
বিষাদ বসুধা
লেখক
মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ
নিয়াজ চৌধুরী তুলি
সময় প্রকাশন
প্রকাশকাল
ফেব্রুয়ারি বইমেলা
২০২৫
বিশ্বযুদ্ধের পর গত এক শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্তকর ঘটনা কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব। সংক্ষেপে আমরা যাকে করোনাভাইরাস বলি। এই করোনার প্রভাব ছিল যেমন বহুমুখী, তেমনি সর্বব্যাপী। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক থেকে শুরু করে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ-কাঠামো এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এর ধ্বংসের ছোঁয়া লাগেনি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এত বড় একটা ঘটনার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক-বয়ান সৃষ্টি হয়নি। যেমনটি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে। করোনা নিয়ে যা কিছু হয়েছে তা নিছক বিচ্ছিন্ন কিছু গল্প-কবিতায় সীমাবদ্ধ। বড় ক্যানভাসে কোনো চলচ্চিত্রও চোখে পড়ে না। তবে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, সতর্কবাণী প্রচার করা হয়েছে, প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। যত যাই-ই হোক না কেন সাহিত্যিক-ন্যারেটিভের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবেদনের বর্ণনা আর ঘটনার ভেতর দিয়ে যাত্রা করা চরিত্রের পরিবেদনা কখনো একরকম হবে না। বিগত সময়ের হাজারো ইতিহাস বোঝার জন্য আমরা এখনো সাহিত্যের দ্বারস্থ হই। ফিকশন হয়ে ওঠে ঘটনার মানবিক দিক খোঁজার বড় একটা উৎস। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল ঠিক এই জায়গা বেছে নিয়েছেন করোনা ভাইরাসের বিপর্যস্তকর ন্যারেটিভ নির্মাণে। বিষাদ বসুধা নামীয় উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে তার শিল্পীত ক্ষেত্র।
একটি অদৃশ্য উপাদান কীভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলে দিল, সমাজ ও রাষ্ট্রের কত কী তছনছ করল, আলোড়িত করল, বিপর্যস্ত করল- সেই অভিঘাতের সাহিত্যিক-উৎস হয়ে উঠেছে বিষাদ বসুধা।
সংবাদ বা প্রতিবেদন তো পেশাগত ব্যাপার। সাহিত্য কিন্তু অন্যকিছু। সেখানে যা উঠে আসে তা সংবাদ বা প্রতিবেদন থেকে অন্যতর সৃজনশীল কিছু। কেউ পেশাগত দায় থেকে এ কাজ করেন না। করেন শিল্পের দায় থেকে। এ দায়ের জন্য কেউ কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় না। একজন সংবেদনশীল সৃজনমুখর লেখকই স্বেচ্ছায় এই দায় নিজ কাঁধে তুলে নেন। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল এই কাজটিই করেছেন।
উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে মোহিনী ভালোবেসে বিয়ে করে সহপাঠী আরেফিনকে। যে মেধাবী হলেও গ্রামের হতদরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কেন জানি আরেফিনের সঙ্গে সংসারে সুর ওঠে না মোহিনীর। মোহিনী তার আচরণে কখনো উচ্চবিত্তীয় ভাবধারা প্রদর্শন না করলেও আরেফিনের ভেতরে এক ধরনের হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। এভাবে বিত্তীয় ব্যবধান তাদের ভেতরে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে আর মেধাভিত্তিক নিবেদনে একনিষ্ঠ হওয়ার জন্য চীনের উহানে কয়েক মাসের ট্রেনিংয়ের সুযোগ পায় আরেফিন। এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে মোহিনীর সঙ্গে চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয় আরেফিনের। মোহিনীর অমত সত্ত্বেও আরেফিন চলে যায় চীনে। একদিন খবর আসে সে মারা গেছে করোনাভাইরাসে। ততদিনে বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে মরণঘাতী এই ভাইরাস। এবং এর ফলে বদলে গেছে পুরো বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ও কাঠামো।
