ঢাকা ১১ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
English

নিঃশব্দ কান্না

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৮ পিএম
নিঃশব্দ কান্না
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

সেদিন ছিল ঈদের দিন। ভাড়াটিয়ারা অনেকেই ছানাপোনাসহ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গেছে। বাড়িটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আমার নিঃসন্তান হৃদয়ে এই শূন্যতা মুহুর্মুহু আহাজারিতে গুমরে মরছে। কেননা, আমি মানুষটা কোলাহলের, নিরালার নই। তবে ঈদ-আনন্দ গ্রামে উপভোগ করতে চাই আমিও। কিন্তু আমার যে সন্তান হচ্ছে না। এই না হওয়ার হাজারো অপবাদ আর অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি বড্ড ক্লান্ত।    

ভেজা চুল ঝেড়েমুছে তোয়ালেটা নিয়ে মাত্র বের হলাম। হঠাৎ আমার ভাড়াটিয়া সুমির মা এসে বলল- ‘আফা, সকাল থাইকা পিচ্চিটা আফনেগো গেটের ভেতরে খাড়ায়ে রইছে। তা-ই লইয়া আইলাম।’ ছেলেটির বয়স বড়জোড় আড়াই-তিন বছর হবে হয়তো। গায়ের রং কালো। পরনে লাল প্রিন্টের শার্ট-প্যান্ট। মুখমণ্ডল গোলাকার। ফোলাফোলা টোলপড়া গালে শ্লেষ্মার আঁটলি। মায়ামায়া চোখযুগল। আমি আদর করে কোলে নিলাম। সে তার চোখের গোল কর্নিয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। নাম জানতে চাইলাম। কিছুই বলে না। সম্ভবত স্বল্পবাক। ওর টোপাটোপা গালে শ্লেষ্মা-আঁটলি দেখে আমার স্বামী বলল- দেখছ কী? ওরে গায়-গোসল করিয়ে আগে খেতে দাও। পরে খোঁজ-খবর নিয়ে না হয় একটা বিহিত-ব্যবস্থা করব। 

গোসল করিয়ে সাজুগুজু করালাম। বাহ! এখন খুব সুন্দর লাগছে। খাওয়ালাম। শান্ত সুবোধ শিশুটি সুন্দর করে খেল। ওমা! দেখি, খাবার মুখে নিয়েই ও ঘুমে ঢলে পড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে শোয়ালাম। ও আরামসে ঘুমিয়ে গেল। কোনো কান্নাকাটি নেই। অস্থিরতা নেই। নেই মনস্তাপ। শান্ত, নিটোল শিশুটির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। আহা রে, না জানি পাগলপ্রায় মা-বাবা হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। ঈদের দিনেও বুকচাপড়ে কাঁদছে। এদিকে অবোধ মানিকসোনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়, পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তার পর মাইকিং করাব। অনেকক্ষণ পর মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ওর মাথায় হাত রাখি। আমার আলতো স্পর্শেই ও জেগে উঠল। ওয়াশরুমে নিয়ে ওকে প্রসাব করলাম। ভুনাখিচুড়ি আর কলিজাভুনা দিয়ে ওকে খাওয়ালাম।      

প্রাক-সন্ধ্যার আলো-আঁধারী। সন্ধ্যারাগের সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠল! ভাবছি, এখন অবধি কোনো খবর হলো না। অমনি  হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল তিন-চারজন। এসেই বাচ্চাটির মায় খাট থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে কোলে নিল। ওকে নাকে-মুখে, গাল-ঠোঁটে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলল। বুকে ঠেসে ধরে জড়িয়ে কেঁদে দিল। আহা রে! হারানো সন্তানপ্রাপ্তির এক মায়ের সন্তান বাৎসল্যের আকুতির গভীরতা কতটা স্পর্শকাতর! আরও অনুভব করছি, বাঙালি মায়েদের মাতৃত্বের ভাণ্ডার বুঝি এমনই বিশ্বজনীন স্নেহ-মায়া-মমতায় ভরপুর থাকে। 

তাছাড়া, বাচ্চাটির মুখাবয়বের উজ্জ্বলতায়ও বলে দিচ্ছে সেও মনে মনে আনন্দিত। ওর কাজলদিঘি চোখ এখন প্রাপ্তির পূর্ণতায় উদ্ভাসিত। ওরা যেমন আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকল তেমনি আকস্মিকভাবেই-না ছোঁ মেরে ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিথি! অথচ রেখে গেল স্মৃতির ক্যানভাস-জমিনে মায়াময় স্মৃতি! আমার অবচেতন মনে কখন জানি ওর প্রতি মাতৃত্ব জেগে উঠেছে জানি না। তাই কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ ছিলাম। যাওয়ার সময় ওরা অবশ্য বলেছে, ‘আফনেগো মাঝমধ্যিখানে আইয়া দেখাইয়া নিয়া যামু।’

জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। হঠাৎ একটি ফুটফুটে ছয়- সাত বছরের মেয়ে এল। বলল- আফা, আমি আফনেগো স্কুলে পড়ি। আমরা গরিব। বাবায় কয়, খোরাকির টাকাই জোগাইতে পারি না। পড়ামু কেমনে? তাই আমি আফনেগো কাম করমু আর পড়মু। অনাহারশীর্ণ মেয়েটির কথা আমার অন্তর্মূলকে বিদ্ধ করল। এই বয়সে মেয়েটির কষ্টের অনুভূতির অনুধাবন ক্ষমতা এতটা সংবেদনশীল? আমি বিস্ময়াভিভূত!  

মেয়েটিকে বললাম, আগামীকাল জানাব। আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলাম।  আসার পথে মেয়েটির বাড়িওয়ালার বাড়িতে গেলাম। একজন বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আফা, ওর বাবা বছরব্যারামি। কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। সংসারের পোষ বেশি। ঘরে খাওন নাই। কষ্টে আছে। মাইয়াডারে আফনে নিয়া নেন আফা। এই কথা শুনে ওই দিনই ওকে নিয়ে নিলাম।

ওর নাম মাসুমা। সুন্দরী ও সুশ্রী। দুধে-আলতা গায়ের রং। ডাগর-ডাগর চোখের ভ্রুগুলো যেন চিরুনিটানা। ওর গোলাকৃতি মুখের হাসিটাও সুন্দর। আপেলরাঙা ভরাটগাল। দাঁতগুলো ঝকঝকে। জীর্ণবস্ত্র, শীর্ণকায় শরীরটা যেন ধনুকের মতো বেঁকে আছে। পেট চুপসে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে। আমি তড়িঘড়ি ঘরে গিয়ে ওকে খেতে দিলাম। ক্ষুধার্ত মেয়েটির খাওয়ার আকুলতা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।

সেই থেকে মাসুমা আমার কাছেই আছে। ও এখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। 

বছর দুয়েক পর। আমি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সেই সুমির মা-ই এসে  বলল, আফা, পিচ্চিটা সহাল থাইকা  ঘুরঘুর করছে। এর লাইগা লইয়া আইলাম। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, আমার সঙ্গে এমনটি কেন ঘটছে?  

মাসুমাকে বললাম, ওকে রুটি-হালুয়া খাওয়াতে। রুটি হাতে নিয়ে ও সুমির সঙ্গে ওদের ঘরে গেল। দেখলাম, ও একটি চেয়ারে বসে পা ঝোলাচ্ছে আর খাচ্ছে। ওর সঙ্গে সুমিও। ওরা হাসছে, খেলছে। তাই আমি নিশ্চিন্তে স্কুলে গেলাম। 

ফার্স্ট শিফট ছুটি। হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে একটু বাসায় গেলাম। ইতোমধ্যে আমার স্বামী এক ডজন সাগর কলা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি শুয়ে কলা খাচ্ছে। আমি আরেকটি কলা দিলাম। কলা পেয়ে ওর সেকি আনন্দ! ও আমার স্বামীকে বলছে, ‘তুই আমার লাইগা এত্তগুলান কলা আনছস!’ এই বলে আমার স্বামীর শরীরের ওপর দিয়ে এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমরা ওর মা-বাবা। তুই-তোকারি সম্বোধনে বুঝলাম, ও মা-বাপের বড্ড আদুরে মেয়ে। 

ওর দায়িত্ব সুমির মায়ের ওপর দিয়ে আমি মাসুমাকে নিয়ে স্কুলে এলাম। এরেই মধ্যে কয়েকটা মসজিদ থেকে মেয়েটির সম্পর্কে ঘোষণা করানো হয়েছে। ভাবছি, বিকেলে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করব। দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আবারও বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সুমির মা গোসল করিয়ে  মুখে পাউডার, চোখে কাজল দিয়েছে। ওর ফ্রকটা ধুয়ে সুমির ফ্রক পরিয়েছে। ভাত খাইয়েছে। শুনলাম- সুমির মা ওকে পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাতে পাকুতি বুড়ি বলে- আমার মা আমারে পাছায় জোরেজোরে থাপ্পড় দিত। তুমিও এমনি কইরা দেও। তাইলে আমি ঘুমামু। তা শুনে আমিও হেসে লুটোপুটি। স্কুলে এসে কাজে মন দিলাম। 
স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। আমরাও বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে একজন মহিলা কান্নাকাটি করতে করতে স্কুলে ঢুকেছে। এসেই বলছে-  আমাগো মাইডারে নাকি এই স্কুলের আপার বাসায় আছে। আমি এগিয়ে এসে বললাম, হ্যাঁ।  তিনি জানালেন, ওর মা ভোরে হাসপাতালে গেছে। যাওয়ার সময় ও যাইতে চাইছিল। ওর মা কাঁন্দাইয়া থুইয়া গেছে। কোন ফাঁকে ও  ফ্রক হাতে লইয়া বাইর হইয়া গেছে। আমরা টেরই পাইনি।

সব শুনে হেডস্যার বলছেন, আপা, সুমির মাকে বলেন, মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে আসতে। এখান থেকেই ওকে অভিভাকের হাতে তুলে দেব। খবর পেয়েই সুমির মা নিয়ে এল ওকে। ওর গায়ে ধোয়া ফ্রক-প্যান্ট। মুখে স্নো-পাউডার। কপালে কাজলের টিপ। আঁচড়ানো পরিপাটি চুল। বেশ ফুটফুটে লাগছে। ওমা! আপারা সবাই এর কোল থেকে ওর কোলে নিচ্ছে। ও যাচ্ছে নিঃসংকোচে। 

হেডস্যার বললেন, ওর বাবা কিংবা মা একজনকে আসতে হবে। কিছুক্ষণ পরই ওর বাবা আরও একজন মুরুব্বি কিছিমের লোক নিয়ে সরাসরি এলেন। ও তখন ওর জেঠিমার কোলে। ওর বাবাকে দেখেই বলে, এত্তক্ষণে তর মনে অইল আমার কতা? অভিমানী মেয়েটি এই বলে কেঁদে ফেলে। বুঝলাম, শিশুর মনেও অভিমানের দহন থাকে। পাকুতি বুড়ির পাকানো কথা শুনে সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তার পর স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ওর বাবার কোলে মেয়েটিকে তুলে দিলাম। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে সবাইকে মায়াময় ভালোবাসায় জড়ায়ে গেল। আমার মাতৃ হৃদয়েও একটা শূন্যতার ঝোড়ো হাওয়ায় তোলপাড় করছে। ভেতর থেকে অবদমিত কান্না ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি। ওরা বলেছিল, মাঝেমধ্যে আমার কাছে নিয়ে আসবে ওকে। কিন্তু কেউ-ই কথা রাখেনি। না আসুক, তাতে কী? বাচ্চা দুটোর মা-বাবার কাছে ওদের তুলে দিতে পেরেছি, এতেই আমার শান্তি। একজন গেল নীরব ভালোবাসায় জড়ায়ে। আরেকজন গেল সরব ভালোবাসায় কাঁদায়ে। এই কান্না একান্তই আমার। নিঃসন্তান হৃদয়ে অন্তর্নিহিত অস্তিত্বে গুমড়ে ওঠা অদৃশ্যমান এক নিঃশব্দ কান্না!  

এরই মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে চাষাঢ়া রেললাইন ধরে হাঁটছি। মাসুমা আমাদের রেখে আগেভাগে যাচ্ছে। আমরা পেছন থেকে ডাকছি। ও হাত নেড়ে শুধু আগাচ্ছে। একসময় মাসুমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমন তো সবসময়ই করে। আগে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয়। আমরা এটাই ভাবছি। কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখি মাসুমা যায়নি। তা শুনে আমার মাথায় চক্কর খেল! আমি হতবিহ্বল! তার পর খোঁজাখুঁজি আর  কান্নাকাটি! আমার বুকটায় যেন হাতুড়িপেটানোর মতো ধাপুস-ধুপুস শব্দ হচ্ছে। অজানা আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপছে। ভয়ে-ভয়ে ওর মাকে ফোনে খোলাসা করে ঘটনাটা বলি। ওর মা বিশ্বাস করছে না। বলে, কত মানুষ গুম কইরা রাইখ্যা মিছা কতা কয়। ধানাইপানাই থুইয়া, ঠিকানা দেন তাড়াতাড়ি। এত সহজে ছাড়মু না। ওর কথার ধার শুনে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিলাম। মায়ের মন তো, এমনটি বলা স্বাভাবিক। রাগ করলাম না। এতক্ষণ মসজিদে মাইকিং করেও কোনো খোঁজ পাইনি।

