
খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ প্রকাশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কয়েকদিন থেকেই এর প্রকাশের আগাম বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল। কাগজের অফিস থেকে লেখক হিসেবে প্রাপ্ত আমার কপি কবে আসবে তার অপেক্ষায় অধীর হয়ে পড়ছিলাম, আমার বাসার কাছে শংকর বাসস্ট্যান্ডের খবরের কাগজ স্টল থেকে সদ্য ছাপা হয়ে আসা একখানা সংকলন নগদ মূল্যে সংগ্রহ করলাম।
ঈদসংখ্যা ২০২৫ হাতে পেয়ে খুবই তৃপ্ত হলাম। ২৫০ টাকায় প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার একটি সংকলন, বহু খ্যাতনামা প্রবীণ ও উদীয়মান নবীন লেখকের সৃজন দৃষ্টান্ত, ছাপা-বাঁধাই সুন্দর। কাগজ খুবই মানসম্মত, অলংকরণ হাল আমলের যন্ত্রনির্ভর, তবে আকর্ষণীয় ও অর্থপূর্ণ। শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলি ও নাজমুল আলম মাসুমকে বিশেষ অভিনন্দন।
আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, মধ্য আশিতে, লেখক তালিকায় যারা আছেন, তিন-চারজন হবেন আমার সিনিয়র (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পবিত্র সরকার, মির্জা আজিজুল ইসলাম প্রমুখ), সবাই অত্যন্ত নমস্য ব্যক্তি। যারা আমার জুনিয়র, তারাও অধিকাংশই খুবই প্রতিভাবান মানুষ, নিজ নিজ পেশাগত জীবনে, প্রতিষ্ঠায় ও সৃজন কুশলতায়।
বয়সের কারণে আমার শারীরিক কিছু সমস্যা তো আছেই, যেমন বাঁ চোখে একেবারেই পড়তে পারি না, ঈদসংখ্যায় শাহনাজ মুন্নি যেমন লিখেছেন ‘বৃদ্ধ হওয়ার একটা বড় অসুবিধা হলো তোমার চোখের দৃষ্টি দুর্বল হবে’ (পৃ. ২৯৬)। শুধু ডান চোখে পড়া ও লেখার কাজ সারি। তার ওপর আমি সব সময়য়েই খুব ধীর গতির পাঠক, স্লো রিডার। মোটা বই, উপন্যাস হলেও খুব একটা হাতে নিই না। মূলত নন ফিকশন সাহিত্যেরই পাঠক। খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল ও সিনিয়র সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণার তাগিদে ঈদসংখ্যা নিয়ে অতি সংক্ষেপে আমার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। (আমি নিজে এই সংখ্যার একজন লেখক, সে কারণে আমার মতামত দেওয়া হয়তো সঙ্গত নয়)।
আগেই বলেছি, সংকলণটি যথার্থই প্রশংসনীয়। ২০২৪ ঈদসংখ্যাও উচ্চমান সম্পন্ন হয়েছিল।
২০২৫ ঈদসংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছেন সুপরিচিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। তুলনামূলকভাবে অর্থনীতিবিদদের লেখার সংখ্যাধিক্য, তা দেশের অর্থনীতির অবস্থা যত খারাপই হোক, নাকি সে যুক্তিতেই? বাংলা একাডেমির বর্তমান সভাপতি ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের মাত্র দুই পৃষ্ঠার প্রবন্ধটিকে অসাধারণ। শ্রদ্ধেয় প্রাবন্ধিক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা সব সময়েই পাঠককে ঋদ্ধ করে। তার ‘কেউ থাকে যুদ্ধে কেউ চলে ভিক্ষায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাঙালির দীর্ঘ রাজনৈতিক সামাজিক তৎপরতার আলোচনায় মীর মোশারফ হোসেন ছাড়া আর কোনো মুসলিম মনীষার নাম পেলাম না। মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ‘গরিব-দুখীর বাংলাদেশ’ একটি অনুপ্রেরণামূলক রচনা। এই প্রবন্ধে (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।
সংকলনের সাতটি উপন্যাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি পড়েছি। মনি হায়দারের ‘খণ্ডিত পুরুষ’ আধুনিক আঙ্গিকের উপন্যাস। এতে অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে এসেছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোর নোটন প্রসঙ্গ এবং তাতে দেশের একজন প্রথিতজশা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামালের পেশাদারি মতামত প্রণিধানযোগ্য। সম্পাদক মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘রিমির দ্বিতীয় জীবন’ সহজপাঠ্য।
খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫-এর মূল্যবান সংকলন ২৫টি গল্প, যেখানে প্রথাগত গল্পের পাশাপাশি জটিল আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক আঙ্গিকের গল্পও স্থান পেয়েছে (যেমন- মোজাফফর হোসেনের ‘লাশটি জীবিত’ বা স্বকৃত নোমানের ‘খেলার আগে ও পরে’। অন্যদিকে প্রবীণ গল্পকার আতা সরকার ও চপল বাশারের গল্পও চেতনার উদ্রেক করে। কবিতার সংখ্যাও ২৫, এতে প্রসিদ্ধ প্রবীণ কবিদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবিদের সৃজন দৃষ্টান্ত রয়েছে। কবিতার সমৃদ্ধ সমাহার বটে।
ঈদসংখ্যা ২০২৫-এ প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প ও কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের আরও নানা শাখা ও বিষয় নিয়ে নানা কলেবরের লেখা স্থান পেয়েছে। কিছুটা হতাশা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়গুলো প্রায় অনালোচিত রয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে বিস্ময়ের মনে হয়েছে, লেখক তালিকায় নারী লেখকদের প্রতিনিধিত্ব এত কম কেন? প্রবন্ধকার তো একজনও নেই, অন্যান্য শাখাতেও তাদের সংখ্যা স্বল্পতা অবাক করার মতো। তাও ভালো শাহনাজ মুন্নির উপন্যাস ‘বাবার কণ্ঠস্বর’ পেয়েছি। সংকলনে মোট লেখক সংখ্যা প্রায় ৯০, যার মধ্যে নারী লেখক দশেরও কম।
এ ধরনের কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি বলব, খবরের কাগজ ঈদসংখ্যা ২০২৫ একটি মূল্যবান সাহিত্য সংকলন। সময় নিয়ে পড়ার মতো। উল্লেখ উচিত, আমি এখনো সংকলনের অনেক লেখাই পড়তে পারিনি, তবে পড়ছি। এবং আমার ঘনিষ্ঠজন অনেককে পড়তে তাগিদ দিচ্ছি।
সবশেষে, ঈদসংখ্যা ২০২৫-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল ও সহযোগীদের অভিনন্দন অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি সৃজনকর্ম সম্পাদনের জন্য। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের ঐতিহ্যের একটি অংশই বটে এরকম উদ্যোগ।
লেখক: ইমেরিটাস প্রফেসর, নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক