ঢাকা ১১ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
English

লাল টিপ

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
লাল টিপ
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সন্ধ্যা নামার তখনো খানিক বাকি। অস্তগামী সূর্যটা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো আর রঙের ফোয়ারা। ভরদুপুরের মতো সে আলো তাতিয়ে তোলার মতো নয়। আবার নয় ক্লান্ত পথিকের মতো ম্রিয়মাণ। ভ্রমণক্লান্ত সূর্যটা ততক্ষণে শরীর থেকে খসিয়ে ফেলেছে সবটুকু তেজোদীপ্ত প্রলেপ। তেজটুকুন এখন পোড়ানোর পরিবর্তে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ি বৃক্ষশাখায় পড়েছে তার স্নিগ্ধ আবির। সদ্য গজিয়ে ওঠা কলাপাতা ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি নববধূর মতো সরিয়ে ফেলা অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে উন্মোচন করেছে পেলব দেহশ্বৈর্য। বহুদিন পর এমন বিকেলের রূপ ঐশ্বর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারল না বিহান। হবেই বা না কেন? এমন একটা স্নিগ্ধ বিকেল ভাগ্যক্রমে জোটে। নাগরিক ঠাসবুননের ভিড়ে বারো মাস নিজেকে এক অর্থে বন্দি করে রাখে। বেড়াতে এল বলেই না এমন সুন্দরের সাক্ষী হতে পারল। এক তলা সুরম্য হোটেল-লাগোয়া ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে এক অর্থে গুনগুনিয়ে উঠল,

এখন যদি সন্ধ্যা নামে পথে, ক্ষতি কী বলো তুমি তো
রয়েছো সাথে…

চারদিকে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। নিসর্গ প্রসাধন চর্চা করে অষ্টাদশী নারী মূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে আছে বিহানের সামনে। ছুঁয়ে দিতে মন চায় গভীর তৃষ্ণায় যেমন নদী ছোঁয় সাগর মোহনাকে।

কী রহস্য লুকায়িত আছে আজকের বিকেলে? পুলক বোধ করল বিহান। কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। হালকা বাতাসের দোলার ফাঁকে ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে পাতাদের আড়াল ভেদ করে। যেমন পালকির ভেতর থেকে উঁকি দেয় অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নববধূ।

চিরচেনা মলচত্বরের কথা মনে পড়ল বিহানের। সোনালি সেই দিনগুলোতে মলচত্বরের নৈসর্গিক চাতুর্যে বিহান বিভা হারিয়ে যেত। নিসর্গের সে ছাতার নিচে বসে কত দিন কেটেছিল কথার পর কথামালা গেঁথে।

একেবারে সাদামাটা ঘাসফুলের জীবন ছিল তার। সাধারণ সে জীবনে প্রাচুর্য নিয়ে এসেছিল বিভা নামের মেয়েটি। বিভার বাসা ছিল উত্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া-আসা করত সে। বিহান থাকত সূর্যসেন হলে। রোজ বিভাকে বাসে তুলে দিয়ে নিজের হলে ঢুকত। আজ এত বছর স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টে দিচ্ছে যেন কোনো অদৃশ্য হাত।

কদম গাছের ডালে ডালে কদমের কুড়ি ফুটতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরই বর্ষাকাল। তারই আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে। তারই আয়োজন কদমের ডালে। আষাঢ় মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে কদমের সঙ্গে পাতার বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য দেখার মতো হয় নিশ্চয়ই। কর্তব্যের ঘেরাটোপ আর নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গেছে মহুয়া মাতাল ভালোলাগাগুলো। সে জন্যই ইচ্ছের পালে হাওয়া লাগিয়ে আজকের এই বেরিয়ে পড়া। পুরানো স্মৃতির অ্যালবাম উল্টাতেই চোখে ভেসে আসে রঙিন সব অতীত চিত্রকল্পেরা।

সবুজ চত্বরঘেরা সেই চির নবীন মলচত্বরে হাতে হাত রাখতে কেউ। বিকেলের শেষ আলোকে সাক্ষী রেখে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছিল কেউ। সে কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় বুনো এক কাঠঠোকরা যেন ঠোকরাতে শুরু করল।

সে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল একটি হলদে রঙের পাতার ভূপাতিত হওয়ার দিকে। বোঁটা থেকে যে পাতাটি এইমাত্র খসে পড়ল, ওই ঝরা পাতার মতোই কেউ তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। অপূর্ণ সে দীর্ঘশ্বাসটা ঝুলিয়ে দিল বিদায়ি বসন্তের বৈকালিক বাতাসের কার্নিশে। যে মানবী একদিন চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে যেত, সে নিজেই বিহানকে মনের আড়াল করে বসে আছে।

কীভাবে পারল! এ প্রশ্নটি পাঁচ বছর ধরে ঘুরছে তার মনে। কতদিন দেখা হয় না দুজনের। অথচ, তার সঙ্গে মানসিক সংসার বিহানের। সেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব শূন্য। তবুও কেউ কেউ অদ্ভুতভাবে ভালোবাসাগুলো বাঁচিয় রাখে। বিহান তেমনি একজন।

কী-ই বা করত বিভা? কোনো উপায় ছিল না তার। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে সে। বাবা-মা ভালো পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিহান তখন মাত্র থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে ফোর্থ ইয়ারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। গ্রাম থেকে নগর প্রকোষ্ঠে পা রেখেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। নীড়হারা বিচলিত পাখির মতো গহিন অরণ্যের অন্বেষণ করাই ছিল তার কাজ। বেকার ছেলের সঙ্গে প্রেম কোন বাবা-মা মেনে নেয় এই সমাজে? তাই হয়তো বিহানও ধরে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করেনি। আজ কর্ম-কোলাহল থেকে একটু অবসর তাকে অতীতচারী করে তুলল। তার সঙ্গীরা বের হলেও সে যায়নি।

দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি থেকে রেহাই পেতে সে ঘুমকেই সঙ্গী করেছিল। আজ আধুনিক বাংলোর সুরম্য বারান্দায় তাকে স্মৃতির আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পাহাড়ের বুকচিরে বেরিয়ে পড়া ঝরনা ধারায় ভিজতে ভীষণ ভালো লাগত বিভার।

‘চলতে চলতে খাড়া পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে যাবে ডানপিটে দস্যিপনায়।’ এমন কথা প্রায়ই বলত বিভা।

স্মৃতি আর বিস্মৃতি, ব্যথা আর কথার দ্বৈত মিশেলে বেশ জমিয়ে রাখত বিকেলগুলো। স্পর্শহীন কিছু অনুভূতি থাকে, যাকে স্পর্শের বাইরে চিন্তা করলে এক চিন্তাতীত জগতের সৃষ্টি হয়। তেমনটাই হলো বিহানের। বর্ষিয়ান চাম্বুল গাছটা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সভ্যতার শেষ ছায়া। এমন আধ্যাত্মিক আবহে সে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখে নিজেকে। কেমন একটা চেনা চেনা ঘ্রাণ এসে তার নাসারন্ধ্র উসকে দেয়। পাশেই হাস্নাহেনা ফুলের গাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি গোছের পাপর গাছ। তার শরীর জড়িয়ে তরতর করে ওপরে উঠেছে কিছু লতাগুল্ম। গাছটাও তাদের উদ্যত আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মাতৃআবেগে। বিহান একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশজুড়ে থোকা থোকা ইতস্তত মেঘ। কিছু দিন ধরে মেঘেদের আনাগোনা চলছে। এমন মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না। এ মেঘ চঞ্চলতা ছড়ায়। অদ্ভুত চপলতায় হারিয়ে যায় দূর থেকে দূর অজানায়। মেঘ দেখলে বিভার কথা বেশি করে মনে পড়ে। ও বৃষ্টি দেখলেই হয়ে যেত চঞ্চলা ডাহুক পক্ষী। বৃষ্টিতে ভেজা ওর কাছে রোমাঞ্চের মতো ছিল।

‘এখনো তুমি বৃষ্টিস্নাত হও রোজ
বৃষ্টি বেলায় আমার মনের একটু রাখো খোঁজ’?

আপনা আপনি বেরিয়ে পড়ে কবিতার দুটো চরণ। যে চলে গেছে চোখের আড়ালে তাকে মনের মাঝে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে রাখতে হয়। বিভার কপালের লাল টিপটা এখনো আছে বিহানের ডায়েরির পাতার ভাঁজে। মাঝে মাঝে ডায়েরির পাতা উল্টে টিপটা স্পর্শ করে। তাতে সে বিভার ছোঁয়া পায়। কোনো এক বসন্তে উষ্ণ ঠোঁটে কপাল ছুঁয়েছিল বিভার। তখন টিপটা বিহানের ঠোঁটে লেগে গিয়েছিল। লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। আজও বিভা জানল না সে কথা।

বিদায়ি সূর্যটা যাই যাই করছে। পাখিরা ডানা মেলে উড়ে ফিরছে নীড়ে। কখনো ঝাঁকবেঁধে। আবার কোনো পাখি দলছুট একাকী। বিহান যেন নিজের সঙ্গে দলছুট ভাতশালিকটার সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দলছুট হতে হয়। এ তো অনিবার্য। এমন ভাবতে ভাবতেই বিহানের চোখ আটকে গেল বট গাছটায়। তার তলে একটা মেয়ে পায়চারি করছে। লাল সালোয়ার-কামিজের মেয়েটি ঘন সবুজ চত্বর মিলে মনে হচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিছুটা এগিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়াল মেয়েটি। তার শরীরী ভাষা বলছে সে কারও জন্য অপেক্ষারত। বিহানের বুকের বা পাশটা কেঁপে উঠল। তাকে এমন চেনা চেনা লাগছে কেন? মেয়েটির এলো চুল উড়ছে বাতাসে। উড়ছে ওড়নার প্রান্তদেশ।

বিহান গুটিগুটি পায়ে কখন যে মেয়েটির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি টের পায়নি।
ইক্সকিউজ মি! বিহানের কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকাল মেয়েটি। দুজনই বাকরুদ্ধ, বজ্রাহত।
প্রথমে বিভা কিছু বলতে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কেউ ডাকলে ‘মা’।

বিভার চার বছরের মেয়ে বিভার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বাবার হাত ধরে হাঁটছে। কিছু দিন আগে বান্দরবান জেলার ডিসি হিসেবে জয়েন করেছে বিভার স্বামী। ছুটির দিন তারা বেরিয়েছে শহর দেখতে।
বিভা এগিয়ে গেল স্বামী সন্তানের দিকে। বিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বিভাব চলার ছন্দ নির্ণয় করতে লাগল।
মনে মনে বলল,

যতটুকু আলোড়নে কেঁপে ওঠে বুক
কেঁপে ওঠে বুকের ঠিক বাম
যতটুকু আঘাতে জল গড়ায় চোখে
অশ্রু দিয়েছি ডাকনাম।

ততক্ষণে গোধূলির ধূসরতা প্রকৃতির ছেড়ে বিহানের বুকে নেমেছে। প্রদোষকাল যাপন করছে নির্ঘুম চোখ। তোমার কপালের টিপ আমার আঁধারকে আরও গাঢ় করুক। কপালের টিপ আমার একমাত্র বিত্তহীন বৈভব। এক জীবনে সাধের শৈল্পিক বেসাতী।

শুভ জন্মদিন কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১১:০৭ এএম
কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

লেখার শিরোনাম পড়েই অনেকেই ধন্ধে পড়ে যাবেন, কোন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কথাশিল্পী? বাংলাদেশে একজনই আছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, নতুন দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। নিঃসন্দেহে তিনিই কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সিরাজ স্যার সাহিত্যের প্রথম সোপানে পা রেখেছিলেন গল্প আখ্যানের মাধ্যমে, গত শতকের ষাটের দশকে। প্রায় ৭০ বছর আগে তিনি গল্পের বিস্তারের রেখায় রেখায় নিজেকে পরিস্ফূট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি গল্প-উপন্যাস ছেড়ে প্রবন্ধের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এবং আমরা নিশ্চিত করেই লিখতে পারি, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবন্ধিক বিশ্ব বাংলা সাহিত্যে।

কিন্তু লেখার শিরোনামে যখন কথাশিল্পী শব্দ লেখা হয়েছে, তখন পাঠকের কাছে কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রকাশ করাই শ্রেয়। ‘ভালমানুষের জগৎ’ গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে অনেক আগেই। কথাপ্রকাশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। বইটিতে ১১টি গল্প রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে- একজন গল্পকার হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ইতিহাস আছে। তিনি ‘ভালমানুষের জগৎ’ বইয়ের সেই গল্পের ইতিহাস তুলে ধরেছেন- ‘আজ থেকে একত্রিশ বছর আগে ১৯৮৯ সালে চারটি গল্প নিয়ে বের হয়েছিল এ বইয়ের আদি সংস্করণ। ১২ বছর পরে ২০০১ সালে যখন দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়, তখন আরও পাঁচটি অগ্রন্থিত গল্প যুক্ত করায় গল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় নয়টি। উনিশ বছর পরে আরও দুটি অগ্রন্থিত গল্প যুক্ত করায় গল্প হয়েছে এগারোটি। 

প্রতিটি সংস্করণের পেছনেই একজন প্রকাশকের আগ্রহ কার্যকর ছিল। নতুন সংস্করণে উপস্থিত আছেন কথাপ্রকাশের জসিম উদ্দিন। তাঁকে ধন্যবাদ।’

আমরা কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্পের ইতিহাসটা জেনে গেলাম। গল্পবই ‘ভালমানুষের জগৎ’-এর গল্পগুলোর তালিকার দিকে দৃষ্টি রাখি- সীমান্তে, হারাবার কিছু নেই, পিঠের বোঝা, ভালমানুষের জগৎ, জাহানারার চিঠিপত্র, খেলার সাথী, হাফিজুর রহমানের অগ্রযাত্রা, অভিন্ন, কোনো দাম নেই, কান্না এবং তলোয়ার। অদ্ভুত সরল বাক্যে সহজিয়া অনুভবে সিরাজ স্যার মনোরম ভঙ্গিমায় গল্প লেখেন। পরীক্ষা বা নিরীক্ষার নামে শক্ত তিক্ত বা কঠিন কোনো অনুষঙ্গ নির্মাণ করেন না। ফলে, পাঠকদের গল্প পড়ে যেতে কোনো ক্লেশ বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মধ্যে নিপতিত হতে হয় না। কিন্তু সিরাজ স্যারের গল্পবিশ্বে প্রবেশ করার আগে মনে রাখা দরকার, তিনি অধিকাংশ গল্প লিখেছেন ষাট ও সত্তরের দশকের সময় ও টপভূমি ধারণ করে। তাহলেই পাঠক আর গল্পকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মধ্যে গড়ে উঠবে পাঠ অভিযোজনা। 

চুম্বক আলোচনায় ‘জাহানারার চিঠিপত্র’ গল্পটাই যদি পড়ি, সরকারের আমলাচক্র কীভাবে ক্ষমতার চাবুক চালায় নিরীহ স্ত্রীর ওপর, এবং জীবনের প্রান্তবেলায় এসে স্ত্রীও নিজের মতো করে প্রতিশোধ নেয় কিংবা জীবনের জটিল অঙ্কের সমাধান করে, তারই শিল্পীত প্রতিবিম্ব। প্রত্যেকটা গল্পের মধ্যে চারপাশের দেখা জীবনের আয়নায় গল্পকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিফলিত করেছেন তিক্ত কাঁটার বিষাক্ত প্রতিবেশ। গল্প তো জীবনের গভীর আখ্যান। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দুটি উপন্যাস রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে হায়েনা দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা-  ‘শেষ নেই’। সত্যি, সেই লড়াইয়ের রক্তের জীবন দানের কোনো শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে কিন্তু সবই প্রায় একরৈখিক। যুদ্ধের ডামাডোল, ধর্ষণ আর নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোনের ঝামায় ঘষে ঘষে মুক্তিযুদ্ধের পারিবারিক ও ব্যক্তির লড়াই, রক্তাক্ত পরিস্থিতি একদম তুলে দেওয়া হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘শেষ নেই’ উপন্যাসে একাত্তরের পারিবারিক জীবনের যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দগদগে ঘা, এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের দেশপ্রেমের রসায়নে যুক্ত হওয়া- পাকিস্তানি হার্মাদ সৈন্য ও এদেশীয় নরাধম রাজাকারদের নারকীয় কর্মের বিবরণ আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- এ উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে উপন্যাসিক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক। পাকিস্তানি জেনারেলদের হত্যা তালিকায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামও ছিল। তিনি পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন। নিজের চোখে দেখা ঘটনা ও সরাসরি অভিজ্ঞতার নির্যাস এ উপন্যাস- ‘শেষ নেই’।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় বা শেষ উপন্যাস ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’। কণা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বাঙালির সমাজ ও সংসারে প্রথম শত্রু নিকটাত্মীয়, ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’ উপন্যাসের মূল আখ্যান এটাই। এবং একটি মেয়ে যদি হয় কেন্দ্রবিন্দু, তাহলে কতভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয় বিরুদ্ধ বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে, উপন্যাসিক নিজস্ব রসায়নে- সে ঘটনাই তুলে ধরেছেন। 

‘অনেক কথাই অবশ্য আহাদকে জানানো যায়, কোনো কোনোটা তো না জানালেই নয়। যেমন এই কথাটা যে জাহানারা খানের বাড়িতে ওর ছদ্মপরিচয়ের ব্যাপারটা ওর জন্য বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে কণার অস্বস্তি যেদিন থেকে ওই আজগুবি বিজ্ঞাপনটিতে সে সাড়া দিয়েছে, সেদিন থেকেই। কম আর বেশি। জাহানারা খানকে সে খালা বলে মেনে নিয়েছে, তার আপন তো থেকেও নেই,  এই পাতানো খালাই আসল। কিন্তু কণা নিজে তো আসল নয়, খাঁটি নয়, সে তো একেবারেই নকল। জাহানারা খালা আছেন তার নিজের জায়গাতেই কিন্তু কণা তো নেই, সে তো সীমা নয়। সীমাকে কতদিন কণা আর ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াবে? মাঝে মাঝে ভীষণ গ্লানিকর, অত্যন্ত অসহ্য ঠেকে সমস্ত ঘটনাটা।’

১২০ পৃষ্ঠার ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’ উপন্যাসের ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠার একটা স্তবক পাঠ করলেই অনুভব করা যায়, একজন কণা কতটা বিড়ম্ভিত জীবনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে!

‘শেষ নেই’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু মুক্তিযুদ্ধ। কণার অনিশ্চিত যাত্রা উপন্যাসের আখ্যান সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না হলেও, অনেকটা জড়িয়ে আছে। কেননা- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা যে সময়ের মধ্যদিয়ে গড়ে ও বেড়ে উঠেছেন- গোটা সময়ই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিচুল্লি। সুতরাং মুক্তি নেই মুক্তিযুদ্ধের ভলকানো উত্তাপ ও আগুন থেকে। 

‘বাবুলের বেড়ে ওঠা’- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কিশোর উপন্যাস। ‘বাবুল’ এ উপন্যাসে প্রতীকায়িত হয়ে অজস্র কিশোরের মনজমিন ও বেড়ে ওঠার মানচিত্র কেবল নয়, সুন্দর সময়েরও অঙ্গীকার হয়ে ওঠে। 

খুব ছোট পরিসরে কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর চারটি বইয়ের পরিচয় তুলে ধরা গেল।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:২৩ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

গত সংখ্যার পর

উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে মোহিনী ও আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করতেন। সেখানেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটাও একটা বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে। মোহিনী বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ক্লাস করতে পারতেন না। সেই সময়ে আরেফিন তাকে নোট দিয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। এতে মোহিনী ভালো রেজাল্ট করেন। আরেফিন নিজেও মেধাবী ছাত্র। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মোহিনী এর বিনিময়ে তাকে কিছু উপহার দিতে চান। বললেন, ‘তুমি যে উপকার করলে তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। তার পরও আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। তুমি আমার কাছে কী চাও? তুমি যা চাইবে আমি সম্ভব হলে তাই দেব। মন থেকে বলবে।’ মোহিনীর এই বন্ধুত্ব-কৃতজ্ঞতায় আরেফিন যে তাকেই চেয়ে বসবেন তা তিনি নিজেও কখনো চিন্তা করেননি, ভাবেনওনি। আরেফিন জানতেন মোহিনীকে চাওয়া বা পাওয়া কোনো সহজতর বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ দুজনের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকতর অসমতা। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোহিনী ঢাকা শহরের ধনী পরিবারের সন্তান। তার সামাজিক সম্মান মর্যাদা অনেক উচ্চস্তরের। অরেফিনের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে এর বিপরীত। আরেফিন দরিদ্র্য পরিবারের সন্তান। তার পরিবারে তিনিই একমাত্র পড়ালেখা করেন। পরিবারে আয়-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আরেফিন টিউশনি করে নিজের পড়ালেখো করেন এবং পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠান। সেই টাকাতেই তাদের সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়। আরেফিন ‘গোবরে পদ্মফুল’। এ কথার যথার্থ যুক্তিও রয়েছে। গ্রামের অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র একটি পরিবার থেকে আরেফিনের মতো একটা মেধাবী ছেলের জন্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন- এটা সহজতর বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব একটি ব্যাপার। গোবরে পদ্মফুল যেমন অকল্পনীয়, এরকম হতদরিদ পরিবারে আরেফিনের মতো মেধাবী সন্তানের জন্মও অকল্পনীয়। যখন সত্যিই বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে তখন তা যথার্থভাবেই ‘গোবরে পদ্মফুল’-এর সঙ্গে তুল্য হয়ে ওঠে। এক কথায় যা অবিশ্বাস্য। মোহিনী এটা জানতেন। আরেফিনের শুধুই অরেফিন- এর বাইরে আরেফিনের আর কিছু নেই। এরকম অবস্থায় আরেফিনের চাওয়াকে গ্রহণ করা তার জন্য কতটা কঠিন, তাও তিনি জানতেন। তার অভিজাত পরিবার যে এটা সহজেই গ্রহণ করবে না, মানবে না- সে বিষয়েও তিনি স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতেন। ফলে আরেফিন যখন তাকেই চেয়েছেন উপহারস্বরূপ, তখন সেই চাওয়াকে যেমন উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, আবার গ্রহণ করাও সহজ হয়ে ওঠে না। যখন পারিবারিক এ সিদ্ধান্তে একদমই অমত- অরাজি, তখন কৃতজ্ঞ-মোহিনী মা-বাবাকে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কি পরিবারকে বিয়ে করব নাকি আরেফিনকে? পরিবার দেখার দরকার নেই। তোমরা আরেফিনকে দেখ।’ বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার অদম্য এ উচ্চারণ মানবিকতা ও কৃতজ্ঞতার চরমতম প্রকাশ। একই সঙ্গে সমাজজীবনে ধনী-গরিবের যে শ্রেণিবৈষম্য, তা তিনি ভেঙে সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে চেয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন ধনী-গরিবের যে বৈষম্য, সেই বৈষম্য দূর করে ভালোবাসায়-মনুষ্যত্বে-মানবিকতায় মানুষ হয়ে ওঠাটাই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিবারের অমতে আরেফিনকে জীবনে গ্রহণ করে শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমান্তরালে দাঁড়িয়েছিলেন- যেখানে আভিজাত্য নয়, মানুষই বড়, মনুষ্যত্বই বড়। মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর হলো ভালোবাসা। সেটিকেই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে, উদার মানসিকতায়, প্রেমের গহিন শক্তিতে, ভালোবাসার ঔদার্যে গ্রহণ করেছিলেন। আরেফিনকে গ্রহণের ভেতর দিয়েই তিনি চিরাচরিত আত্মম্ভরিতাপূর্ণ এ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।

আরেফিন মোহিনীকে চেয়েছেন। পেয়েছেন। সমস্যা তৈরি হয়েছে তার মানসিকতায়। তিনি মোহিনীকে চরমভাবে ভালোবাসলেও নিজেকে সমসময় অযোগ্য ভেবে নিজের ভেতর নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। দাম্পত্যজীবনে অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। মোহিনীর ভেতর অজস্র প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছেন, কখনো নিজের আত্মসমালোচনায়, কখনো আরেফিনের সঙ্গে কথা বলে, বোঝাপড়া করে। মোহিনী কখনই আরেফিন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারেননি। আরেফিনের মদ খাওয়া, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে দরোজায় পাশে পড়ে থাকা- এতকিছুর পরও মোহিনী কখনই আরেফিনকে ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। কখনো ক্ষোভ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে, আবার নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজেই আরেফিনকে স্পষ্টত বলেছেন, ‘আজ আমরা খোলামেলা আলোচনা করব। এতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা থাকতে পারবে না।’ মোহিনী আলোচনা করেছেন। আরেফিন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কথা দিয়েছেন আর কখনো এরকম হবে না। তার পরও কথা ঠিক রাখেননি।  মোহিনী আরেফিনকে কাছে বসিয়ে বলেছেন, ‘তুমি সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি যা করতে বলেছি তার উল্টোটা করেছ। আমি যা অপছন্দ করি তাই তুমি করো। এর কারণ কী তুমি বলো তো? খোলাখুলি বলো। একটি শব্দও মিথ্যা বলবে না। আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো আমাদের এখনই শোধরাতে হবে। তা না হলে অনেক বড় সমস্যা হবে। বিয়ে যখন করেছি তখন একটা সুন্দর আনন্দময় সংসার আমি করতে চাই।’ এটা শোনার পরে আরেফিনও নিজের চরম সত্যটাকেই বলেছেন মোহিনীকে, ‘তোমার সঙ্গে তুলনা করলে আমার অবস্থা তোমার এক শ ভাগের এক ভাগ। আমার সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। তুমি কী পছন্দ করো আর কী অপছন্দ করো তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় থাকি। তুমি কীসে মন খারাপ করো, আর কীসে রাগ করো তা বুঝতে পারি না।... ভয়ের কারণে তোমাকে ঠিকমতো আদরও করতে পারি না।’ আরেফিনের কথা শুনে মোহিনী তাকে বলেছেন, ‘জীবনটা কয়দিনের বলো! তোমাকে ভালোবেসেছি বলেই তো তোমাকে বিয়ে করেছি।... শপথ করো, আমাকে কোনো কিছু গোপন করবে না। যা ভালো লাগে খুলে বলবে।’ আরেফিন সম্মতি জানায়। আরেফিন প্রমিজ করে আর কখনো মোহিনীকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু আরেফিন কথা রাখেনি। মোহিনী তাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তাকে ত্যাগ করার কথা কখনো ভাবেননি। বরং তার প্রতি আরও মমত্ব বেড়েছে, তার জন্য তিনি অস্থির হয়েছেন। বিশেষ করে যখন তিনি শুনেছেন আরেফিন চীনে যাচ্ছেন অফিসের দায়িত্বে। অথচ তাকে আগে থেকে কিছুই বলেননি। এটা মোহিনী মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে নিজের বাসা ছেড়ে বাবা-মার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। আরেফিন চীনে গিয়ে মোহিনীকে ফোন করলেও রাগে ক্ষোভে কষ্টে ফোন রিসিভি করেননি। কিন্তু যখন বাবার কাছে জানতে পারলেন, চীনের হুবেতে ব্যাপকভাবে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। টিভি নিউজেও সেটা দেখলেন মোহিনী। এ সংবাদে ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি হয় মোহিনীর ভেতর। আরেফিনের জন্য তার ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। আরেফিনের মোবাইলে ফোন করেও আরেফিনকে তিনি পাননি। করোনা এদিকে আঘাত হানে বাংলাদেশেও। মানুষের জীবনযাপন-জীবিকা সবকিছু বদলে যায়। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকরির অনিশ্চয়তা, মানুষ আত্মীয়-স্বজনহীন একা হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন এক নতুন জীবন হয়ে ওঠে মানুষের। সেই জীবনে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু বাস্তবে ভয়াবহ কঠিনে রূপ নেয়। মৃত্যু-আতঙ্ক নগরীতে মোহিনী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। খাদ্য-অর্থ সহযোগিতা নিয়ে- অফিসের কোনো কর্মচারীকে ছাঁটাই না করে, বরং তাদের পাশে থেকেছেন সাধ্যমতো। মানবিক এক মোহিনীকে আমরা লক্ষ্য করি। যদিও মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্মগতভাবেই তিনি পেয়েছেন। তার বাবা মোহসীন আহমেদ ও মা আনোয়ারা বেগম দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে সব সময় সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এসব প্রচারে তিনি বিব্রতবোধ করেন। মোহিনীও ঠিক তাই। একবার তার সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ করা হলে তিনি খুশি হননি, বরং নিজের ভেতর একরকম বিব্রত হয়েছেন। বাবা কী ভাববেন! 

মোহিনী করোনায় আরেফিনের মৃত্যুর খবর জেনে স্তব্ধ হয়ে যান। সবকিছু থেকে নিজেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে রাখেন কয়েকদিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়েছে আরেফিনের লাশ আসবে বিমানবন্দরে। তিনি বিমানবন্দরে যেতে পারবেন, বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখতে পারবেন। কিন্তু তার মুখ দেখা যাবে না কোনোভাবেই। তার পরও তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছেন আরেফিনের সম্মানে, ভালোবাসায়। বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখেছেন কষ্টগুলোকে বুকে ভারী পাথরের মতো চেপে রেখে। আরেফিনকে হারিয়ে মোহিনী পাথর হয়ে গেছেন। কান্নাও তিনি ভুলে গেছেন- ‘কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হতে পারতেন তিনি।’ কিন্তু কান্না এখন তার জন্য এক কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। বরং নিজেকে তিনি আত্ম-প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করেন- কেন আরেফিনের ওপর অত রাগ করেছিলেন! কেন বাসা ছেড়ে চলে এসেছিলেন! আত্ম-অপরাধবোধে ও আত্মসমালোচনায় জর্জরিত হতে থাকেন।  

মোহিনী বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখে গাড়ি নিয়ে বের হতেই আর এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন। একজন বৃদ্ধ লোক সন্তান হারানোর বেদনায় বিলাপ করছেন, পথচারীরা ঘিরে আছেন তাকে। পথচারীরা সন্তান হারানো বৃদ্ধ বাবাকে কী সান্ত্বনা দেবেন। অসহায় চোখে তাকে দেখছেন, ঘিরে আছেন। মোহিনী কী ভেবে গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে বৃদ্ধলোকটির কাছে এগিয়ে যান। বৃদ্ধলোকটাকে প্রশ্ন করেন, তার ছেলের লাশ কোন দেশ থেকে এসেছে? ছেলের কী নাম? বৃদ্ধ লোকটির নাম-ঠিকানা জানতে চান। সব জেনে তিনি যখন বুঝলেন ইনি আরেফিনের বাবা। স্তম্ভিত হয়ে পড়েন মোহিনী- ‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।’  এখানেও মোহিনী নিজের আবেগ সংযত রাখতে চেষ্টা করেন। আরেফিনের বাবা আলী আকবরকে নিজের গাড়িতে করে অফিসে নিয়ে যান। অফিস দেখে আলী আকবর কল্পনার সঙ্গেও মেলাতে পারেন না। 
চলবে...

অন্য ভুবন

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:১১ পিএম
অন্য ভুবন
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সায়মন কোনো দিন ভাবেনি তাকে একদিন দেশ ছেড়ে ছুটতে হবে জীবিকার সন্ধানে অন্য কোনো দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মার তাগিদে যখন সে শিক্ষাবৃত্তির জন্য চেষ্টা করছিল, তখনো মনে মনে স্থির করে রেখেছিল বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্র যদি তৈরিও হয়, তা হলেও সে যাবে না। কিন্তু এখন? এখন তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পাল্টে গেছে জীবনের মেরুকরণের সব সমীকরণ। বারান্দায় দোল খাওয়া কেদারায় দুলতে দুলতে সায়মন তা-ই ভাবছিল। হঠাৎ মুঠোফোনের রিংটোন তার ভাবনায় ছেদ ঘটাল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই সায়মন অজানা এক আনন্দে অদ্ভুতভাবে শিহরিত হলো। মনে মনে ভাবছিল চিৎকার দিয়ে পরিপার্শ্ব কাঁপিয়ে তুলে সবাইকে জানিয়ে দেয়, জীবনের সব গল্পে মানুষ হেরে যায় না। আরও ভাবছিল চঞ্চলার ফোনের জন্য তার কত প্রতীক্ষা। আজ হঠাৎ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। হঠাৎ বৃষ্টি।

ও-প্রান্তে ফোনটা মুঠোয় ধরে চঞ্চলা স্থির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফোন রিংয়ের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চঞ্চলা ভাবতেই পারছে না সায়মন তার ফোনটা রিসিভ করেনি! কারণ সে তো জানে সায়মনের কত অধীর আগ্রহ তার ফোনের জন্য। তাহলে সায়মন কি তার উপেক্ষা সইতে সইতে সে-ই এখন উপেক্ষা করছে তাকে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে চঞ্চলা। এই ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে রিংটোন। সায়মনের ফোন। চঞ্চলা বিলম্ব না করেই ফোন রিসিভ করে। চঞ্চলার অত্যন্ত বিনম্র সম্ভাষণ। একটু নয়, বেশ বিচলিত হয় সায়মন। যে ব্যক্তিটি প্রায় ১৪ মাস আগে সায়মনের ওপর রেগে গিয়ে যোগাযোগের সব মাধ্যমের কপাট বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ তার বিপরীত সুর!

চঞ্চলা ফোন ধরেই একটানা বলতে থাকে, ‘ফোন ধরলেন না কেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত না অন্য কোনো কারণে। নাকি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন? আমি জানি, আপনি মাসের পর মাস আমার ফোনের অপেক্ষা করছেন। প্রায় ১৪ মাস আগে আমি যেদিন আপনার ওপর খুব খেপে গিয়ে বাজে আচরণ করেছিলাম এর কিছুক্ষণ পরই আমি বুঝেছিলাম কাজটা আমি মোটেই ঠিক করিনি। এমন অসৌজন্য আচরণ কোনো সভ্য মানুষ করতে পারে না। এমনটি হয়তো অনেক সময় ঘটে যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। আমার ক্ষেত্রে এমন হবে তা ভেবে দীর্ঘ সময় ধরে খুব যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছি। আপনার সঙ্গে যাতে আমার দেখা না হয় সেজন্য নিজেকে রেখেছি খুব সন্তর্পণে। কিন্তু আজ, আজ পারছিলাম না। আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই ফোন করেছিলাম।’

এটুকু বলে চঞ্চলা থেমে যায়। ও-প্রান্তে সায়মন নির্বাক। কখন থেকে তার মধ্যে এক ধরনের উদাসী ভাবনা চেপে বসে তা-ও ঠাওর করতে পারছিল না। চঞ্চলার প্রতিটি শব্দ তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তার মৌনতা ভাঙল চঞ্চলা।

‘কী ব্যাপার, কোনো কথা বলছেন না যে! আমাকে কি ক্ষমা করা কিংবা ক্ষমায় রাখা সম্ভব নয়? এমনটি না পারাই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রে এমনটি হলে আমি হয়তো পারতাম না। কিন্তু অনেকটা নির্লজ্জের মতো আমি আপনার কাছে অনুশোচনার দহন সইতে না পেরে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ধারণা, মানুষের কাতরতা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই বিফলে যায়। আপনার তরফেও আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করা নিশ্চয় অমানবিক কিছু হবে না। কিন্তু কেন জানি আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস আপনি আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করবেন না।’

মৌনতা ভাঙে সায়মনের। সে বলতে শুরু করে, ‘আসলে আমি সেভাবে ভাবছি না বটে কিন্তু তোমার ফোনালাপ যে আমাকে খুব স্পর্শ করেছে তা স্বীকার করি না। তোমার ধারণা ভুল নয়। প্রায় ১৪টা মাস আমি তোমার অপেক্ষা করেছি। সারাক্ষণ ভেবেছি এই হয়তো তোমার ফোন পাব, এই হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, এই হয়তো পেছন থেকে ডাক পাব- শুনছেন, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি...। তুমি আমার সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করে যে দহনে ভুগেছ এর চেয়ে আমি কোনোভাবেই কম দগ্ধ হইনি তোমার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে। একজন উচ্চশিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে সোনালি দিন সমাবর্তন। অথচ সেই দিনেই আমি তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েও তোমার অপেক্ষায়ই রয়েছি। আমি হয়তো তোমার সঙ্গে আমার ভালো লাগার বিষয়টি নিয়ে ভণিতা করতে পারতাম কিন্তু আগপিছ না ভেবেই আমার জীবনের সোনালি দিনটিতে তোমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কথাটি শেষ করতে না করতেই তুমি যেভাবে আমার ওপর খেপে গেলে তা-ও আমি অস্বাভাবিক মনে করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, একটা ছেলে যত সহজে ভালোবাসি শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা ততটা সহজ নয়। তোমার আচরণে আমি লজ্জিত কিংবা দুঃখিত হয়নি, শুধু উপযুক্ত-অনুপযুক্ততার কথা ভাবছিলাম।’ কথা কেড়ে নেয় চঞ্চলা।

‘এ আপনার বিনয়। বিনয়ী মানুষ আখেরে হারে না, এও আমার বিশ্বাস। আপনাকে কোনো অংশেই কম চিনতাম না, জানতাম না। আমরা একই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী বলেই শুধু নয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আপনার প্রত্যয়ও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা, যাকে হারিয়েছি কৈশোরে। তিনি বলতেন, জীবনটা নদীর স্রোতের মতো। নদী যেমন স্বচ্ছ পানি ধারণ করে, তেমন ওই জলে আবর্জনাসহ জীবনের জন্য হিতকর নয়, এমন অনেক কিছুই থাকে। মায়া মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যেরও অনেক গল্প আছে। জীবন অনেক ক্ষেত্রেই মহাশয় অর্থাৎ যা সওয়ানো যায় তা-ই সয়।’

চঞ্চলার সঙ্গে পরিচয়ের সাড়ে চার বছরের মধ্যে এমন খোলামেলা কথাবার্তা সায়মনের এভাবে কোনো দিনই হয়নি। সে চঞ্চলার কথার গভীরতায় যেন ডুবসাঁতার কাটছে। নিজের নীরবতা ভেদ করে সে চঞ্চলাকে কিছু বলতে গেলে এই ফাঁকে চঞ্চলা ফের কথা শুরু করে।
‘আমি বহুদিন পরে জেনেছি, জীবনের স্বাস্থ্যকর বিষয় হলো আনন্দ। আনন্দ করতে হবে বিষাদের সব বেষ্টনী ভেঙে তা-ও বুঝেছি পরে। আসলে আমি এত পোড় খাওয়া শতছিদ্রবিশিষ্ট একটি জীবন, যে জীবনের রয়েছে অন্তহীন গল্প।’

চঞ্চলাকে থামিয়ে দিয়ে সায়মন ওকে প্রশ্ন করে, ‘গল্পগুলো শোনাবে?’

চঞ্চলার ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ, ‘জীবনের কোনো কোনো গল্প অল্প করেও কাউকেই শোনানো যায় না। এ গল্প লুকোবার, শুধুই লুকোবার। কিন্তু এও সত্য, সব গল্পে জীবন হেরেও যায় না। জীবনেরই কোনো কোনো গল্প আছে জীবনপাত্র উছলিয়া মাধুরী দানের। অনেকেই জানে না এ গল্পের মূল্যের পরিমাণ। প্রসন্ন মুখ তুলে মধুর মরণে পূর্ণ করে সঁপে যায় কত প্রাণ শুধু চরণে চরণে। গোপন ব্যথার নীরব কত বিনিদ্র রাত কাটে মরমে ঢেলে জীবনের কত গান।’

সায়মন বিস্মিত! সে যত কথা বলছে ততই নতুন করে আবিষ্কার করছে চঞ্চলাকে। সায়মন যখন মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসে তখন চঞ্চলা অনার্স শেষ বর্ষে। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে দুজনের বয়সের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু চঞ্চলাকে তার অনেক বেশি পরিপক্ব মনে হয়। মানুষ জীবনে যত পোড় খায় তত বেশি সমৃদ্ধ হয়- এ ধারণাই জন্মেছে চঞ্চলার সঙ্গে আলাপচারিতায় সায়মনের।

