ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দাগ

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম
দাগ
অলকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুরি
হাওলাদার বাড়ির ছেলে জয়েন। মামারা তালুকদার। শৈশবের স্মৃতি মনে করতেই জয়েন হাওলাদার কেমন নড়েচড়ে বসে। জয়েনকে সবাই জনা বলে ডাকে। এলাকার মানুষের মঙ্গলের জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা সে করে না। এজন্য গ্রামে গরিবদের কোনো সমস্যা হলেই ছুটে আসে তার কাছে। বিশেষ করে কৃষকরা তার কাছে আসে ভূস্বামী ও সামন্তবাদীদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে। অন্তজ্য শ্রেণির মানুষ মনে করে জনার কাছে গেলে সে কিছু একটা করবে।
 
একসময় সাধারণ মানুষের দিপদে ও অধিকারের কথা বলতে গিয়ে লাখো মানুষের নেতা হয়ে যায় জয়েন হাওলাদার। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। জয়েন শুনেছে, দাদার আমলে তাদের অনেক জমিজমা ছিল। বাবার সময় থেকে একটি ভিটে আর দুই বিঘে জমিই সম্বল। এনিয়ে কোনো ভাবনা নেই তার। গরিবদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ নেওয়াই যেন তার কাজ। নিজেকে নিয়ে সুখ খোঁজে না কখনো। যেখানেই কৃষকদের সঙ্গে ভূস্বামীদের অনিয়ম সেখানেই জয়েন কৃষকদের হয়ে নেতৃত্ব দেয়। শোষকদের বিরুদ্ধে কথা বলে। সংগ্রাম জয়েনের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।
 
তখন অবিভক্ত বাংলা। ইংরেজদের হাতে ভারত উপমহাদেশ। সব জায়গায় শুধু সাদা চামড়ার মানুষের দাপট। ওদের  বিরুদ্ধে কেউ সঠিক কথা বলতে পারে না। রাজা প্রজাদের ওপর যে শোষণ-নিপীড়ন চালায় তা দেখে জয়েন চুপ থাকতে পারে না। সে প্রতিবাদ করে। কেউ কৃষকদের হয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই জেল-হাজতে পুরে ইংরেজ প্রশাসন। তাতে কী? জয়েন ভয় পায় না।
 
একের পর এক জয়েনের ওপর গ্রেপ্তার আর নির্যাতনের ফলে সে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে কৃষক আন্দোলনে। চারদিকে ভারত থেকে ব্রিটিশ তাড়াও আন্দোলন। স্বাধীনতাকামীরা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। কখন স্বাধীন ভারতের পুব আকাশে নতুন সূর্য উদিত হবে। হিন্দু-মুসলিমদের অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে ভারত উপমহাদেশ। পরাধীন জীবন বড়ই বেদনার। সেই জীবনে আলোর মুখ দেখতে পায় না কেউ।
 
জয়েন হাওলাদার তখনো বিয়ে থা করেনি। খুবই তেজি, উদ্যোমী আর পরিশ্রমী। সংসারে মা ও দুই বোন। মায়ের বয়েস ক্রমেই বাড়ছে। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মা জয়েনকে বিয়ের জন্য তাগিদ দেন। সেদিকে খেয়াল নেই জয়েনের। তার একটাই কাজ গণমানুষের অধিকার ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করা। কীভাবে রাজ্যের কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন করা যায় তা নিয়েই তার ভাবনা।
 
দলে জয়েনের দায়দায়িত্ব বাড়তে লাগল। নেতা-কর্মীরা তার ওপর নির্ভর করতে লাগল। রাজ্যের বিশাল এক এলাকা নিয়ে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দলে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করল জয়েন।
 
মায়ের মৃত্যুর ছয় মাস আগে বিয়ে করল জয়েন। জয়েনের বয়সের তুলনায় স্ত্রীর বয়স খুব কম। বিয়ের প্রথম প্রথম সপ্তাহখানেক স্ত্রীকে সময় দিয়েছে। পার্টি অফিসে যাওয়ার কারণে স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না। জয়েন মায়ের খুব ভক্ত ছিল। মতিবিবি সারা জীবন জয়েনকে বুকে আগলে রেখেছে। ছেলের কিছু হলে মা সইতে পারত না।
 
মতিবিবি একদিন বললেন, জয়েন তুই তো এখন কৃষকদের অধিকার নিয়ে কথা বলিস। গরিব-দুখির সেবা করিস। আমার না খুব ভালো লাগে। তোর বাবাও এমন ছিল। আমার ঘরে ভালো খাবার না জুটলেও তোর কর্ম আমার খুব পছন্দ। বাবা, নেতৃত্ব দিতে গেলে বাধা আসবেই। পিছিয়ে থাকলে চলবে না।
 
মা তোমার দোয়া আর মানুষের ভালোবাসাই আমার পুঁজি। আমার প্রচুর অর্থ-সম্পদ নেই। গরিব কৃষকদের ভালোবাসা আছে।
 
বাবা, সাবধান! ওই ব্রিটিশরা খুবই ভয়ংকর। বিনা কারণে মানুষকে ফাঁসি দেয়।
দেশ ও দশের ভালোর জন্য ফাঁসির কাষ্ঠে যেতেও আমি রাজি, মা।
 
বেনিয়ারা আমাদের দেশে এসেছিল বাণিজ্য করবে বলে। ধীরে ধীরে ভারতবাসীর সরলতার সুযোগ নিয়ে পুরো দেশটাই দখলে নিয়ে নিল।
 
মা, ওদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আর আমাদের মধ্যে ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। না হলে ওরা এত বড় দেশ কখনোই দখলে নিতে পারত না।
আজ আমরা পরাধীনতার স্বাদ নিচ্ছি। 
জয়েন, এই ভারতবর্ষ আবার স্বাধীন হবে। ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবই আমরা।
তাই যেন হয়, মা।
 