তাই গেলাম ফতুল্লা থানায় জিডি করতে। ওসি সাহেব বললেন, ঘণ্টাখানেক বসেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী, ও আবার ঠিকানাও জানে। এরই মধ্যে হয়তো খবর পেতে পারেন। আমি পাগলের মতো ঘড়ি দেখছি। ভাবছি, না পাওয়া গেলে কী হবে আমাদের? এত সুন্দরী, গায়-গতরে ডাঙ্গর-ডোঙ্গর। খারাপ ছেলেদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে। তাহলে তো আমি ফেঁসে যাব। এই ভয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি। আল্লাহকে শুধুই ডাকছি। গলা, জিহ্বা ও ঠোঁট শুকিয়ে চটচটে হয়ে আছে। আমি তো ওকে ফুলের টবে রাখা গাছের মতো করে বড় করেছি। ওর কোনো চাহিদা আমি অপূর্ণ রাখিনি। পোশাক-আশাক দেখে সবাই বলত আমাদের মেয়ে। আমরাও তা-ই বলেছি। এসব মনে করে এখন কপাল চাপড়াচ্ছি।

হঠাৎ মোবাইলে রিং হলো। সুমির মা মোবাইলে জানাচ্ছে, আফা মাসুমাকে দুজন বেডায়  নিয়া আইছে। আফনেরা তাড়াতাড়ি আইয়েন। হে আল্লাহ! সত্যি সত্যিই তুমি আছ গো আল্লাহ! আমার ডাক কবুল করেছ। আমার ধরে যেন প্রাণ ফিরে এল।   
ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনাদের ভাগ্য ভালো। এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।’ আসতে আসতে বুঝলাম, যে নারী জন্ম দেয় সে মাতা। 
কিন্তু মাতৃত্ব আসে হৃদয় থেকে। সন্তান জন্ম না দিয়ে, মাতা না হয়েও মাতৃত্ব আসতে পারে। এটা কিছুটা হৃদয়ঘটিত, কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।  

সন্তানহীনা মায়েরা অষ্টপ্রহর কষ্টের দ্যোতনা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। তাদের মুখাবয়বে একটা বিষণ্নতার অমোচনীয় কালোছায়ার আবরণ থাকে চিরদিন। তবুও মিছে মায়ায় বাসায় এসে মাসুমাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুভুক্ষু হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ-মমতা উজার করে চমু খাই। আনন্দে কেঁদে ফেলি। যে মাসুমাকে নিয়ে এসেছে ও রেলওয়েতে মাস্টাররোলে চাকরি করছে। বয়স সম্ভবত ৩৫-৩৬। কথাবার্তায় বুঝলাম, লেখাপড়া কিছু জানে। আমি বললাম, তুমি আজ আমার মেয়েটির মানসম্মান, ইজ্জত রক্ষা করেছ। কী চাও ভাই তুমি? লোকটি বলল, ভাইবোনের মধ্যে লেনদেন কেন আপা? ও তো আমার মেয়ের মতো মনে করেই নিয়ে এলাম। কেননা, সমাজে হারানো, চুরি-যাওয়া, পাচার হওয়া ছেলেদের ঘরে তোলে। কিন্তু মেয়েদের অনেকেই তোলে না। কারণ, সমাজের চর্মচক্ষুতে তারা অচ্ছ্যুত। এ জন্য আজই মুরুব্বিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনে মনে বলছি, এত ছোট চাকরি করা একজন গরিব মানুষ! তার মুখে এত মূল্যবান কথা! তা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে। সে চিত্তে বিত্তবান একজন মহতী মনের মানুষ। ওর যা আছে এ দেশের অধিকাংশ কোটিপতিরও তা নেই। মন থেকে তাকে শুধু সহস্রবার স্যালুট জানালাম! 

মাতৃস্নেহের সবটুক সুধা ঢেলে মাসুমাকে বড় করেছি। হয় তো ওকেও ওর অভিভাবক নিয়ে যাবে। তবুও আমি বহুত খুশি। এর আগে আমি আরও দুজন হারানো বাচ্চাকে তাদের অভিভাবকদের কাছে সযত্নে তুলে দিয়েছিলাম। বিধাতা মাসুমাক ফিরে দিয়েছেন। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। মাসুমা চলে গেলে আমি সারা জীবন মনোকষ্টে ভুগবো সত্যি। তখন না হয় ‘নিঃশব্দ কান্না’ই হবে আমার নিঃসন্তান জীবনের অনুষঙ্গী।

শুভ জন্মদিন কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১১:০৭ এএম
কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

লেখার শিরোনাম পড়েই অনেকেই ধন্ধে পড়ে যাবেন, কোন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কথাশিল্পী? বাংলাদেশে একজনই আছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, নতুন দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। নিঃসন্দেহে তিনিই কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সিরাজ স্যার সাহিত্যের প্রথম সোপানে পা রেখেছিলেন গল্প আখ্যানের মাধ্যমে, গত শতকের ষাটের দশকে। প্রায় ৭০ বছর আগে তিনি গল্পের বিস্তারের রেখায় রেখায় নিজেকে পরিস্ফূট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি গল্প-উপন্যাস ছেড়ে প্রবন্ধের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এবং আমরা নিশ্চিত করেই লিখতে পারি, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবন্ধিক বিশ্ব বাংলা সাহিত্যে।

কিন্তু লেখার শিরোনামে যখন কথাশিল্পী শব্দ লেখা হয়েছে, তখন পাঠকের কাছে কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রকাশ করাই শ্রেয়। ‘ভালমানুষের জগৎ’ গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে অনেক আগেই। কথাপ্রকাশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। বইটিতে ১১টি গল্প রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে- একজন গল্পকার হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ইতিহাস আছে। তিনি ‘ভালমানুষের জগৎ’ বইয়ের সেই গল্পের ইতিহাস তুলে ধরেছেন- ‘আজ থেকে একত্রিশ বছর আগে ১৯৮৯ সালে চারটি গল্প নিয়ে বের হয়েছিল এ বইয়ের আদি সংস্করণ। ১২ বছর পরে ২০০১ সালে যখন দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়, তখন আরও পাঁচটি অগ্রন্থিত গল্প যুক্ত করায় গল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় নয়টি। উনিশ বছর পরে আরও দুটি অগ্রন্থিত গল্প যুক্ত করায় গল্প হয়েছে এগারোটি। 

প্রতিটি সংস্করণের পেছনেই একজন প্রকাশকের আগ্রহ কার্যকর ছিল। নতুন সংস্করণে উপস্থিত আছেন কথাপ্রকাশের জসিম উদ্দিন। তাঁকে ধন্যবাদ।’

আমরা কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গল্পের ইতিহাসটা জেনে গেলাম। গল্পবই ‘ভালমানুষের জগৎ’-এর গল্পগুলোর তালিকার দিকে দৃষ্টি রাখি- সীমান্তে, হারাবার কিছু নেই, পিঠের বোঝা, ভালমানুষের জগৎ, জাহানারার চিঠিপত্র, খেলার সাথী, হাফিজুর রহমানের অগ্রযাত্রা, অভিন্ন, কোনো দাম নেই, কান্না এবং তলোয়ার। অদ্ভুত সরল বাক্যে সহজিয়া অনুভবে সিরাজ স্যার মনোরম ভঙ্গিমায় গল্প লেখেন। পরীক্ষা বা নিরীক্ষার নামে শক্ত তিক্ত বা কঠিন কোনো অনুষঙ্গ নির্মাণ করেন না। ফলে, পাঠকদের গল্প পড়ে যেতে কোনো ক্লেশ বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মধ্যে নিপতিত হতে হয় না। কিন্তু সিরাজ স্যারের গল্পবিশ্বে প্রবেশ করার আগে মনে রাখা দরকার, তিনি অধিকাংশ গল্প লিখেছেন ষাট ও সত্তরের দশকের সময় ও টপভূমি ধারণ করে। তাহলেই পাঠক আর গল্পকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মধ্যে গড়ে উঠবে পাঠ অভিযোজনা। 

চুম্বক আলোচনায় ‘জাহানারার চিঠিপত্র’ গল্পটাই যদি পড়ি, সরকারের আমলাচক্র কীভাবে ক্ষমতার চাবুক চালায় নিরীহ স্ত্রীর ওপর, এবং জীবনের প্রান্তবেলায় এসে স্ত্রীও নিজের মতো করে প্রতিশোধ নেয় কিংবা জীবনের জটিল অঙ্কের সমাধান করে, তারই শিল্পীত প্রতিবিম্ব। প্রত্যেকটা গল্পের মধ্যে চারপাশের দেখা জীবনের আয়নায় গল্পকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিফলিত করেছেন তিক্ত কাঁটার বিষাক্ত প্রতিবেশ। গল্প তো জীবনের গভীর আখ্যান। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দুটি উপন্যাস রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে হায়েনা দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা-  ‘শেষ নেই’। সত্যি, সেই লড়াইয়ের রক্তের জীবন দানের কোনো শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে কিন্তু সবই প্রায় একরৈখিক। যুদ্ধের ডামাডোল, ধর্ষণ আর নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোনের ঝামায় ঘষে ঘষে মুক্তিযুদ্ধের পারিবারিক ও ব্যক্তির লড়াই, রক্তাক্ত পরিস্থিতি একদম তুলে দেওয়া হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘শেষ নেই’ উপন্যাসে একাত্তরের পারিবারিক জীবনের যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দগদগে ঘা, এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের দেশপ্রেমের রসায়নে যুক্ত হওয়া- পাকিস্তানি হার্মাদ সৈন্য ও এদেশীয় নরাধম রাজাকারদের নারকীয় কর্মের বিবরণ আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- এ উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে উপন্যাসিক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক। পাকিস্তানি জেনারেলদের হত্যা তালিকায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামও ছিল। তিনি পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন। নিজের চোখে দেখা ঘটনা ও সরাসরি অভিজ্ঞতার নির্যাস এ উপন্যাস- ‘শেষ নেই’।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় বা শেষ উপন্যাস ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’। কণা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বাঙালির সমাজ ও সংসারে প্রথম শত্রু নিকটাত্মীয়, ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’ উপন্যাসের মূল আখ্যান এটাই। এবং একটি মেয়ে যদি হয় কেন্দ্রবিন্দু, তাহলে কতভাবে টিকে থাকার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয় বিরুদ্ধ বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে, উপন্যাসিক নিজস্ব রসায়নে- সে ঘটনাই তুলে ধরেছেন। 

‘অনেক কথাই অবশ্য আহাদকে জানানো যায়, কোনো কোনোটা তো না জানালেই নয়। যেমন এই কথাটা যে জাহানারা খানের বাড়িতে ওর ছদ্মপরিচয়ের ব্যাপারটা ওর জন্য বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে কণার অস্বস্তি যেদিন থেকে ওই আজগুবি বিজ্ঞাপনটিতে সে সাড়া দিয়েছে, সেদিন থেকেই। কম আর বেশি। জাহানারা খানকে সে খালা বলে মেনে নিয়েছে, তার আপন তো থেকেও নেই,  এই পাতানো খালাই আসল। কিন্তু কণা নিজে তো আসল নয়, খাঁটি নয়, সে তো একেবারেই নকল। জাহানারা খালা আছেন তার নিজের জায়গাতেই কিন্তু কণা তো নেই, সে তো সীমা নয়। সীমাকে কতদিন কণা আর ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াবে? মাঝে মাঝে ভীষণ গ্লানিকর, অত্যন্ত অসহ্য ঠেকে সমস্ত ঘটনাটা।’

১২০ পৃষ্ঠার ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’ উপন্যাসের ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠার একটা স্তবক পাঠ করলেই অনুভব করা যায়, একজন কণা কতটা বিড়ম্ভিত জীবনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে!

‘শেষ নেই’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু মুক্তিযুদ্ধ। কণার অনিশ্চিত যাত্রা উপন্যাসের আখ্যান সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না হলেও, অনেকটা জড়িয়ে আছে। কেননা- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা যে সময়ের মধ্যদিয়ে গড়ে ও বেড়ে উঠেছেন- গোটা সময়ই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিচুল্লি। সুতরাং মুক্তি নেই মুক্তিযুদ্ধের ভলকানো উত্তাপ ও আগুন থেকে। 

‘বাবুলের বেড়ে ওঠা’- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কিশোর উপন্যাস। ‘বাবুল’ এ উপন্যাসে প্রতীকায়িত হয়ে অজস্র কিশোরের মনজমিন ও বেড়ে ওঠার মানচিত্র কেবল নয়, সুন্দর সময়েরও অঙ্গীকার হয়ে ওঠে। 

খুব ছোট পরিসরে কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর চারটি বইয়ের পরিচয় তুলে ধরা গেল।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:২৩ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

