
‘ভাষা’ ও ‘স্বাধীনতা’ কবিতার অন্ত্যমিলের মতোই পাশাপাশি দুটি অন্তর্নিহিত শক্তিশালী শব্দ। ভাষা হলো একটি জাতির অস্তিত্ব আর স্বাধীনতা হলো জাতির মুক্তি। বাঙালিরা এই দুটি শব্দের জন্য সংগ্রাম করেছে এবং জীবন দিয়ে। প্রথমেই আসা যাক, কীভাবে ভাষা একটি জাতির অস্তিত্ব বা পরিচয়? ধরুন একটি নদী, কলস্রোতা নদী, ধীরে ধীরে সেই নদীটি পানি হারাচ্ছে, একসময় সেই নদীটি মরে গেল। আসলে পানি ছাড়া নদী বাঁচে না, ভাষাও পানির মতো, জাতির ভাষা হারিয়ে গেলে, সেই জাতি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কীভাবে হারিয়ে যায়? চলুন সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমরা জানি, বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশে ৭ হাজার ৯৯টি ভাষা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ কোনো কোনো দেশে একাধিক ভাষা আছে, খুব কাছে থেকে উদাহরণ দিচ্ছি- আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪২ জন এবং তাদের ২৮টি অঙ্গরাজ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃত ২২টি ভাষা রয়েছে (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)।
১৯৯৪ সালে লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় তার কলকাতার বাসায় আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দেখো পৃথিবীতে তোমরাই একমাত্র সংগ্রামী ও গৌরবান্বিত জাতি, যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছ, সুতরাং ভাষার মর্যাদা যে জাতি দেয়, সে জাতি পৃথিবীতে ভাস্বর হয়ে থাকে’ কথাটি বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে ৫০ বছর পর বাংলা ভাষার প্রচলন থাকবে কি না, এই প্রসঙ্গে। কারণ হিসেবে বলেছেন যে, ‘কখনো কখনো একটি ভাষা অন্য একটি ভাষাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে। যেমন হিন্দির যে প্রভাব ও বিস্তার ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, তাতে আশঙ্কা করছি এখানে বাংলা ভাষা ৫০ বছর বিলুপ্ত হয়ে যায় কি না।’ এই যে বাংলা ভাষার কথা তিনি বললেন, সেটির ত্যাগ ও মহিমার কথা একবার চিন্তা করুন সবাই।
আমরা সবাই জানি, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ: পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার পুরো পাকিস্তানের সব ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ মাতৃভাষা বাংলার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। শহিদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহিদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন, শহিদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়’।
এখন আমাদের করণীয় কী? করণীয় হলো- সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। শুদ্ধ বাংলা চর্চা করা, কথনে, পঠনে ও লিখনে বাংলাকে সুন্দর করে যত্ন করা। এই যত্নে অবহেলা করা যাবে না। কারণ মনে রাখতে দুটি কথা- ১. এই ভাষা প্রতিষ্ঠা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে ও ২. ভাষার মর্যাদা না দিলে, চর্চা না করলে, মায়ের মলিন মুখের মতোই হয়ে যাবে, জলবিহীন নদীর মতোই ধীরে ধীরে মরে যাবে। মনে রাখতে হবে ভাষা জাতির আত্মা। আমরা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভাষা ব্যবহার করব, তবে তা মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে বা অপমান করে নয়। হাজার বছরের লালিত নিজস্ব পরিচয়ের শক্তি ভাষাকে পাশ কাটালে, নিজেকেই ঠকানো হবে। শিশুরা যেমন দুধ খেতে মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে, তেমনি ভাষাও শিশুর মতো, তাকে হাতে হাতে পরম্পরায় না রাখলে, সে অভিমান করে, পালিয়ে অগোচরে। ভাষা প্রাণ, ভাষা প্রাণ। তাকে জীবিত রাখতে হয়। ভাষার এই জীবনের নাম আদর। তাই আসুন ভাষাকে আদর করি- ভাষা ও দেশ, মায়ের নন্দিত মুখ। ভালোবাসি দেশ, স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ।