
সন্ধ্যা নামার তখনো খানিক বাকি। অস্তগামী সূর্যটা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো আর রঙের ফোয়ারা। ভরদুপুরের মতো সে আলো তাতিয়ে তোলার মতো নয়। আবার নয় ক্লান্ত পথিকের মতো ম্রিয়মাণ। ভ্রমণক্লান্ত সূর্যটা ততক্ষণে শরীর থেকে খসিয়ে ফেলেছে সবটুকু তেজোদীপ্ত প্রলেপ। তেজটুকুন এখন পোড়ানোর পরিবর্তে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ি বৃক্ষশাখায় পড়েছে তার স্নিগ্ধ আবির। সদ্য গজিয়ে ওঠা কলাপাতা ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি নববধূর মতো সরিয়ে ফেলা অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে উন্মোচন করেছে পেলব দেহশ্বৈর্য। বহুদিন পর এমন বিকেলের রূপ ঐশ্বর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারল না বিহান। হবেই বা না কেন? এমন একটা স্নিগ্ধ বিকেল ভাগ্যক্রমে জোটে। নাগরিক ঠাসবুননের ভিড়ে বারো মাস নিজেকে এক অর্থে বন্দি করে রাখে। বেড়াতে এল বলেই না এমন সুন্দরের সাক্ষী হতে পারল। এক তলা সুরম্য হোটেল-লাগোয়া ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে এক অর্থে গুনগুনিয়ে উঠল,
এখন যদি সন্ধ্যা নামে পথে, ক্ষতি কী বলো তুমি তো
রয়েছো সাথে…
চারদিকে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। নিসর্গ প্রসাধন চর্চা করে অষ্টাদশী নারী মূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে আছে বিহানের সামনে। ছুঁয়ে দিতে মন চায় গভীর তৃষ্ণায় যেমন নদী ছোঁয় সাগর মোহনাকে।
কী রহস্য লুকায়িত আছে আজকের বিকেলে? পুলক বোধ করল বিহান। কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। হালকা বাতাসের দোলার ফাঁকে ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে পাতাদের আড়াল ভেদ করে। যেমন পালকির ভেতর থেকে উঁকি দেয় অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নববধূ।
চিরচেনা মলচত্বরের কথা মনে পড়ল বিহানের। সোনালি সেই দিনগুলোতে মলচত্বরের নৈসর্গিক চাতুর্যে বিহান বিভা হারিয়ে যেত। নিসর্গের সে ছাতার নিচে বসে কত দিন কেটেছিল কথার পর কথামালা গেঁথে।
একেবারে সাদামাটা ঘাসফুলের জীবন ছিল তার। সাধারণ সে জীবনে প্রাচুর্য নিয়ে এসেছিল বিভা নামের মেয়েটি। বিভার বাসা ছিল উত্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া-আসা করত সে। বিহান থাকত সূর্যসেন হলে। রোজ বিভাকে বাসে তুলে দিয়ে নিজের হলে ঢুকত। আজ এত বছর স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টে দিচ্ছে যেন কোনো অদৃশ্য হাত।
কদম গাছের ডালে ডালে কদমের কুড়ি ফুটতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরই বর্ষাকাল। তারই আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে। তারই আয়োজন কদমের ডালে। আষাঢ় মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে কদমের সঙ্গে পাতার বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য দেখার মতো হয় নিশ্চয়ই। কর্তব্যের ঘেরাটোপ আর নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গেছে মহুয়া মাতাল ভালোলাগাগুলো। সে জন্যই ইচ্ছের পালে হাওয়া লাগিয়ে আজকের এই বেরিয়ে পড়া। পুরানো স্মৃতির অ্যালবাম উল্টাতেই চোখে ভেসে আসে রঙিন সব অতীত চিত্রকল্পেরা।
সবুজ চত্বরঘেরা সেই চির নবীন মলচত্বরে হাতে হাত রাখতে কেউ। বিকেলের শেষ আলোকে সাক্ষী রেখে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছিল কেউ। সে কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় বুনো এক কাঠঠোকরা যেন ঠোকরাতে শুরু করল।
সে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল একটি হলদে রঙের পাতার ভূপাতিত হওয়ার দিকে। বোঁটা থেকে যে পাতাটি এইমাত্র খসে পড়ল, ওই ঝরা পাতার মতোই কেউ তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। অপূর্ণ সে দীর্ঘশ্বাসটা ঝুলিয়ে দিল বিদায়ি বসন্তের বৈকালিক বাতাসের কার্নিশে। যে মানবী একদিন চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে যেত, সে নিজেই বিহানকে মনের আড়াল করে বসে আছে।
কীভাবে পারল! এ প্রশ্নটি পাঁচ বছর ধরে ঘুরছে তার মনে। কতদিন দেখা হয় না দুজনের। অথচ, তার সঙ্গে মানসিক সংসার বিহানের। সেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব শূন্য। তবুও কেউ কেউ অদ্ভুতভাবে ভালোবাসাগুলো বাঁচিয় রাখে। বিহান তেমনি একজন।
কী-ই বা করত বিভা? কোনো উপায় ছিল না তার। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে সে। বাবা-মা ভালো পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিহান তখন মাত্র থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে ফোর্থ ইয়ারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। গ্রাম থেকে নগর প্রকোষ্ঠে পা রেখেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। নীড়হারা বিচলিত পাখির মতো গহিন অরণ্যের অন্বেষণ করাই ছিল তার কাজ। বেকার ছেলের সঙ্গে প্রেম কোন বাবা-মা মেনে নেয় এই সমাজে? তাই হয়তো বিহানও ধরে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করেনি। আজ কর্ম-কোলাহল থেকে একটু অবসর তাকে অতীতচারী করে তুলল। তার সঙ্গীরা বের হলেও সে যায়নি।
দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি থেকে রেহাই পেতে সে ঘুমকেই সঙ্গী করেছিল। আজ আধুনিক বাংলোর সুরম্য বারান্দায় তাকে স্মৃতির আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পাহাড়ের বুকচিরে বেরিয়ে পড়া ঝরনা ধারায় ভিজতে ভীষণ ভালো লাগত বিভার।
‘চলতে চলতে খাড়া পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে যাবে ডানপিটে দস্যিপনায়।’ এমন কথা প্রায়ই বলত বিভা।
স্মৃতি আর বিস্মৃতি, ব্যথা আর কথার দ্বৈত মিশেলে বেশ জমিয়ে রাখত বিকেলগুলো। স্পর্শহীন কিছু অনুভূতি থাকে, যাকে স্পর্শের বাইরে চিন্তা করলে এক চিন্তাতীত জগতের সৃষ্টি হয়। তেমনটাই হলো বিহানের। বর্ষিয়ান চাম্বুল গাছটা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সভ্যতার শেষ ছায়া। এমন আধ্যাত্মিক আবহে সে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখে নিজেকে। কেমন একটা চেনা চেনা ঘ্রাণ এসে তার নাসারন্ধ্র উসকে দেয়। পাশেই হাস্নাহেনা ফুলের গাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি গোছের পাপর গাছ। তার শরীর জড়িয়ে তরতর করে ওপরে উঠেছে কিছু লতাগুল্ম। গাছটাও তাদের উদ্যত আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মাতৃআবেগে। বিহান একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশজুড়ে থোকা থোকা ইতস্তত মেঘ। কিছু দিন ধরে মেঘেদের আনাগোনা চলছে। এমন মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না। এ মেঘ চঞ্চলতা ছড়ায়। অদ্ভুত চপলতায় হারিয়ে যায় দূর থেকে দূর অজানায়। মেঘ দেখলে বিভার কথা বেশি করে মনে পড়ে। ও বৃষ্টি দেখলেই হয়ে যেত চঞ্চলা ডাহুক পক্ষী। বৃষ্টিতে ভেজা ওর কাছে রোমাঞ্চের মতো ছিল।
‘এখনো তুমি বৃষ্টিস্নাত হও রোজ
বৃষ্টি বেলায় আমার মনের একটু রাখো খোঁজ’?
আপনা আপনি বেরিয়ে পড়ে কবিতার দুটো চরণ। যে চলে গেছে চোখের আড়ালে তাকে মনের মাঝে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে রাখতে হয়। বিভার কপালের লাল টিপটা এখনো আছে বিহানের ডায়েরির পাতার ভাঁজে। মাঝে মাঝে ডায়েরির পাতা উল্টে টিপটা স্পর্শ করে। তাতে সে বিভার ছোঁয়া পায়। কোনো এক বসন্তে উষ্ণ ঠোঁটে কপাল ছুঁয়েছিল বিভার। তখন টিপটা বিহানের ঠোঁটে লেগে গিয়েছিল। লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। আজও বিভা জানল না সে কথা।
বিদায়ি সূর্যটা যাই যাই করছে। পাখিরা ডানা মেলে উড়ে ফিরছে নীড়ে। কখনো ঝাঁকবেঁধে। আবার কোনো পাখি দলছুট একাকী। বিহান যেন নিজের সঙ্গে দলছুট ভাতশালিকটার সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দলছুট হতে হয়। এ তো অনিবার্য। এমন ভাবতে ভাবতেই বিহানের চোখ আটকে গেল বট গাছটায়। তার তলে একটা মেয়ে পায়চারি করছে। লাল সালোয়ার-কামিজের মেয়েটি ঘন সবুজ চত্বর মিলে মনে হচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিছুটা এগিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়াল মেয়েটি। তার শরীরী ভাষা বলছে সে কারও জন্য অপেক্ষারত। বিহানের বুকের বা পাশটা কেঁপে উঠল। তাকে এমন চেনা চেনা লাগছে কেন? মেয়েটির এলো চুল উড়ছে বাতাসে। উড়ছে ওড়নার প্রান্তদেশ।
বিহান গুটিগুটি পায়ে কখন যে মেয়েটির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি টের পায়নি।
ইক্সকিউজ মি! বিহানের কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকাল মেয়েটি। দুজনই বাকরুদ্ধ, বজ্রাহত।
প্রথমে বিভা কিছু বলতে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কেউ ডাকলে ‘মা’।
বিভার চার বছরের মেয়ে বিভার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বাবার হাত ধরে হাঁটছে। কিছু দিন আগে বান্দরবান জেলার ডিসি হিসেবে জয়েন করেছে বিভার স্বামী। ছুটির দিন তারা বেরিয়েছে শহর দেখতে।
বিভা এগিয়ে গেল স্বামী সন্তানের দিকে। বিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বিভাব চলার ছন্দ নির্ণয় করতে লাগল।
মনে মনে বলল,
যতটুকু আলোড়নে কেঁপে ওঠে বুক
কেঁপে ওঠে বুকের ঠিক বাম
যতটুকু আঘাতে জল গড়ায় চোখে
অশ্রু দিয়েছি ডাকনাম।
ততক্ষণে গোধূলির ধূসরতা প্রকৃতির ছেড়ে বিহানের বুকে নেমেছে। প্রদোষকাল যাপন করছে নির্ঘুম চোখ। তোমার কপালের টিপ আমার আঁধারকে আরও গাঢ় করুক। কপালের টিপ আমার একমাত্র বিত্তহীন বৈভব। এক জীবনে সাধের শৈল্পিক বেসাতী।