গত সংখ্যার পর

উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে মোহিনী ও আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করতেন। সেখানেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটাও একটা বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে। মোহিনী বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ক্লাস করতে পারতেন না। সেই সময়ে আরেফিন তাকে নোট দিয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। এতে মোহিনী ভালো রেজাল্ট করেন। আরেফিন নিজেও মেধাবী ছাত্র। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মোহিনী এর বিনিময়ে তাকে কিছু উপহার দিতে চান। বললেন, ‘তুমি যে উপকার করলে তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। তার পরও আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। তুমি আমার কাছে কী চাও? তুমি যা চাইবে আমি সম্ভব হলে তাই দেব। মন থেকে বলবে।’ মোহিনীর এই বন্ধুত্ব-কৃতজ্ঞতায় আরেফিন যে তাকেই চেয়ে বসবেন তা তিনি নিজেও কখনো চিন্তা করেননি, ভাবেনওনি। আরেফিন জানতেন মোহিনীকে চাওয়া বা পাওয়া কোনো সহজতর বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ দুজনের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকতর অসমতা। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোহিনী ঢাকা শহরের ধনী পরিবারের সন্তান। তার সামাজিক সম্মান মর্যাদা অনেক উচ্চস্তরের। অরেফিনের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে এর বিপরীত। আরেফিন দরিদ্র্য পরিবারের সন্তান। তার পরিবারে তিনিই একমাত্র পড়ালেখা করেন। পরিবারে আয়-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আরেফিন টিউশনি করে নিজের পড়ালেখো করেন এবং পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠান। সেই টাকাতেই তাদের সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়। আরেফিন ‘গোবরে পদ্মফুল’। এ কথার যথার্থ যুক্তিও রয়েছে। গ্রামের অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র একটি পরিবার থেকে আরেফিনের মতো একটা মেধাবী ছেলের জন্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন- এটা সহজতর বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব একটি ব্যাপার। গোবরে পদ্মফুল যেমন অকল্পনীয়, এরকম হতদরিদ পরিবারে আরেফিনের মতো মেধাবী সন্তানের জন্মও অকল্পনীয়। যখন সত্যিই বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে তখন তা যথার্থভাবেই ‘গোবরে পদ্মফুল’-এর সঙ্গে তুল্য হয়ে ওঠে। এক কথায় যা অবিশ্বাস্য। মোহিনী এটা জানতেন। আরেফিনের শুধুই অরেফিন- এর বাইরে আরেফিনের আর কিছু নেই। এরকম অবস্থায় আরেফিনের চাওয়াকে গ্রহণ করা তার জন্য কতটা কঠিন, তাও তিনি জানতেন। তার অভিজাত পরিবার যে এটা সহজেই গ্রহণ করবে না, মানবে না- সে বিষয়েও তিনি স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতেন। ফলে আরেফিন যখন তাকেই চেয়েছেন উপহারস্বরূপ, তখন সেই চাওয়াকে যেমন উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, আবার গ্রহণ করাও সহজ হয়ে ওঠে না। যখন পারিবারিক এ সিদ্ধান্তে একদমই অমত- অরাজি, তখন কৃতজ্ঞ-মোহিনী মা-বাবাকে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কি পরিবারকে বিয়ে করব নাকি আরেফিনকে? পরিবার দেখার দরকার নেই। তোমরা আরেফিনকে দেখ।’ বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার অদম্য এ উচ্চারণ মানবিকতা ও কৃতজ্ঞতার চরমতম প্রকাশ। একই সঙ্গে সমাজজীবনে ধনী-গরিবের যে শ্রেণিবৈষম্য, তা তিনি ভেঙে সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে চেয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন ধনী-গরিবের যে বৈষম্য, সেই বৈষম্য দূর করে ভালোবাসায়-মনুষ্যত্বে-মানবিকতায় মানুষ হয়ে ওঠাটাই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিবারের অমতে আরেফিনকে জীবনে গ্রহণ করে শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমান্তরালে দাঁড়িয়েছিলেন- যেখানে আভিজাত্য নয়, মানুষই বড়, মনুষ্যত্বই বড়। মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর হলো ভালোবাসা। সেটিকেই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে, উদার মানসিকতায়, প্রেমের গহিন শক্তিতে, ভালোবাসার ঔদার্যে গ্রহণ করেছিলেন। আরেফিনকে গ্রহণের ভেতর দিয়েই তিনি চিরাচরিত আত্মম্ভরিতাপূর্ণ এ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।

আরেফিন মোহিনীকে চেয়েছেন। পেয়েছেন। সমস্যা তৈরি হয়েছে তার মানসিকতায়। তিনি মোহিনীকে চরমভাবে ভালোবাসলেও নিজেকে সমসময় অযোগ্য ভেবে নিজের ভেতর নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। দাম্পত্যজীবনে অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। মোহিনীর ভেতর অজস্র প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছেন, কখনো নিজের আত্মসমালোচনায়, কখনো আরেফিনের সঙ্গে কথা বলে, বোঝাপড়া করে। মোহিনী কখনই আরেফিন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারেননি। আরেফিনের মদ খাওয়া, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে দরোজায় পাশে পড়ে থাকা- এতকিছুর পরও মোহিনী কখনই আরেফিনকে ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। কখনো ক্ষোভ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে, আবার নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজেই আরেফিনকে স্পষ্টত বলেছেন, ‘আজ আমরা খোলামেলা আলোচনা করব। এতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা থাকতে পারবে না।’ মোহিনী আলোচনা করেছেন। আরেফিন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কথা দিয়েছেন আর কখনো এরকম হবে না। তার পরও কথা ঠিক রাখেননি।  মোহিনী আরেফিনকে কাছে বসিয়ে বলেছেন, ‘তুমি সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি যা করতে বলেছি তার উল্টোটা করেছ। আমি যা অপছন্দ করি তাই তুমি করো। এর কারণ কী তুমি বলো তো? খোলাখুলি বলো। একটি শব্দও মিথ্যা বলবে না। আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো আমাদের এখনই শোধরাতে হবে। তা না হলে অনেক বড় সমস্যা হবে। বিয়ে যখন করেছি তখন একটা সুন্দর আনন্দময় সংসার আমি করতে চাই।’ এটা শোনার পরে আরেফিনও নিজের চরম সত্যটাকেই বলেছেন মোহিনীকে, ‘তোমার সঙ্গে তুলনা করলে আমার অবস্থা তোমার এক শ ভাগের এক ভাগ। আমার সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। তুমি কী পছন্দ করো আর কী অপছন্দ করো তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় থাকি। তুমি কীসে মন খারাপ করো, আর কীসে রাগ করো তা বুঝতে পারি না।... ভয়ের কারণে তোমাকে ঠিকমতো আদরও করতে পারি না।’ আরেফিনের কথা শুনে মোহিনী তাকে বলেছেন, ‘জীবনটা কয়দিনের বলো! তোমাকে ভালোবেসেছি বলেই তো তোমাকে বিয়ে করেছি।... শপথ করো, আমাকে কোনো কিছু গোপন করবে না। যা ভালো লাগে খুলে বলবে।’ আরেফিন সম্মতি জানায়। আরেফিন প্রমিজ করে আর কখনো মোহিনীকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু আরেফিন কথা রাখেনি। মোহিনী তাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তাকে ত্যাগ করার কথা কখনো ভাবেননি। বরং তার প্রতি আরও মমত্ব বেড়েছে, তার জন্য তিনি অস্থির হয়েছেন। বিশেষ করে যখন তিনি শুনেছেন আরেফিন চীনে যাচ্ছেন অফিসের দায়িত্বে। অথচ তাকে আগে থেকে কিছুই বলেননি। এটা মোহিনী মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে নিজের বাসা ছেড়ে বাবা-মার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। আরেফিন চীনে গিয়ে মোহিনীকে ফোন করলেও রাগে ক্ষোভে কষ্টে ফোন রিসিভি করেননি। কিন্তু যখন বাবার কাছে জানতে পারলেন, চীনের হুবেতে ব্যাপকভাবে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। টিভি নিউজেও সেটা দেখলেন মোহিনী। এ সংবাদে ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি হয় মোহিনীর ভেতর। আরেফিনের জন্য তার ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। আরেফিনের মোবাইলে ফোন করেও আরেফিনকে তিনি পাননি। করোনা এদিকে আঘাত হানে বাংলাদেশেও। মানুষের জীবনযাপন-জীবিকা সবকিছু বদলে যায়। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকরির অনিশ্চয়তা, মানুষ আত্মীয়-স্বজনহীন একা হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন এক নতুন জীবন হয়ে ওঠে মানুষের। সেই জীবনে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু বাস্তবে ভয়াবহ কঠিনে রূপ নেয়। মৃত্যু-আতঙ্ক নগরীতে মোহিনী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। খাদ্য-অর্থ সহযোগিতা নিয়ে- অফিসের কোনো কর্মচারীকে ছাঁটাই না করে, বরং তাদের পাশে থেকেছেন সাধ্যমতো। মানবিক এক মোহিনীকে আমরা লক্ষ্য করি। যদিও মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্মগতভাবেই তিনি পেয়েছেন। তার বাবা মোহসীন আহমেদ ও মা আনোয়ারা বেগম দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে সব সময় সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এসব প্রচারে তিনি বিব্রতবোধ করেন। মোহিনীও ঠিক তাই। একবার তার সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ করা হলে তিনি খুশি হননি, বরং নিজের ভেতর একরকম বিব্রত হয়েছেন। বাবা কী ভাববেন! 

মোহিনী করোনায় আরেফিনের মৃত্যুর খবর জেনে স্তব্ধ হয়ে যান। সবকিছু থেকে নিজেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে রাখেন কয়েকদিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়েছে আরেফিনের লাশ আসবে বিমানবন্দরে। তিনি বিমানবন্দরে যেতে পারবেন, বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখতে পারবেন। কিন্তু তার মুখ দেখা যাবে না কোনোভাবেই। তার পরও তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছেন আরেফিনের সম্মানে, ভালোবাসায়। বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখেছেন কষ্টগুলোকে বুকে ভারী পাথরের মতো চেপে রেখে। আরেফিনকে হারিয়ে মোহিনী পাথর হয়ে গেছেন। কান্নাও তিনি ভুলে গেছেন- ‘কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হতে পারতেন তিনি।’ কিন্তু কান্না এখন তার জন্য এক কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। বরং নিজেকে তিনি আত্ম-প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করেন- কেন আরেফিনের ওপর অত রাগ করেছিলেন! কেন বাসা ছেড়ে চলে এসেছিলেন! আত্ম-অপরাধবোধে ও আত্মসমালোচনায় জর্জরিত হতে থাকেন।  

মোহিনী বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখে গাড়ি নিয়ে বের হতেই আর এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন। একজন বৃদ্ধ লোক সন্তান হারানোর বেদনায় বিলাপ করছেন, পথচারীরা ঘিরে আছেন তাকে। পথচারীরা সন্তান হারানো বৃদ্ধ বাবাকে কী সান্ত্বনা দেবেন। অসহায় চোখে তাকে দেখছেন, ঘিরে আছেন। মোহিনী কী ভেবে গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে বৃদ্ধলোকটির কাছে এগিয়ে যান। বৃদ্ধলোকটাকে প্রশ্ন করেন, তার ছেলের লাশ কোন দেশ থেকে এসেছে? ছেলের কী নাম? বৃদ্ধ লোকটির নাম-ঠিকানা জানতে চান। সব জেনে তিনি যখন বুঝলেন ইনি আরেফিনের বাবা। স্তম্ভিত হয়ে পড়েন মোহিনী- ‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।’  এখানেও মোহিনী নিজের আবেগ সংযত রাখতে চেষ্টা করেন। আরেফিনের বাবা আলী আকবরকে নিজের গাড়িতে করে অফিসে নিয়ে যান। অফিস দেখে আলী আকবর কল্পনার সঙ্গেও মেলাতে পারেন না। 
চলবে...

অন্য ভুবন

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:১১ পিএম
অন্য ভুবন
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

সায়মন কোনো দিন ভাবেনি তাকে একদিন দেশ ছেড়ে ছুটতে হবে জীবিকার সন্ধানে অন্য কোনো দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মার তাগিদে যখন সে শিক্ষাবৃত্তির জন্য চেষ্টা করছিল, তখনো মনে মনে স্থির করে রেখেছিল বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্র যদি তৈরিও হয়, তা হলেও সে যাবে না। কিন্তু এখন? এখন তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পাল্টে গেছে জীবনের মেরুকরণের সব সমীকরণ। বারান্দায় দোল খাওয়া কেদারায় দুলতে দুলতে সায়মন তা-ই ভাবছিল। হঠাৎ মুঠোফোনের রিংটোন তার ভাবনায় ছেদ ঘটাল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই সায়মন অজানা এক আনন্দে অদ্ভুতভাবে শিহরিত হলো। মনে মনে ভাবছিল চিৎকার দিয়ে পরিপার্শ্ব কাঁপিয়ে তুলে সবাইকে জানিয়ে দেয়, জীবনের সব গল্পে মানুষ হেরে যায় না। আরও ভাবছিল চঞ্চলার ফোনের জন্য তার কত প্রতীক্ষা। আজ হঠাৎ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। হঠাৎ বৃষ্টি।

ও-প্রান্তে ফোনটা মুঠোয় ধরে চঞ্চলা স্থির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফোন রিংয়ের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চঞ্চলা ভাবতেই পারছে না সায়মন তার ফোনটা রিসিভ করেনি! কারণ সে তো জানে সায়মনের কত অধীর আগ্রহ তার ফোনের জন্য। তাহলে সায়মন কি তার উপেক্ষা সইতে সইতে সে-ই এখন উপেক্ষা করছে তাকে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে চঞ্চলা। এই ভাবতে ভাবতেই মোবাইলে রিংটোন। সায়মনের ফোন। চঞ্চলা বিলম্ব না করেই ফোন রিসিভ করে। চঞ্চলার অত্যন্ত বিনম্র সম্ভাষণ। একটু নয়, বেশ বিচলিত হয় সায়মন। যে ব্যক্তিটি প্রায় ১৪ মাস আগে সায়মনের ওপর রেগে গিয়ে যোগাযোগের সব মাধ্যমের কপাট বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ তার বিপরীত সুর!

চঞ্চলা ফোন ধরেই একটানা বলতে থাকে, ‘ফোন ধরলেন না কেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত না অন্য কোনো কারণে। নাকি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন? আমি জানি, আপনি মাসের পর মাস আমার ফোনের অপেক্ষা করছেন। প্রায় ১৪ মাস আগে আমি যেদিন আপনার ওপর খুব খেপে গিয়ে বাজে আচরণ করেছিলাম এর কিছুক্ষণ পরই আমি বুঝেছিলাম কাজটা আমি মোটেই ঠিক করিনি। এমন অসৌজন্য আচরণ কোনো সভ্য মানুষ করতে পারে না। এমনটি হয়তো অনেক সময় ঘটে যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। আমার ক্ষেত্রে এমন হবে তা ভেবে দীর্ঘ সময় ধরে খুব যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছি। আপনার সঙ্গে যাতে আমার দেখা না হয় সেজন্য নিজেকে রেখেছি খুব সন্তর্পণে। কিন্তু আজ, আজ পারছিলাম না। আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই ফোন করেছিলাম।’

এটুকু বলে চঞ্চলা থেমে যায়। ও-প্রান্তে সায়মন নির্বাক। কখন থেকে তার মধ্যে এক ধরনের উদাসী ভাবনা চেপে বসে তা-ও ঠাওর করতে পারছিল না। চঞ্চলার প্রতিটি শব্দ তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তার মৌনতা ভাঙল চঞ্চলা।

‘কী ব্যাপার, কোনো কথা বলছেন না যে! আমাকে কি ক্ষমা করা কিংবা ক্ষমায় রাখা সম্ভব নয়? এমনটি না পারাই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রে এমনটি হলে আমি হয়তো পারতাম না। কিন্তু অনেকটা নির্লজ্জের মতো আমি আপনার কাছে অনুশোচনার দহন সইতে না পেরে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ধারণা, মানুষের কাতরতা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই বিফলে যায়। আপনার তরফেও আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করা নিশ্চয় অমানবিক কিছু হবে না। কিন্তু কেন জানি আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস আপনি আমার কাতরতা প্রত্যাখ্যান করবেন না।’

মৌনতা ভাঙে সায়মনের। সে বলতে শুরু করে, ‘আসলে আমি সেভাবে ভাবছি না বটে কিন্তু তোমার ফোনালাপ যে আমাকে খুব স্পর্শ করেছে তা স্বীকার করি না। তোমার ধারণা ভুল নয়। প্রায় ১৪টা মাস আমি তোমার অপেক্ষা করেছি। সারাক্ষণ ভেবেছি এই হয়তো তোমার ফোন পাব, এই হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, এই হয়তো পেছন থেকে ডাক পাব- শুনছেন, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি...। তুমি আমার সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করে যে দহনে ভুগেছ এর চেয়ে আমি কোনোভাবেই কম দগ্ধ হইনি তোমার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে। একজন উচ্চশিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে সোনালি দিন সমাবর্তন। অথচ সেই দিনেই আমি তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েও তোমার অপেক্ষায়ই রয়েছি। আমি হয়তো তোমার সঙ্গে আমার ভালো লাগার বিষয়টি নিয়ে ভণিতা করতে পারতাম কিন্তু আগপিছ না ভেবেই আমার জীবনের সোনালি দিনটিতে তোমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কথাটি শেষ করতে না করতেই তুমি যেভাবে আমার ওপর খেপে গেলে তা-ও আমি অস্বাভাবিক মনে করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, একটা ছেলে যত সহজে ভালোবাসি শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা ততটা সহজ নয়। তোমার আচরণে আমি লজ্জিত কিংবা দুঃখিত হয়নি, শুধু উপযুক্ত-অনুপযুক্ততার কথা ভাবছিলাম।’ কথা কেড়ে নেয় চঞ্চলা।

‘এ আপনার বিনয়। বিনয়ী মানুষ আখেরে হারে না, এও আমার বিশ্বাস। আপনাকে কোনো অংশেই কম চিনতাম না, জানতাম না। আমরা একই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী বলেই শুধু নয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আপনার প্রত্যয়ও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা, যাকে হারিয়েছি কৈশোরে। তিনি বলতেন, জীবনটা নদীর স্রোতের মতো। নদী যেমন স্বচ্ছ পানি ধারণ করে, তেমন ওই জলে আবর্জনাসহ জীবনের জন্য হিতকর নয়, এমন অনেক কিছুই থাকে। মায়া মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যেরও অনেক গল্প আছে। জীবন অনেক ক্ষেত্রেই মহাশয় অর্থাৎ যা সওয়ানো যায় তা-ই সয়।’

চঞ্চলার সঙ্গে পরিচয়ের সাড়ে চার বছরের মধ্যে এমন খোলামেলা কথাবার্তা সায়মনের এভাবে কোনো দিনই হয়নি। সে চঞ্চলার কথার গভীরতায় যেন ডুবসাঁতার কাটছে। নিজের নীরবতা ভেদ করে সে চঞ্চলাকে কিছু বলতে গেলে এই ফাঁকে চঞ্চলা ফের কথা শুরু করে।
‘আমি বহুদিন পরে জেনেছি, জীবনের স্বাস্থ্যকর বিষয় হলো আনন্দ। আনন্দ করতে হবে বিষাদের সব বেষ্টনী ভেঙে তা-ও বুঝেছি পরে। আসলে আমি এত পোড় খাওয়া শতছিদ্রবিশিষ্ট একটি জীবন, যে জীবনের রয়েছে অন্তহীন গল্প।’

চঞ্চলাকে থামিয়ে দিয়ে সায়মন ওকে প্রশ্ন করে, ‘গল্পগুলো শোনাবে?’

চঞ্চলার ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ, ‘জীবনের কোনো কোনো গল্প অল্প করেও কাউকেই শোনানো যায় না। এ গল্প লুকোবার, শুধুই লুকোবার। কিন্তু এও সত্য, সব গল্পে জীবন হেরেও যায় না। জীবনেরই কোনো কোনো গল্প আছে জীবনপাত্র উছলিয়া মাধুরী দানের। অনেকেই জানে না এ গল্পের মূল্যের পরিমাণ। প্রসন্ন মুখ তুলে মধুর মরণে পূর্ণ করে সঁপে যায় কত প্রাণ শুধু চরণে চরণে। গোপন ব্যথার নীরব কত বিনিদ্র রাত কাটে মরমে ঢেলে জীবনের কত গান।’

সায়মন বিস্মিত! সে যত কথা বলছে ততই নতুন করে আবিষ্কার করছে চঞ্চলাকে। সায়মন যখন মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসে তখন চঞ্চলা অনার্স শেষ বর্ষে। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে দুজনের বয়সের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু চঞ্চলাকে তার অনেক বেশি পরিপক্ব মনে হয়। মানুষ জীবনে যত পোড় খায় তত বেশি সমৃদ্ধ হয়- এ ধারণাই জন্মেছে চঞ্চলার সঙ্গে আলাপচারিতায় সায়মনের।

সে চঞ্চলাকে বলে, ‘তুমি যে বললে তুমি পোড় খাওয়া মানুষ তাতে আমার মনে হলো জীবনে পোড় খাওয়া দরকার, খুব দরকার। তুমি এ পর্যন্ত যেভাবে জীবন দেখেছ, জীবনকে জীবনের শিক্ষক হিসেবে গণ্য করার সুযোগ পেয়েছ, সে রকমটি আমি পাইনি বলেই আমার বোধের খতিয়ান এত শূন্য। তোমার সঙ্গে আজ ভিন্নমাত্রায় কথা বলে আমার তেমনটিই মনে হচ্ছে। চঞ্চলা, তোমার ভাবনার উর্বর জমিনে আমি যে কতটা অনুর্বর তা নির্ণয় করাও কঠিন।’

চঞ্চলার গলা জড়িয়ে আসছে। সে সায়মনকে মূল কথা বলতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে শুধু সময়ই নষ্ট করেনি, সায়মনের কাছাকাছি থাকলে জীবনে কল্যাণের সেতুটা চওড়া হতো। তার মনে পড়ে জীবন সম্পর্কে মনীষীদের কিছু উক্তি। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।’ মনে পড়ছে তুরস্কের উপকূলবর্তী এজিয়ান সাগরের দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী যার জীবনাবসান হয় ইতালিতে সেই দার্শনিক পিথাগোরাসকে, যিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ এবং না কথা দুটো সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে ছোট। কিন্তু এ কথা দুটো বলতেই জীবনে সবচেয়ে বেশি ভাবতে হয়।’ তার মনে পড়ছে ইংরেজ নাট্যকার জর্জ লিললোকে, যিনি বলেছেন, ‘একজন আহত ব্যক্তি তার যন্ত্রণা যত সহজে ভুলে যায়, একজন অপমানিত ব্যক্তি তত সহজে অপমান ভোলে না।’ কিন্তু সে যে সায়মনকে অপমান করেছিল তা সায়মন ভুলে গেছে। এখন তার এও মনে হয়, সায়মন কত বড়। তার আরও মনে পড়ে সেই প্রবাদ, ‘ফলবান বৃক্ষই নতজানু হয়।’

সায়মনের ভাবনায় আসে নতুন দিগন্ত। সে মনে মনে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথকে। তার ইচ্ছা হচ্ছিল সে চঞ্চলাকে চিৎকার দিয়ে শোনায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের সেই গানের লিরিক, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ/ রজনীগন্ধা অগোচরে/ যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে,/ তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই,/ তুমি জানো নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান।’ কিন্তু পারেনি। কেন পারেনি তা সে নিজেও জানে না।

সায়মন-চঞ্চলা দুই প্রান্তে দুজনই নীরব। শুধু ইথারে ভেসে আসছে দুজনের তরঙ্গায়িত নিঃশ্বাস। এ যেন দুজনের সৃষ্টি অদৃশ্য বহুমাত্রিক এক অন্য ভুবন। হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে দুই প্রান্তে দুজনই সমস্বরে উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, ‘পাওয়া কাকে বলে যে মানুষ জানে না, সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।’

জ্বরতপ্ত অবসরে

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
জ্বরতপ্ত অবসরে

কবিতার প্রিয় অন্তর্জাল ছেড়ে জ্বরতপ্ত অবসরে নিমজ্জিত
নিজেই নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছি… আতঙ্কে
জ্যৈষ্ঠে জ্বর হলে এমনিতে ভয় লাগে… মা নেই!
বাসকপাতা ছেঁচে মা রস খাওয়াতেন দুবেলা
পাথরকুচি পাতার জুস- সাগু বার্লি কত কী?

মাথার কাছে বসে মা নিজেই জলপট্টি হতেন-
পানি অদল বদল করে উষ্ণতা ছুড়ে দিতেন মাটির মটকায়-
মা যখন বার্লি রেঁধে আনতে যেতেন- ছোট বোন পাহারায় বসে থাকত পাশে-
এই ফাঁকে পাশের বাড়ির সহপাঠী আমার পাণ্ডুর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাত কিছুক্ষণ- পলকেই সরে যেত আড়ালে-কখনো জানা হলো না জ্বর হলে সে কেন এভাবে দেখতে আসে অজান্তে…
জ্বরের ঘোরে বিছানাকে মনে হতো তার হাতের স্পর্শ 
রুগ্‌ণ প্রান্তরে শুয়ে আজো তাই তারা গুনি আকাশের।
আহা, ঠাণ্ডা জল বাতাসে আমি আর কবে হাওয়ার মাতম হব!
আজ এতকাল পরে কে নেবে এই জ্বরের উত্তাপভার…

আছিয়া

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:০২ পিএম
আছিয়া

নাম লিখিনি, লিখতে চাইনি;
মৃত্যু দিয়ে বৈধতা দিলে সেই নামের উচ্চারণ!
আজ তুমি মরে নক্ষত্র হলে,
স্বর্গের দেশে আল্লাহর সকাশে তোমার আবাসন।
তাই দেখো- আজ চাঁদও রক্তিম
নিষ্পাপ খেলার সাথীকে স্বাগত জানায় চাঁদের বুড়ী
জানি না ঐখানে কি তোমার ড্রেস কোড?
অথবা মাহারাম ছাড়া আছে কি যৌন সুড়সুড়ি?
আচ্ছা-আছিয়া; তনু, ইয়াসমিনরা ভালো আছে?
ওরা তোমার পূর্বসূরি, তোমার বড় বোন
ওরাও এভাবেই পৃথিবী ছেড়েছিল
আমরাও ঠিক মিছিল করেছিলাম, মশাল মিছিল
তবুও তো ধর্ষণের দরজায় লাগেনি খিল।
এ দেশ ধর্ষণ উপত্যকা!
এ দেশ তাহলে কি আমার নয়?
বিধাতার কাছে সব বলে দিও,
অভিশাপে যদি হয় ক্ষয়!
লজ্জিত এ মাতৃভূমি, আমার বাংলাদেশ!
তোমার অভিশাপে যেন হয় এই নৃশংসতার শেষ।