হাওলাদার বাড়ির ছেলে জয়েন। মামারা তালুকদার। শৈশবের স্মৃতি মনে করতেই জয়েন হাওলাদার কেমন নড়েচড়ে বসে। জয়েনকে সবাই জনা বলে ডাকে। এলাকার মানুষের মঙ্গলের জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা সে করে না। এজন্য গ্রামে গরিবদের কোনো সমস্যা হলেই ছুটে আসে তার কাছে। বিশেষ করে কৃষকরা তার কাছে আসে ভূস্বামী ও সামন্তবাদীদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে। অন্তজ্য শ্রেণির মানুষ মনে করে জনার কাছে গেলে সে কিছু একটা করবে।
একসময় সাধারণ মানুষের দিপদে ও অধিকারের কথা বলতে গিয়ে লাখো মানুষের নেতা হয়ে যায় জয়েন হাওলাদার। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। জয়েন শুনেছে, দাদার আমলে তাদের অনেক জমিজমা ছিল। বাবার সময় থেকে একটি ভিটে আর দুই বিঘে জমিই সম্বল। এনিয়ে কোনো ভাবনা নেই তার। গরিবদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ নেওয়াই যেন তার কাজ। নিজেকে নিয়ে সুখ খোঁজে না কখনো। যেখানেই কৃষকদের সঙ্গে ভূস্বামীদের অনিয়ম সেখানেই জয়েন কৃষকদের হয়ে নেতৃত্ব দেয়। শোষকদের বিরুদ্ধে কথা বলে। সংগ্রাম জয়েনের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
তখন অবিভক্ত বাংলা। ইংরেজদের হাতে ভারত উপমহাদেশ। সব জায়গায় শুধু সাদা চামড়ার মানুষের দাপট। ওদের বিরুদ্ধে কেউ সঠিক কথা বলতে পারে না। রাজা প্রজাদের ওপর যে শোষণ-নিপীড়ন চালায় তা দেখে জয়েন চুপ থাকতে পারে না। সে প্রতিবাদ করে। কেউ কৃষকদের হয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই জেল-হাজতে পুরে ইংরেজ প্রশাসন। তাতে কী? জয়েন ভয় পায় না।
একের পর এক জয়েনের ওপর গ্রেপ্তার আর নির্যাতনের ফলে সে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে কৃষক আন্দোলনে। চারদিকে ভারত থেকে ব্রিটিশ তাড়াও আন্দোলন। স্বাধীনতাকামীরা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। কখন স্বাধীন ভারতের পুব আকাশে নতুন সূর্য উদিত হবে। হিন্দু-মুসলিমদের অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে ভারত উপমহাদেশ। পরাধীন জীবন বড়ই বেদনার। সেই জীবনে আলোর মুখ দেখতে পায় না কেউ।
জয়েন হাওলাদার তখনো বিয়ে থা করেনি। খুবই তেজি, উদ্যোমী আর পরিশ্রমী। সংসারে মা ও দুই বোন। মায়ের বয়েস ক্রমেই বাড়ছে। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মা জয়েনকে বিয়ের জন্য তাগিদ দেন। সেদিকে খেয়াল নেই জয়েনের। তার একটাই কাজ গণমানুষের অধিকার ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করা। কীভাবে রাজ্যের কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন করা যায় তা নিয়েই তার ভাবনা।
দলে জয়েনের দায়দায়িত্ব বাড়তে লাগল। নেতা-কর্মীরা তার ওপর নির্ভর করতে লাগল। রাজ্যের বিশাল এক এলাকা নিয়ে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দলে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করল জয়েন।
মায়ের মৃত্যুর ছয় মাস আগে বিয়ে করল জয়েন। জয়েনের বয়সের তুলনায় স্ত্রীর বয়স খুব কম। বিয়ের প্রথম প্রথম সপ্তাহখানেক স্ত্রীকে সময় দিয়েছে। পার্টি অফিসে যাওয়ার কারণে স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না। জয়েন মায়ের খুব ভক্ত ছিল। মতিবিবি সারা জীবন জয়েনকে বুকে আগলে রেখেছে। ছেলের কিছু হলে মা সইতে পারত না।
মতিবিবি একদিন বললেন, জয়েন তুই তো এখন কৃষকদের অধিকার নিয়ে কথা বলিস। গরিব-দুখির সেবা করিস। আমার না খুব ভালো লাগে। তোর বাবাও এমন ছিল। আমার ঘরে ভালো খাবার না জুটলেও তোর কর্ম আমার খুব পছন্দ। বাবা, নেতৃত্ব দিতে গেলে বাধা আসবেই। পিছিয়ে থাকলে চলবে না।
মা তোমার দোয়া আর মানুষের ভালোবাসাই আমার পুঁজি। আমার প্রচুর অর্থ-সম্পদ নেই। গরিব কৃষকদের ভালোবাসা আছে।
বাবা, সাবধান! ওই ব্রিটিশরা খুবই ভয়ংকর। বিনা কারণে মানুষকে ফাঁসি দেয়।
দেশ ও দশের ভালোর জন্য ফাঁসির কাষ্ঠে যেতেও আমি রাজি, মা।
বেনিয়ারা আমাদের দেশে এসেছিল বাণিজ্য করবে বলে। ধীরে ধীরে ভারতবাসীর সরলতার সুযোগ নিয়ে পুরো দেশটাই দখলে নিয়ে নিল।
মা, ওদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আর আমাদের মধ্যে ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। না হলে ওরা এত বড় দেশ কখনোই দখলে নিতে পারত না।
আজ আমরা পরাধীনতার স্বাদ নিচ্ছি।
জয়েন, এই ভারতবর্ষ আবার স্বাধীন হবে। ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবই আমরা।
তাই যেন হয়, মা।
জয়েন প্রিয়তমা নিলুফাকে তখনো স্ত্রী হিসেবে মনে করেনি। বন্ধু ভেবে ভালোবেসেছে। একদিন দূরের হাট থেকে কত গয়নাঘাটি কিনে এনেছে। ওর হাতে দিতে পারেনি লজ্জায়। পরে মতিবিবিই সেসব নিলুফার হাতে তুলে দেয়। মা-ও মনে মনে খুশি।
এরই মধ্যে আবার কৃষকদের ওপর ভূস্বামীদের অত্যাচার। জয়েন আন্দোলনের ডাক দিলেন। ক্ষেপে গেল সামন্তবাদী ও অত্যাচারী জমিদাররা। কঠিন এক ষড়যন্ত্রে ফেঁসে গেল জয়েন। ওপর থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের নির্দেশ হলো। গরিব প্রজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকে আহত হলো। নিহত অনেকে। জয়েনকে যেতে হলো জেলে। বিচলিত হয়নি সে। কৃষকদের ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়ে গেল।
জয়েন জেলে যাওয়ার পর অনেক সময় পার হয়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর জেলজীবনে কতকিছু অতীত হয়েছে তার। কত ভাবনা এসে জড়ো হয়েছে।
জড়ো হয়েছে বাড়িতে বৃদ্ধা মা কেমন আছেন, নিলুফা কেমন আছে, গ্রামের গরিব প্রজারা কেমন আছে। কৃষকরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে মাঠে-ময়দানে সংগ্রাম করতে পারছে তো?
মনের ভেতর হাজার চিন্তা থাকলেও একাকিত্ব জয়েনকে কাবু করতে পারেনি। জেলে ব্রিটিশবিরোধী কত নেতা। সবার এক দাবি- নিম্নশ্রেণির অধিকার। প্রান্তিক মানুষের অধিকার। সর্বপরি দেশের স্বাধীনতা লাভ। কারাগারে জয়েনকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তবুও গরিব কৃষক, নিজ পরিবারের কথা ভোলেনি একদিনের জন্য। নিলুফা কেমন আছে- খুব করে ভাবিয়েছে তাকে।
মতিবিবি একদিন নিলুফাকে বলেন, মা জানি খুব কষ্ট হয় তোমার। মা হয়ে আমার যে কিছুই করার নেই। ধৈর্য ধারণ কর। দেখ কী হয়। নিশ্চয়ই জয়েন ফিরে আসবে। ওর কাছে মানুষের অধিকার আগে।
আমাকে নিয়ে কষ্ট হয় না, মা। কষ্ট হয় আপনার ছেলেকে নিয়ে। ব্রিটিশরা আপনার ছেলেকে বাঁচতে দেবে তো?
সবই আল্লাহ জানে। শুধু ওর জন্য দোয়া করো। সৃষ্টিকর্তা যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।
কিন্তু বিধিবাম! ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার কয়েক বছর পরেই জয়েন কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ছুটে যায় কৃষকদের মাঝে। গরিব কৃষক জয়েনকে পেয়ে খুব খুশি হয়। তার পর ছুটে গেল বাড়িতে। বাড়ি কেমন খাঁ খাঁ করছে। মা বেঁচে নেই। নিলুফা চলে গেছে নতুন এক সংসারে। ভেঙে পড়ে জয়েন। কষ্টে ভেতরে হাহাকার করছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি। জয়েনের বড় ভাইয়ের মেয়ে আরজু মনের অবস্থা বুঝতে পারলেও চাচা জয়েনকে কিছু বলতে পারেনি। কয়েক বছর এদিক-সেদিক ঘুরেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। জেলার কৃষকদের নিয়ে নতুন করে সংগঠন করেছে। অথচ ঘর ফাঁকা। মা নেই। প্রিয় স্ত্রী নেই। ঘরে তার মন টেকে না। একদিন এক নেতার পীড়াপী ড়িতে জয়েন আবার বিয়ে করে। সংসারজুড়ে দুই ছেলে। তার পরও যেন কোথাও একটা ফারাক। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিলুফার জায়গায় স্থান দিতে পারেনি জয়েন। ঘরে এলে মনমরা হয়ে থাকে। মাকনূর জয়েনকে বলে, আপনার কী হয়েছে? ঘরে এলে চুপচাপ থাকেন।
তেমন কিছু না।
শুনেছি আপনার প্রথম বউয়ের কথা এখনো ভুলতে পারেন নাই। আমার ভেতরে কী আপনি তারে খুঁইজা পান নাই? আমার বাবার অনেক টাকা নাই। তয় আমার একটা মন আছে। সেই মনের ভেতর আপনারে সারা জীবন ধইরা রাখতে পারব।
জয়েন কোনো কথা বলে না। চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ে। জয়েনের দুই ছেলে পড়ালেখা শিখে বড় হয়। দুজনেরই চাকরি হয়। ওদের ঘর-সংসার হয়। আবার আগের মতো ঘর আলোয় আলোয় ভরে যায়। শুধু জয়েনের ভেতরেই গভীর অন্ধকার। সংগঠনের কাজে কত রাজ্যে গেছে সে। কত জায়গায় ঘুরেছে। অন্তর চোখ দিয়ে নিলুফাকে খুঁজেছে। পায়নি। জয়েন শরীরে আগের মতো শক্তি পায় না। বেশির ভাগ সময় ঘরেই বইপত্তর, সংবাদপত্র পড়ে সময় কাটায়। কৃষক আন্দোলনের নেতারা তার বাসায় আসে। তাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। কেটে যায় সময়। একদিন জয়েনের ভাইয়ের মেয়ে আরজু এসে বলে, কাকা আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
কী কথা, মা?
নিলুফা কাকিমাকে খুঁজে পেয়েছি।
বলিস কী!
হ্যাঁ। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে কাকিমার সন্ধান পেয়েছি।
নিলুফা তাহলে বেঁচে আছে। কীভাবে সন্ধান পেলি, মা?
আমার এক লেখক বন্ধুর মাধ্যমে। কাকিমারও বিশাল সংসার। ছেলেমেয়ে আছে। নাতিপুতি আছে। তবে ভালো নেই কাকিমা। বয়সের ভারে নুয়ে গেছে।
আর কত? সময় দ্রুত চলে যায়। মনে হয় এই তো সেদিন। অথচ সত্তর বছর অতিক্রম করল মনের অচিনপাখি। জয়েন বলে।
কাকিমা নিলুফার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে আরজু। নিলুফার ছেলে ফিরোজ বাদ সাধল না জয়েন ও নিলুফার সাক্ষাৎ করানোর বিষয়ে। আবার নতুন করে আশার চর জেগে ওঠে জয়েনের মনের ভেতর। যদি একবার নিলুফার দেখা পায়। কিন্তু কীভাবে তার সামনে যাবে সে?
ভাবে।
নিলুফা যদি জয়েনের সামনে না আসে। দেখা না দেয়। নিজেকে অপরাধী ভাবে জয়েন। কয়েকদিন ধরে ঘুম নেই জয়েনের। দেখতে দেখতে মাসের এক শুক্রবারে তাদের মধ্যে দেখা হয়। জয়েন নিলুফার বাড়ি গিয়ে দেখে তার কোনোকিছুতে অভাব নেই। বিশাল ঘর, বাগান, পুকুর। আম-কাঁঠালের গন্ধে পুরো বাড়ি যেন ম ম করছে। পাখির কিচিরমিচির মনকে আরও উদ্বেলিত করে। জয়েন নিলুফার রুমে ঢোকে। একপলক ওকে দেখতেই জয়েন চিনে ফেলে। পাশাপাশি বসে। যেন ওর ষোড়শীর চপলতা নেই। জামের রসের মতো টসটসে ঠোঁট নেই। চোখের দৃষ্টিতে আবেদন নেই।
যা কিছু আছে তা ঝরা পাতার ঘ্রাণ। তবুও সেই ঘ্রাণ বারবার প্রাণ ছুঁয়ে যায়। তাদের একরুমে দিয়ে আরজু ও ফিরোজ পাশের রুমে চলে যায়। জয়েন ও নিলুফার বুকে জমে থাকা কত কথা হয়। কিন্তু কথায় আর প্রাণ ফিরে আসে না। দুজনারই আলাদা আলাদা সংসার। জয়েন নিলুফার মাথায় হাত রাখে। নিলুফা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে।
জয়েন নিলুফাকে বলে, তুমি কেমন করে পারলে? কেমন করে পারল তোমার বাবা-মা? কীভাবে বেঁচে আছি জানতে চাইবে না আজ?
বিশ্বাস কর, আমার কোনো দোষ ছিল না। সেদিন বাবা-মায়ের মুখের ওপর আমি কিছুই বলতে পারিনি।
বুঝেছি। তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে আমিও আবার নতুন সংসার গড়েছি। কিন্তু মনের মণিকোঠায় তোমাকে ছাড়া কাউকে ঠাঁই দিতে পারিনি। তুমিই যে আমার একজনমের সঙ্গী। আমি ভাবতেও পারিনি তোমার দেখা পাব। মুখোমুখি বসব। ভাতিজি আরজুর মাধ্যমে তোমার দেখা পেয়েছি।
নয়নভরে দেখছি তোমাকে। তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?
না। যে জীবনে আমি তোমার হইনি সে জীবনে সুখ-দুঃখের কাব্য শুনিয়ে আর কী লাভ। যাক সে কথা। তুমি কেমন আছ? নিলুফা বলে।
তোমাকে ছাড়া যেমন থাকা যায়। জানো, তোমাকে না পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর সংসার গড়ব না।
তা কী হয়। মাকনূর কেমন আছে?
যেমনটা তুমি আছ।
বিয়ে করে ভালো করেছ। এই বয়সে তোমাকে কে দেখভাল করত? জয়েন আমাকে ক্ষমা করে দিও।
না না। কী বলছ। তোমার তো কোনো দোষ ছিল না।
জানো জয়েন, আমার এক-একটি রাত বড়ই বিষাদময় হয়ে ওঠে। আমার চারপাশে সবুজ প্রকৃতি অথচ ভেতরে ধু ধু বালুচর। শুধুই হাহাকার। ভেতরে একটা দাগ আছে। অনেক চেষ্টা করেও মুছতে পারিনি। জয়েন তোমার মা বেঁচে আছে?
না। জয়েন বলে।
বিচ্ছেদের সত্তর বছর পর আবার আমাদের দেখা হলো। কথা হলো। বিধাতার কী নিয়ম। তাই না?
নিলুফা আজ তাহলে আসি?
আসবে? আর একটু বসে গেলে হতো না। কত যুগ পরে তোমাকে দেখেছি। আবার কী আমাদের দেখা হবে না?
জয়েনের দুচোখের কোনায় জল। নিলুফা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জয়েনের পথ...।