
বাঙালি সমাজের একটা প্রথা, বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই, তাকে বিদায় দেওয়ার সময়ে, সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। এপার বাংলায় তিনজন বাঙালিকে এই প্রথা অবলম্বন করতে দেখা যেত। প্রথমজন হলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। দ্বিতীয় জন সত্যজিৎ রায় এবং তৃতীয় জন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র।
অন্নদাশঙ্কর রায় প্রায় শতবর্ষী হয়েছিলেন। শেষ দিকে শারীরিক কারণে অতিথিকে ফ্ল্যাটে দুয়ার অবধি পৌঁছে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। সত্যজিৎ রায় কিন্তু শেষবার বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত প্রথাটি বজায় রেখেছিলেন। এমনকি হিউস্টনে ডা. ডেন্টন কুলিকে দিয়ে বাইপাস অপারেশন করিয়ে আসার পরও। যেমনটা রেখেছিলেন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র।
একেবারে অজানা-অচেনা কোনো অনুরাগী-অনুগামী এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে। সাধারণত নিজের হাতেই দরজা খুলতেন এবং আলাপের পর ঘর থেকে সদর দুয়ার পর্যন্ত নিজে পৌঁছে দিতেন। আর সত্যজিৎ রায়ের সময়টা ছিল ল্যান্ডফোনের কাল। বাড়িতে থাকলে ফোন বাজলে, সেই ফোনটা তিনি নিজের হাতে ধরতেন। বহু অনুরাগী-অনুগামী এভাবে সরাসরি ফোন করে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হয়েছিলেন। তা ছাড়া কোনো অনুরাগী যদি তাকে চিঠি লিখতেন, একটু দেরি হলেও, নিজের হাতে লিখে চিঠির উত্তর দিতেন। কোনো মামুলি উত্তর কিন্তু নয়। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতেন। কারণ সময়ের অভাবে বড় চিঠি লেখা মুশকিল। কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবনার স্বাক্ষর থাকত তার চিঠিতে।
এক অনুরাগী পুত্রের জন্মের পর সত্যজিৎ রায়ের কাছে আবদার করে চিঠি লিখেছেন, পুত্রের নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। সত্যজিৎ নিজের হাতে লিখে সে চিঠিটির উত্তরে বললেন; মনোযোগ সহকারে মহাভারত পড়ুন, বহু নাম পাবেন। সত্যজিতের সময়কালে এপার বাংলায় অনেক বাঙালি সেলিব্রেটি ছিলেন, যারা সেকালের চল সাইক্লোস্টাইল কপিতে অনুরাগীদের উত্তর দিতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাজ করার জন্য তাদের ছিল বেতন করা কর্মী।
সত্যজিৎ কিন্তু সেভাবে কোনোদিনও চলেননি। নিজের হাতে সব সময় ভক্তদের চিঠির উত্তর দিতেন। বহু ক্ষেত্রে তার ভক্তরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইত। সাধারণত কাউকেই তিনি নিরাশ করতেন না। পাঁচ মিনিট হলেও অনুরাগীকে সময় দিতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরিচিত অনুরাগী এলেও সত্যজিতের পরিবারের পক্ষ থেকে চা বা মিষ্টি দিয়ে আগন্তুককে আপ্যায়িত করা হতো। তবে সত্যজিতের সময়ানুবর্তিতা ছিল দেখার মতো। সেই সঙ্গে স্মৃতিশক্তি।
যদি কাউকে সময় দিয়ে থাকেন অমুকটার সময়ে আসতে, ঠিক সেই সময়েই তিনি কিন্তু অপেক্ষা করতেন সেই আগন্তুকের জন্য। খুব বেশি সময় এদিক-ওদিক হয়ে গেলে বিরক্ত অনুভব করতেন। আবার একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে যদি কোনো অচেনা আগন্তুক আসতেন, খুশি হতেন। সেই আগন্তুক, যাকে তিনি কখনো দেখেননি কিন্তু আগে থেকে টেলিফোন বা অন্য কোনো মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নির্দিষ্ট হয়ে আছে। সেটি স্মরণ করে অতিথি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, কোথা থেকে এসেছেন ইত্যাদি ব্যাপারে অনায়াসে তিনি বলে দিয়ে, অতিথির কাছে প্রশ্ন করতেন বা উত্তর দিতেন -- এমনটাই ছিল সত্যজিৎ রায়ের স্মরণ শক্তি।
