
সত্যজিতের ‘হিরক রাজার দেশে’ সভাকবির ভূমিকা, না করি কী করে। সম্ভবত বোধনই এ দেশে একমাত্র দল, যারা এ নাটকটি মঞ্চায়ন করেছিল আর আমি হাতে গোনা কয়েকজন সৌভাগ্যবান অভিনেতার একজন, যে এ নাটকের সভাকবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। হিরক রাজা যখন জিজ্ঞেস করে, সভাকবি আপনি তো স্বভাবকবি, তাই না? আমি তখন উত্তর করি- আজ্ঞে আমি নিজে বলতে চাই না? আসলেই সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে আমি নিজে আর কিছু বলতে চাই না।…
বাদল সরকারের একটা নাটক যার শিরোনাম ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। এ নাটকে অনেকের গল্পের সঙ্গে ইন্দ্রজিতের গল্পও বলা হয়, তাই নাটকটির নাম ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। আমি আমার লেখার শিরোনাম দিচ্ছি ‘এবং সত্যজিৎ’। যার অর্থ দাঁড়াবে পৃথিবীর তাবড় তাবড় পরিচালকের নাম বলার পরে ‘এবং’ যুক্ত করে তবে সত্যজিৎ বাবুর নাম বলতে হবে। তিনি এতই বিশেষ, এতই কুশলী। সত্যজিৎ রায় আমার কাছে এক চমকের নাম। সালটা ১৯৮০, আমি তখন সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক। সে সালের ঈদের দিন বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ চলচ্চিত্র আয়োজনে ছিল ‘হিরক রাজার দেশে’র বিটিভি প্রিমিয়ার। সত্যজিৎ রায় নামটা তখন বেশ শুনেছি, পত্রপত্রিকায় পড়েছিও। তার নামে তখন লেখালেখি হয়েছে ঢের। চলচ্চিত্রজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষ তাকে এই বলে স্বীকৃতিও দিয়েছেন যে, বাংলা সিনেমার স্বতন্ত্র শৈলী ও ভাষা তৈরি করেছেন সত্যজিৎবাবু।
পথের পাঁচালীর শট ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে তাকে নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু তখনো তার কোনো ছবি দেখার সুযোগ ঘটেনি আমার। ফলে যখন জানলাম সত্যজিতের হিরক রাজার দেশে দেখানো হবে টিভিতে, তখন মনটা নেচে উঠল। এই প্রথম সত্যজিতের একখানা ছবি দেখব। দুপুরের এই আয়োজনে রঞ্জু নামের এক বন্ধুর বাড়িতে আরও কজন বন্ধু মিলে বসে গেলাম সত্যজিতের কারিশমা দেখতে। ওপেনিং শর্ট থেকে চমকের পর চমক। কিছুটা দেখে বুঝলাম গল্পটা এক রাজার হলেও তা রাজকীয় কোনো গল্প নয়। সাধারণ মানুষের, সাধারণ জীবনের অসাধারণ উপস্থাপনা। রাজা ও তার সভাসদ একটা রূপক কাঠামো, যে কাঠামোর ভেতরে সাধারণের সর্বনাশ ঘটে। নির্মাণের স্বতন্ত্র শৈলী আর শটের ভাষা খোঁজা বাদ দিয়ে তখন নিবিষ্ট হলাম গল্প অনুসরণে। যখন পল্লী গায়ক গেয়ে ওঠে- ‘দেখো ভালো জনে রইলো ভাঙা ঘরে, আর মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে’ ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’। এই গান আমাকে তখনকার দেখা দুনিয়াটাকে যেন নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকল। পাল্টে যেতে থাকল আমার দেখা মানুষের চেহারা। রাজার চেহারা। একটা যন্ত্রর-মন্তর ঘরের প্রভাব অনুভব করলাম। এক সময় সেই কৃষকের সঙ্গে আমিও বলে উঠলাম ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না। ভরপেট নাও খাই, রাজ কর দেওয়া চাই’। সবাই একটা মগজধোলাইয়ের বুলি আওড়াচ্ছে। ছন্দে ছন্দে ছকবাঁধা ছাঁচে কথা বলে চলেছে। রাজা, মন্ত্রিবর্গ, সভাসদ, সভাকবি, বিদুষক, কৃষক, গায়েন সবাই ছকবাঁধা ছাঁচে কাব্যছন্দে বাক্যালাপ করছে। কেবল একজন, উদয়ন পণ্ডিতের কথায় কোনো ছন্দ নেই, অন্তমিল নেই। মুক্ত ছন্দে মুক্তবাক। আমি বিস্ময়ে কিছুটা বাকরহিত ততক্ষণে।
