ঢাকা ৪ বৈশাখ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

পুরোনো রণক্ষেত্র

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৪ পিএম
আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম
পুরোনো রণক্ষেত্র
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ধুলোবালি মাখা বাতাস বইছে। চোখ মেলে তাকানো যায় না। পেছনের রিকশা থেকে গলা বাড়িয়ে শিউলি জিজ্ঞেস করে- আর কয় মাইল হবে আলম ভাই?
মাইল চারেক, কষ্ট হচ্ছে খুব?
না, ঠিক আছে।

শাহ আলম মাথা ঘুরিয়ে পেছনের রিকশাটার দিকে তাকায়। পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের শরীরটা আগের মতো নেই বলে সহজেই পাড়ি দেওয়া গেছে। অমসৃণ মেঠো পথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও অনেকদূর আসা গেছে। কংক্রিটের সড়ক হলেও দেশ স্বাধীনের পর খুব একটা মেরামত হয়নি। এমন সড়কে হাঁটা তবু ভালো, রিকশায় চাপলে জান বেরোবার জোগাড় হয়।

শেরপুর পেরোতেই সড়কের চেহারা আরও সঙ্গিন মনে হয়। যত্রতত্র ইঁদুরের গর্ত। ট্রাক ও মহাজনি মোষের গাড়ি চলে খাদ-খন্দকে বেহাল বানিয়েছে সড়ক। অতএব দুজন নারী সহযাত্রীর অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারে শাহ আলম। বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা অনেকটা পথ শক্তি সঞ্চয় করে টিকেছিলেন। ভেবেছিলেন- কষ্ট তো হবেই। কিন্তু আরও মাইল কয়েক চলার পর শরীরটাকে আর সামলে রাখতে পারলেন না তিনি। মেয়ে শিউলির বুকে মাথা রেখে বললেন- আমাকে একটু ধরবি, মা।

ঢাকা থেকে বাসে জামালপুর পৌঁছাতেই পাঁচ ঘণ্টার বেশি লেগেছে। বৃদ্ধার শরীর ভেঙে গেছে তখনি। তবু কিছু বলেননি। কিন্তু খেয়াঘাট পেরিয়ে রিকশাটা চলতেই তিনি কাঁপতে থাকলেন। তার মতো একজনের এরকম ধকল সইবার কথা নয়। কিন্তু শরীর আজ তার কাছে বড় নয়, যে করেই হোক তিনি গন্তব্যে পৌঁছতে চান।

আরও ঘণ্টা খানেক পর সড়কের পাশে বড় একটা আমগাছ দেখতে পায় শাহ আলম। গাছটাকে বেশ চেনা মনে হয়। শাহ আলম রিকশা থেকে নামে। পা দুটো জমে গেছে, রগগুলো টনটন করছে। যতদূর মনে পড়ে, এই গাছটার নিচে অনেকবারই তারা বিশ্রাম নিয়েছে যুদ্ধের সময়। 

গাছটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম। অনেক বছরের ব্যবধানে অনেক বদলে গেছে। আগের শরীর নেই। তবু চেনা যায়। পাশের পুলটি আজও সে রকম, তেমন মেরামত হয়নি। দক্ষিণের বিলটা প্রায় জলশূন্য। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম চিনতে পারে এলাকাটি।

পেছনের রিকশাটা ইতোমধ্যে কাছে আসে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে বলে, মা, নামুন, একটু বিশ্রাম নিন।

বৃদ্ধাকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় শাহ আলম। পা ফেলতেই ধপাস করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েন বৃদ্ধ মহিলা। জিরজিরে শরীরে এমন ধকল সইবার কথা নয়।

ওরা যখন আমগাছের নিচে বসে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিল, ঠিক তখনই গাছটার পাতা কাঁপিয়ে, ডালপালা বেয়ে এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। শিউলি সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে- ইশ কী ঠাণ্ডা, বৃষ্টি হবে নাকি আলম ভাই?
হবে হয়তো, এ সময় তো বৃষ্টি হয়, যা গরম।

ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে শিউলি মুখের ঘাম মুছতে থাকে। ইতোমধ্যে গাছের গোড়ালিতে শরীর ঠেকিয়ে বসে পড়েন বৃদ্ধা। চোখ ঘুরিয়ে জায়গাটা দেখতে থাকেন। আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। কোনোদিন আসতে হবে তাও ভাবেননি, অথচ এসেছেন। কেন, কীসের টানে, অজানা-অচেনা এলাকাটি এত বছর পর এলেন তিনি? সবার অগোচরে আঁচলে চোখ মুছলেন বৃদ্ধা। 

গারো পাহাড়ঘেঁষা জামালপুর - শেরপুর অঞ্চল। ব্রহ্মপুত্র নদ ও বেশ কয়েকটি স্রোতস্বিনী বয়ে গেছে উত্তর জনপদের এলাকাটার মাঝ দিয়ে। পূব দিকে যমুনা, পশ্চিমে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। অনেক বছর হয়ে গেলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি শাহ আলমের। আরও মাইল কয়েক গেলেই তার স্মৃতির রণাঙ্গন। সামনের একটা কংক্রিটের পুল দেখে শিউরে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা। মনে পড়ে - এই পুলটায় অ্যাম্বুশ বসিয়ে একবার সেনা ও রসদ বোঝাই তিনটি পাকিস্তানি ট্রাক উড়িয়ে দিয়েছিল ওদের প্লাটুন। 

অক্টোবরের শেষ। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় সব রণাঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। একদিন ভোর হতে না হতেই সেনাভর্তি জিপ ও ট্রাক আসতে থাকে জেলা শহর থেকে। দুপাশের জঙ্গলে সারা রাত লুকিয়ে থাকে ১৫ জনের একটি গেরিলা দল। নির্ধারিত সময়ে শাহ আলমের হাতে মেশিনগানের ব্যারেল কেঁপে ওঠে। পুলের ওপর গাড়িগুলো উঠতেই বিকট শব্দে মাইন ফাটে। ভোর রাতের বাতাস তোলপাড় হতে থাকে। খেতের ফসল কেঁপে ওঠে। জয় বাংলা বলে একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে সবাই। 
তারপর?

পরের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেন শাহ আলম। নস্টালজিয়া থেকে তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে শিউলি। বলে, জায়গাটা আপনার খুব চেনা - ভাইয়া কি এখানেই? 

শিউলির সহজ প্রশ্ন শাহ আলমকে কাঁপিয়ে তোলে। এত সহজে এ রকম কোনো প্রশ্ন কি করা যায়! কিন্তু সে শান্ত থাকে। বলে, ঠিক বলেছো, এলাকাটা আমার বেশ চেনা - অনেক স্মৃতি আছে এখানে।
আর ভাইয়া? 

না, সে জায়গাটা এখানে নয় - কামালপুরে - আরও বেশ খানিকটা যেতে হবে আমাদের। 

১৯৭১ সালে শিউলির বয়স অনেক কম। চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঘটনা ঘটে গেলেও ওর মনে তেমন দাগ কাটেনি। শিউলিদের নতুন নতুন জেনারেশন তৈরি হয়েছে। পলাতক সময় অতীত ভুলিয়ে দিচ্ছে। শাহ আলম এবং শিউলির আবেগের মাঝে তাই বিস্তর ফারাক।

বুড়ো ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে সামনের একটি বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। বহুমূত্র রোগ তার। ফিরেই বললেন - কামালপুরটা আর কদ্দুর রে বাবা? 

এইতো মা, সামনেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু করার যে কিছু নেই মা। রাস্তাঘাট খুবই খারাপ।

কীসের কষ্ট রে - এসেই তো গেলাম। তুই যা উপকার করলি বাবা, কাজকর্ম ফেলে ছুটলি আমাদের সঙ্গে। তুই বাঁচালি, বাবা, বাঁচালি আমাকে। 

এই বৃদ্ধাকে কী এমন উপকার করেছে শাহ আলম? সন্তানের বধ্যভূমি দেখতে যাবেন মা। গোটা দেশটাই আশা-আকাঙ্ক্ষার আরেক বধ্যভূমি হতে বসেছে। একজন সহযোদ্ধার মাকে না হয় কিছুটা সময়ই দিয়েছে সে - আর বেশি কী! প্রথম দিকে শাহ আলম চেষ্টা করেছিল সহযোদ্ধার মাকে ফেরাতে। বোঝাবার চেষ্টা করেছিল - এত বছর পর হয়তো কোনো চিহ্নই থাকবে না সেখানে - শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? বলেছিল - মা, একটা কথা বলি, শুধু শুধু মনটা খারাপ করে কী লাভ?
কী লাভ জানিনে বাবা, একটি বার তুই নিয়ে চল - শুধু একবার।

ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকাটা শাহ আলমের চেনা। বর্ডারের সামান্য ভেতরে ইপিআরের ক্যাম্প, তাকে ঘিরে শক্ত ঘাটি বানিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। বহু সহযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত এলাকা। অনেক স্মৃতি তার এখানে। সেই পুরোনো রণক্ষেত্রের স্মৃতি বুকে ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ফিরে যাচ্ছে আজ সেখানে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে - এমন এক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করছে সে - যেখানে সে ছিল জননন্দিত রাজদ্রোহী - প্রজার রক্ত শোষণ করা রাজাধিরাজের সিংহাসন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হাজারো-লাখো রাজবিদ্রোহী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তখন! সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি! শত্রুকে পরাস্ত করে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় মহান এক রণযাত্রা! রক্ত নদীতে স্নান করে বাঙালির বাঙালি হয়ে বসবাসের মহোৎসব!

কিন্তু আজ কে শত্রু কে মিত্র বোঝা যায় না। সবকিছু পাল্টে গেছে। স্বাধীনতার পতাকা নামিয়ে দিতে আসছে অচেনা মানুষ। শাহ আলমের হাতে আজ রাইফেল নেই। সেদিনের বন্ধুরা কে কোথায় সে খোঁজও জানে না সে। 

রিকশা এগিয়ে চলছে। কড়কড়ে রোদে চালক দুজন ঘেমে অস্থির। একজন বেশ বৃদ্ধ - শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন। তবে চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। শাহ আলম ওদের ঘর্মাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে - পরিবার আর আছে ভাই ?
আল্লায় দিলে আছে কয়েকজন। 
ছেলেমেয়ে?
তাও আছে।

হঠাৎ শাহ আলমের চোখ যায় লোকটার বাঁ হাতের দিকে। লক্ষ করলেই বোঝা যায় শক্ত কোনো আঘাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল কখনো। 

হাতে কী হয়েছিল?
রেজাকারে ধইর‌্যা পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে দিছিল। বাইনট দিয়া খুঁচাইছে, জানে মরি নাই খোদার রহমে।

রিকশাওয়ালার কথায় শাহ আলমের চোখে ৭১ সাল ভেসে ওঠে। প্রাচীন দেখার আরশিতে চোখ রাখে সে। শেরপুর-জামালপুরের মধ্যবর্তী এলাকাটা হঠাৎ সবাক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। স্বচ্ছ মন্ত্র পড়া আয়নায় নাকি দূর অতীতের ছবি দেখা যায়। অনেক জাদুকর নাকি পারেন এমন অসম্ভব সাধন করতে।
তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে?

না স্যার, ছোট ছিলাম, মুক্তিগর ক্যাম্পে যাতায়াত করতাম, খবরাখবর দিতাম।
ওরা তো তোমাকে মেরেও ফেলতে পারত? 

কত মানুষই তো মরল বাবা, সব্বনাসী একাত্তর কত মানুষের জান নিল, কত মানুষ শহিদ হইল। কিন্তু আল্লাহ তো শেষ পর্যন্ত বাঁচাইয়া রাখল আমারে। 

পড়ন্ত বিকেলে রণক্ষেত্র কামালপুরের সীমানায় এসে দাঁড়ায় রিকশা দুটি। পুরোনো রণক্ষেত্রে পা রাখতেই দেহটা কেঁপে উঠে শাহ আলমের। না, এখানে আজ কোনো বাংকার নেই। যত্রতত্র পড়ে নেই বুলেট ও মর্টারের খোসা। সেই কামালপুরকে চেনার কোনো উপায় নেই। নতুন ফসলের মাঠ। যত্রতত্র ঘরবাড়ি। ইপিআর ক্যাম্পটির নাম বদলে হয়েছে বিডিআর ক্যাম্প। নবীন বৃক্ষরাজি বেড়ে ওঠে ইতিহাসের কামালপুরকে এক অচেনা জনপদ বানিয়েছে। একাত্তরের ৯ মাসে অসংখ্য জনযোদ্ধা এই মাটিতে প্রাণত্যাগ করেছে, এখানেই স্বাধীনতার জন্য আত্মবলি দিয়েছে অগণিত বাঙালি যুবক। এসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ!

শহিদ সাদেক আহমদের মাকে ধরে রিকশা থেকে নামায় শাহ আলম। মাটিতে পা রেখেই বৃদ্ধা বললেন, একটু পানি পাওয়া যাবে, বাবা, তেষ্টা পেয়েছে।
নিশ্চয়ই মা, আমি পানি আনছি।

বলেই শাহ আলম পানির খোঁজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? দুর্ধর্ষ গেরিলা কমান্ডার শাহ আলম এবং সাদেক আহমদকে একদিন এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ চিনত। ভালোবাসা উজাড় করে দিত। কিন্তু সবকিছুই বদলেছে। গাছ, ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব বদল হয়েছে। শাহ আলম তবু হাঁটতে থাকে। 

ব্যস্ত মানুষ যার যার কাজে চলেছে। স্কুল থেকে দলবেঁধে ফিরছে একদল বালিকা। ভারত সীমান্তের উঁচু বাঁধটা দেখা যাচ্ছে। ধানুয়া গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে সেই আগের মতো। এক থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত বাংকার ছিল এই গ্রামে। উঁচু একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষে। শাহ আলম দেখল সে গাছটি নেই।

চোখ ছল ছল করে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের। মনে আক্রোশ জমে ওঠে। কেন এই রণক্ষেত্রের সব নরনারী, গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ সবাই আজ ছুটে আসছে না? প্রতিটি দোকানপাট, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি ফসলের খেত থেকে কেন ছুটে আসছে না হাজার কৃতজ্ঞ মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে?

