
শিশুবেলায় আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রবল আগ্রহে অনুসরণ করার মতো একজন মানুষ পেয়েছি। তিনি আবুল কাশেম ফজলুল হক। যাকে আমরা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক বলে চিনেছি। আমরা তার মতো হতে চেয়েছি। তিনি আমাদের শৈশবের নায়ক।
মানুষ তার কাজ ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে নায়ক হয়ে ওঠেন। শিশুবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়লাম বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার চাখার গ্রামের একজন অসাধারণ মানুষের কথা। তার ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে মুসলমান শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। সেই ১৮৮৯ সালের কথা। তিনি জন্মেছেন ১৮৭৩ সালে। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ (উচ্চমাধ্যমিক সমমান) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এফএ পাস করার পর তিনি গণিত, রসায়ন আর পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে ডিগ্রি পাস করেন। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগে। ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তার এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়তে ভয় পায়। কারণ তারা মেধাবী নয়।
একথা শুনে এ কে ফজলুল হকের জেদ চেপে গেল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন অঙ্ক বিষয় নিয়েই মাস্টার্স পরীক্ষা দেবেন। পরীক্ষার সময় আছে আর মাত্র ছয় মাস। সেই ছয় মাস পড়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণি লাভ করলেন।
এসব ঘটনা একসময় তাকে গল্পকাহিনীর ভেতর নিয়ে যায়। তার ফটোগ্রাফিক মেমোরির কথা শুনি আমরা সেই শিশুবেলায়। তিনি একবার যা পড়তেন বা দেখতেন কিংবা শুনতেন তা ভুলতেন না। তার শরীরে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। তিনি এক ঘুসি দিয়ে ঝুনো নারকেল ছিলতে পারতেন। মুখে পুরে দিতেন আস্ত আম। বাজারের সবচেয়ে বড় কাঁঠাল এক বসাতে খেয়ে শেষ করতে তার দ্বিতীয় কারও দরকার হতো না। এসবই তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তবে এসব ঘটনার ভেতর কিছু কাল্পনিক গল্পও ঢুকে যায়। যেমন তিনি খালি হাতে বাঘ শিকার করেছিলেন বলেই তার নামের আগে যুক্ত হয়েছে ‘শের-ই-বাংলা’ বা ‘বাংলার বাঘ’।
আদতে তিনি ছিলেন ভীষণ বাকপটু, সুবক্তা। তার ‘লক্ষণৌ চুক্তি’, দিল্লি অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ, পাকিস্তান প্রস্তাব পেশের জ্বালাময়ী বক্তৃতা ইতিহাসের স্বর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে। সেসব বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসী এ কে ফজলুল হককে ‘শের-ই-বঙ্গাল’ উপাধি দিয়েছিল। ‘শের-ই-বঙ্গাল’ মানে হচ্ছে ‘বাংলার বাঘ’। সেটাই পরে আমাদের কাছে ‘শের-ই-বাংলা’ হয়ে থেকে গেছে। তার অসীম সাহসিকতা, অদমনীয় মনোভাব এই ‘বাংলার বাঘ’ উপাধিকে যথার্থতা দিয়েছে। বাংলার মানুষ তাকে ভালোবেসে ‘হক সাহেব’ বলেও ডেকেছে।
বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন করেছেন এ কে ফজলুল হক। কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেছিলেন। তার পর ঢুকলেন সরকারি চাকরিতে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন। সরকারের সঙ্গে তার মতের মিল হলো না। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলেন আইন পেশায়।
তিনি ছিলেন জনপ্রিয় বাঙালি কূটনীতিক। নানান রাজনৈতিক পদ অলংকৃত করেছেন জীবদ্দশায়। তিনি ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের মেয়র। এ পদে তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান। এ কে ফজলুল হক ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন।
শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক আমাদের অনুসরণীয় বীরনায়ক। যার জীবণাচরণ আমাদের শিশুবেলা থেকে প্রেরণা জুগিয়েছে দেশপ্রেমের। মাতৃভূমিকে ভালোবাসার। তিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে দরিদ্র কৃষকের ওপর থেকে কর মওকুফ করেন। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস করে প্রজাদের ওপর জমিদারদের ভয়াবহ অত্যাচার বন্ধ করেন। ‘চাষি খাতক আইন’-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ডকে শক্তিশালী করেন।
এ কে ফজলুল হক দেশের সাধারণ মানুষ বলতে কৃষককে বুঝেছেন। তিনি সবসময় কৃষকের স্বার্থ বিশেষভাবে দেখেছেন। যে কৃষকরা আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। তিনি কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাটচাষিদের জন্য পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে এ কে ফজলুল হক পাট অধ্যাদেশ জারি করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসারে নিরলস কাজ করে গেছেন।
এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝিনে। ওসব দিয়ে আমি ফজলুল হককে বিচার করিনে। আমি তাকে বিচার করি গোটা দেশ ও জাতির স্বার্থ দিয়ে।... বাঙালিত্ব ও সাচ্চা মুসলমানিত্বের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনে।’
শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক আমাদের উদ্দীপ্ত করেন, প্রেরণা হয়ে থাকেন। কেবল রাজনীতি নয়, তিনি খেলাধুলা আর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও ছিলেন অনন্য সাধারণ। কিশোর-কিশোরীদের জন্য তিনি বরিশালে থাকাকালীন বালক নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ভারত সুহৃদ নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ সময় কলকাতা থেকে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছিল নবযুগ পত্রিকা। এ কে ফজলুল হক নবযুগ পত্রিকার প্রকাশনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশের পর চারদিকে আলোড়ন তৈরি হয়। তখন কলকাতা উচ্চ আদালতের ইংরেজ বিচারপতি টিউনন সাহেব এ কে ফজলুল হককে নিজ খাস কামরায় ডেকে ব্রিটিশবিরোধী লেখার সঙ্গে তার সম্পৃক্ত
থাকা নিয়ে ভর্ৎসনা করেন এবং হুঁশিয়ার করে দেন। এ কে ফজলুল হক সেখান থেকে ফিরেই কাজী নজরুল ইসলামকে এসে বলেন, ‘আরও গরম লিখে যাও। ইংরেজ সাহেবদের টনক নাড়িয়ে দাও।’
এ কে ফজলুল হকের মতো এমন একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বকে পেয়ে আমরা গর্বিত। তিনি আমাদের পথের দিশা হয়ে আছেন। দেশের স্বার্থে, দেশের আপামর সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক আমাদের অসীম প্রেরণা।
এই মহান মানুষ ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টা কুড়ি মিনিটে পরলোকগমন করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে।
আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব প্রেরণাদায়ী, অসীম সাহসী, দেশের স্বার্থে অনমনীয় এই মানুষের প্রতি তার মৃত্যুদিনে আভূমিনত গভীর শ্রদ্ধা।