
একজন সৈয়দ আলী আহসানের অনেক পরিচয়। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, নন্দনতাত্ত্বিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং প্রশাসক। বাংলাদেশে অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তিই বহুমাত্রিক প্রতিভায় ভাস্বর। তবে লক্ষ করলে দেখা যাবে তাদের নানা ধরনের পরিচয় ভেদ করে কোনো একটি পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। সৈয়দ আলী আহসানের সেসব ব্যক্তিত্বজনের মধ্যে অন্যতম যার কোনো একটি পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠেনি। তার সবগুলো পরিচয়ই মুখ্য। কারণ যতগুলো ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন সবগুলোর ক্ষেত্রেই তিনি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। সে অর্থে তিনি একজন প্রকৃত সব্যসাচী।
কবিতা দিয়ে তার শিল্পযাত্রার শুরু। আধুনিকতার যাত্রাকালের অল্পকিছু কাল পরেই এই শিল্পক্ষেত্রে তার পদচারণা। যে সংকট ও দ্বিধা তার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে ছিল তিনি অনায়াসেই তা এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। তার কবিমানস ওই যুগসন্ধিক্ষণকে খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিল। তার স্পষ্ট ছাপ আমরা লক্ষ করি ‘অনেক আকাশ’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। এরপর ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যে তার কাব্য প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে। এই কাব্যের প্রতিটি কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই কাব্যের অন্তর্গত ‘আমার পূর্ব- বাংলা’ সিরিজ কবিতাটি ধ্রুপদী কবিতার মর্যাদাপ্রাপ্ত। ‘আমার পূর্ব-বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ/ অন্ধকারের তমাল/ অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/ একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ/ সন্ধ্যার উন্মেষের মতো/ সরোবরের অতলের মতো/ কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো/ বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি/ আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ।’ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক, আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার যে মেলবন্ধন তারই শিল্পীত মনোসংযোগ এই কবিতা। বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে বাংলার মানুষের সম্পর্ককে তিনি এমনভাবে দেখিয়েছেন যেন তারা সহোদর এবং একই সঙ্গে তাদের বেড়ে ওঠা, বিকাশ ও মিথস্ক্রিয়া।
প্রাবন্ধিক হিসেবে যদি তার কর্মপ্রয়াসের দিকে তাকাই মনে হবে তিনি আসলে প্রাবন্ধিকই। তার আর অন্য কোনো পরিচয়ের দরকার নেই। তার কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮) এবং আধুনিক বাংলা কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০)সহ অন্যান্য প্রবন্ধের বইয়ে কবিতার ভাব-ভাষা-কাঠামো নিয়ে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা অতুলনীয়। একটি কবিতা কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে, এর ক্রাফটম্যানশিপে কী কী উপাদান অনিবার্য, কবিতায় শব্দের ব্যবহারের টেমপারমেন্ট কীরূপ তা এক অনন্য কুশলতায় তুলে ধরেছেন। তরুণ কবিরা এখনো বইগুলোকে তাদের কাব্য যাত্রা সুগম করতে অনিবার্য পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করে। কবিতায় শব্দের বিকাশ কীরূপে ঘটে, তার কালাকালভিত্তিক অর্থ কীরূপে পরিবর্তিত হয়- কবিতায় শব্দের অন্তর্গত স্বরূপ উদঘাটনে এই বিবেচনাগুলো খুব জরুরি। সৈয়দ আলী আহসান এসব বিষয়-আশয় শিল্পকুশলতায় উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষায়, ‘কবির ভাষা একটি স্বাক্ষরিত বিবেচনার ভাষা।’ তার বিশ্লেষণ ও স্বীয় কবিতায় তা প্রয়োগ যেন এই কথাটিই মনে করে দেয়।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ)সহ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ) আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৮২ সালে Approach নামে একটি ষাণ্মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার আগে তার সম্পাদনায় বের হয়ে পদ্মাবতী, মধুমালতী। ইকবালের কবিতাসহ অনুবাদ করেছেন ফরাসি প্রেমের কবিতা, জার্মানের সাহিত্য, রাজা ইডিপাস। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ইংরেজি অনুবাদও তার।
এগুলোর বাইরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছেন মহানবী। আমাদের বাঙালির মানস বিশ্লেষণ করে লিখেছেন ‘আমাদের আত্মপরিচয় ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।’ এ দেশের মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়ের যে সংকট আমরা সুদীর্ঘকাল অনুভব করে আসছি তার দ্বিধা ও সংকট মোচন করার জন্য লিখেছেন উক্ত গ্রন্থটি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল, সংকট ও উত্তরণের উপায় নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিল্পী ও শিল্পবোধ নামে লিখেছেন চিত্রকলাবিষয়ক বই। রবীন্দ্রনাথের ও মধুসূদনের কাব্য বিশ্লেষণ করে লিখেছেন বই। এমনকি তার লেখা গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে রান্নার বইও। জীবনের শিলান্যাস তার আত্মজীবনী। যেখানে তার সুদীর্ঘ জীবনের বহুবর্ণিল অবদানের কথা শিলাস্তরের মতো করে বিন্যাসিত। বাংলাদেশ নামক বর্তমান ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব প্রাপ্তির উন্মেষকাল থেকে শুরু করে এর জন্ম ও বিকাশের সুদীর্ঘকালের এক রাজসাক্ষী তিনি। আত্মজীবনীর প্রতি পরতে পরতে তা ওঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে ‘পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠন আন্দোলনসহ তিনি এ সময়ে টিএস এলিয়টের চিন্তাধারা এবং বাংলা পুঁথিসাহিত্য ও মুসলিম ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। এ সময় তিনি ‘চেনাকণ্ঠ’ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদ অলংকৃত করাসহ বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।
একজন মানুষ এক জীবনে এত কিছু সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে তা সৈয়দ আলী আহসানের কর্মময় জীবনের দিক না তাকালে বোঝা যায় না। যখন কবি হিসেবে তার দিকে তাকাই তাকে নিরঙ্কুশ কবিই মনে হয়। যখন অনুবাদক হিসেবে তার দিকে তাকাই তখন তাকে একজন নিরঙ্কুশ অনুবাদকই মনে হয়। এভাবে প্রাবন্ধিক হিসেবে, আধুনিকতার বিশ্লেষক হিসেবে, চিত্রকলার সমালোচক হিসেবে, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে, শিক্ষায়, জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও মানস বিশ্লেষণে, সাহিত্য আন্দোলনে কিংবা প্রশাসনে- আমরা যেভাবেই সৈয়দ আলী আহসানের কর্মময় জীবনের দিকে তাকাই না কেন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তার সাফল্য অতুলনীয়।