সায়মন কোনো দিন ভাবেনি তাকে একদিন দেশ ছেড়ে ছুটতে হবে জীবিকার সন্ধানে অন্য কোনো দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মার তাগিদে যখন সে শিক্ষাবৃত্তির জন্য চেষ্টা করছিল, তখনো মনে মনে স্থির করে রেখেছিল বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্র যদি তৈরিও হয়, তা হলেও সে যাবে না। কিন্তু এখন? এখন তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পাল্টে গেছে জীবনের মেরুকরণের সব সমীকরণ। বারান্দায় দোল খাওয়া কেদারায় দুলতে দুলতে সায়মন তা-ই ভাবছিল। হঠাৎ মুঠোফোনের রিংটোন তার ভাবনায় ছেদ ঘটাল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই সায়মন অজানা এক আনন্দে অদ্ভুতভাবে শিহরিত হলো। মনে মনে ভাবছিল চিৎকার দিয়ে পরিপার্শ্ব কাঁপিয়ে তুলে সবাইকে জানিয়ে দেয়, জীবনের সব গল্পে মানুষ হেরে যায় না। আরও ভাবছিল চঞ্চলার ফোনের জন্য তার কত প্রতীক্ষা। আজ হঠাৎ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। হঠাৎ বৃষ্টি।
ও-প্রান্তে ফোনটা মুঠোয় ধরে চঞ্চলা স্থির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফোন রিংয়ের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চঞ্চলা ভাবতেই পারছে না সায়মন তার ফোনটা রিসিভ করেনি! কারণ সে তো জানে সায়মনের কত অধীর আগ্রহ তার ফোনের জন্য। তাহলে সায়মন কি তার উপেক্ষা সইতে সইতে সে-ই এখন উপেক্ষা করছে তাকে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে চঞ্চলা। এই ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে রিংটোন। সায়মনের ফোন। চঞ্চলা বিলম্ব না করেই ফোন রিসিভ করে। চঞ্চলার অত্যন্ত বিনম্র সম্ভাষণ। একটু নয়, বেশ বিচলিত হয় সায়মন। যে ব্যক্তিটি প্রায় ১৪ মাস আগে সায়মনের ওপর রেগে গিয়ে যোগাযোগের সব মাধ্যমের কপাট বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ তার বিপরীত সুর!
চঞ্চলা ফোন ধরেই একটানা বলতে থাকে, ‘ফোন ধরলেন না কেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত না অন্য কোনো কারণে। নাকি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন? আমি জানি, আপনি মাসের পর মাস আমার ফোনের অপেক্ষা করছেন। প্রায় ১৪ মাস আগে আমি যেদিন আপনার ওপর খুব খেপে গিয়ে বাজে আচরণ করেছিলাম এর কিছুক্ষণ পরই আমি বুঝেছিলাম কাজটা আমি মোটেই ঠিক করিনি। এমন অসৌজন্য আচরণ কোনো সভ্য মানুষ করতে পারে না। এমনটি হয়তো অনেক সময় ঘটে যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। আমার ক্ষেত্রে এমন হবে তা ভেবে দীর্ঘ সময় ধরে খুব যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছি। আপনার সঙ্গে যাতে আমার দেখা না হয় সেজন্য নিজেকে রেখেছি খুব সন্তর্পণে। কিন্তু আজ, আজ পারছিলাম না। আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই ফোন করেছিলাম।’
এটুকু বলে চঞ্চলা থেমে যায়। ও-প্রান্তে সায়মন নির্বাক। কখন থেকে তার মধ্যে এক ধরনের উদাসী ভাবনা চেপে বসে তা-ও ঠাওর করতে পারছিল না। চঞ্চলার প্রতিটি শব্দ তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তার মৌনতা ভাঙল চঞ্চলা।
‘কী ব্যাপার, কোনো কথা বলছেন না যে! আমাকে কি ক্ষমা করা কিংবা ক্ষমায় রাখা সম্ভব নয়? এমনটি না পারাই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রে এমনটি হলে আমি হয়তো পারতাম না। কিন্তু অনেকটা নির্লজ্জের মতো আমি আপনার কাছে অনুশোচনার দহন সইতে না পেরে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ধারণা, মানুষের কাতরতা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই বিফলে যায়। আপনার তরফেও আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করা নিশ্চয় অমানবিক কিছু হবে না। কিন্তু কেন জানি আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস আপনি আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করবেন না।’
মৌনতা ভাঙে সায়মনের। সে বলতে শুরু করে, ‘আসলে আমি সেভাবে ভাবছি না বটে কিন্তু তোমার ফোনালাপ যে আমাকে খুব স্পর্শ করেছে তা স্বীকার করি না। তোমার ধারণা ভুল নয়। প্রায় ১৪টা মাস আমি তোমার অপেক্ষা করেছি। সারাক্ষণ ভেবেছি এই হয়তো তোমার ফোন পাব, এই হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, এই হয়তো পেছন থেকে ডাক পাব- শুনছেন, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি...। তুমি আমার সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করে যে দহনে ভুগেছ এর চেয়ে আমি কোনোভাবেই কম দগ্ধ হইনি তোমার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে। একজন উচ্চশিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে সোনালি দিন সমাবর্তন। অথচ সেই দিনেই আমি তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েও তোমার অপেক্ষায়ই রয়েছি। আমি হয়তো তোমার সঙ্গে আমার ভালো লাগার বিষয়টি নিয়ে ভণিতা করতে পারতাম কিন্তু আগপিছ না ভেবেই আমার জীবনের সোনালি দিনটিতে তোমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কথাটি শেষ করতে না করতেই তুমি যেভাবে আমার ওপর খেপে গেলে তা-ও আমি অস্বাভাবিক মনে করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, একটা ছেলে যত সহজে ভালোবাসি শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা ততটা সহজ নয়। তোমার আচরণে আমি লজ্জিত কিংবা দুঃখিত হয়নি, শুধু উপযুক্ত-অনুপযুক্ততার কথা ভাবছিলাম।’ কথা কেড়ে নেয় চঞ্চলা।
‘এ আপনার বিনয়। বিনয়ী মানুষ আখেরে হারে না, এও আমার বিশ্বাস। আপনাকে কোনো অংশেই কম চিনতাম না, জানতাম না। আমরা একই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী বলেই শুধু নয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আপনার প্রত্যয়ও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা, যাকে হারিয়েছি কৈশোরে। তিনি বলতেন, জীবনটা নদীর স্রোতের মতো। নদী যেমন স্বচ্ছ পানি ধারণ করে, তেমন ওই জলে আবর্জনাসহ জীবনের জন্য হিতকর নয়, এমন অনেক কিছুই থাকে। মায়া মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যেরও অনেক গল্প আছে। জীবন অনেক ক্ষেত্রেই মহাশয় অর্থাৎ যা সওয়ানো যায় তা-ই সয়।’
চঞ্চলার সঙ্গে পরিচয়ের সাড়ে চার বছরের মধ্যে এমন খোলামেলা কথাবার্তা সায়মনের এভাবে কোনো দিনই হয়নি। সে চঞ্চলার কথার গভীরতায় যেন ডুবসাঁতার কাটছে। নিজের নীরবতা ভেদ করে সে চঞ্চলাকে কিছু বলতে গেলে এই ফাঁকে চঞ্চলা ফের কথা শুরু করে।
‘আমি বহুদিন পরে জেনেছি, জীবনের স্বাস্থ্যকর বিষয় হলো আনন্দ। আনন্দ করতে হবে বিষাদের সব বেষ্টনী ভেঙে তা-ও বুঝেছি পরে। আসলে আমি এত পোড় খাওয়া শতছিদ্রবিশিষ্ট একটি জীবন, যে জীবনের রয়েছে অন্তহীন গল্প।’
চঞ্চলাকে থামিয়ে দিয়ে সায়মন ওকে প্রশ্ন করে, ‘গল্পগুলো শোনাবে?’
চঞ্চলার ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ, ‘জীবনের কোনো কোনো গল্প অল্প করেও কাউকেই শোনানো যায় না। এ গল্প লুকোবার, শুধুই লুকোবার। কিন্তু এও সত্য, সব গল্পে জীবন হেরেও যায় না। জীবনেরই কোনো কোনো গল্প আছে জীবনপাত্র উছলিয়া মাধুরী দানের। অনেকেই জানে না এ গল্পের মূল্যের পরিমাণ। প্রসন্ন মুখ তুলে মধুর মরণে পূর্ণ করে সঁপে যায় কত প্রাণ শুধু চরণে চরণে। গোপন ব্যথার নীরব কত বিনিদ্র রাত কাটে মরমে ঢেলে জীবনের কত গান।’
সায়মন বিস্মিত! সে যত কথা বলছে ততই নতুন করে আবিষ্কার করছে চঞ্চলাকে। সায়মন যখন মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসে তখন চঞ্চলা অনার্স শেষ বর্ষে। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে দুজনের বয়সের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু চঞ্চলাকে তার অনেক বেশি পরিপক্ব মনে হয়। মানুষ জীবনে যত পোড় খায় তত বেশি সমৃদ্ধ হয়- এ ধারণাই জন্মেছে চঞ্চলার সঙ্গে আলাপচারিতায় সায়মনের।
সে চঞ্চলাকে বলে, ‘তুমি যে বললে তুমি পোড় খাওয়া মানুষ তাতে আমার মনে হলো জীবনে পোড় খাওয়া দরকার, খুব দরকার। তুমি এ পর্যন্ত যেভাবে জীবন দেখেছ, জীবনকে জীবনের শিক্ষক হিসেবে গণ্য করার সুযোগ পেয়েছ, সে রকমটি আমি পাইনি বলেই আমার বোধের খতিয়ান এত শূন্য। তোমার সঙ্গে আজ ভিন্নমাত্রায় কথা বলে আমার তেমনটিই মনে হচ্ছে। চঞ্চলা, তোমার ভাবনার উর্বর জমিনে আমি যে কতটা অনুর্বর তা নির্ণয় করাও কঠিন।’
চঞ্চলার গলা জড়িয়ে আসছে। সে সায়মনকে মূল কথা বলতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে শুধু সময়ই নষ্ট করেনি, সায়মনের কাছাকাছি থাকলে জীবনে কল্যাণের সেতুটা চওড়া হতো। তার মনে পড়ে জীবন সম্পর্কে মনীষীদের কিছু উক্তি। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।’ মনে পড়ছে তুরস্কের উপকূলবর্তী এজিয়ান সাগরের দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী যার জীবনাবসান হয় ইতালিতে সেই দার্শনিক পিথাগোরাসকে, যিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ এবং না কথা দুটো সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে ছোট। কিন্তু এ কথা দুটো বলতেই জীবনে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হয়।’ তার মনে পড়ছে ইংরেজ নাট্যকার জর্জ লিললোকে, যিনি বলেছেন, ‘একজন আহত ব্যক্তি তার যন্ত্রণা যত সহজে ভুলে যায়, একজন অপমানিত ব্যক্তি তত সহজে অপমান ভোলে না।’ কিন্তু সে যে সায়মনকে অপমান করেছিল তা সায়মন ভুলে গেছে। এখন তার এও মনে হয়, সায়মন কত বড়। তার আরও মনে পড়ে সেই প্রবাদ, ‘ফলবান বৃক্ষই নতজানু হয়।’
সায়মনের ভাবনায় আসে নতুন দিগন্ত। সে মনে মনে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথকে। তার ইচ্ছা হচ্ছিল সে চঞ্চলাকে চিৎকার দিয়ে শোনায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের সেই গানের লিরিক, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ/ রজনীগন্ধা অগোচরে/ যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে,/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান।’ কিন্তু পারেনি। কেন পারেনি তা সে নিজেও জানে না।
সায়মন-চঞ্চলা দুই প্রান্তে দুজনই নীরব। শুধু ইথারে ভেসে আসছে দুজনের তরঙ্গায়িত নিঃশ্বাস। এ যেন দুজনের সৃষ্টি অদৃশ্য বহুমাত্রিক এক অন্য ভুবন। হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে দুই প্রান্তে দুজনই সমস্বরে উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, ‘পাওয়া কাকে বলে যে মানুষ জানে না, সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।’