কিন্তু সে আশা পূরণ হয় না। কেউ তাকে চিনতে পারে না। কেউ এগিয়ে আসে না। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় - তোমরা কেউ কি মনে করতে পারো - আমি সেই কমান্ডার শাহ আলম, আর ওই তো সেই মা, যার সন্তান সাদেক আহমদ রক্ত তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।

বেশ খানিকক্ষণ পর একটি চা দোকান থেকে এক গ্লাস পানি হাতে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদের মা তখন বিডিআর ক্যাম্পের উপরে জাতীয় পতাকার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ওই তো সেই পতাকা- যার গায়ে তার সন্তানের রক্তের দাগ!
মা, এই যে পানি।

কোনো কথা না বলে স্পষ্ট, সোজাসুজি তাকালেন বৃদ্ধা। হঠাৎ বদলে গেল পরিস্থিতি। শাহ আলম মাথা নিচু করে বলল, মা, এই যে পানি এনেছি আপনার জন্য। 

শিউলি ঠিক তখনি এগিয়ে গেল মায়ের কাছে। বলল - পানি খেতে চাইলেন না আপনি? নিচ্ছেন না যে?

হঠাৎ আকাশ ফাটা আর্তনাদ করে শহিদ সাদেক আহমদের মা ডুকরে উঠলেন। দুই হাত বাড়িয়ে শাহ আলমকে জাপটে ধরলেন। - আমি পানি চাই না বাবা, তুই শুধু বল - কোন জায়গায়, ঠিক কোন জায়গায় আমার বাবাকে ফেলে গেছিস তোরা? একবার বল - কোন জায়গায় - কোন জায়গায়?

উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকলেন শহিদ জননী। বারবার করে ডুকরে উঠলেন - বাবা-বাবারে, জাদুমণি রে। আয় বাবা, আয়। একবার, শুধু একবার বুকে আয়।

কিছুতেই থামালেন না বৃদ্ধা। সে রোদনে গাছের ডালে বসা পাখিরা গান থামিয়ে দিল। গরু-ছাগলগুলো সকরুণ চোখে তাকিয়ে থাকল। শহিদ সাদেক আহমদের মায়ের হাতের ঝাঁকুনিতে গ্লাসের পানি পুরোনো রণক্ষেত্রের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। পানির রং গাঢ় লাল হয়ে শাহ আলম ও শিউলির শরীর, কাপড় রাঙিয়ে দিল। 

মাটিতে আছড়ে পড়তে থাকলেন শহিদ জননী। কেবলই বলতে থাকলেন - শুধু একবার জায়গাটা দেখিয়ে দে বাবা। বল, আমার সাদেক কোথায় শুয়ে আছে? আমি আমার বাবার কাছে শুয়ে থাকব।

মায়ের রোদনে চোখ ভিজে ওঠে শিউলির। শিশু বয়সের স্মৃতি মনে না পড়লেও চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীর ভেসে ওঠে। দ্রুত খুলে যায় ঢেকে রাখা বিস্মৃতির চাদর। রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটি ওর কাছে তীর্থভূমি মনে হয়। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। 

লোকজন জমে যায় ইতোমধ্যে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে - কে এই বৃদ্ধা, কেন কাঁদছেন তিনি? এমন প্রশ্নে বোবা হয়ে যায় শাহ আলম। জড়ো হওয়া মানুষগুলোর ওপর আক্রোশ বাড়তে থাকে। শহিদের মাকে সে থামাতে চেষ্টা করে না, কাঁদুক, যত পারে কাঁদুক শহিদ সহযোদ্ধার মা।

শাহ আলমের কানে তখন রাইফেল, মর্টার এবং এলএমজির গর্জন ছাড়া কিছুই পৌঁছে না। ১৪ দিন অবরুদ্ধ কামালপুরের শত্রুঘাঁটি। মুক্তিবাহিনী ঘিরে রেখেছে দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি ক্যাম্প। অবিরত গোলাবর্ষণ চলছে কামালপুর বিওপির ওপর। কোম্পানি কমান্ডার সাদেক আহমদ সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢুকে গেছে শত্রুঘাঁটিতে। রক্তে ভিজে গেছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তভূমি। হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পতাকা উড়িয়েছে। জয়বাংলার বিজয় উৎসব চলছে। বাংকার থেকে বেরিয়ে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসছে পরাজিত সেনারা। চোখে-মুখে ওদের পরাজয়ের গ্লানি। 

পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র- গোলাবারুদ এক জায়গায় এনে জড়ো করা হচ্ছে। চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে অনেকেই তখন গান ধরেছে, ..আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।

বিশাল বিজয়ের পর দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরে দুজনকে। চোখ দিয়ে দুজনের নোনা পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। সদ্য শত্রুমুক্ত ঘাটিতে জড়ো হতে থাকে অজস্র মানুষ। জয় বাংলা এবং জয় মুক্তিবাহিনীর স্লোগানে বাতাস আন্দোলিত হয়ে উঠছে। বিজয়ের অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। শাহ আলমের সব মনে পড়ে এখনো।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট এক বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে রণক্ষেত্র। প্রথমে কেউই বুঝতে পারে না কী ঘটল। শাহ আলম দ্রুত ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করে। দেখে, সাদেক আহমদের বিক্ষত শরীর পড়ে আছে। পাশে পড়ে আছে কাঠিতে বাঁধা একটি জাতীয় পতাকা এবং কমান্ডারের পরিত্যক্ত স্টেনগান। ছিন্নভিন্ন শরীরের নিচের অংশটি উড়ে গেছে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনে।

অনেক বছর আগের কথা - শাহ আলম নিজেও ভুলতে বসেছিল। কিন্তু রণক্ষেত্র কামালপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাখা স্মৃতি তাকে কঠিন করে তোলে। নতুন ক্রোধ, নতুন ঘৃণা, নতুন এক প্রত্যয় দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরে। এক প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করতে থাকে শাহ আলম। সে প্রচণ্ড বেগে ছুটতে চায়, একটি ঝড় কামনা করে, নতুন একটি ঝড়। 

শিউলির ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে শাহ আলম। শহিদ জননীর বিলাপ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। উৎসুক মানুষের ভিড় কমতে শুরু করেছে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই এ এলাকা ছাড়তে হবে। অচেনা গ্রাম - কে কাকে চিনবে, কে কাকে কোথায় আশ্রয় দেবে। 

আলম ভাই, মাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিন তো, সন্ধ্যা হচ্ছে। এক হাতে মাকে আগলে রেখে অনুরোধ করে শিউলি।

এরপর নবীন গজানো গাছপালা, বৃক্ষরাজি, নতুন-পুরোনো ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল, অফিসঘর পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় ওরা। শাহ আলম জায়গাটাকে চিনতে চেষ্টা করে। না, আগের কিছু নেই, নেই সারি সারি বাংকার, নেই বোমা ও গ্রেনেডের আগুনে পোড়া খয়েরি রঙের মাটি। এখন কোনো ভারী সামরিক ট্রাক চলে না এখানে, নতুন ঘাস গজিয়েছে। শহিদের রক্তের দাগ ঢেকে দিয়েছে নতুন মাটি ও দূর্বাঘাসে।

অনেকক্ষণ ঘুরে শাহ আলম সহযোদ্ধাকে হারাবার জায়গাটা ঠিক চিনতে পারে। ওই তো আকাশমুখী সেই দেবদারু গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চিত হয় - ওই তো, ওখানেই তো ঢলে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমদ। 

না, সেই বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেনি। বরং গাছটার নিচে, দেখা গেল, নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে দুটি নেড়ে কুকুর - কড়কড় শব্দে হাড্ডি ভাঙছিল তারা। মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম এ দৃশ্য মেনে নিতে পারে না। ঘামে শরীর ভিজে ওঠে - এ হয় না, এ হতে পারে না!

ভদ্র মহিলা ইতোমধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। বললেন, কোথায় রে বাবা - কোন জায়গাটায়? একটু থেমে আবারও বলেন, বেশি দেরি হবে না বাবা, এক মুঠ মাটি নিয়েই চলে যাব আমি, কেবল এক মুঠ মাটি। 
মা, একটু অপেক্ষা করুন। 

বলেই শিউলির চোখের দিকে তাকায় শাহ আলম। শিউলি বুঝতে পারে তার ভাইয়ের বন্ধুর চোয়ালগুলো টানটান হয়ে উঠছে। চোখ দুটি সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। সে দু হাতে মাকে জাপটে ধরে। 

তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হাতে দুটি ইটের টুকরো তুলে নেয় শাহ আলম। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ইট দুটিকে কুকুরগুলোর দিকে ছুড়ে মারে। ঘেউ ঘেউ শব্দে কুকুরগুলো স্থান ত্যাগ করতেই পরিবেশটা হালকা হয়। শাহ আলমের কাছে যেন আজ আবারও একাত্তর।

এরপর সহযোদ্ধার মায়ের কাছে এগিয়ে যায় শাহ আলম। বলে, মা, এবার আপনি আসুন। ওই তো সেই জায়গা, সেই পবিত্র জায়গা।

হো হো করে কেঁদে ওঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শহিদ জননী। মাটি খাবলে কিছু মাটি-ধুলোবালি হাতে নিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে রাখেন তিনি। শিউলির চোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাহ আলম এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলে - চল, আমরা দুজনেই মাকে সাহায্য করি। 

খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ সৃজনশীলতায় মেধা ও আবেগের অনন্য মিশেলে গড়া

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০০ পিএম
আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০২ পিএম
সৃজনশীলতায় মেধা ও আবেগের অনন্য মিশেলে গড়া
খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা

কৈশোর আর তারুণ্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে মনে হয়। তখন আমরা যুক্তি দিয়ে বাস্তবতাকে বুঝতে শিখি। কোনটা নেব আর কোনটা নেব না সেই স্বাধীন বিবেচনার বোধ তৈরি হয়। সেই বোধ হয় তীব্র। তখন কখনো যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে আবেগকে, কখনো আবেগের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে যুক্তি। কখনো আবার যুক্তি আর আবেগ মিলেমিশে একসঙ্গে থাকে। 

আমাদের কৈশোর আর তারুণ্যে সময়কাল ছিল বড্ড টালমাটাল। মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন দেশ গড়ে উঠছে। সেখানে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক পট। বিশ্বরাজনীতির অবস্থাও গোলমেলে। বিশ্ব ভাঙছে। এরকম দিশেহারা অনিশ্চিত সময়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আশ্রয়ের। সাহিত্য আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। সব অস্থিরতার ভেতর থেকে শান্ত দিঘির মতো স্থির থেকে আমাদের পথ নির্দেশ করেছে। হাতের নাগালে পাওয়া দেশ-বিদেশের নানা বই আমাদের পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে সত্য। তবে সেই সময় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেছে ঈদসংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা। সমসাময়িক বিষয়, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সবকিছু তরতাজা। হালনাগাদ। ঈদসংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা আমাদের সময়ের সঙ্গে রেখেছে, সমৃদ্ধ করেছে। 

তারপর একসময় দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা এসেছে। পুঁজিতে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। বছর ঘুরে রোজা এলেই ঈদসংখ্যার আড়ত জমে উঠেছে। নানা পত্রিকার ঈদসংখ্যার স্তূপে ভরে গেছে। আমরা সন্ধান করতে থাকি সাহিত্যের সৃজনশীলতা। সমসাময়িক যা কিছু আছে, সজীব উচ্ছ্বাস আর আনন্দময় সব। 

যদি পক্ষপাতের দায় নিতে হয়, তবু সেই দায় নিয়ে বলছি কৈশোর তারুণ্যে বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে সাহিত্য ঈদসংখ্যায় যা পেয়েছিলাম তা নতুন আঙ্গিকে পেয়েছি খবরের কাগজ ঈদসংখ্যায়। গত বছর মানে ২০২৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা। এবার ২০২৫ সালে দ্বিতীয়বার।

এখানে সবচেয়ে জরুরি যা পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে সৃজনশীলতার মেধা ও আবেগের অনন্য মিশেল। তাই দিয়ে গড়া হয়েছে খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫। সম্পূর্ণ রঙিন। চার রঙে ছাপা, ঝকঝকে কাগজ, গেটআপ, মেকআপ, বাঁধাই দারুণ দৃষ্টিনন্দন। পত্রিকার অলংকরণ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হাতে আঁকা বা কম্পিউটার গ্রাফিক্স, তবু মনে হয় জীবন্ত। দরকারি যেটা তা হচ্ছে গল্প, কবিতা, উপন্যাস বা প্রবন্ধ যা কিছুর অলংকরণ করা হয়েছে তা শিল্পী যেমন দরদ দিয়ে করেছেন, তেমনি তিনি সেখানে তুলে এনেছেন লেখার মূলভাব। পুরো লেখা না পড়লে এমনভাবে অলংকরণ করা সম্ভব হবে না। তা আবার শুধু পড়া নয়, লেখার ভেতরের গভীর সত্যের উপলব্ধি। এতে শিল্পীর সততার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। তার একাগ্রতা ও নিজ কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ মূর্ত হয়ে ওঠে।

এখানে বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। তিনি এই ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ এবং শিল্প নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকার অলংকরণে নিয়াজ চৌধুরী তুলির সঙ্গে ছিলেন নাজমুল আলম মাসুম। গ্রাফিক্স ডিজাইন করেছেন মেহেদী হাসান। তারা সবাই মিলে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর করে তুলেছেন পত্রিকা।

খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ হাতে নিয়ে বোঝা যায় এটা টিমওয়ার্কের ফসল, একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেকে তার কাজটুকু দায়িত্ব নিয়ে যত্ন করে করেছেন। তা সম্পাদক থেকে প্রুফরিডার, ছাপাখানার কর্মী, বাইন্ডার, অলংকরণ শিল্পী সবাই। প্রত্যেকে নিজের কাজটুকু করেছেন অতি যত্নসহকারে দরদ দিয়ে। যেন সবার কাছে একটি সত্যই মূল্যবান ছিল তা হচ্ছে এটি খবরের কাগজ প্রকাশনা। 

এবার সৃজনশীল মেধার কথা বলি। কেন এত এত ঈদসংখ্যার ভিড়ে এমন আগ্রহ নিয়ে খবরের কাগজ ঈদসংখ্যায় আস্থা রাখছি। তার চেহারাও স্পষ্ট হয় যখন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার দিকে তাকাই। সেই কৈশোর আর তারুণ্যের যুক্তি আর বাস্তবতা দিয়ে বিবেচনা করার সময় ফিরে পাই।

খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি প্রবন্ধ, ৭টি উপন্যাস, ২৫টি গল্প, ২৫টি কবিতা। এ ছাড়া আছে ছড়া, আমাদের অহংকার গর্বের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা, ভাষার লড়াই, গণঅভ্যুত্থান, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা, অগ্রন্থিত রচনা, ভ্রমণ, চিত্রকলা, প্রকৃতি, সাক্ষাৎকার, খেলাধুলা, রান্নার রেসিপিসহ নানা আয়োজন। সব লেখা তরতাজা নতুন, সমসাময়িক। যা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সময়কে ধারণ করে আছে।

এ তো গেল সংখ্যার দিক। এবার দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে কী বিশেষ আকর্ষণ আছে এই প্রকাশনায়। বাংলাদেশের একসময়ের তুখোড় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম সাক্ষাৎকার দিয়েছেন খবরের কাগজ ঈদসংখ্যার জন্য। এই যে সিনিয়র শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা, তার কাজ আর চিন্তা, মনন সম্পর্কে বুঝতে পারা তা তো জানা হলো এই খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ থেকে! সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাবিনা ইয়াসমিন আছেন এ সংখ্যায়। তাদের সম্মান দিতে পেরে আমরা ধন্য হই। তাদের কথা আমরা এখনো জানতে চাই। তারা আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভিত গড়ে দিয়েছেন। সেই ভিতের কথা না জানলে কেমন করে বর্তমানকে বুঝব!

উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, গল্প লিখেছেন এ সময়ের সাহিত্যের পাঠকপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা। তাদের লেখা পড়লে বোঝা যায় প্রত্যেকে নিজ লেখার প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন তেমনি খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫-এর জন্য সেই লেখাটি দিয়েছেন যে লেখা তাকে প্রতিনিধিত্ব করে।

বৈচিত্র্যময়তা ধরা পড়ে নির্বাচিত প্রবন্ধের দিকে নজর দিলে। যা একটি পত্রিকার সক্ষমতা ও বিস্তৃত পরিধির পরিচয় বহন করে। শক্তিমত্তা প্রকাশ করে। সেখানে আছে বর্তমান সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনীতির চাঁছাছোলা বিশ্লেষণ, আছে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান-পতনের রাজনীতির কথা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ফেলে আসা দিন, ব্যাংকিং, শিক্ষা ও চারুকলা। লিখেছেন এ সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় চিন্তাবিদ লেখকরা। খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ বাংলা ভাষায় দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা তুলে দিয়েছে। সাহিত্যে দুই বাংলা মিশেছে এক স্রোতে। এখানে বয়স বা দলমত নয়, গোষ্ঠী বিবেচনা নয়, বরং আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সময়ের নেতৃত্বস্থানীয় লেখকদের। 

সম্পাদক হিসেবে সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। ঈদসংখ্যা সম্পাদনা করেছেন এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ গবেষক ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন। সম্পাদনা সহযোগী ছিলেন ড. সারিয়া সুলতানা, খালেদ আহমেদ, শেহনাজ পূর্ণা এবং সানজিদ সকাল। সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন মিন্টু ভূষণ রায়। আর প্রধান সম্পাদনা সহকারী ছিলেন মো. সোহরব হোসেন। যাদের সম্মিলিত মেধা, শ্রম, যত্ন ও ভালোবাসায় খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ হয়ে উঠেছে অন্য সবার থেকে আলাদা ও অনন্য। ৪৮০ পৃষ্ঠার পত্রিকার দাম রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। 

আশা করি খবরের কাগজ বরাবর দায়িত্ব নিয়ে আগামীতেও একইভাবে যুক্তি আর বাস্তবতায় তৈরি হওয়া স্বাধীন বিবেচনাবোধকে সম্মান জানিয়ে সৃজনশীলতায় মেধা ও আবেগের মিশেলে গড়া ‘আমাদের’ পত্রিকা হয়ে থাকবে।

লাল টিপ

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
লাল টিপ
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সন্ধ্যা নামার তখনো খানিক বাকি। অস্তগামী সূর্যটা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো আর রঙের ফোয়ারা। ভরদুপুরের মতো সে আলো তাতিয়ে তোলার মতো নয়। আবার নয় ক্লান্ত পথিকের মতো ম্রিয়মাণ। ভ্রমণক্লান্ত সূর্যটা ততক্ষণে শরীর থেকে খসিয়ে ফেলেছে সবটুকু তেজোদীপ্ত প্রলেপ। তেজটুকুন এখন পোড়ানোর পরিবর্তে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ি বৃক্ষশাখায় পড়েছে তার স্নিগ্ধ আবির। সদ্য গজিয়ে ওঠা কলাপাতা ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি নববধূর মতো সরিয়ে ফেলা অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে উন্মোচন করেছে পেলব দেহশ্বৈর্য। বহুদিন পর এমন বিকেলের রূপ ঐশ্বর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারল না বিহান। হবেই বা না কেন? এমন একটা স্নিগ্ধ বিকেল ভাগ্যক্রমে জোটে। নাগরিক ঠাসবুননের ভিড়ে বারো মাস নিজেকে এক অর্থে বন্দি করে রাখে। বেড়াতে এল বলেই না এমন সুন্দরের সাক্ষী হতে পারল। এক তলা সুরম্য হোটেল-লাগোয়া ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে এক অর্থে গুনগুনিয়ে উঠল,

এখন যদি সন্ধ্যা নামে পথে, ক্ষতি কী বলো তুমি তো
রয়েছো সাথে…

চারদিকে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। নিসর্গ প্রসাধন চর্চা করে অষ্টাদশী নারী মূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে আছে বিহানের সামনে। ছুঁয়ে দিতে মন চায় গভীর তৃষ্ণায় যেমন নদী ছোঁয় সাগর মোহনাকে।

কী রহস্য লুকায়িত আছে আজকের বিকেলে? পুলক বোধ করল বিহান। কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। হালকা বাতাসের দোলার ফাঁকে ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে পাতাদের আড়াল ভেদ করে। যেমন পালকির ভেতর থেকে উঁকি দেয় অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নববধূ।

চিরচেনা মলচত্বরের কথা মনে পড়ল বিহানের। সোনালি সেই দিনগুলোতে মলচত্বরের নৈসর্গিক চাতুর্যে বিহান বিভা হারিয়ে যেত। নিসর্গের সে ছাতার নিচে বসে কত দিন কেটেছিল কথার পর কথামালা গেঁথে।

একেবারে সাদামাটা ঘাসফুলের জীবন ছিল তার। সাধারণ সে জীবনে প্রাচুর্য নিয়ে এসেছিল বিভা নামের মেয়েটি। বিভার বাসা ছিল উত্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া-আসা করত সে। বিহান থাকত সূর্যসেন হলে। রোজ বিভাকে বাসে তুলে দিয়ে নিজের হলে ঢুকত। আজ এত বছর স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টে দিচ্ছে যেন কোনো অদৃশ্য হাত।

কদম গাছের ডালে ডালে কদমের কুড়ি ফুটতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরই বর্ষাকাল। তারই আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে। তারই আয়োজন কদমের ডালে। আষাঢ় মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে কদমের সঙ্গে পাতার বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য দেখার মতো হয় নিশ্চয়ই। কর্তব্যের ঘেরাটোপ আর নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গেছে মহুয়া মাতাল ভালোলাগাগুলো। সে জন্যই ইচ্ছের পালে হাওয়া লাগিয়ে আজকের এই বেরিয়ে পড়া। পুরানো স্মৃতির অ্যালবাম উল্টাতেই চোখে ভেসে আসে রঙিন সব অতীত চিত্রকল্পেরা।

সবুজ চত্বরঘেরা সেই চির নবীন মলচত্বরে হাতে হাত রাখতে কেউ। বিকেলের শেষ আলোকে সাক্ষী রেখে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছিল কেউ। সে কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় বুনো এক কাঠঠোকরা যেন ঠোকরাতে শুরু করল।

সে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল একটি হলদে রঙের পাতার ভূপাতিত হওয়ার দিকে। বোঁটা থেকে যে পাতাটি এইমাত্র খসে পড়ল, ওই ঝরা পাতার মতোই কেউ তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। অপূর্ণ সে দীর্ঘশ্বাসটা ঝুলিয়ে দিল বিদায়ি বসন্তের বৈকালিক বাতাসের কার্নিশে। যে মানবী একদিন চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে যেত, সে নিজেই বিহানকে মনের আড়াল করে বসে আছে।

কীভাবে পারল! এ প্রশ্নটি পাঁচ বছর ধরে ঘুরছে তার মনে। কতদিন দেখা হয় না দুজনের। অথচ, তার সঙ্গে মানসিক সংসার বিহানের। সেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব শূন্য। তবুও কেউ কেউ অদ্ভুতভাবে ভালোবাসাগুলো বাঁচিয় রাখে। বিহান তেমনি একজন।

কী-ই বা করত বিভা? কোনো উপায় ছিল না তার। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে সে। বাবা-মা ভালো পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিহান তখন মাত্র থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে ফোর্থ ইয়ারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। গ্রাম থেকে নগর প্রকোষ্ঠে পা রেখেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। নীড়হারা বিচলিত পাখির মতো গহিন অরণ্যের অন্বেষণ করাই ছিল তার কাজ। বেকার ছেলের সঙ্গে প্রেম কোন বাবা-মা মেনে নেয় এই সমাজে? তাই হয়তো বিহানও ধরে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করেনি। আজ কর্ম-কোলাহল থেকে একটু অবসর তাকে অতীতচারী করে তুলল। তার সঙ্গীরা বের হলেও সে যায়নি।

দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি থেকে রেহাই পেতে সে ঘুমকেই সঙ্গী করেছিল। আজ আধুনিক বাংলোর সুরম্য বারান্দায় তাকে স্মৃতির আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পাহাড়ের বুকচিরে বেরিয়ে পড়া ঝরনা ধারায় ভিজতে ভীষণ ভালো লাগত বিভার।

‘চলতে চলতে খাড়া পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে যাবে ডানপিটে দস্যিপনায়।’ এমন কথা প্রায়ই বলত বিভা।

স্মৃতি আর বিস্মৃতি, ব্যথা আর কথার দ্বৈত মিশেলে বেশ জমিয়ে রাখত বিকেলগুলো। স্পর্শহীন কিছু অনুভূতি থাকে, যাকে স্পর্শের বাইরে চিন্তা করলে এক চিন্তাতীত জগতের সৃষ্টি হয়। তেমনটাই হলো বিহানের। বর্ষিয়ান চাম্বুল গাছটা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সভ্যতার শেষ ছায়া। এমন আধ্যাত্মিক আবহে সে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখে নিজেকে। কেমন একটা চেনা চেনা ঘ্রাণ এসে তার নাসারন্ধ্র উসকে দেয়। পাশেই হাস্নাহেনা ফুলের গাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি গোছের পাপর গাছ। তার শরীর জড়িয়ে তরতর করে ওপরে উঠেছে কিছু লতাগুল্ম। গাছটাও তাদের উদ্যত আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মাতৃআবেগে। বিহান একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশজুড়ে থোকা থোকা ইতস্তত মেঘ। কিছু দিন ধরে মেঘেদের আনাগোনা চলছে। এমন মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না। এ মেঘ চঞ্চলতা ছড়ায়। অদ্ভুত চপলতায় হারিয়ে যায় দূর থেকে দূর অজানায়। মেঘ দেখলে বিভার কথা বেশি করে মনে পড়ে। ও বৃষ্টি দেখলেই হয়ে যেত চঞ্চলা ডাহুক পক্ষী। বৃষ্টিতে ভেজা ওর কাছে রোমাঞ্চের মতো ছিল।

‘এখনো তুমি বৃষ্টিস্নাত হও রোজ
বৃষ্টি বেলায় আমার মনের একটু রাখো খোঁজ’?

আপনা আপনি বেরিয়ে পড়ে কবিতার দুটো চরণ। যে চলে গেছে চোখের আড়ালে তাকে মনের মাঝে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে রাখতে হয়। বিভার কপালের লাল টিপটা এখনো আছে বিহানের ডায়েরির পাতার ভাঁজে। মাঝে মাঝে ডায়েরির পাতা উল্টে টিপটা স্পর্শ করে। তাতে সে বিভার ছোঁয়া পায়। কোনো এক বসন্তে উষ্ণ ঠোঁটে কপাল ছুঁয়েছিল বিভার। তখন টিপটা বিহানের ঠোঁটে লেগে গিয়েছিল। লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। আজও বিভা জানল না সে কথা।

বিদায়ি সূর্যটা যাই যাই করছে। পাখিরা ডানা মেলে উড়ে ফিরছে নীড়ে। কখনো ঝাঁকবেঁধে। আবার কোনো পাখি দলছুট একাকী। বিহান যেন নিজের সঙ্গে দলছুট ভাতশালিকটার সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দলছুট হতে হয়। এ তো অনিবার্য। এমন ভাবতে ভাবতেই বিহানের চোখ আটকে গেল বট গাছটায়। তার তলে একটা মেয়ে পায়চারি করছে। লাল সালোয়ার-কামিজের মেয়েটি ঘন সবুজ চত্বর মিলে মনে হচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিছুটা এগিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়াল মেয়েটি। তার শরীরী ভাষা বলছে সে কারও জন্য অপেক্ষারত। বিহানের বুকের বা পাশটা কেঁপে উঠল। তাকে এমন চেনা চেনা লাগছে কেন? মেয়েটির এলো চুল উড়ছে বাতাসে। উড়ছে ওড়নার প্রান্তদেশ।

বিহান গুটিগুটি পায়ে কখন যে মেয়েটির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি টের পায়নি।
ইক্সকিউজ মি! বিহানের কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকাল মেয়েটি। দুজনই বাকরুদ্ধ, বজ্রাহত।
প্রথমে বিভা কিছু বলতে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কেউ ডাকলে ‘মা’।

বিভার চার বছরের মেয়ে বিভার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বাবার হাত ধরে হাঁটছে। কিছু দিন আগে বান্দরবান জেলার ডিসি হিসেবে জয়েন করেছে বিভার স্বামী। ছুটির দিন তারা বেরিয়েছে শহর দেখতে।
বিভা এগিয়ে গেল স্বামী সন্তানের দিকে। বিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বিভাব চলার ছন্দ নির্ণয় করতে লাগল।
মনে মনে বলল,