জয়েন প্রিয়তমা নিলুফাকে তখনো স্ত্রী হিসেবে মনে করেনি। বন্ধু ভেবে ভালোবেসেছে। একদিন দূরের হাট থেকে কত গয়নাঘাটি কিনে এনেছে। ওর হাতে দিতে পারেনি লজ্জায়। পরে মতিবিবিই সেসব নিলুফার হাতে তুলে দেয়। মা-ও মনে মনে খুশি।
এরই মধ্যে আবার কৃষকদের ওপর ভূস্বামীদের অত্যাচার। জয়েন আন্দোলনের ডাক দিলেন। ক্ষেপে গেল সামন্তবাদী ও অত্যাচারী জমিদাররা। কঠিন এক ষড়যন্ত্রে ফেঁসে গেল জয়েন। ওপর থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের নির্দেশ হলো। গরিব প্রজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকে আহত হলো। নিহত অনেকে। জয়েনকে যেতে হলো জেলে। বিচলিত হয়নি সে। কৃষকদের ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়ে গেল।
 
জয়েন জেলে যাওয়ার পর অনেক সময় পার হয়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর জেলজীবনে কতকিছু অতীত হয়েছে তার। কত ভাবনা এসে জড়ো হয়েছে।
 
জড়ো হয়েছে বাড়িতে বৃদ্ধা মা কেমন আছেন, নিলুফা কেমন আছে, গ্রামের গরিব প্রজারা কেমন আছে। কৃষকরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে মাঠে-ময়দানে সংগ্রাম করতে পারছে তো?
 
মনের ভেতর হাজার চিন্তা থাকলেও একাকিত্ব জয়েনকে কাবু করতে পারেনি। জেলে ব্রিটিশবিরোধী কত নেতা। সবার এক দাবি- নিম্নশ্রেণির অধিকার। প্রান্তিক মানুষের অধিকার। সর্বপরি দেশের স্বাধীনতা লাভ। কারাগারে জয়েনকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তবুও গরিব কৃষক, নিজ পরিবারের কথা ভোলেনি একদিনের জন্য। নিলুফা কেমন আছে- খুব করে ভাবিয়েছে তাকে।
 
মতিবিবি একদিন নিলুফাকে বলেন, মা জানি খুব কষ্ট হয় তোমার। মা হয়ে আমার যে কিছুই করার নেই। ধৈর্য ধারণ কর। দেখ কী হয়। নিশ্চয়ই জয়েন ফিরে আসবে। ওর কাছে মানুষের অধিকার আগে। 
আমাকে নিয়ে কষ্ট হয় না, মা। কষ্ট হয় আপনার ছেলেকে নিয়ে। ব্রিটিশরা আপনার ছেলেকে বাঁচতে দেবে তো?
সবই আল্লাহ জানে। শুধু ওর জন্য দোয়া করো। সৃষ্টিকর্তা যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। 
 
কিন্তু বিধিবাম! ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার কয়েক বছর পরেই জয়েন কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ছুটে যায় কৃষকদের মাঝে। গরিব কৃষক জয়েনকে পেয়ে খুব খুশি হয়। তার পর ছুটে গেল বাড়িতে। বাড়ি কেমন খাঁ খাঁ করছে। মা বেঁচে নেই। নিলুফা চলে গেছে নতুন এক সংসারে। ভেঙে পড়ে জয়েন। কষ্টে ভেতরে হাহাকার করছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি। জয়েনের বড় ভাইয়ের মেয়ে আরজু মনের অবস্থা বুঝতে পারলেও চাচা জয়েনকে কিছু বলতে পারেনি। কয়েক বছর এদিক-সেদিক ঘুরেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। জেলার কৃষকদের নিয়ে নতুন করে সংগঠন করেছে। অথচ ঘর ফাঁকা। মা নেই। প্রিয় স্ত্রী নেই। ঘরে তার মন টেকে না। একদিন এক নেতার পীড়াপী ড়িতে জয়েন আবার বিয়ে করে। সংসারজুড়ে দুই ছেলে। তার পরও যেন কোথাও একটা ফারাক। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিলুফার জায়গায় স্থান দিতে পারেনি জয়েন। ঘরে এলে মনমরা হয়ে থাকে। মাকনূর জয়েনকে বলে, আপনার কী হয়েছে? ঘরে এলে চুপচাপ থাকেন।
তেমন কিছু না।
 
শুনেছি আপনার প্রথম বউয়ের কথা এখনো ভুলতে পারেন নাই। আমার ভেতরে কী আপনি তারে খুঁইজা পান নাই? আমার বাবার অনেক টাকা নাই। তয় আমার একটা মন আছে। সেই মনের ভেতর আপনারে সারা জীবন ধইরা রাখতে পারব।
জয়েন কোনো কথা বলে না। চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ে। জয়েনের দুই ছেলে পড়ালেখা শিখে বড় হয়। দুজনেরই চাকরি হয়। ওদের ঘর-সংসার হয়। আবার আগের মতো ঘর আলোয় আলোয় ভরে যায়। শুধু জয়েনের ভেতরেই গভীর অন্ধকার। সংগঠনের কাজে কত রাজ্যে গেছে সে। কত জায়গায় ঘুরেছে। অন্তর চোখ দিয়ে নিলুফাকে খুঁজেছে। পায়নি। জয়েন শরীরে আগের মতো শক্তি পায় না। বেশির ভাগ সময় ঘরেই বইপত্তর, সংবাদপত্র পড়ে সময় কাটায়। কৃষক আন্দোলনের নেতারা তার বাসায় আসে। তাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। কেটে যায় সময়। একদিন জয়েনের ভাইয়ের মেয়ে আরজু এসে বলে, কাকা আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
 
কী কথা, মা?
নিলুফা কাকিমাকে খুঁজে পেয়েছি।
বলিস কী!
হ্যাঁ। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে কাকিমার সন্ধান পেয়েছি।
নিলুফা তাহলে বেঁচে আছে। কীভাবে সন্ধান পেলি, মা?
 
আমার এক লেখক বন্ধুর মাধ্যমে। কাকিমারও বিশাল সংসার। ছেলেমেয়ে আছে। নাতিপুতি আছে। তবে ভালো নেই কাকিমা। বয়সের ভারে নুয়ে গেছে।
 
আর কত? সময় দ্রুত চলে যায়। মনে হয় এই তো সেদিন। অথচ সত্তর বছর অতিক্রম করল মনের অচিনপাখি। জয়েন বলে।
কাকিমা নিলুফার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে আরজু। নিলুফার ছেলে ফিরোজ বাদ সাধল না জয়েন ও নিলুফার সাক্ষাৎ করানোর বিষয়ে। আবার নতুন করে আশার চর জেগে ওঠে জয়েনের মনের ভেতর। যদি একবার নিলুফার দেখা পায়। কিন্তু কীভাবে তার সামনে যাবে সে?
ভাবে।
 
নিলুফা যদি জয়েনের সামনে না আসে। দেখা না দেয়। নিজেকে অপরাধী ভাবে জয়েন। কয়েকদিন ধরে ঘুম নেই জয়েনের। দেখতে দেখতে মাসের এক শুক্রবারে তাদের মধ্যে দেখা হয়। জয়েন নিলুফার বাড়ি গিয়ে দেখে তার কোনোকিছুতে অভাব নেই। বিশাল ঘর, বাগান, পুকুর। আম-কাঁঠালের গন্ধে পুরো বাড়ি যেন ম ম করছে। পাখির কিচিরমিচির মনকে আরও উদ্বেলিত করে। জয়েন নিলুফার রুমে ঢোকে। একপলক ওকে দেখতেই জয়েন চিনে ফেলে। পাশাপাশি বসে। যেন ওর ষোড়শীর চপলতা নেই। জামের রসের মতো টসটসে ঠোঁট নেই। চোখের দৃষ্টিতে আবেদন নেই।
 
যা কিছু আছে তা ঝরা পাতার ঘ্রাণ। তবুও সেই ঘ্রাণ বারবার প্রাণ ছুঁয়ে যায়। তাদের একরুমে দিয়ে আরজু ও ফিরোজ পাশের রুমে চলে যায়। জয়েন ও নিলুফার বুকে জমে থাকা কত কথা হয়। কিন্তু কথায় আর প্রাণ ফিরে আসে না। দুজনারই আলাদা আলাদা সংসার। জয়েন নিলুফার মাথায় হাত রাখে। নিলুফা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে।
জয়েন নিলুফাকে বলে, তুমি কেমন করে পারলে? কেমন করে পারল তোমার বাবা-মা? কীভাবে বেঁচে আছি জানতে চাইবে না আজ?
 
বিশ্বাস কর, আমার কোনো দোষ ছিল না। সেদিন বাবা-মায়ের মুখের ওপর আমি কিছুই বলতে পারিনি।
বুঝেছি। তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে আমিও আবার নতুন সংসার গড়েছি। কিন্তু মনের মণিকোঠায় তোমাকে ছাড়া কাউকে ঠাঁই দিতে পারিনি। তুমিই যে আমার একজনমের সঙ্গী। আমি ভাবতেও পারিনি তোমার দেখা পাব। মুখোমুখি বসব। ভাতিজি আরজুর মাধ্যমে তোমার দেখা পেয়েছি।
নয়নভরে দেখছি তোমাকে। তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?
 
না। যে জীবনে আমি তোমার হইনি সে জীবনে সুখ-দুঃখের কাব্য শুনিয়ে আর কী লাভ। যাক সে কথা। তুমি কেমন আছ? নিলুফা বলে।
 
তোমাকে ছাড়া যেমন থাকা যায়। জানো, তোমাকে না পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর সংসার গড়ব না।
তা কী হয়। মাকনূর কেমন আছে?
যেমনটা তুমি আছ।
 
বিয়ে করে ভালো করেছ। এই বয়সে তোমাকে কে দেখভাল করত? জয়েন আমাকে ক্ষমা করে দিও।
না না। কী বলছ। তোমার তো কোনো দোষ ছিল না।
 
জানো জয়েন, আমার এক-একটি রাত বড়ই বিষাদময় হয়ে ওঠে। আমার চারপাশে সবুজ প্রকৃতি অথচ ভেতরে ধু ধু  বালুচর। শুধুই হাহাকার। ভেতরে একটা দাগ আছে। অনেক চেষ্টা করেও মুছতে পারিনি। জয়েন তোমার মা বেঁচে আছে?
না। জয়েন বলে।
 
বিচ্ছেদের সত্তর বছর পর আবার আমাদের দেখা হলো। কথা হলো। বিধাতার কী নিয়ম। তাই না?
নিলুফা আজ তাহলে আসি?
 
আসবে? আর একটু বসে গেলে হতো না। কত যুগ পরে তোমাকে দেখেছি। আবার কী আমাদের দেখা হবে না?
জয়েনের দুচোখের কোনায় জল। নিলুফা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জয়েনের পথ...।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৫২ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী মোস্তফা কামাল। তার ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাস অসামান্য এক শিল্পকর্ম। পুরো পৃথিবী যে করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, তাতে চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে উঠেছিল, সেই প্রেক্ষিতে এ দেশের মানুষের জীবনযাপনে কী ভয়াবহ নিস্তব্ধতা, অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার নেমে এসেছিল, সেটাকেই উপজীব্য করে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেছেন। এদিক বিবেচনা করলে এটি একটি বিশেষ সময়-পরিস্থিতিনির্ভর উপন্যাস। সে কারণে একে বিশেষায়িত উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। আমাদের সাহিত্যে উপন্যাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শাখা। সাহিত্যে উপন্যাস বা কবিতা-গল্প যেটাই হোক, সেখানে নিজের অবস্থান সুনিশ্চিত করতে হলে নিজস্ব স্টাইল তৈরি ও বিষয়বস্তুতে ভিন্নতা ধারণ ব্যতীত সম্ভব নয়। প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে শুরু করে এ সময়কাল বিবেচনায় নিলে, যারা খ্যাতিমান হয়েছেন উপন্যাস সাহিত্যে, তারা প্রত্যেকেই নিজস্বতাগুণে অমরত্ব বা কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্ম সেই বিবেচনায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারছে বা পেরেছে, সে বিচার-বিবেচনার সময় এখনো আসেনি। তবে স্বতন্ত্র তীব্র একটা আলো তার সাহিত্যকর্মে যে ছড়ানো, বিভাসিত- তাতে করে তিনি যে কালের যাত্রায় ভিন্নতর সাহিত্যসাধক, তা অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয় না। তার উপন্যাসের প্যাটার্ন ও বলার ভঙ্গি একদমই আলাদা। উপন্যাসে শিল্প যে একটা বড় ব্যাপার এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ, মোস্তফা কামালের উপন্যাসে সেটা দারুণভাবে আছে। শুধু গল্পের জন্য গল্প বললে সেটা সার্থক শিল্পকর্ম হয় না। হয়তো পাঠক মেলে। জনপ্রিয়তাও হয়। কিন্তু সাহিত্যগুণ বিচার-বিশ্লেষেণে এসবের গুরুত্ব থাকে না। মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্ম শুধু গল্প বলার জন্য গল্প নয়, সেখানে সুনির্দিষ্ট সুপরিকল্পিত বার্তা থাকে, দর্শন থাকে, উপস্থাপনে মৌলিকত্ব থাকে এবং শিল্পের ব্যবহারে সচেষ্ট ও সচেতন থাকেন তিনি। 

বাংলা উপন্যাসের ধারায় আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। মোস্তফা কামাল সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারায়, এ সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগেও বাংলা ভাষায় উপন্যাস বা উপন্যাস ধরনের আখ্যান রচিত হয়েছে। হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’, প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাঙালি লেখক যিনি বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাধারণ সবশ্রেণির পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। তার উপন্যাসের বিষয়বস্তুও ছিল অতীতের লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গঠনশৈলী, ভাষা, বিষয়বস্তু, শৈল্পিকতা- সবদিক থেকে নতুনত্বে পূর্ণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের মূলত সেখান থেকেই শক্ত ও সফল অভিযাত্রা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বপ্রতিভাও উপন্যাসে প্রথম দিকে বঙ্কিমের জন্মপ্রিয়তার কাছে ম্লান ছিলেন। কিন্তু তার উপন্যাস সবদিক থেকে বঙ্কিম থেকে ভিন্ন ছিল। সময়ের সিঁড়ি ধরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে একসময় মগ্ন হয়ে ওঠেন বাঙালি পাঠক। বাংলা ছোটগল্পেরও সার্থক সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের হাতে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস ও গল্প রচনা করে রবীন্দ্রনাথের সময়কালেই তুমুল জনপ্রিয়তা পান। এভাবে মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর বাংলা উপন্যাসে বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলীতে পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনও যে ব্যাপক জনপ্রিয় হতে পেরেছিলেন, তার কারণ তাদের উপন্যাসে বিষয়বস্তু, গঠন ভাষাশৈলীতে পুরো নিজস্বতা বিদ্যমান ছিল। উপন্যাসের এ ধারাবাহিকতায় নিজস্ব শৈলীতে বিখ্যাত হয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, আকবর হোসেন, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রাজিয়া খাতুন, মাহমুদুল হক, রাবেয়া খাতুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, জহির, ইমদাদুল হক মিলন-সহ অনেক কথাশিল্পী, তারা উপন্যাসে গতানুগতিক ধারাকে গ্রহণ করেননি। যারা গতানুগতিকতা গ্রহণ করে সাহিত্যকর্ম করেছেন, তাদের সমকালীন অনেকেই বাহবা লাভ করলেও কালের যাত্রায় বিস্মৃত ও অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছেন, তাদের সৃষ্টিকর্ম সেভাবে গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে মেধাবী ও দূরদর্শী যেকোনো কথাশিল্পীই সৃষ্টিকর্মে বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে গঠনপ্রক্রিয়া, শিল্পমান, নিজস্ব বার্তা, সমাজ-সমকাল-রাজনীতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-অর্থনীতি-অবক্ষয় এসব গ্রহণে ও সৃষ্টিশীলতায় সতর্ক থাকেন। যারা বাংলা কথাসাহিত্যে অমরত্ব অর্জন করেছেন তারা মৌলিকত্বে অসম্ভবরকম সচেতন ছিলেন এবং সৃষ্টিকর্মে নিজস্ব ধরন বা স্টাইল প্রতিষ্ঠা করে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিসহ আরও বহু বিচিত্র বিষয় উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্বতা সৃষ্টিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রত্যেকেই নিজস্ব মৌলিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মোস্তফা কামালও সেই জায়গাটিতে অধিকতর সচেতন তার শিল্পকর্মের মৌলিকত্বে ও নিজস্ব স্টাইল নির্মাণে।

বাংলা সাহিত্যে অধিকাংশ উপন্যাসই পারিবারিক-সমাজব্যবস্থা ও রোমান্টিকতাকে কেন্দ্র করে মূল বিষয়বস্তুতে গড়ে ওঠা। রাজনীতি, সমকাল এসব ধারণ করেও যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে দায়বোধ কাজ করেছে বেশি। এ ধরনের উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লেখকের আত্মসচেতনা ও বিশেষ প্রস্তুতি থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই এ ধরনের উপন্যাস হুট করে লেখা যায় না। লেখককে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেই এ ধরনের উপন্যাস রচনা করতে হয়। সে কারণে বাংলা সাহিত্যে বিশেষায়িত উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা অপ্রতুল। এর পরও কথা হলো, এসব বিষয়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সার্থক উপন্যাস বা বৃহত্তর ক্যানভাসে কয়টি উপন্যাস রচিত হয়েছে, যেখানে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা হয়েছে। এগুলো জাতীয় বিষয়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর আগে যে করোনাসংকট তৈরি হয়, তাতে গোটা পৃথিবী একসঙ্গে প্রায় মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়েছিল। এরকম ঘটনা পৃথিবীতে বিরল, যা একই সঙ্গে গোটা পৃথিবীর রোগে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশও স্বাভাবিকভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। করোনায় বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাভাবিক জীবনযাপন ভেঙে পড়েছিল। প্রতিদিন স্বজন আত্মীয়হীন করুণ মৃত্যু। এই প্রথম মানুষ বুঝল, মানুষ মূলত একা। এই ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে পৃথিবীতে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। বাংলাদেশেও সৃজনশীল সাহিত্যে অনেক কবি-সাহিত্যেকের উপন্যাস-কবিতা-গল্পে করোনা মূল বিষয়বস্ত হয়ে উঠেছে, সেই সময়কালকে ধারণ এবং সেই সময়কালের মৃত্যু-ভয়াবহতার কঠিনতম যে বাস্তবতা, তা অনেকের সাহিত্যকর্মে যথাযথভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। সমকালকে ধারণ না করে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিও তো অসম্ভব একটি ব্যাপার। মোস্তফা কামাল এ সময়কালে মেধাবী ও নিবেদিত লেখক। করোনাকালীন সময়কালকে ধারণ করে সেই সময়ের বহমাত্রিক কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতাকে ধারণ করে ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাস লিখেছেন। এ কাজটি বেশ কঠিন। কারণ তার সময়কালের এ ঘটনা, নিজের দেখা, হয়তো নিজেও অনেকখানি শিকারও। সেটাকে শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করা বেশ কঠিন। কারণ দেখা ঘটনা বা জীবনের কোনো ঘটনা সহজেই বলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে শিল্পরূপ দিয়ে সর্বজনীন করে মহৎ সাহিত্য নির্মাণ কঠিনই। মোস্তফা কামাল সততা ও ধ্যানীভঙ্গিতে নির্মোহ দৃষ্টিতে করোনাকালীন বাংলাদেশের যে ভয়াবহতা, আর এর ভেতর দিয়েই মানবহৃদয়ের বহুমাত্রিক ক্ষতবিক্ষত স্বরূপটি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আরও বিস্ময়কর, তিনি এ উপন্যাসে নিজের মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ করেছেন। তিনি খুব কৌশলে বলেছেন, চীনের লোকজন ইংরেজি জানে না। জানার প্রয়োজনও মনে করে না। যাদের প্রয়োজন তারা চীনা ভাষা শিখে নেবে। মূলত এর মাধ্যমেই তিনি আমাদের ভাষাপ্রীতির মূল মেসেজটি দিয়ে দিয়েছেন।

বিষাদ বসুধা উপন্যাসের নামকরণে প্রথমেই মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু নামটি স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ  বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটি এত বছর পরও এখনো বাঙালি পাঠকমনে তরতাজা হয়ে বেঁচে আছে। সে কারণে বিষাদ বসুধা যে বিষাদ-সিন্ধু নামটি মনে করিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। বিষয়বস্তুতে ও বিরাটত্বে দুটো উপন্যাস একদমই দুই মেরুর। বিষাদ বসুধা ছাড়া অন্য আর কোনো নামও এখানে যৌক্তিক হতো বলে মনে হয় না। উপন্যসটির প্রধান চরিত্র মোহিনীর নামে ভাবা যেতে পারত, কিন্তু বিষয়বস্তুর যে বিরাটত্ব, তাতে ‘মোহিনী’ চরিত্রের মধ্যেও পুরোট ধারণ করা সম্ভব ছিল না। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের নামকরণ রোহিনী হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাধ ঠাকুরের’ চোখের বালি’ উপন্যাসের নাম বিনোদিনী নয়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের নাম অচলা হয়নি, কিংবা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের নামও তো কপিলা হতে পারত, হয়নি। কারণ কপিলা পুরো উপন্যাসটিকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। একইভাবে আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসের নামকরণ রোকেয়া হয়নি। অথচ এসব উপন্যাসের এরা প্রত্যেকেই প্রধান চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের বিশালত্বে-বিষয়বস্তুতে-গুরুত্বে এসব চরিত্রকে ছাপিয়ে সর্বজনীন ও অধিক অর্থপূর্ণ নাম এসে নির্বিধায় দখল করে নিয়েছে- এখানেই লেখকের শিল্পমত্তার পরিচয়। মোস্তফা কামাল উপন্যাসটির নামকরণে দুর্দান্ত শিল্পদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।  

উপন্যাসটি পাঠের শুরুতে একটুও অনুধাবন করা যায়নি, এটা করোনাকালীন সময়কালকে ধারণ করে রচিত। উপন্যাসটিতে ৩৪টি অধ্যায় আছে। মোট পৃষ্ঠা ২০৭। ৪৮ পৃষ্ঠায় এসে প্রথম করোনার কথা পাঠককে বললেন লেখক। অথচ উপন্যাসটির মূল উপজীব্য করোনাকে কেন্দ্র করে। কী অদ্ভুত শিল্পশক্তিতে লেখক ধীরে ধীরে করোনাকালীন সময়কালের মধ্যে, কঠিন বাস্তবতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন, এবং যা খুবই প্রাসঙ্গিকতায়। এক অদ্ভুত কৌশলে পাঠককে তিনি ধাবিত করেন করোনার ভয়াবহতার ভেতর। প্রথম দিকে বিশেষ করে ছয় অধ্যায়ের মধ্যে এসবের ছিটেফোঁটাও নেই। তখন মস্তিষ্কের কোষে কোষে নক করছে ‘চোখের বালি’ কিংবা ‘মাদাম বোভারি’র মতো এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংকট। বিনোদিনী যেমন প্রকাশ্যে না বলে নিজের ভেতর নিজে যেমন অনেক প্রশ্ন তুলেছে-উত্তর খুঁজেছে, বোভারি যেমন অনেক কথাই রোদলফকে না বলে নিজের ভেতর বোঝাপড়া করেছে, মোহিনীও তো ঠিক তাই- নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া-অজস্র প্রশ্ন- আত্মসমালোচনা করেছেন। বহুবার বোঝাপড়া করতে চেয়েছেন আরেফিনের সঙ্গে। এক-দুবার করেছেনও। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-রাগ-অভিমান ক্ষোভ যখন চরমে মোহিনীর, তখনই করোনার কবলে মুষড়ে পড়েন তিনি নিজেই- আরেফিনের জন্য। কারণ আরেফিন তখন চীনের হুবে শহরে অফিসের কাজে। হুবে তখন করোনা আক্রান্ত শহর। করোনায় মরছে মানুষ। যে আরেফিনের প্রতি মোহিনীর এত ক্ষোভ, অভিমান, করোনার খবরে বেদনায় আছড়ে পড়েন নিজের ভেতরে নিজেই। মনস্তাত্ত্বিকতার সঙ্গে লেখক কঠিন এক বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দেন মোহিনীর সঙ্গে পাঠককেও। সেখান থেকে আর কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না। প্রবল স্রোতধারায় অসহনীয় এক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে শুধুই ধাবিত হতে হয় সম্মুখে। সেই স্রোতধারার ভেতর প্রেম-প্রণয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানবতা,  অমানবিকতা, খাদ্যসংকট, দুর্বিষহ জীবনযাপন, অসংখ্য অযত্ন-অনাদর-অসহায় মৃত্যু- একাত্ম হয়ে ভেসে যায়, সেখান থেকে উজান ঠেলে ফিরে আসা কঠিনের চেয়ে কঠিন- অসম্ভব এক ব্যাপার হয়ে ওঠে।
চলবে...

মৃত্তিকার ঘ্রাণ

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম
আপডেট: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
মৃত্তিকার ঘ্রাণ
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুদ

অরুণোদয়ের আগেই উদয় পালের বাড়িতে মৃত্তিকায় তৈরি বাসনকোসন পোড়ানোর ভাটার হাপর জ্বলছে। পালবাড়ির বড় ছেলে রাতুল পাল আর ছেলের বউয়ের ঘুম ভেঙেছে সবার আগে। পালবাড়ির ভেতরে ছোট্ট একটা মন্দির। সেখানে বসে উদয় পালের স্ত্রী মিনতি পাল প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় শিঙা বাজায়। আজও শিঙা বাজাচ্ছে। বড় ছেলের বউ রেণুকা পাল জ্বলন্ত ভাটার হাপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। করাত কলের গুঁড়ো আর খড়ি যখন একসঙ্গে জ্বলে তখন ভাটার হাপরে দপ্ দপ্ শব্দ হয়। শব্দটা বুকে এসে লাগে রেণুকার। রতন পালের সঙ্গে এক বছর আগে পরিণয় সূত্রে এ বাড়িতে এসেই মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে রেণুকা। সময় সময় রতন পালের ওপর খুব রাখ হয় রেণুকার। সে ভাবে, লোকটা একেবারেই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে করতে সেও মাটির মতো সর্বংসহা হয়ে গেছে। এত কটু কথা কই, এত বকাঝকা করি তবুও উচ্চবাচ্য করে না। ঘরে আর দুই দিন পরেই লোকটা বলেছিল, শোনো রেণু, মাটি আর সুতা দুটোই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে ধৈর্য থাকতে হয়, মাটির মতো নরম হতে হয়। সুতার সঙ্গে একই আচরণ করা লাগে। একটু টান লাগলেই সুতা ছিঁড়ে যায়। কুমার আর তাঁতিদের ধৈর্যহারা হলে চলে না। রাগও মাটি করতে হয়। সেদিন থেকেই বুঝে গেছি লোকটার স্বভাব। মানুষ নরম হয়, তাই বলে এত নরম হয়! 

রতন ভাটার হাপরে খড়ি দিচ্ছে। রেণুকার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। দইয়ের মালসা, ঢাকুন, ঢোকসা, হাঁড়িপাতিল পোড়াচ্ছে রতন। বোশেখ মাসে ভাটা বন্ধ থাকে। ভাটায় আগুন জ্বলে না। তার পর বৃষ্টির সময় ঠিকমতো কাজ করা যায় না। শীতকালটা কাজের উপযোগী সময়। এ সময় এঁটেল মাটির অভাব হয় না। মাটি ক্রয় করা, তা কেটে এনে মাটির টিবি বানিয়ে জমা রাখা। এ সময় রাতদিন কাজ করতে হয়। বোশেখ আসার আগেই কলস, কয়েলদানি, খোলা-বালেন, কোলা, মাটির ব্যাংকসহ নিত্যব্যবহার্য বাসনকোসন তৈরি করে ঘরে মজুত করে রাখা লাগে। রেণুকা বাড়িতে আসার পর রতনের শনৈ শনৈ উন্নতি হচ্ছে। রেণুকা ফুলদানি, রঙিন মাছ, খেলনা পুতুল, কলমদানিসহ নানারকম মাটির জিনিস তৈরি করতে পারে। রেণুকার প্রতি পরিবারের সবাই খুশি। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। শ্বশুরবাড়িতে রেণুর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তার কথামতো সবকিছু হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুর কথার বাইরে কিছু করে না। এক বছরে সবার মন জয় করে শ্বশুরবাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে।
রতন অনেকক্ষণ পর রেণুকার দিকে নেত্রপল্লব ফেরালো। রেণুকে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রতন বলল, কিছু কবা-

-কী কব? তুমি কি কথা কও। বোবার সঙ্গে থাকতি থাকতি বোবা হয়ে যাচ্ছি।

-কাম করব না কতা কব। গত কয় মাসে কী কষ্টই না গেল। এঁটেল মাটি কিনে বাড়িতি আনা, টিবি বানানো, মাটি ছেনা, চড়কায় তোলা, জিনিসপত্র বানানো, কত্ত কাম।
-তুমি বিয়ে করিছিলে ক্যা, কও তো?

-কী সব আবোল-তাবোল কতা কচ্ছ। তুমার কোনোটার কমতি আছে?
-তোমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই মাটির সঙ্গে আছি। মাটির গন্ধ নিয়ে আছি। মাটি নিয়ে খেলছি। তুমিও তো মাটিরই, তোমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি না। তোমাকে নিয়ে খেলার সময় দিলে কই?

