
পঞ্চদশ পর্ব
মোহিনী আরও ভাবেন, আরেফিন চলে যাওয়ার পর প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব অনুভব করছি। মনের আঙিনায় কেবলই সে ফিরে আসে। আমার মনে দোলা দিয়ে চলে যায়। তাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যখন সে ছিল তখন কেন ভালোবাসা টের পাইনি! কেন বারবার মনে হতো, সে আমায় ভালোবাসে না! কেন বারবার মনে হতো, আমি ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী করেছি! মা-বাবার কথা না শুনে ভুল করেছি! এখন মনে হচ্ছে, আমিই ঠিক ছিলাম। সঠিক মানুষকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু বোঝার ভুলে আমি তাকে হারিয়েছি। তার জায়গায় অন্য কারও কথা ভাবতেও পারি না। ভাবতে গেলেই সে এসে দাঁড়ায়। তার হাসিমাখা মুখ-চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন মনে হয় সে আমার সঙ্গেই আছে। আমি যখন কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি; তখন আমি তার উপস্থিতি টের পাই। তার মানে কী! আমার সমস্ত সত্তাজুড়েই সে আছে। সে কখনো আমাকে সান্ত্বনা দেয়; কখনো সাহস জোগায়; আবার কখনো অনুপ্রেরণা দেয়। এমন বন্ধুকে কি ভুলে থাকা যায়!
আরেফিনের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যরকম হয়ে যান মোহিনী। তার আজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গান খুব মনে পড়ছে। গানটা প্রায়ই গুনগুনিয়ে গাইতেন আরেফিন।
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
মনের মাঝে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
ভুলো না তারে ডেকে নিতে।
বন্ধু তুমি পথের সাথীকে চিনে নিও...
১২
কলেজছাত্রী রুবিনার আত্মহত্যার খবর বের হয় কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে। প্রথম দিন খুবই সংক্ষিপ্ত একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয়, বনানীর একটি ফ্ল্যাট থেকে রুবিনা নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাশটি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। বনানী থানার পুলিশ জানায়, রুবিনা রাজধানীর একটি কলেজে লেখাপড়া করত। সে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল।
প্রথম দিনের খবর পড়ে মনে হলো, এটি একটি অপমৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু এর পেছনে যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানা গেল পরদিন। পুলিশই খুঁজে বের করল সেই রহস্য। বনানী থানার তদন্ত কর্মকর্তা শ্যামল পাল রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ছুটে যায় বনানীর সেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। তার সঙ্গে উদ্ধারকারী তিন পুলিশ সদস্য এবং বাড়ির কেয়ারটেকার রয়েছে। বিশালাকৃতির ফ্ল্যাটে ঢুকে ফাঁকা দেখে সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, কী ব্যাপার! এই বাসায় আর কেউ থাকে না?
বাড়ির কেয়ারটেকার খালেক মিয়া বলল, না স্যার। আর কেউ থাকে না।
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে শ্যামল পাল আবার বলল, মানে! এ রকম একটা অভিজাত ফ্ল্যাটে মেয়েটি একা থাকত!
জি স্যার; একাই থাকত।
এই ফ্ল্যাটের ভাড়া কত?
সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা স্যার।
এক লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে মেয়েটি একা থাকত!
জি স্যার।
বলো কী! এ দেশে কোনো কলেজছাত্রীর পক্ষে এটা কী করে সম্ভব!
খালেক মিয়া চুপ করে আছে। কী বলবে সে বুঝতে পারছে না। শ্যামল পাল আবারও বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, এই মেয়ের বাবা কি খুব বড়লোক! আর বড়লোক হলেও সে তার মেয়েকে একা একটি ফ্ল্যাটে রাখবে কেন!
কথা বলতে বলতে শ্যামল পাল নিজের মোবাইল ক্যামেরায় ফ্ল্যাটের অনেকগুলো ছবি তুলল। তার পর সে পুলিশ সদস্যদের কাছে জানতে চাইল, মেয়েটিকে কোথায় ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে?
উত্তরে জনৈক পুলিশ সদস্য বলল, বেডরুমের খাটের ওপরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে।
শ্যামল পাল বেডরুমে গিয়ে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করল। দেয়ালে টাঙানো একটি ছবি তার ক্যামেরায় ধরা পড়ল। ছবিটিকে সে ক্লোজ শটে তার ক্যামেরায় ধারণ করল। তার পর ছবিটার সামনে এগিয়ে গেল। ভালো করে দেখে বলল, মেয়েটার সঙ্গে এটা কে?
আরেক পুলিশ সদস্য বলল, স্যার দেখে তো মনে হয় মেয়েটির স্বামী; কিংবা প্রেমিক।
ছবিটাকে জব্দের তালিকায় রাখ। আর বিশেষ কিছু পাওয়া গেছে? যা আলামত হিসেবে কাজে লাগবে?
জি স্যার। মেয়েটার একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। এই যে স্যার ডায়েরি।
শ্যামল পাল ডায়েরি হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই দেখল, দেয়ালে টাঙানো ছবির মতো আরেকটি থ্রি-আর সাইজের ছবি ডায়েরির প্রথম পাতায় আঠা দিয়ে লাগানো। ছবির ওপরে লেখা, শাহবাজ+রুবিনা। প্রাণের মানুষ; ভালোবাসার মানুষ; হৃদয়ের মানুষ।
শ্যামল পাল আরও দু-তিনটি পাতা উল্টে পড়তে লাগল। পাতায় পাতায় ভালোবাসার কথা লেখা। শাহবাজ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তুমিই আমার সব। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার। যেকোনো মূল্যে আমি তোমাকে চাই। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ, বিয়ে করবে। আমাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। আমার সঙ্গে কখনো প্রতারণা করবে না। তোমাকে না পেলে কিন্তু আমি মরেই যাব। নিজেকেই নিজে শেষ করে দেব।
শ্যামল পাল ডায়েরিটা একজন পুলিশ সদস্যের হাতে দিয়ে বললেন, এটাও জব্দের তালিকায় রাখ। সাবধান! এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। হাতছাড়া করো না। আচ্ছা, মেয়েটির গলা কি রশি দিয়ে বাঁধা ছিল; নাকি কাপড় দিয়ে?
কাপড় দিয়ে স্যার। এই যে দেখেন কাপড়।
শ্যামল পাল কাপড়টি খুলে দেখে বলল হুম। এই কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল তো!
জি স্যার।
মেয়েটির পা কিন্তু খাটের সঙ্গে লেগে যাওয়ার কথা! ঝুলে থাকার কথা না।
জি স্যার। খাটের ওপর দুই পা ছিল।
তার মানে সে আত্মহত্যা করেনি!
পুলিশ সদস্যরা চুপ করে আছে। খালেক মিয়া বলল, স্যার ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। পুলিশ আসার পর বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খোলা হয়েছে।
সেটা কোনো সমস্যা না। আচ্ছা খালেক মিয়া; একা একটা মেয়েকে এ রকম একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হলো কেন?
স্যার, ভাড়া তো মেয়েটা নেয় নাই!
কে নিয়েছে?
অন্য একটা লোক নিছে।
সে কে?
তার নাম বলা নিষেধ স্যার।
বিস্ফারিত চোখে শ্যামল পাল খালেক মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, কী!
স্যার, একজন ব্যবসায়ী।
সে কে? ব্যবসায়ীর নাম কী?
খালেক মিয়া চুপ করে আছে। শ্যামল পালের মেজাজ তেতে উঠছে। কিন্তু মেজাজ নিয়ন্ত্রণের অদ্ভুত এক শক্তি আছে তার। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, খালেক মিয়া; আমার সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি বল। তা না-হলে কী করব তা তো বোঝই।
স্যার, ওই যে ছবি তুললেন! ওই লোকটাই ভাড়া নিয়েছে।
সে কে?
সে একজন ব্যবসায়ী।
কী নাম তার?
চলবে...
পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, পর্ব-৮, পর্ব-৯, পর্ব-১০, পর্ব-১১, পর্ব-১২, পর্ব-১৩, পর্ব-১৪