
বিরাট পৃথিবী। তার মাঝে মানুষজন দেখি। দেখি গাছপালা। নদী মেঘ পাহাড় আলো। কী এক অজানা ইশারায় আমাকে সবকিছু মনে করিয়ে দিতে গিয়েও পারছে না। সে সময়ের জন্য আমি এখনো তৈরি হয়ে উঠতে পারিনি। পুরোনো বইয়ের আলমারির খাঁজে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে সোনার গুঁড়ো পাই। পাই রুপোর গুঁড়ো। রূপের গুঁড়ো। মানুষের যে কত রূপ! কী বিস্ময়কর এই মানুষ। অবিরাম অনুসন্ধানেও দেখি- ভালোবাসারও নানা চেহারা। একটা বয়সে যে মন নিয়ে কেউ আমাকে ভালোবাসে, বেশি বয়সে পৌঁছে দেখি সে মন আর নেই। শরীরের পুরোনো ব্যথার স্মৃতিটুকু শুধু পড়ে আছে। ভালোবাসা আর নেই। তখন অনুসন্ধানে নামি, এমন কেন হয়?...
সময়ের দূরত্বে সাধারণ কথাই রূপকথা হয়ে যায়। জীবনে কেউ তো আর বিশিষ্ট হওয়ার জন্য গুছিয়ে ঘটনা ঘটায় না। বহতা নদীর মতোই জীবনটা নাচতে নাচতে ঢেউ তুলে কালের তীর ধরে কথা-কাহিনি ছড়াতে ছড়াতে বয়ে যায়। তার পর একদিন সব জীবনই মৃত্যুর মতো এক অনন্ত নিদ্রা বা মহাসাগরে গিয়ে পড়ে। সেই নিদ্রাসাগরই আমাদের জীবনের মোহনা। কিংবা এই মোহনা থেকেই অনন্ত জন্মের মহাজীবন। আমি এমন কেউ নই যে, আমার কথা বলতে গিয়ে এত গম্ভীর হয়ে যাব। দুঃখের ভেতরেও হাসির ঝিলিক আমার আগে চোখে পড়ে। গুরুগম্ভীরের অসঙ্গতি আমায় হাসায়।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫ মার্চ অবিভক্ত ভারতের খুলনা শহরে। খুলনা শহর, খুলনা জিলা স্কুল, ভৈরব-রূপসা নদী, খেয়াঘাট, শহরতলি তার শৈশবের বিচরণভূমি। পিতা মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতা কিরণবালা। দেশভাগের পর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতায় এসে কেসিস্ট্রি অনার্স নিয়ে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ছাত্ররাজনীতি করার অপরাধে বিতাড়িত হন কলেজে থেকে। কলেজ ছেড়ে ইস্পাত কারখানায় চাকরি করেন। চাকরি ছেড়ে ফের ভর্তি হন চারুচন্দ্র কলেজে। কিছুদিন মথুরানাথ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার পর যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শুরুর বর্ষে ভর্তি হন। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৮-১৯৭৬ সালে যোগ দেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। ১৯৭৭-১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিলেন ‘যুগান্তর’-এ। এই সময়ই দায়িত্ব পান সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ সম্পাদনার। তার পর ১৯৯০ থেকে আমৃত্যু ‘আজকাল’-এ। ‘বলরাম’ ছদ্মনামে লিখতেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘ভূমিলক্ষ্মী’র পাতায়। ‘বৈকুণ্ঠ পাঠক’ নামে সাপ্তাহিক ‘অমৃত’তে লিখতেন সাহিত্যের কলাম। তার প্রথম গল্প ‘চর’ (১৯৫৩) প্রকাশিত হয় ‘অগ্রণী’ পত্রিকায়। গল্প লিখেছেন আড়াই শ-এর অধিক। প্রথম উপন্যাস ‘বৃহন্নলা’ (১৯৬১), পরে ছাপা হয় ‘অর্জুনের অজ্ঞাতবাস’ নামে। প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় পঁচাত্তর। কিন্তু ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ প্রকাশিত হওয়ার পরই শ্যামলের লেখনী বাংলা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। ব্যক্তিজীবনে বোহেমিয়ান, সুরসিক ও আড্ডাবাজ ছিলেন তিনি।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই লিখেছেন, ‘নিজের জীবন, শরীর, সম্মান, অস্তিত্ব, নিরাপত্তা বারবার নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো বিপজ্জনক জুয়ায় তলিয়ে যেতে যেতে ভেসে উঠে ঢেউয়ের ফেনায় যেটুকু খড়কুটো ধরা যায়, সেটুকুই শিল্প। নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে যা জানা যায়, তা শুধুই জানা নয়, বোধও বটে। এই বোধকে আমি এভাবে বলি, যে চিন্তা ঘাম দিয়ে আয়না হয়, সে চিন্তার কোনো দাম নেই। ঘাম ঝড়িয়ে, নিজেকে ক্ষয় করে যে ভাবনাকে পাই, তাই হোক শিল্পের বিষয়। কথা তো বলছি বড় বড়, আমি কি নিজে সমসময় তা পেরেছি? জানি না। বিরাট বিশ্ব। কাল অনন্ত। তার মাঝে মানুষজন দেখি। দেখি গাছপালা। নদী মেঘ পাহাড় আলো। দেখতে দেখতে কোনো ব্যাপারকে মনে হয় বুঝিবা গত জন্মের। কী এক অজানা ইশারায় আমাকে সব মনে করিয়ে দিতে গিয়ে পারছে না। আবার কোনো জিনিস বা মনে হয় খুবই আগামীর। তার জন্য আমি এখনো তৈরি হয়ে উঠতে পারিনি। পুরোনো আসবাবের খাঁজে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে সোনার গুঁড়ো পাই। পাই রুপোর গুঁড়ো। রূপের গুঁড়ো। মানুষের যে কত রূপ! কী বিস্ময়কর এই মানুষ। অবিরাম অনুসন্ধানেও এ মানুষ ফুরোবার নয়। এ এক অনন্ত খনি। ভালোবাসারও নানা চেহারা। একটা বয়সে যে মন নিয়ে কাউকে ভালোবাসি, বেশি বয়সে পৌঁছে দেখি সে মন আর নেই। হাঁটুর পুরোনো ব্যথার স্মৃতিটুকু শুধু পড়ে আছে। ভালোবাসা আর নেই। তখন অনুসন্ধানে নামি, এমন কেন হলো?’...
বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো ভূমিকার অপেক্ষা রাখেন না। বিশেষত, গদ্যসাহিত্যে তার আসন স্বপ্রতিভায় দীপ্যমান। এ প্রসঙ্গে ভারতের বিশিষ্ট প্রকাশক সুধাংশু শেখর দে স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর একটি গদ্যরচনায় এক জায়গায় এরকমই লিখেছেন- পঞ্চাশ কি ষাট বছর পরেও কোনো লেখা পড়ে পাঠক যদি বই বন্ধ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে হবে সেই লেখা সার্থক।’
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে সাহিত্য আকামেদি পুরস্কার ‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসের জন্য। পেয়েছেন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, ভূয়ালকা, শিরামণি, মতিলাল, সর্বভারতীয় কথা পুরস্কার, গজেন্দ্রকুমার মিত্র স্মৃতি ও শরৎ স্মৃতি পুরস্কার। মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।