যতটুকু আলোড়নে কেঁপে ওঠে বুক
কেঁপে ওঠে বুকের ঠিক বাম
যতটুকু আঘাতে জল গড়ায় চোখে
অশ্রু দিয়েছি ডাকনাম।

ততক্ষণে গোধূলির ধূসরতা প্রকৃতির ছেড়ে বিহানের বুকে নেমেছে। প্রদোষকাল যাপন করছে নির্ঘুম চোখ। তোমার কপালের টিপ আমার আঁধারকে আরও গাঢ় করুক। কপালের টিপ আমার একমাত্র বিত্তহীন বৈভব। এক জীবনে সাধের শৈল্পিক বেসাতী।

গাজাকে কেন এত ‍গুরুত্ব দিচ্ছি

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
গাজাকে কেন এত ‍গুরুত্ব দিচ্ছি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

কারণ, মাঝরাতে বুকে কষ্ট চেপে উন্মাদের মতো 
অন্য আরেকটা নিরাপদ তাঁবু খুঁজতে আপনাকে 
হন্যে হয়ে পাগলের মতো দৌড়াতে হয়নি – 

সৌভাগ্যবশত, আপনি ও আপনার পরিবার 
বৃষ্টির মতো বর্ষিত বোমায় 
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি

গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি আপনার বাড়ি
ছিনিয়ে নেওয়া হয়নি আপনার শৈশবের স্মৃতি 
মানুষের পোড়া মাংসের গন্ধে 
অপবিত্র করা হয়নি এরকম পবিত্র ভূমি

অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

ইয়াহিয়া লাবাবিদি
সমকালের আমেরিকান-ফিলিস্তিনি প্রখ্যাত কবি। এ পর্যন্ত কবিতা ও প্রবন্ধের ১১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লন্ডন ম্যাগাজিন ও ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডেসহ অসংখ্য অভিজাত ও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার জন্য পেয়েছেন পুরস্কার।

গাজার জন্য একটি কবিতা, ফিলিস্তিনের জন্য একটি কবিতা

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩২ পিএম
আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
গাজার জন্য একটি কবিতা, ফিলিস্তিনের জন্য একটি কবিতা
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

গাজা, সবশেষে তোমার যা দরকার তা হলো একটি কবিতা।  
বলো আর কী চাই তোমার!
আমার তো অন্য কিছু দেওয়ার নেই। কবিতা শুধু কবিতাই…
কবিতা কীই-বা করতে পারে? বলো তো!
কিন্তু আর কিছু না হোক, একটি কবিতা না হয় হলে।

তুমি ছিলে উন্মুক্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড, আর
তোমার সমুদ্রে কখনো রক্তস্রোত দেখা যেত না। 
হ্যাঁ, একসময় এরকমই ছিল সবকিছু, 
এই পৃথিবীর কাছে কিছুই চাওনি তুমি, 
পৃথিবীও তোমাকে 
দেয়নি কিছুই।

আমাদের সমস্ত প্রতিবাদী ভাষাকে জড়ো করে আজ 
শূন্য কূপে ফেলে দিচ্ছ।
এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের কানে কিছুই শুনতে চায় না 
সবকিছু লুকিয়ে রাখছে 
আর যখন আবির্ভূত হতে শুরু করে 
তখন বাইরে বেরিয়ে আসে। 

ক্ষতস্থানে যুক্তির প্রলেপ দিয়ে সবকিছু কলুষিত করা হচ্ছে 
আমরা সবাই কথা বলছি, কিন্তু কাজের কাজ 
কিছুই হচ্ছে না।

আমরা সবাই জানি, যা কিছু বলা হচ্ছে তার সবই কথার কথা
তাই কেউ শুনছে না।

বাস্তবে যে ক্ষত দেখা যাচ্ছে, চিন্তা দিয়ে 
তা দূর করা যাবে না। এটা আমরা সবাই জানি-

আমাকে তোমার প্রার্থনায় রেখ না, এবং 
দয়া করে আমাকে আমার সমস্ত অপরাধ থেকে মুক্ত করো।

শিশুদের চিৎকার আর কান্নার উপরে কী
চোখ রেখেই চলব আমি?

আমি চাই আমার কবিতা রক্ত ঝরাক এবং 
আমি বলেই যাব
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা…
আমি চাই তুমি কাঁদো, আমি বলেই যাব 
এখানে একই নামের একটাই ভূখণ্ড ছিল –  
আর সেখানে ছিল সেই ভূখণ্ডেরই সব মানুষ

আপনারা যা করতে চান করেন, কিছুই বদলাবে না – 
একবার তারা অদৃশ্য হয়ে যাবে, আবার তাদের 
আবির্ভাবও ঘটবে

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, গাজা, 
গাজা এরকমই থাকবে।

অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

আহমাদ আলমাল্লাহ
এই সময়ের প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি কবি। দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা ও ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের জন্য পুরস্কার ও ফেলোশিপ পেয়েছেন। বর্তমানে ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স ইন ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ হিসেবে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।  

ধারাবাহিক উপন্যাস মোহিনী

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২২ পিএম
আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪১ পিএম
মোহিনী
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

চতুর্দশ পর্ব

মোহিনীর জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করে দিল করোনা। করোনায় তিনি প্রথমে তার স্বামীকে হারালেন। তার পর হারালেন বাবাকে। এই ক্ষতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়; কিন্তু জীবনের ক্ষতি পোষানো যায় না। যে জীবন একবার নিভে যায় সে জীবনের আলো আর কখনোই জ্বলে না। জ্বালানো যায় না। হইজগতের সব মায়া, সব দেনা-পাওয়া চুকিয়ে তাকে চলে যেতে হয় অনন্তের জগতে। সেই জগৎ সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা নেই। সেখানে মানুষ ভালো থাকে; নাকি মন্দ সে বিষয়েও কেউ কিছু জানে না। কোনোদিন জানতেও পারবে না। জানার কোনো সুযোগ নেই। 

মোহিনী মনে মনে ভাবেন, করোনাকালে আমি আমার সামর্থ্যের বাইরেও অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এখনো নিয়মিতভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। ফ্যাক্টরিগুলোতে উৎপাদন বন্ধ। রপ্তানি বন্ধ। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি ঠিকই দিতে হচ্ছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়লে তাকেও সহযোগিতা করতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি করোনার কারণে যারা কর্মহীন হয়ে খাদ্যসংকটে পড়েছে তাদের খাদ্যসহায়তা দিচ্ছি। অথচ বিধাতা আমাকেই বারবার পরীক্ষায় ফেলছেন। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন। আর কত পরীক্ষা দিতে হবে কে জানে!

মোহিনী ঘরের মধ্যে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলেন। এ সময় আনোয়ারা বেগম তার ঘরে এসে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাকে চিন্তিত দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, মোহিনী কী হয়েছে! 

মোহিনী আনোয়ারা বেগমের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার পর বললেন, আমার খুব অস্থির লাগছে মা। কিছুই ভালো লাগছে না। 

আনোয়ারা বেগম মোহিনীর কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি জানি তোর মন কেন অস্থির। কিন্তু মা, নিয়তির ওপর কারও কোনো হাত নেই। কেন যে বিধাতা এত বড় পরীক্ষায় আমাদের ফেলেছেন তা তিনিই জানেন। আমাদের শুধু ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। একটা ব্যাপার তুই লক্ষ করেছিস!