উদয়ন পণ্ডিতকে সত্যজিত বাবু আলাদা করলেন কেন? বোধে ও বন্দনায় রাজার মুখাপেক্ষি নয়, এমন করে গড়ে তুললেন কেন? উত্তরটাও মিলে গেল কাছাকাছি সময়েই। ‘হিরক রাজার দেশে’ তো রাজার গল্প নয়। প্রজার গল্প। রাজার মোড়কে রাজা হননের গল্প। মুক্তবাক ও মুক্তির গল্প। উদয়ন পণ্ডিত আলাদা না হলে স্বতন্ত্র না হলে রাজাকে যন্ত্রর-মন্তর ঘরে নিয়ে কে তার মগজে মন্ত্র গেথে দেবে ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’। উদয়নকে তাই আলাদা হতেই হবে। হিরকের রাজা দর্শনে আমার ভেতরে কী এক মিথস্ক্রিয়া ঘটে গেল। নিজের সঙ্গে নিজের মিথস্ক্রিয়া। ভাবনার সঙ্গে ভাবনার মিথস্ক্রিয়া। ভাবনাটা কতটা জরুরি। একটা চিত্রনাট্যকে চলচ্চিত্রের ফিতায় তোলার ভাবনার কথা বলছি না। আমি যা বিশ্বাস করি তা কীভাবে কোন কাঠামোয় বা প্লটে বা বিষয়বস্তুতে একটা স্টেটমেন্ট তৈরি করে দর্শককে দেখাব, সেই ভাবনা। দর্শক পর্দায় স্বচোখে যা দেখবে তাই যে চলচ্চিত্র নয়, এর বাইরেও চলচ্চিত্র আলাদা একটা ব্যাপার, যা নির্মাতার ভাবনা ও বিশ্বাসকে অতি সংগোপনে দর্শকের অন্তরে প্রোথিত করে। হিরক রাজার দেশে দেখার পরে তা আমি প্রত্যক্ষ অনুধাবন করেছি। একটা চলচ্চিত্রের এত গভীর ছাপ আর কোনো চলচ্চিত্র আমার মনে ফেলতে পারেনি।
হয়তো তা আমার তখনকার বয়সের কারণে বা কিছুটা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বড়ভাইদের সাহচর্যে আমার মনটা তৈরিই হয়ে ছিল সত্যজিৎ রায়ের হিরক রাজার দেশে দেখে আলোড়িত হওয়ার জন্য। এই আলোড়ন আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল যখন বোধন থিয়েটার হিরক রাজাকে মঞ্চে নিয়ে এল। বোধন থিয়েটার আমার প্রথম থিয়েটার দল। কুষ্টিয়ায় আমার কৈশোরের প্রথম সংগঠন। বোধন তখন বেশ কটা নাটক মঞ্চে এনেছে। এরই ভিতর টিভিতে হিরক রাজার দেশে স্ক্রিনিং হলো। আমার মতো আমার দলের সবাই সত্যজিতের এই ছবির মগ্নতা কাঁটাতে পারছিল না। তখন কেউ একজন খবর দিল- এটাকে থিয়েটার রূপ দিয়ে মঞ্চে নামানো যাবে। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছুটিতে বাড়ি এসে এসব জানতে পারলাম। ইতোমধ্যে এর দুটো প্রদর্শনীও হয়ে গেছে। তখন তৃতীয় প্রদর্শনীর মহড়া চলছে। যিনি সভাকবির ভূমিকায় মঞ্চে আসতেন, সেই আল মাসুম প্রদর্শনীটা করতে পারবেন না। ফলে নির্দেশক বললেন, এটা মাসুম রেজা করুক। আমি অভিনয় তেমন করিনি। কিন্তু সত্যজিতের ‘হিরক রাজার দেশে’ সভাকবির ভূমিকা, না করি কী করে। সম্ভবত বোধনই এ দেশে একমাত্র দল যারা এ নাটকটি মঞ্চায়ন করেছিল আর আমি হাতে গোনা কয়েকজন সৌভাগ্যবান অভিনেতার একজন, যে এ নাটকের সভাকবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। হিরক রাজা যখন জিজ্ঞেস করে, সভাকবি আপনি তো স্বভাব কবি, তাই না? আমি তখন উত্তর করি- আজ্ঞে আমি নিজে বলতে চাই না? আসলেই সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে আমি নিজে আর কিছু বলতে চাই না। এবার আপনারা বলুন।
লেখক: নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক