চতুর্দশ পর্ব
মোহিনীর জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করে দিল করোনা। করোনায় তিনি প্রথমে তার স্বামীকে হারালেন। তার পর হারালেন বাবাকে। এই ক্ষতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়; কিন্তু জীবনের ক্ষতি পোষানো যায় না। যে জীবন একবার নিভে যায় সে জীবনের আলো আর কখনোই জ্বলে না। জ্বালানো যায় না। হইজগতের সব মায়া, সব দেনা-পাওয়া চুকিয়ে তাকে চলে যেতে হয় অনন্তের জগতে। সেই জগৎ সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা নেই। সেখানে মানুষ ভালো থাকে; নাকি মন্দ সে বিষয়েও কেউ কিছু জানে না। কোনোদিন জানতেও পারবে না। জানার কোনো সুযোগ নেই।
মোহিনী মনে মনে ভাবেন, করোনাকালে আমি আমার সামর্থ্যের বাইরেও অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এখনো নিয়মিতভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। ফ্যাক্টরিগুলোতে উৎপাদন বন্ধ। রপ্তানি বন্ধ। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি ঠিকই দিতে হচ্ছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়লে তাকেও সহযোগিতা করতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি করোনার কারণে যারা কর্মহীন হয়ে খাদ্যসংকটে পড়েছে তাদের খাদ্যসহায়তা দিচ্ছি। অথচ বিধাতা আমাকেই বারবার পরীক্ষায় ফেলছেন। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন। আর কত পরীক্ষা দিতে হবে কে জানে!
মোহিনী ঘরের মধ্যে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলেন। এ সময় আনোয়ারা বেগম তার ঘরে এসে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাকে চিন্তিত দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, মোহিনী কী হয়েছে!
মোহিনী আনোয়ারা বেগমের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার পর বললেন, আমার খুব অস্থির লাগছে মা। কিছুই ভালো লাগছে না।
আনোয়ারা বেগম মোহিনীর কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি জানি তোর মন কেন অস্থির। কিন্তু মা, নিয়তির ওপর কারও কোনো হাত নেই। কেন যে বিধাতা এত বড় পরীক্ষায় আমাদের ফেলেছেন তা তিনিই জানেন। আমাদের শুধু ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। একটা ব্যাপার তুই লক্ষ করেছিস!
কী মা?
বিধাতা যা কিছু করেন সবই নাকি ভালোর জন্য করেন। দেখ, তোর বাবা তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ট্রাস্টি বোর্ডে লিখে দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেলেন! করোনা একটি উছিলা। হয়তো বিধাতা চান, আমরা নিজেদের মানবকল্যাণে নিয়োজিত করি!
মোহিনী সহমত পোষণ করে বললেন, হতে পারে। কথাটা তুমি মন্দ বলনি মা।
ধৈর্য ধর মা! আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া কি-ই বা করার আছে!
ধৈর্য তো ধরছিই মা। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কাজে মন বসে না। এ কী হলো মা!
প্রকৃতির কী খেয়াল কে জানে!
দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোহিনী। আনোয়ারা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলেন, তুই চা-কফি কিছু খাবি? আনতে বলি?
মোহিনী কোনো কথা বললেন না। তার পরও আনোয়ারা বেগম রহিমাকে ডেকে কফি দিতে বললেন। মোহিনী কোনো আপত্তি করলেন না। তিনি আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ করে বললেন, মা শোন, আমাদের হাসপাতালের কাজটা করছে বিটিআই। ওরা এমনি খুব ভালো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে তারা কাজটা শেষ করবে। তার পরও আমার মনে হয় কী! তুমি যদি মাঝে-মধ্যে একটু তদারকি করে আসো...!
আনোয়ারা বেগম সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি যাব। তুই কোনো চিন্তা করিস না।
আর মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে ফ্যাক্টরিগুলো দেখতে যেও। ভালো লাগবে তোমার। তাছাড়া সময়টাও কাটবে।
তা ঠিকই বলেছিস। বাসায় বসে কতক্ষণ কাটানো যায়!
আরেকটা কথা, আমরা কি একটা মিডিয়া হাউস করতে পারি?
বিস্ময়ের সঙ্গে আনোয়ারা বেগম বললেন, মানে!
মানে একটা পত্রিকা করতে চাই।
কী বলিস! ওসব আমরা কি বুঝি?
আমরা তো নিজেরা করব না! আমরা বিনিয়োগ করব।
হঠাৎ মিডিয়ার ব্যাপারে তোর আগ্রহের কারণ?