সংকটে না পড়লে আসল চিত্র ভেসে ওঠে না। বাংলাদেশেও তাই হলো। এতে কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের আসল চেহারা বের হয়ে এল। আরেফিন তো চলেই গেল না ফেরার দেশে। করোনাজনিত কারণে দুজনের বিচ্ছেদই শেষ কথা নয়। জীবন তো বহতা নদীর মতো। মোহিনীর জীবনও চলতে চলতে বাঁক ফেরে। সেই বাঁকে মোহিনীর সঙ্গে সন্নিবেশ ঘটল আরও অনেক চরিত্রের। অফিসে মোহিনীর কার্যক্রম দেখা গেল, অধীনস্ত কলিগদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জানা গেল, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু আসিফ আহমেদের আদর্শ ও কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল, কলেজে প্রেম নিবেদন করা শিল্পপতি বন্ধু শাহবাজ খান যিনি কি না আবার সম্পাদক বন্ধুর পত্রিকার মালিক- তার নীতি-নৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি সম্পর্কে জানা হলো এবং তা থেকে তার মুক্তির অপকৌশলও, জানা হলো শাহেদ করিমের মতো করোনা-ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। অবধারিতভাবেই উপন্যাসের ডালপালা মেলে গেল। ধীরে ধীরে বের হয়ে এল কিছু মানুষের মহৎ বৈশিষ্ট্য আর কিছু মানুষের দানবিক দিক।
করোনার অভিঘাতে সামাজিক আচারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদনেও ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। বন্ধ হয়ে গেল উৎপাদন। এই অভিঘাতের ক্ষতি পুষতে পুষতে পত্রিকার মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কর্মী ছাঁটাইয়ের। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে গেল সম্পাদক ও মালিকপক্ষের। সম্পাদক চান না কর্মী ছাঁটাই। মালিক পক্ষ অনড়। একপর্যায়ে সম্পাদক নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন।
অন্যদিকে মোহিনী কোনো কর্মী ছাঁটাই তো দূরের কথা যথাসাধ্য সাহায্য করতে থাকল গরির ও সীমিত আয়ের মানুষদের। এবং এটা নিয়ে তার ব্যবসায়ী বন্ধু শাহবাজ খানের সঙ্গে আদর্শিক দ্বন্দ্বও প্রকাশ্য হয়ে উঠল। যদিও তা প্রকটরূপ ধারণ করে সম্পর্কের ইতি ঘটাল না। যে যার মতো ভূমিকা রেখেও একদা প্রেমিক শাহবাজ খানের প্রেমসত্তার কাছে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকল মোহিনী।
সম্পাদক ও মালিকের যে দ্বন্দ্ব তা মানবিকতা বনাম দানবিকতার। এই দ্বন্দ্বে দানবিকতা আপাত জয়লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে জিতে যান সম্পাদক নিজে তার মানবিক আচরণ ও প্রতিবাদ সত্তার জন্য।
বিষাদ বসুধা এভাবে হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ সময়ের মানবিকতা বনাম দানবিকতার দ্বন্দ্বের শিল্পীত বয়ান।
বসুধা তো বসুধাই। বিষাদ ছুঁয়েছে তাকে। বসুধা যখন মোহিনীর প্রতীক- তাকেও ছুঁয়েছে। যখন আরেফিনের প্রতীক তখন তাকেও ছুঁয়েছে। বিষাদ ছুঁয়েছে সম্পাদক ও মালিকের মানবিকতা বনাম দানবিকতার দ্বন্দ্বকেও। একটি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন মোহিনী সেই পত্রিকার মালিক ও শিল্পপতির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার দিকে যায় তখনো কোথাও কোনো এক শুভসত্তায় বিষাদ ছুঁয়ে যায়। করোনার প্রভাব এভাবে বিষাদকে বিস্তৃত করতে করতে পুরো বসুধাকেই বিষাদাক্ত করে ফেলে।
উপন্যাসের শেষে জানা যায় প্রথম পর্ব সমাপ্ত। তার মানে পরবর্তী পর্বে জানা যাবে মোস্তফা কামাল-অঙ্কিত বহুমাত্রিক বিষাদের আরও নানারকম রূপ। সেই বিষাদ এই বসুধার আর কোথায় কোথায় স্পর্শ করবে তা জানার জন্য আমাদের অপার কৌতূহল। আপাতত অপেক্ষা।