সে চঞ্চলাকে বলে, ‘তুমি যে বললে তুমি পোড় খাওয়া মানুষ তাতে আমার মনে হলো জীবনে পোড় খাওয়া দরকার, খুব দরকার। তুমি এ পর্যন্ত যেভাবে জীবন দেখেছ, জীবনকে জীবনের শিক্ষক হিসেবে গণ্য করার সুযোগ পেয়েছ, সে রকমটি আমি পাইনি বলেই আমার বোধের খতিয়ান এত শূন্য। তোমার সঙ্গে আজ ভিন্নমাত্রায় কথা বলে আমার তেমনটিই মনে হচ্ছে। চঞ্চলা, তোমার ভাবনার উর্বর জমিনে আমি যে কতটা অনুর্বর তা নির্ণয় করাও কঠিন।’

চঞ্চলার গলা জড়িয়ে আসছে। সে সায়মনকে মূল কথা বলতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে শুধু সময়ই নষ্ট করেনি, সায়মনের কাছাকাছি থাকলে জীবনে কল্যাণের সেতুটা চওড়া হতো। তার মনে পড়ে জীবন সম্পর্কে মনীষীদের কিছু উক্তি। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।’ মনে পড়ছে তুরস্কের উপকূলবর্তী এজিয়ান সাগরের দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী যার জীবনাবসান হয় ইতালিতে সেই দার্শনিক পিথাগোরাসকে, যিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ এবং না কথা দুটো সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে ছোট। কিন্তু এ কথা দুটো বলতেই জীবনে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হয়।’ তার মনে পড়ছে ইংরেজ নাট্যকার জর্জ লিললোকে, যিনি বলেছেন, ‘একজন আহত ব্যক্তি তার যন্ত্রণা যত সহজে ভুলে যায়, একজন অপমানিত ব্যক্তি তত সহজে অপমান ভোলে না।’ কিন্তু সে যে সায়মনকে অপমান করেছিল তা সায়মন ভুলে গেছে। এখন তার এও মনে হয়, সায়মন কত বড়। তার আরও মনে পড়ে সেই প্রবাদ, ‘ফলবান বৃক্ষই নতজানু হয়।’

সায়মনের ভাবনায় আসে নতুন দিগন্ত। সে মনে মনে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথকে। তার ইচ্ছা হচ্ছিল সে চঞ্চলাকে চিৎকার দিয়ে শোনায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের সেই গানের লিরিক, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ/ রজনীগন্ধা অগোচরে/ যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে,/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান।’ কিন্তু পারেনি। কেন পারেনি তা সে নিজেও জানে না।

সায়মন-চঞ্চলা দুই প্রান্তে দুজনই নীরব। শুধু ইথারে ভেসে আসছে দুজনের তরঙ্গায়িত নিঃশ্বাস। এ যেন দুজনের সৃষ্টি অদৃশ্য বহুমাত্রিক এক অন্য ভুবন। হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে দুই প্রান্তে দুজনই সমস্বরে উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, ‘পাওয়া কাকে বলে যে মানুষ জানে না, সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।’

জ্বরতপ্ত অবসরে

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
জ্বরতপ্ত অবসরে

কবিতার প্রিয় অন্তর্জাল ছেড়ে জ্বরতপ্ত অবসরে নিমজ্জিত
নিজেই নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছি… আতঙ্কে
জ্যৈষ্ঠে জ্বর হলে এমনিতে ভয় লাগে… মা নেই!
বাসকপাতা ছেঁচে মা রস খাওয়াতেন দুবেলা
পাথরকুচি পাতার জুস- সাগু বার্লি কত কী?

মাথার কাছে বসে মা নিজেই জলপট্টি হতেন-
পানি অদল বদল করে উষ্ণতা ছুড়ে দিতেন মাটির মটকায়-
মা যখন বার্লি রেঁধে আনতে যেতেন- ছোট বোন পাহারায় বসে থাকত পাশে-
এই ফাঁকে পাশের বাড়ির সহপাঠী আমার পাণ্ডুর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাত কিছুক্ষণ- পলকেই সরে যেত আড়ালে-কখনো জানা হলো না জ্বর হলে সে কেন এভাবে দেখতে আসে অজান্তে…
জ্বরের ঘোরে বিছানাকে মনে হতো তার হাতের স্পর্শ 
রুগ্‌ণ প্রান্তরে শুয়ে আজো তাই তারা গুনি আকাশের।
আহা, ঠাণ্ডা জল বাতাসে আমি আর কবে হাওয়ার মাতম হব!
আজ এতকাল পরে কে নেবে এই জ্বরের উত্তাপভার…

আছিয়া

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:০২ পিএম
আছিয়া

নাম লিখিনি, লিখতে চাইনি;
মৃত্যু দিয়ে বৈধতা দিলে সেই নামের উচ্চারণ!
আজ তুমি মরে নক্ষত্র হলে,
স্বর্গের দেশে আল্লাহর সকাশে তোমার আবাসন।
তাই দেখো- আজ চাঁদও রক্তিম
নিষ্পাপ খেলার সাথীকে স্বাগত জানায় চাঁদের বুড়ী
জানি না ঐখানে কি তোমার ড্রেস কোড?
অথবা মাহারাম ছাড়া আছে কি যৌন সুড়সুড়ি?
আচ্ছা-আছিয়া; তনু, ইয়াসমিনরা ভালো আছে?
ওরা তোমার পূর্বসূরি, তোমার বড় বোন
ওরাও এভাবেই পৃথিবী ছেড়েছিল
আমরাও ঠিক মিছিল করেছিলাম, মশাল মিছিল
তবুও তো ধর্ষণের দরজায় লাগেনি খিল।
এ দেশ ধর্ষণ উপত্যকা!
এ দেশ তাহলে কি আমার নয়?
বিধাতার কাছে সব বলে দিও,
অভিশাপে যদি হয় ক্ষয়!
লজ্জিত এ মাতৃভূমি, আমার বাংলাদেশ!
তোমার অভিশাপে যেন হয় এই নৃশংসতার শেষ।