কারণ নিশ্চয়ই আছে। দেখ, তুমি আর আমি ছাড়া আমাদের পরিবারে কিন্তু আর কেউ নেই! লোভী মানুষগুলো সারাক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ যদি আমাদের সবকিছু দখল করেও নেয়, তাহলে কথা বলারও লোক থাকবে না! তাছাড়া আল্লাহ না করুক আমাদের যদি কিছু হয়ে যায়!
অবাক বিস্ময়ে আনোয়ারা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, আমি তো কখনো এভাবে চিন্তা করিনি! তুই ঠিকই বলেছিস মোহিনী! চিন্তার বিষয় বটে!
মোহিনী বললেন, এ কারণেই বিষয়টা আমার মাথায় এল। তাছাড়া আমার এক বন্ধুর কথা তো তুমি জানো। অনেক বড় সাংবাদিক।
কে আসিফ আহমেদ?
হুম।
তোর বাবাও তার কথা বলত। তার কী অবস্থা রে?
সে তো একটি বড় পত্রিকার সম্পাদক ছিল। এখন নতুন কিছু করার কথা ভাবছে। আমি তাকে দিয়ে একটি পত্রিকা করার কথা চিন্তা করেছি। তুমি রাজি থাকলে তাকে আমি ডাকব। তার সঙ্গে কথা বলব।
বাসায় ডাক না একদিন। আমিও কথা বলি।
তার আগে বলো, মিডিয়া করার ব্যাপারে তোমার সম্মতি আছে কি না?
এর পর আর সম্মতি দেওয়ার কিছু আছে? সঠিক ভাবনাই ভেবেছিস মা!
ধন্যবাদ মা। আমি খুব শিগগিরই তাকে ডাকব। আচ্ছা মা, তোমার চা-কফি তো কিছু এল না! ঘটনা কী?
আনোয়ারা বেগম দরাজ গলায় রহিমাকে ডাকেন। রহিমার কোনো সাড়া নেই। তিনি ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যান। মোহিনীও তার পেছনে পেছনে এগিয়ে যান।
অনেকদিন পর আরেফিনকে স্বপ্নে দেখলেন মোহিনী। তাকে নিয়ে যে তিনি ভেবেছেন তা নয়। ইদানীং তিনি কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সবকিছু একা সামলাতে হচ্ছে তাকে। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তো আছেই; বাবার রেখে যাওয়া সবগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই তাকে দেখভাল করতে হয়। সঙ্গত কারণেই অতিমাত্রায় ব্যস্ত তিনি। এখন আর নিজের জীবন নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। ভাবেনও না। কী হবে ভেবে? যে ভাবনার কোনো কূলকিনারা নেই, সেই ভাবনা ভেবে কোনো লাভ নেই। তিনি ভাগ্যটাকে নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি কাজ করে যাবেন। কাজের মধ্যদিয়েই নিয়তি তার পথরেখা ঠিক করবে।
তখন শেষ রাত। মোহিনী স্বপ্নে দেখেন, আরেফিন উহান থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে ছুটে যান তিনি। তার হাতে গোলাপের তোড়া। গোলাপ ফুল ভীষণ পছন্দ আরেফিনের। বিমানবন্দরে ফুল হাতে মোহিনীকে দেখে আনন্দে ফেটে পড়েন আরেফিন। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরেন। আরেফিনের উষ্ণতা ভালোবাসায় মোহিনীও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তার পর তার ঘুম ভেঙে যায়। কোনো কথা বলার সুযোগ হয়নি আরেফিনের সঙ্গে।
ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম হয়নি মোহিনীর। তিনি আরেফিনকে নিয়ে শুধু ভেবেছেন। গভীর ভাবনায় ডুবে গেছেন আরেফিনকে নিয়ে। কখনো স্মৃতিকাতর হয়েছেন। কখনো চোখের পানি ফেলেছেন। আবার কখনো প্রাণ খুলে হেসেছেন। স্বপ্নের মতোই যেন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলেও স্বপ্নের ঘোর তার কাটেনি। ভাবনার মধ্যেই তিনি বলেন, কী গভীরভাবে ভালোবাসত সে আমাকে! কিন্তু বিয়ের পর কেন সে এমন বদলে গেল! নাকি আমার বোঝার ভুল! আমি কি তাকে বুঝতে পারিনি! নাকি সে আমাকে বুঝতে পারেনি! আরেফিন কি আমাকে ভয় পেত? ভয়ের কারণে অনেক কিছু গোপন করত! ভুলটা হয়তো আমার। আমিই তাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। তাকে সময় দিইনি। নিজের কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থেকেছি। হয়তো আমার ওপর অভিমান ছিল তার। তাই সে চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!
চলবে...
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, পর্ব-৮, পর্ব-৯, পর্ব-১০, পর্ব-১১, পর্ব-১২, পর্ব-১৩