কী মা?

বিধাতা যা কিছু করেন সবই নাকি ভালোর জন্য করেন। দেখ, তোর বাবা তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ট্রাস্টি বোর্ডে লিখে দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেলেন! করোনা একটি উছিলা। হয়তো বিধাতা চান, আমরা নিজেদের মানবকল্যাণে নিয়োজিত করি! 

মোহিনী সহমত পোষণ করে বললেন, হতে পারে। কথাটা তুমি মন্দ বলনি মা। 
ধৈর্য ধর মা! আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া কি-ই বা করার আছে!  

ধৈর্য তো ধরছিই মা। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কাজে মন বসে না। এ কী হলো মা!
প্রকৃতির কী খেয়াল কে জানে! 

দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোহিনী। আনোয়ারা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলেন, তুই চা-কফি কিছু খাবি? আনতে বলি?

মোহিনী কোনো কথা বললেন না। তার পরও আনোয়ারা বেগম রহিমাকে ডেকে কফি দিতে বললেন। মোহিনী কোনো আপত্তি করলেন না। তিনি আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ করে বললেন, মা শোন, আমাদের হাসপাতালের কাজটা করছে বিটিআই। ওরা এমনি খুব ভালো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে তারা কাজটা শেষ করবে। তার পরও আমার মনে হয় কী! তুমি যদি মাঝে-মধ্যে একটু তদারকি করে আসো...!

আনোয়ারা বেগম সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি যাব। তুই কোনো চিন্তা করিস না। 
আর মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে ফ্যাক্টরিগুলো দেখতে যেও। ভালো লাগবে তোমার। তাছাড়া সময়টাও কাটবে। 
তা ঠিকই বলেছিস। বাসায় বসে কতক্ষণ কাটানো যায়! 
আরেকটা কথা, আমরা কি একটা মিডিয়া হাউস করতে পারি?
বিস্ময়ের সঙ্গে আনোয়ারা বেগম বললেন, মানে! 
মানে একটা পত্রিকা করতে চাই। 
কী বলিস! ওসব আমরা কি বুঝি?
আমরা তো নিজেরা করব না! আমরা বিনিয়োগ করব। 
হঠাৎ মিডিয়ার ব্যাপারে তোর আগ্রহের কারণ?

কারণ নিশ্চয়ই আছে। দেখ, তুমি আর আমি ছাড়া আমাদের পরিবারে কিন্তু আর কেউ নেই! লোভী মানুষগুলো সারাক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ যদি আমাদের সবকিছু দখল করেও নেয়, তাহলে কথা বলারও লোক থাকবে না! তাছাড়া আল্লাহ না করুক আমাদের যদি কিছু হয়ে যায়! 

অবাক বিস্ময়ে আনোয়ারা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, আমি তো কখনো এভাবে চিন্তা করিনি! তুই ঠিকই বলেছিস মোহিনী! চিন্তার বিষয় বটে!

মোহিনী বললেন, এ কারণেই বিষয়টা আমার মাথায় এল। তাছাড়া আমার এক বন্ধুর কথা তো তুমি জানো। অনেক বড় সাংবাদিক। 
কে আসিফ আহমেদ?
হুম।

তোর বাবাও তার কথা বলত। তার কী অবস্থা রে?

সে তো একটি বড় পত্রিকার সম্পাদক ছিল। এখন নতুন কিছু করার কথা ভাবছে। আমি তাকে দিয়ে একটি পত্রিকা করার কথা চিন্তা করেছি। তুমি রাজি থাকলে তাকে আমি ডাকব। তার সঙ্গে কথা বলব। 
বাসায় ডাক না একদিন। আমিও কথা বলি। 

তার আগে বলো, মিডিয়া করার ব্যাপারে তোমার সম্মতি আছে কি না?
এর পর আর সম্মতি দেওয়ার কিছু আছে? সঠিক ভাবনাই ভেবেছিস মা!
ধন্যবাদ মা। আমি খুব শিগগিরই তাকে ডাকব। আচ্ছা মা, তোমার চা-কফি তো কিছু এল না! ঘটনা কী?
আনোয়ারা বেগম দরাজ গলায় রহিমাকে ডাকেন। রহিমার কোনো সাড়া নেই। তিনি ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যান। মোহিনীও তার পেছনে পেছনে এগিয়ে যান। 

অনেকদিন পর আরেফিনকে স্বপ্নে দেখলেন মোহিনী। তাকে নিয়ে যে তিনি ভেবেছেন তা নয়। ইদানীং তিনি কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সবকিছু একা সামলাতে হচ্ছে তাকে। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তো আছেই; বাবার রেখে যাওয়া সবগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই তাকে দেখভাল করতে হয়। সঙ্গত কারণেই অতিমাত্রায় ব্যস্ত তিনি। এখন আর নিজের জীবন নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। ভাবেনও না। কী হবে ভেবে? যে ভাবনার কোনো কূলকিনারা নেই, সেই ভাবনা ভেবে কোনো লাভ নেই। তিনি ভাগ্যটাকে নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি কাজ করে যাবেন। কাজের মধ্যদিয়েই নিয়তি তার পথরেখা ঠিক করবে। 

তখন শেষ রাত। মোহিনী স্বপ্নে দেখেন, আরেফিন উহান থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে ছুটে যান তিনি। তার হাতে গোলাপের তোড়া। গোলাপ ফুল ভীষণ পছন্দ আরেফিনের। বিমানবন্দরে ফুল হাতে মোহিনীকে দেখে আনন্দে ফেটে পড়েন আরেফিন। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরেন। আরেফিনের উষ্ণতা ভালোবাসায় মোহিনীও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তার পর তার ঘুম ভেঙে যায়। কোনো কথা বলার সুযোগ হয়নি আরেফিনের সঙ্গে। 

ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম হয়নি মোহিনীর। তিনি আরেফিনকে নিয়ে শুধু ভেবেছেন। গভীর ভাবনায় ডুবে গেছেন আরেফিনকে নিয়ে। কখনো স্মৃতিকাতর হয়েছেন। কখনো চোখের পানি ফেলেছেন। আবার কখনো প্রাণ খুলে হেসেছেন। স্বপ্নের মতোই যেন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলেও স্বপ্নের ঘোর তার কাটেনি। ভাবনার মধ্যেই তিনি বলেন, কী গভীরভাবে ভালোবাসত সে আমাকে! কিন্তু বিয়ের পর কেন সে এমন বদলে গেল! নাকি আমার বোঝার ভুল! আমি কি তাকে বুঝতে পারিনি! নাকি সে আমাকে বুঝতে পারেনি! আরেফিন কি আমাকে ভয় পেত? ভয়ের কারণে অনেক কিছু গোপন করত! ভুলটা হয়তো আমার। আমিই তাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। তাকে সময় দিইনি। নিজের কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থেকেছি। হয়তো আমার ওপর অভিমান ছিল তার। তাই সে চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!
চলবে...

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-

পর্ব-১পর্ব-২,  পর্ব-৩পর্ব-৪পর্ব-৫পর্ব-৬পর্ব-৭পর্ব-৮পর্ব-৯, পর্ব-১০পর্ব-১১পর্ব-১২, পর্ব-১৩