরু করেছে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই এ এলাকা ছাড়তে হবে। অচেনা গ্রাম - কে কাকে চিনবে, কে কাকে কোথায় আশ্রয় দেবে। 

আলম ভাই, মাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিন তো, সন্ধ্যা হচ্ছে। এক হাতে মাকে আগলে রেখে অনুরোধ করে শিউলি।

এরপর নবীন গজানো গাছপালা, বৃক্ষরাজি, নতুন-পুরোনো ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, অফিসঘর পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় ওরা। শাহ আলম জায়গাটাকে চিনতে চেষ্টা করে। না, আগের কিছু নেই, নেই সারি সারি বাংকার, নেই বোমা ও গ্রেনেডের আগুনে পোড়া খয়েরি রঙের মাটি। এখন কোনো ভারী সামরিক ট্রাক চলে না এখানে, নতুন ঘাস গজিয়েছে। শহিদের রক্তের দাগ ঢেকে দিয়েছে নতুন মাটি ও দূর্বাঘাসে।

অনেকক্ষণ ঘুরে শাহ আলম সহযোদ্ধাকে হারাবার জায়গাটা ঠিক চিনতে পারে। ওই তো আকাশমুখী সেই দেবদারু গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চিত হয় - ওই তো, ওখানেই তো ঢলে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদ। 

না, সেই বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেনি। বরং গাছটার নিচে, দেখা গেল, নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে দুটি নেড়ে কুকুর - কড়কড় শব্দে হাড্ডি ভাঙছিল তারা। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম এ দৃশ্য মেনে নিতে পারে না। ঘামে শরীর ভিজে ওঠে - এ হয় না, এ হতে পারে না!

ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। বললেন, কোথায় রে বাবা - কোন জায়গাটায়? একটু থেমে আবারও বলেন, বেশি দেরি হবে না বাবা, এক মুঠ মাটি নিয়েই চলে যাব আমি, কেবল এক মুঠ মাটি। 
মা, একটু অপেক্ষা করুন। 

বলেই শিউলির চোখের দিকে তাকায় শাহ আলম। শিউলি বুঝতে পারে তার ভাইয়ের বন্ধুর চোয়ালগুলো টানটান হয়ে উঠছে। চোখ দুটি সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। সে দু হাতে মাকে জাপটে ধরে। 

তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হাতে দুটি ইটের টুকরো তুলে নেয় শাহ আলম। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ইট দুটিকে কুকুরগুলোর দিকে ছুড়ে মারে। ঘেউ ঘেউ শব্দে কুকুরগুলো স্থান ত্যাগ করতেই পরিবেশটা হালকা হয়। শাহ আলমের কাছে যেন আজ আবারও একাত্তর।

এরপর সহযোদ্ধার মায়ের কাছে এগিয়ে যায় শাহ আলম। বলে, মা, এবার আপনি আসুন। ওই তো সেই জায়গা, সেই পবিত্র জায়গা।

হো হো করে কেঁদে ওঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শহিদ জননী। মাটি খাবলে কিছু মাটি-ধুলোবালি হাতে নিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে রাখেন তিনি। শিউলির চোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলে - চল, আমরা দুজনেই মাকে সাহায্য করি। 

ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

সন্ধ্যার নির্জনতায় আমি যখন বা‌ড়ি ফির‌ছিলাম 
‌বিপণি‌বিতা‌নের মৃদু আলোয় চারপা‌শের মানুষ ও
যানবাহ‌নের ধূসরতা রহস্যময় হ‌য়ে আব‌র্তিত হ‌তে
থা‌কে। মানু‌ষের স্বভাবজাত ইতিহাস বড় বেদনার 
বড় বিষা‌দের। ক্রমশ অদৃশ্য হ‌তে থা‌কে সম্প‌র্কের
অমল বিন্যাস। আজকাল মানুষের সা‌থে মানু‌ষের
দূরত্ব বৃ‌ষ্টির জ‌লের ম‌তো গ‌ড়ি‌য়ে গ‌ড়িয়ে যায়।
জ্ঞানীরা নির্ঘণ্ট ছুঁয়ে গ্র‌ন্থের আয়ুষ্কাল ‌নির্ণয় ক‌রে
ফু‌লের সৌগ‌ন্ধের সা‌থে স্মৃ‌তির দর্প‌ণে ভা‌সে 
‌নিরব‌ধিকাল। সূচক ধ‌রে ধ‌রে যে মান‌চিত্র গি‌লে
খায় সে দেশ‌দ্রোহী।

এই পতাকা গর্বিত আজ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
এই পতাকা গর্বিত আজ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আবহমান এই বাংলা
প্রকৃতির অবদান
ঝিরিঝিরি বাতাস শোনায়
শান্তির শুভ গান-

হাওয়ায় হাওয়ায়
আসা-যাওয়ায়
মেঘের নানা খেলা
বৃষ্টি এলে রিমঝিম ঝিম
সকাল-সন্ধ্যা বেলা
জীবন জয়ের মেলা-

স্বপ্নের এই দেশ
কৃষক-শ্রমিক-জেলে-তাঁতির
মুগ্ধতার আবেশ
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা
সোনার বাংলাদেশ-

মাঠে-ঘাটে সময় কাটে
পাখির গানে গানে
এই বাঙালি বিশ্বে অমর
মহৎ অবদানে
এই পতাকা গর্বিত আজ
কীর্তি ও সম্মানে।