
সারা রাত হেঁটে ভোরবেলা ১৫ জনের একটি প্রশিক্ষিত দল নিয়ে মধুপুর ক্যাম্পে এসে পৌঁছে কমান্ডার ফজলু। ক্যাম্প বলতে ভাঙাচোরা একটি স্কুলঘর। মধুপুর গ্রামেরই একজন সাথিযোদ্ধা পথ চেনাতে সাহায্য করেছে তাদের। টর্চের আলো ফেলে রুমগুলো দেখে নেয় যোদ্ধারা। তিনটি রুম পরিষ্কার করে সেখানেই অস্ত্রশস্ত্র রেখে যে যার মতো বসে পড়ে। ক্লান্তি এসে ভর করে শরীরে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে যায় মাটির বিছানায়। পূর্ব দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে নবারুণের উঁকিঝুঁকি প্রকৃতিকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। পাখিরা কলরব করছে। সেদিকে কান পাতে যোদ্ধা মতিন শাহ। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে মতিন শাহ গেয়ে ওঠে- ‘রাত পোহালে পাখি বলে দেরে খ্য়া দেরে খায়...। ক্ষুধায় কাতর মতিন শাহের দরদি কণ্ঠের গানে জেগে ওঠে কেউ কেউ। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়েছে কারও পেটে একটি দানাও পড়েনি। কাতর হয়ে পড়েছে যোদ্ধারা। কমান্ডার ফজলুর প্রথম কাজ সহযোদ্ধাদের খাবার ব্যবস্থা করা।
ইতোমধ্যে ক্যাম্পে এসে যোগ দিয়েছে মধুপুরের মোতালেব। তাদের অনেক সহায়-সম্পদ। কুষ্টিয়া কলেজে যাতায়াতের সুবাদে কমান্ডার ফজলুর সঙ্গে তার পরিচয়। মোতালেবকে পেয়ে ফজলু যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেল। কমান্ডার ফজলু মোতালেবকে বলল- মোতালেব, যা তোমার বাসায় জোটে তাই দিয়ে আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করতে পারবে?
-অবশ্যই পারব। এক শ বার পারব। তোমরা বিশ্রাম কর, আমি খাবার রান্না করে নিয়ে আসছি।
-এখানে মানে এই গাঁয়ের আশপাশে কোনো সমস্যা আছে?
-তেমন একটা সমস্যা নেই। দু-চার মাইল পর পর কয়েকটি ক্যাম্প গড়ে উঠেছে।
-খুব ভালো কথা। ফজলু সঙ্গীদের বলল, তোমরা বিশ্রাম কর, আমি এলাকাটা ঘুরে দেখে আসি। আর শোনো, সাদেক আর সোবহান ক্যাম্প পাহারায় থাকবে। সতর্ক দৃষ্টি রেখো। মোতালেব চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
স্কুলের খেলার মাঠ পেরিয়ে ওরা জিকে ক্যানেলের কাঁচা রাস্তায় উঠে এল। একটু এগিয়ে গিয়ে কালীগঙ্গা নদী। নদীতে পানি আছে স্রোত নেই। নদীর পাশে ছোট্ট একটা বাজার। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে বাজার বসে। বাজারে কয়েকটি টোল ঘরের দেখা মেলে। বাজারের পাশেই মোতালেবদের বাড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে ফজলু জিজ্ঞেস করল, এখানে কি শত্রুসেনাদের কোনো দোসর আছে?
-শান্তি কমিটির সদস্য আছে। আমাদের বন্ধু রমিজ মুন্সি ওই দলের সদস্য।
-তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে?
-কেন পারব না। ও তো আমাদেরই লোক।
-কী করে বুঝলে?
আমি কিছুদিন বংশীতলা ক্যাম্পে ট্রেনিং করেছি। সেসব খবর সে জানে। তার পরও অনেক খোঁজখবর সে আমাকে দেয়। তারও ইচ্ছে ছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে কিন্তু বাবার জন্য পারেনি।
-তাই
কথা শেষ হয় না।
বাড়ির পথে নেমে প্রথমেই মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। সালাম দিল ফজলু। মা সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল। মোতালেব মাকে বলল, মা ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা খাবে, খুব তাড়াতড়ি খিচুরি রান্না করে দাও। ওরা সারা রাত কিছুই খায়নি।
মা হন্তদন্ত হয়ে বলল, তোরা ঘরে গিয়ে বয়, আমি সব জুগার করতিছি।
মা দ্রুত ঘরে গিয়ে মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু ও গুড় এনে ওদের সামনে দিল। ফজলু খাবারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মোতালেব বলল- খাও
সঙ্গীদের রেখে কী করে খাই বলো?
দুজনের কথা শেষ হতে না হতেই মা বড় একটা ধামা ভরে মুড়ি আর গুড় এনে মোতালেবের হাতে দিয়ে বলল, যা শিগগির ওদের দিয়ে আয়।
মোতালেব ধামা মাথায় করে দ্রুত পা ফেলে ক্যাম্পে পৌঁছাল। একজন যোদ্ধার হাতে দিয়ে বলল, তোমরা সবাই নাশতা করো। সাতসকালে মুড়ির ধামা দেখে যোদ্ধারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মোতালেবের দিকে। মোতালেব বলল, তোমরা খাও ফজলুকে একা রেখে এসেছি।
মোতালেব ফিরে আসে বাড়িতে। ফজলুর মুখোমুখি বসে। ফজলু জিজ্ঞেস করে, এ অঞ্চলের সামগ্রিক খবর কি বলতে পাববে?
-এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অনেক শক্ত ঘঁটি আছে। পূর্বাঞ্চলে শান্তি কমিটির খেলাফত বাহিনীর উৎপাত দেখা যাচ্ছে। তাদের আহ্বানে মাঝে মাঝেই শত্রুসেনারা হানা দিচ্ছে বিভিন্ন গাঁয়ে।
শত্রুসেনাদের তৈরি বড় কোনো বাহিনী নেই তাহলে?
আছে। অনেক দূরে গণেশপুরে। এখান থেকে মাইল বিশেক হবে।
ফজলু এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে চলে যায়।
-তুমি কি এখনো পল্লিগীতি গান গাও?
-ওই একটু-আধটু।
-লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছ?
-করতে পারলাম কই
মোতালেব পাল্টা প্রশ্ন করে, তুমি কী করছিলে এতদিন?
এলএলবি শেষ করে কেবলই আইন পেশায় শিক্ষানবিশকাল চলছিল। তার পর তো শুরু হয়ে গেল জনযুদ্ধ।
বিয়ে-থা করেছ?
বিয়ে করব ভাবছিলাম, এর মধ্যে কী আর সেসব ভাবনা থাকে। কপালে থাকলে হবে-
আমাদের গ্রামে দুজন সোমত্ত মেয়ে আছে। তারা মধুপুর স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। তাদের একজনের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে। একজন আছে। দেখতে ভারী সুন্দরী। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। তার ওপর নজর পড়েছে শত্রুসেনাদের। যে কোনোদিন মেয়েটির পরিবারের ওপর আক্রমণ হতে পারে, এমন আতঙ্কে আমরা ছিলাম। কিন্তু তোমরা এ গাঁয়ে ক্যাম্প করায় সেটা মনে হয় আর সম্ভব হবে না।
মা এসে ওদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মা বললেন, খাবার তৈরি হয়েছে, এবার নিয়ে যেতে পার। ফজলু খেয়াল করে দেখল মায়ের মুখটা ঘামে ভিজে গেছে। সে বলল, অনেক কষ্ট দিলাম খালামণি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
মা নরম কণ্ঠে বললেন, তুমরা আমার মুতালেবের মতো। মুতালেব খাবি তুমরা খাবা না, তা তো হতি পারে না। আমি যেমন মুতালেবের মা, মনে করবা আজকেরতেন তুমাদেরও মা। মুতালেব খায়া থাকলি তুমরাও খাবার পাবা।
মায়ের এমন দায় ও দরদের কথা শুনে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল ফজলুর।
মোতালেব আরও দুজনকে ডেকে ক্যাম্পে খাবার নিয়ে হাজির হলো। স্কুলের পাশেই জলাশয়। যোদ্ধারা সেখানে গিয়ে গোসল সেরে নিল। ফজলুও গোসল করল। তার পর গ্রুপ করে খেয়ে নিল সবাই।
বিকেলে গ্রামবাসী হাজির হলো ক্যাম্পে। তরা সবাই যোদ্ধাদের সাহায্য করতে চায়। কে কোনদিন খবার দেবে তার একটা তালিকাও করে ফেলে। গ্রামের মানুষের এমন সরল ভালোবাসা দেখে যোদ্ধরা আপ্লুত হয়। কোনো কষ্টই আর কষ্ট মনে হয় না।
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে জুন-জুলাই শেষ হয়েছে। তীব্র হয়ে উঠেছে শত্রুসেনাদের আক্রমণ। ভয়ে মধুপুরের মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে ক্যাম্পে অবস্থান করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই অপারেশনে যেতে হয় যোদ্ধাদের। সে সময় ক্যাম্পে মায়ের সঙ্গে থাকতে হয় মেয়েটিকে। একটা অরক্ষিত অবস্থা। মেটির মা বসে বসে চোখের জল ফেলে আর ভাবে। সোমত্ত মেয়ে। কোথায় যাব, কী করব, কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছি না। মোতালেব ক্যাম্পে আসে। মোতালেবকে দেখে ভাবনার তাল কেটে গেল মেয়েটির মায়ের। ওদিকে মেয়েটিকে ক্যাম্পে একা রেখে ফজলুও মনে শান্তি পায় না। মনটা কেবলই আইটাই করে। ভাবে, কোথায় রাখা যায় মেয়েটিকে?
দিন যায় রাত আসে। রমিজ মুনশি এসে খবর দিয়ে গেল মধুপুর ক্যাম্প আক্রমণ করবে শত্রুসেনারা। এই প্রথম পরিচয় হলো রমিজ মুনশির সঙ্গে। ফজলুর মনে হলো বেচারা সঠিক ইনফরমার। তার পর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ হয় রমিজ মুনশির সঙ্গে। সে অনেকবার শত্রুদের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় মধুপুর ক্যাম্পটিকে।
এখন রাত। কত রাত হবে! ক্যাম্পের কমান্ডারের রুমে হঠাৎই প্রবেশ করে ক্যাম্পে অবস্থান করা মেয়েটি।
-তুমি! মেয়েটিকে একা রুমের মধ্যে দেখে ফজলুর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
-হ্যাঁ আমি
-তোমার নাম কী?
-মনোয়ারা। তবে সবাই আরা বলেই ডাকে।
-তা এখানে এলে কেন?
-আমি আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাই। যদি না নেন তবে এখানেই মরে পড়ে থকব।
-আচ্ছা এখন যাও। কেউ দেখলে বাজে কিছু ভাবতে পারে। আগামীকাল তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।
মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আরা।
সকালবেলা ফজলু মোতালেবের কাছে রাতের ঘটনা বললে, মোতালেব বেশ সাহসের সঙ্গেই বলল, কমান্ডার আরাকে তুমি জীবনসঙ্গী করে নাও। ও ভীষণ ভালো মেয়ে। রূপে-গুণে, বুদ্ধিতে সেরা একটি মেয়ে। দশ গ্রাম খুঁজলেও এমন একটি নম্রভদ্র, বিনয়ী মেয়ে পাবে না।
-তুমি আমাকে দুর্বল করে ফেলছ মোতালেব। যোদ্ধাকে দুর্বল হলে চলে!
হন্তদন্ত হয়ে রমিজ এল ক্যাম্পে। সে কোনো মতে বলল, বংশীতলা আক্রমণ করেছে শত্রুসেনারা এবার মধুপুর ক্যাম্প উড়ি দেবে ওরা।
এবার আর আরাকে একা ছেড়ে দিল না কমান্ডার ফজলু। দ্রুত অস্ত্র চালনা শিখিয়ে দিল সে। যে পথ দিয়ে শত্রুসেনারা আসবে সে পথে ওত পেতে বসে রইল যোদ্ধারা। নিজে স্টেনগানসহ আরার হাতে যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে কমান্ডারও পজিশনে চলে গেল।
প্রচণ্ড বাতাসে আরার লাল-সবুজ ওড়না উড়ে যাচ্ছিল। এবার সে শক্ত করে মাজার সঙ্গে বেঁধে নিল ওড়নাটা।