
দ্বাদশ পর্ব
মৌলভিরা আরও বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন সময় খোদাতায়ালা জিন জাতি পাঠিয়েছিলেন। তারা যখন সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে নানারকম পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল; তখন আল্লাহর তরফ থেকে গজব নাজিল হয়েছিল। তাতে জিন জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মানবজাতিও যখন আল্লাহকে ভুলে গিয়ে অতিমাত্রায় পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন আল্লাহতায়ালা নানা রকম বালামসিবত দুনিয়ায় প্রেরণ করে পাপীদের শাস্তি দেন। করোনাও আল্লাহতায়ালা মানুষকে শাস্তির উদ্দেশে পাঠিয়েছেন।
কোনো কোনো মৌলভি অবশ্য এরকমও বলছেন, করোনা বিধর্মীদের ওপর এক মহাবিপদস্বরূপ। তারা যেহেতু আল্লাহ-খোদা মানে না; তাই তাদের ওপর গজব নাজিল হয়েছে। প্রকৃত মুসলমানরা তেমন ক্ষতির শিকার হবে না। আর কথায় আছে না; বালা আসলে যেহেতু পীরের গায়েও লাগে। তাই একটুআধটু ক্ষতি তো হতেই পারে!
সরকার যতই আদেশ করুক আর নির্দেশনা জারি করুক তাতে মানুষের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ সরকারের আদেশ-নির্দেশ মানছে না। কেউ সরকারের কথা শুনছে না। সবাই যেন নিজেই নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে আছে। সরকারের নির্দেশনা তারা এক কান দিয়ে ঢোকাচ্ছে আর এক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। মাস্ক পরা, ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাস্ক ব্যবহার না করার কারণে পুলিশ লাঠিপেটা, জরিমানাসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি। পেটের ক্ষুধা কি আর লকডাউন মানে!
একবার এক বাস কন্ডাকটর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতাবাজি শুরু করল। সে চিৎকার দিয়ে বলতে শুরু করল, আমরা লকডাউন মানি না! করোনার চেয়ে আমরা লকডাউনকে বেশি ভয় পাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আপনি লকডাউন তুলে নিন। আমাদের পেটে লাথি দেবেন না। সেই অধিকারও আপনার নেই। প্রতিদিন কাজ না করলে আমাদের পেটে ভাত জোটে না। লকডাউন দিলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়। বাচ্চার দুধের পয়সা জোটে না।
১০
টাকা হলে নাকি কোনো কোনো মানুষের নানা রকম বদ-অভ্যাস তৈরি হয়। মদ-নারীতে আসক্তি বাড়ে। প্রশংসা করার জন্য লোক রাখা হয়। তাদের কোনো দাপ্তরিক কাজ করতে হয় না। শুধু বসের মন জুগিয়ে চলতে হয়। বসের সব কাজে হ্যাঁ বলতে হয়। বসের সঙ্গে কথা বলার সময় হাত কসলাতে হয়; আর মাথা ঝাকাতে হয়। এসব লোকের নিজের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। এদের ডিকশনারিতে মেরুদণ্ড বলেও কোনো শব্দ নেই। এরা সব সময় বসের দিকে মাথা ঝুকিয়ে রাখে। বস যা বলে তাই এরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই। বস যা বলেন তাতেই এরা সায় দেয়।
শাহবাজ খানের যে টাকা-পয়সা হয়েছে তা দুই হাতে ওড়ালেও তার এক জীবনে তিনি শেষ করতে পারবেন না। আর ব্যবসাপাতি যেভাবে চলছে; এভাবে চললেও দু-তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে। তাই ব্যবসাপাতির ভাবনা আপাতত ক্ষান্ত দিতে চান শাহবাজ খান। তিনি এখন শুধু মৌজ করবেন। তার সঙ্গে কিছু তোষামোদকারী থাকবে। তারা সব সময় তার সব কাজের প্রশংসা করবে। জি হুজুর জি হুজুর বলে মুখে ফেনা তুলবে।
শাহবাজ খান মনে মনে ভাবলেন, তোষামোদকারীর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়! দেশে তো তোষামোদকারীর কোনো অভাব নেই। তার মধ্য থেকে অভিজ্ঞ দুজনকে বাছাই করে নেওয়া যাবে। তারাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় তোষামোদকারী। যেই কথা সেই কাজ! শাহবাজ খান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ভাষাটা ছিল এ রকম, দেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য জরুরিভিত্তিতে দুজন অভিজ্ঞ তেলবাজ নিয়োগ করা হবে। তোষামোদী-তেলবাজিতে কমপক্ষে দশ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বেতন আলোচনাসাপেক্ষে। আগ্রহীরা আগামী সাত দিনের মধ্যে আবেদন করতে পারেন। জিপিও পোস্টবক্স নম্বর ১১১।
এক সপ্তাহের মধ্যে পোস্টবক্সে কয়েক হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ল। তার মধ্য থেকে বাছাই করে ১০০ জনকে ডাকা হলো সাক্ষাৎকারের জন্য। শাহবাজ খান নিজেই সাক্ষাৎকার নিলেন। কে কী রকম তেলবাজি করতে পারে তা তিনি নিজেই দেখলেন। তোষামোদের নানা ধরন দেখে তিনি নিজেও হাসলেন। যা হোক, ১০০ জনের মধ্য থেকে দুজনকে তার ভারী পছন্দ হলো। একজনের নাম তৈল মিলন, আরেকজনের নাম তেলবাজ তুষার।
তৈল মিলন তেলবাজিতে ওস্তাদ লোক। তেলবাজি তার নেশা এবং পেশা। এ ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই তার। তেলবাজির কারণেই তার আসল নাম ঢাকা পড়েছে। সে নিজেও বাপ-মায়ের দেওয়া নাম ভুলে গেছে। তৈল মিলনেই সে সাড়া দেয়। অবশ্য তৈল মিলন ছাড়া এখন আর কেউ তাকে চেনেও না। শুরুতে তার বন্ধুরা তাকে তৈল মিলন নামে ডাকা শুরু করে। তার পর তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তৈল মিলন যে সত্যি সত্যিই বড় তেলবাজ তা তার কাজেকর্মেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তেলবাজি করে সে অল্পদিনেই তার বসের মনজয় করে ফেলে। তার সঙ্গে আছে তেলবাজ তুষার। অবশ্য আগে তার নাম ছিল আ-নূর তুষার। তেলবাজির কারণে তার নামও পাল্টে গেছে। তারা দুজনেই শাহবাজ খানের ডানে বাঁয়ে কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছে। তাদের কথার বাইরে এখন আর এক চুলও নড়েন না শাহবাজ খান। তার অফিসের অন্য পুরনো কর্মকর্তারা এখন কোণঠাসা। তারা কাছেই ভিড়তে পারছেন না। দুই তেলবাজের যন্ত্রণায় অফিসের সবাই বিরক্ত। কিন্তু কিছুই করার নেই। তেলবাজরা শুধুই তেলবাজি করছে না। তারা শাহবাজ খানের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী মেয়েও সাপ্লাই দিচ্ছে। এটা অফিসের কেউ কেউ দেখে ফেলেছেন। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
শাহবাজ খান বনানীতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে তিনি রঙ্গশালা বানিয়েছেন। সেই রঙ্গশালায় তিনি সুন্দরী নারীদের নিয়ে রঙ-তামাশা করেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি রঙ্গশালায় ঢোকেন আর রোববার সকালে সেখান থেকে বের হন। টানা তিন রাত তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তার সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ কেউ পান না। শুধুমাত্র তৈল মিলন আর তেলবাজ তুষার তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের আলাদা নম্বর আছে। সেই নম্বর দুই তেলবাজ ছাড়া আর কেউ জানেও না।
একদিন পারিবারিক কোনো একটা কাজের প্রয়োজনে বৈরাম খান ছেলের মোবাইলে ফোন করলেন। কিন্তু ফোনে শাহবাজ খানকে পাওয়া গেল না। তার ফোন বন্ধ। কারও ফোন বন্ধ পেলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। কিন্তু আজ অদ্ভুত কারণে তিনি ধৈর্য হারাননি। মোবাইলে না পেয়ে তিনি ছেলের বাসার নম্বরে ফোন করলেন। অনেকবার রিং বাজার পর বাসার অপারেটর ফোন ধরল। সে হ্যালো বলতেই টেলিফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একটা ভরাট কণ্ঠ ভেসে এল তার কানে। বৈরাম খানের কণ্ঠস্বর তার চেনা। অপারেটর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্যার! স্যার!
তোমার স্যার কোথায়? বলে গর্জে উঠলেন বৈরাম খান। তার গর্জন শুনে থরথর করে কেঁপে উঠল অপারেটর। স্যার স্যার করে সে এবার দাঁড়িয়ে গেল। তার হাত-পা কাঁপছে। সে জানে, কথার এদিক-সেদিক হলেই তার চাকরি নট। কোন কথা জিজ্ঞেস করবেন আর সে কী জবাব দেবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে সে। এর মধ্যেই বৈরম খান আবার গর্জে উঠলেন। শাহবাজ কোথায়?
কাঁপতে কাঁপতে অপরেটরের হাত থেকে টেলিফোন রিসিভার পরে যাওয়ার দশা হলো। সে কোনোমতে কানের কাছে রিসিভারটা চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্যা র! স্যা র.. স্যার.. বা বা বাইরে গেছেন স্যা র..।
চলবে...
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, পর্ব-৮, পর্ব-৯, পর্ব-১০, পর্ব-১১