-বাব্বা, ভালোই তো কতা শিখিছ। সামনের বোশেখে তুমাক সময় দিব। বোশেখ মাস বিয়ের মাস। দেখতি দেখতি এক বছর হতে চলল। কী খুশি তো?
-তুমি আমাক সময় দিবা, তুমি তো কাঁচা খড়ির মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাও।

-আঘাত দিয়ে কথা কচ্ছ রেণু। তুমাক ভালোবাসি। জানের মিদি রাখি। তুমি আমন কতা কলি বাঁচপো না রেণু।
রেনু এগিয়ে গিয়ে রতনের ঘেমে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, 
-আরে বাপু টোকা দিয়ে দেখলাম। মন খারাপ করিছ। ইতিউতি চেয়ে রতনের কপালে আলতো করে চুমো খেল রেণু।

রেণুকার চুমো পেয়েও খুশি ছড়াল না রতনের বিষণ্ন মুখে। করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো রেণুকার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল রতন। ভাবনারা এসে মাথার ভিতর নাড়া দিতে লাগল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সংসারের হাল ধরা। সেই শুরু। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর পড়া হয়নি। ছোট ভাইটি বিএ পাস করেছে। সে এখন চাকরি করে। বাইরে থাকে। ছোট বোনটা এসএসি পাস করেছে। চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গে বিয়েও হয়েছে। মা সুস্থ থাকলেও বাবাকে দেখতে তার সময় চলে যায়। সংসারের কাজকর্ম করে মাটির কজে সাহায্য করতে হয় রেণুকাকে। তারও কষ্টের অন্ত নেই। সত্যি তো, এক বছরে একদিনের জন্যও রেণুকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়িতে কাজের চাপ দেখে শ্বশুরও রেণুকাকে না নিয়ে ফিরে গেছে।

দুপুরের পর ভাটায় খড়ি দেওয়া বন্ধ হলে রতন উঠে স্নানের জন্য বাড়ির পাশে নিস্তরঙ্গ ডাকুয়া নদীতে চলে গেল। রেণুর খোঁচামারা কথা শুনে রতন আর কথা বলছে না। রেণুর মনটা ভাটায় পোড়ানো কলসের মতো পোড়ে। উপায়ান্তর না দেখে রেণুও রতনের পেছন পেছন নদীতে গেল। রেণু ভাবে- কাজপাগল লোকটাকে কথার ঘায়ে কষ্ট দিলাম। সাধারণত দুপুরের পরে নদীর ঘাটে স্নান করতে যায় কুমারপাড়ার লোকেরা। এখন ফাঁকা ঘাট। রতনের গা ঘেঁষে বসে রেণুকা। তার পর ভগ্নকণ্ঠে বলে, আরে আমি তো তুমার সঙ্গে ইয়ারকি করতিছিলাম। 

রেণুকার কথা না শোনার ভান করে স্রোতহীন মজা ডাকুয়ার স্বচ্ছ জলের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকল রতন।

মুহূর্তে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রতনকে মোহিত করার ক্ষমতা রেণুকা রাখে। সে কেয়া সাবান দিয়ে রতনের মুখ, মাথা ঘষতে লাগল। এর আগেও এ কাজ অনেকবার করেছে রেণুকা। বুক-পিঠে সাবান ঘষতে গিয়ে দুষ্টুমি করে ও। হেসে ফেলে রতন। রতনের প্রাণময় হাসিতে খুশি ছড়ালো রেণুকার মুখে।

রেণুকা রতনের মুখের ওপর মুখ রেখে বলল, ভাটার হাপর ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে। দেখলে তো তোমাকে ঠাণ্ডা করে ফেললাম কত অল্প সময়ে।

-আবারও উল্টাপাল্টা কতা কচ্ছ। তুমি আমার চেয়ে বেশি লেখাপড়া জানো ঠিক আছে। দশ ক্লাস পড়িছ। কিন্তু তুমার ঢাকনা দেওয়া কতা বুঝার ক্ষমতা আমার আছে।

সত্যি বলছি। আমি খারাপ অর্থে কিছু বলিনি। তুমি যা বোঝ তা ঠিক নাও হতে পারে। চলো এরপর থেকে আর কোনো 
খুনসুটি নয়।

স্নান সেরে ওরা ডাকুয়া নদীর কূলে ওঠে। রতন আগে, পেছনে রেণু হাঁটছে। রতন বলে, রেণু তুমি সামনে যাও। আমি পেছনে হাঁটি।
-কেন?

-তুমাক দেখতি দেখতি যাই। আর শোনো, আমার দাদু অনেক দিন বেঁচে ছিল। দাদু মজার মজার গল্প করত। কত রকম গল্প। দাদির গল্প বেশি বেশি করত। দাদি তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। দাদু কইত, কাঁচা মাটির এক রকম গন্ধ, হাত-পা দিয়ে ছেনার পর মাটির এক রকম গন্ধ আর পোড়ালি হয় এক রকম গন্ধ। মাটি ছেনার পর যে গন্ধ মাটি দিয়ে বের হয় সেই গন্ধ নাকি যৈবতী মাটির গন্ধ। ভাটায় ওঠার আগে নাকি মাটির শরীরে যৌবন আসে। গন্ধ ছড়িয়ে যায়। দাদা এসব কতা কইত। এসব কতা বিশ্বাস করো রেণু।
তুমি সবকিছুই বোঝ, শুধু পালবধূর মন বুঝতে পার না। মাটির এত গন্ধের খবর রাখো, ঘরের মাটির খবর রাখো না। দাদার মতো যৈবতী মাটির গন্ধ ভালোবাসতে পারলে না। 

ওদের গা ঘেঁষে প্রতিবেশী মালতি দাদি নদীতে যাওয়ার পথে ভাঙা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, তুরা হচ্চিস পালপাড়ার রাধা-কৃঞ্চ। তোরে দেখে আমার প্রাণডা আইটাই করে, তোর দাদার কতা মনে পড়ে। বুঝলি রেণুবালা, তোর দাদাও রতনের মতো নরম মানুষ ছিল।

-তুমি কী করে বুঝলে রতন নরম মানুষ?

-এই ছেড়ি, পঞ্চাশ বছর পুরুষ মানুষ নিয়ে কাটালাম, আর নরম-গরম বুঝিনে।

এবার যাও, স্নান করগে। কথা বাড়াল না রেণু। ওরা দ্রুত হাঁটা ধরল বাঁশবাগানের সরু পথ দিয়ে।

শুক্লাদ্বাদশী। ঘুম নেই রতনের চোখে। একদিকে রেণুর কথার ঝাল, অন্যদিকে পাড়শি দাদির টিপ্পনি। রতনের মনটা মর্মপীড়ায় বিষণ্ন। বাঁশবাগনে রাত জাগা পাখির করুন আর্তনাদ। মধ্য রাত হবে হয়তো। রতন ভাবে, সকালবেলা ভাটার পোড়ানো মাল নামাতে হবে। ঘরে সাজাতে হবে। বেঁচে যাওয়া মাটির ঢিবি পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। চৈত্র মাসের আজ উনত্রিশ দিন। দুই দিন পর থেকে হাতে কাজও নেই। এখন শুধু মালপত্র বিক্রির পালা। বোশেখে ধান ঘরে উঠলি কৃষকরা ধান দিয়ে খোলা-বালেন, ঢাকুন-ঢোকসা কেনে। সারা দিন খাটুনির পর চোখের পাতা এক সময় জোড়া লাগে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রতন। রতন স্বপ্ন পরাবৃত। ও দেখে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ঘরের রোয়াকে পত্রাসনের ওপর বসে আছে। পাশে কেউ নেউ। ঘোমটায় ঢাকা তার মুখ। তার চারপাশে হাঁড়ি-কলসির ভাঙা খাপরার কুচি। খাপরার কুচি নিয়ে কী করছে মেয়েটি? রতন মেয়েটির মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। ঘোমটা সরে গেল মেয়েটির মাথা থেকে। পেছনে মুখ করে বসা মেয়েটি। কেশবতী মেয়েটির মাথার কেশগুচ্ছ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে রেণুকা বিছানায় নেই। মেয়েটি কী রেণু! বলদেব এসে ভর করে রতনের মাথায়। উদ্বেলিত সে। উজবুকের মতো ও উঠে মেয়েটিকে জাপটে ধরতে গেলে মেয়েটিই উঠে রতনকে জাপটে ধরে। উচ্ছল মেয়েটির তুলোর মতো শরীরের মধ্যে রতন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। ভয়ে রতন চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে শব্দে ঘুম ভাঙে রেণুর। রতনকে বুকের সঙ্গে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- অমন করছ কেন? কী হয়েছে তুমার? রেণুকা রতনকে এমনভাবে আদর করতে থাকে যেন সে শক্তি ফিরে পায়। গভীর ধ্বনি দ্বারা নিনাদিত রেণু। মন্দ্রিত সে। মন্দাকিনীর জলে ভিজে যায় জমিন। অতিশয় আনন্দিত সে। রসোদ্গারের স্মৃতি ভুলে যায় রতন। রতনও সাহসী সুকানি হয়ে ওঠে। এখন সে রূপোন্মাদ। উর্বর মাটিতে ফসল রোয়াতে তৎপর হয়ে ওঠে ও।

কতক্ষণ পর রেণু আলুলায়িত কেশদামে কবরী বাঁধতে বাঁধতে আদরণীয় কণ্ঠে রতনের দিকে স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে বলল, অনুভব করতে পারছ, মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে ভাটার চিমনিও ঠাণ্ডা হয়েছে গো। চলো এবার গা শীতল করা ডাকুয়ার জলে যাই। পবিত্র হয়ে ভাটার মালপত্র নামিয়ে ঘরে তুলি।

বিস্ময়াবিভূত রতন রেণুর অত্যুজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো, স্বপ্নে দেখা ওই সুন্দরী মেয়েটি আমাকে দৈবশক্তি দান করে গেছে।

-তুমি কী বলছ এসব! ওরে বলদ, তোমার স্বপ্নে দেখা ওই নাগরী মেয়েটি তো আমিই ছিলাম।

ঘোর কাটে না রতনের। অপ্সরীর মতো দেখতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তার চোখের সামনে ছায়া হয়ে মন্দ্র মাতাল নাচতে থাকল।

কাচের দেয়াল নেই

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
কাচের দেয়াল নেই

কাচের দেয়াল নেই
তবুও আপনার বুকে শত্রুর গুলি বিঁধে যাবার আগে 
কাচভাঙা বিকট শব্দ আমাদের পাড়ার বাতিগুলো 
নিভিয়ে দিয়ে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এলো দুঃসংবাদ, 
আমরা হতবাক, 
আমাদের নিতান্ত সাধারণ প্রয়োজনগুলোর কপালে ঘামের বিন্দু, 
অপ্রস্তুত জানালা দরজা ভিনদেশি আসবাব
চিৎকার করে উঠলেন মুদিদোকানি চা বিক্রেতা-
মুচি রিকশাচালক পাড়ার নবীন ব্যাচেলর;
আপনি কঁকিয়ে ওঠার আগে কেবিন রেখে বেরিয়ে এলেন নার্স, 
অ্যাপ্রোনে তখনও তার গোলাপ সুবাস,
আপনার বুকের চাতালে ফসল শুকাচ্ছেন কৃষাণ কৃষাণী,  
আপনার চোখ সাঁতরে যাচ্ছেন একদল নাবিক,

কাচের দেয়াল নেই তবুও শত্রুর ফাঁদ
তবুও আপনি চুপচাপ নিশানার কেন্দ্রবিন্দু।

বিশালাক্ষী

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৩৬ পিএম
বিশালাক্ষী

তোমার দেখায় আরেকটি চোখ প্রকাশিত হয়;
যে চোখে পূর্ণিমা জাগে রাতআকাশে,
শুকতারা প্রতীতি জাগায় আর একটি ভোরের।

পাংশু আশপাশ আড়মোড়া ভাঙে
ডাঙায় একটি হরিয়াল শুধু ডেকে যায় কপিশ কন্দরে।

চাওয়া-পাওয়া

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
চাওয়া-পাওয়া

আমি যখন সকাল চাই
তুই তখন সন্ধ্যা
আমি যখন ফসল চাই
তুই ঊষর বন্ধ্যা

আমি যখন জলের কাছে
আঁজলা পাতি রাত্রে
তুই তখন দূরে কোথাও
নিবিড় ঘন গাত্রে

আমি যখন মরতে বসি
স্বপ্ন নিয়ে চক্ষে
তুই তখন বাহুলগ্না
অন্য কারও বক্ষে

তবু তোকেই চাই যে আমি
ভালোবাসার শর্তে
চাই বাঁচতে তোকে নিয়েই
তোর জন্য মরতে