
‘তহুরা মঞ্জিল’ উপন্যাসটি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে রৌদ্রছায়া প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসটির লেখক বেবী নাজ করিম, তিনি ময়মনসিংহের শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। এই সময়টায় তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন, লেখিকার পরম আরাধ্যের বিষয় হচ্ছে সৃজনশীলতার চরিত্রায়ন। এ কাজটিই তিনি পরম মমতায় করে যাচ্ছেন নিরবধি। ইতোমধ্যে তার তিনটি গল্পগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এবং ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘তহুরা মঞ্জিল’ লেখিকার দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটিতে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য এবং বাংলার সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনকে গল্পের কাঠামোয় তুলে ধরা হয়েছে, যা পাঠককে গভীর জীবনবোধের পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটাবে। একজন লেখকের মূল কাজই হচ্ছে পাঠককে নতুন বিষয়ের সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কাজে-কর্মে সৃজনশীল আচরণের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে ভূমিকা রাখা।
গ্রন্থ সমালোচকরা বিভিন্নভাবে একটি প্রবন্ধ কিংবা উপন্যাসের খুঁটিনাটি তুলে ধরে থাকেন। যে সমালোচনায় গ্রন্থটির গ্রহণযোগ্যতা ও উপজীব্যতা তুলে ধরার পাশাপাশি গ্রন্থটির সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হয়। সমালোচনার কাজটি অত্যন্ত জটিল এবং গভীর ভাবাবেগের বিষয়, এ বিষয়ে অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারী না হলেও ‘তহুরা মঞ্জিল’ উপন্যাসটি পড়ার পর মনে হয়েছে উপন্যাসটি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। উপন্যাসটি নতুন প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে। কেননা, যেসব গল্প শুনে বাংলার ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবগত হয় তার একটি উত্তম সংযোজন হতে পারে ‘তহুরা মঞ্জিল’ উপন্যাসটি। পাশাপাশি গ্রাম-বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে; স্মৃতিময় জীবনের স্বাদকে দীর্ঘায়িত করতে গ্রামীণ অববাহিকার একজন রমণীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হতে পারে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মানুষের জীবনবোধ ও অস্তিত্বের মিশেলেও তহুরা মঞ্জিল উপন্যাসটি নতুন প্রজন্মের নিকট একটি দীক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাবে নিঃসন্দেহে। নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ ও প্রতিপালনের গুরুত্বের ব্যাপারে আলোচ্য উপন্যাসটি একটি বিশেষ বার্তা প্রদান করে। পাশাপাশি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বাধা-বিপত্তিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে বিশদ অনুধাবন করা সহজতর হবে। কাজেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘নীরু’র চরিত্রটি একটি কালজয়ী চরিত্র, চরিত্রটির ব্যাপকতা অসীম ও জীবনবোধের এক বিশাল সমীরুহ।
একজন লেখকের স্বার্থকতা তখনই প্রকাশ পায় যখন তিনি তার লেখনির শক্তি দিয়ে পাঠককে গল্পের মধ্যে ধরে রাখতে পারেন। এ উপন্যাসে প্রতিটি ধাপ পাঠককে পরের ধাপের জন্য নিবিষ্ট করে তোলে। পাঠককে গভীর জীবনবোধের কল্পনায় নিয়ে যেতে অন্তর্নিহিত আবহে নিমজ্জিত করে। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নীরু। নীরুকে উপজীব্য করেই গল্পটি সামনে এগিয়েছে। বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্য এক সুমহান ইতিহাসের সংযোজন আলোচ্য চরিত্রটি। শত কষ্ট, ত্যাগ এবং সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যে অনেকেই তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে থাকে। নীরু ঠিক তেমনই একটি উজ্জ্বল চরিত্র। বৈষম্য, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েও ইট-কাঠের একটি বাড়িকে নিয়ে স্মৃতি হাতড়িয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। এই বাড়িকে ঘিরে অনেক চক্রান্ত হয়েছে, কেউ বিক্রি করে দিতে চেয়েছে কিংবা কেউ ভেঙে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু নীরুর দৃঢ়তায় এটি সম্ভব হয়নি, তিনি পরম মমতায় তার স্মৃতিময় বাড়িটিকে ধরে রাখতে চেয়েছেন। নীরু চরিত্রটি নিশ্চয়ই একটি বিশেষ বার্তা প্রদান করবে। প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে ধৈর্য ও সততার সম্মিলনে মায়াময় আবহের সৃষ্টি হয়েছে উপন্যাসজুড়ে। পাঠককূল নিশ্চয়ই নীরুর চরিত্রের মাঝে নিজের মা, দাদি, নানি এবং পূর্বপুরুষদের জীবনকে খুঁজে ফেরার তাড়না বোধ করবে।
সর্বোপরি বাঙালি নারীর চরিত্রকে পরম মমতায় লেখক তুলে ধরেছেন নীরুর চরিত্রায়নের মধ্য দিয়ে। নারীর চরিত্রের দৃঢ়তা ও সম্মোহনী শক্তির গভীরতাকে তুলে আনা হয়েছে উপন্যাসটিতে। নীরুর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের মনঃস্তাত্ত্বিক ও পারিবারিক দূরত্বের চিত্রও উঠে এসেছে গল্পে। নিজস্বতা ও সমৃদ্ধির স্মারককে ধরে রাখতে পরিবারের সদস্যদের আস্ফালনের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের চিত্র নীরুর চরিত্রকে আরও উজ্জ্বল করেছে। গল্পে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের গুরুত্বহীন অবস্থাকেও লেখিকা শক্তিশালীভাবে তুলে ধরেছেন। যার কারণে নারীর স্বনির্ভরতা ও ক্ষমতায়নকে পরিবারে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করা উচিত। এ গল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব। নতুন পরিবারে আসা একটি মেয়েকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মর্যাদার জায়গা করে দেওয়ার মানসিকতার বিকাশ আজও ম্রিয়মাণ। এ ব্যাপারে শিক্ষা ও জীবনবোধের দীক্ষা গ্রহণ করতে হবে উপন্যাসের চরিত্রায়ন থেকে।
একজন লেখকের স্বার্থকতা হচ্ছে পাঠককে সম্পূর্ণ আলাপচারিতায় কার্যকরভাবে ধরে রাখা। এর পাশাপাশি পাঠকের মন ও মননে বিশেষ বার্তা প্রদানের মাধ্যমে জীবনবোধের সংশোধন, পরিবর্তন ও সংযোজনের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া। সংশ্লিষ্ট শর্ত বিবেচনায় ‘তহুরা মঞ্জিল’ উপন্যাসটি সময়ের প্রয়োজনে একটি অনন্য সংযোজন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। কেননা, বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্পর্কের ধারণার পাশাপাশি ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার কলাকৌশলের ফিরিস্তির এক অমূল্য সংযোজন এ উপন্যাসে রয়েছে। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার সুমহান শিক্ষা ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়ার উপযোজনও রয়েছে উপন্যাসটিতে। এ ছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অভিযোজন ও সভ্যতার বিকাশমান ধারার চর্চার ফলে শক্তিশালী বার্তার সংমিশ্রণই ‘তহুরা মঞ্জিল’ উপন্যাসটিকে একটি স্বার্থক উপন্যাসের স্বীকৃতি দেবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]