অন্নদাশঙ্কর রায় খুব বলতেন; প্রতিটি মুহূর্তকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটা শেখা উচিত মানিককে দেখে। অন্নদাশঙ্কর বলতেন; দেখবে মানিক একটা মুহূর্তও অপচয় করে না। হয় সে পড়ছে। নয় সে লিখছে। নয় সে ছবি আঁকছে। নয় সে তার ছবির সুর তৈরি করছে। কোনো না কোনো একটা কাজে সে সব সময় নিজেকে ব্যাবৃত্ত রাখে। সেই সঙ্গে যদি কোনো বাইরের মানুষ আসেন, সেই মানুষটির সঙ্গেও অনর্গল কথা বলে চলেছে। অন্নদাশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়ের মেধাশক্তির এই দিকটার প্রতিও বারবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।
অপরপক্ষে সত্যজিৎ নিজে বলতেন; তোমরা মেশো মশাইকে (অন্নদাশঙ্কর) গুরুত্ব দাও। সেটা সমুচিত কাজ করো। কিন্তু মেশো মশাইকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই হয়তো যে গুরুত্ব দেওয়া দরকার মাসিমার (লীলা রায়) প্রতি, সেটা তোমরা দাও না। মাসিমারও কিন্তু অবদান কম নয়। প্রসঙ্গত এখানে বলতে হয়, সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি – অশনি সংকেত থেকে গণশত্রু, প্রতিটি ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল কিন্তু লীলা রায়ের করা। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সেসব অনবদ্য সাবটাইটেল সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মকে বাংলা না জানা মানুষদের কাছে মেলে ধরবার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
সত্যজিৎ রায় অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অন্নদাশঙ্করকে। তার এবং লীলা রায়ের জন্মদিনে বহুবার এসেছেন অন্নদাশঙ্করের বাসায়। অন্নদাশঙ্কর যখন যোধপুর পার্কে থাকতেন, তখন এই আসাটা ছিল নিয়মিত। আশুতোষ চৌধুরী অ্যাভিনিউয়ে অন্নদাশঙ্কর চলে আসার পরে ও তাদের জন্মদিনে এসেছেন। পরে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিয়মিত অন্নদাশঙ্করের কাছে, তার বা লীলা রায়ের জন্মদিনে আর আসা সম্ভব হয়নি সত্যজিৎ রায়ে। তবে যতবার এসেছেন, প্রায় প্রতিবারই সস্ত্রীক এসেছেন।
সত্যজিৎ কি খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন? নিজেকে নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা একজন সাধারণ মানুষেরও যে ধরনের ব্যক্তি জীবন থাকে, তা থেকে কি তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন?
এমন ধারণা বহু মানুষের আছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে যাদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক জীবনশৈলীতে তরল ব্যাপার কিছু ছিল না। তার মানে এই নয় যে, তিনি রসিক ছিলেন না বা আত্মজনের কাছে নিজের গাম্ভীর্যের আবরণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
সত্যজিৎ যখন বাড়িতে থাকতেন অনেক সময় নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অসাধারণ শিস দিতেন। আর সে শিসের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের গানের সুর মেলে ধরা - সেটা বাংলা গানই হোক বা মুম্বাইয়ের বিনোদন জগতের কোনো ধরনের গানই হোক কিংবা পাশ্চাত্যের সুর, এই শিস দেওয়ার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ মুনশিয়ানা ছিল সত্যজিতের- এটা যারা তাকে খুব কাছ থেকে না দেখেছেন, তাদের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা ব্যাপার হিসেবেই থেকে গেছে।
স্নানের ঘরে ঢুকবার আগে বাথরুমের চৌকাঠ থেকে বা চৌকাঠ পার হয়ে চলে গিয়ে, সামনের একটা প্যাসেজে নিজের দুপাটি চটি খানিকটা ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে ছুড়ে দেওয়া ছিল সত্যজিতের একটা ভীষণ প্রিয় খেলা। যেমন তেমন করে ছুড়ে দিলে চলত না! যতক্ষণ না দুপাটি স্লিপার একদম পাশাপাশি থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বারবার তিনি গিয়ে সেই চটি পরে আবার বাথরুমে ঢুকে, চটিটা ছুড়তেন। এটা ছিল তার একটা ভীষণ মজার একটা খেলা।
আর এই ঘটনা যখন ঘটত তখন বুঝতে পারা যেত সত্যজিতের মন-মেজাজ খুব ফুরফুরে রয়েছে। শারদ উৎসবের পর থেকেই পাতলা ভাগলপুরী এন্ডির চাদর গায়ে দেওয়া ছিল সত্যজিতের খুব প্রিয় বিষয়। আর এই চাদর গায়ে দিয়ে নিজের কাজ করতে করতে, অর্থাৎ ছবি আঁকাই হোক, গল্প লেখাই হোক, স্ক্রিপ্ট লেখাই হোক- এই ধরনের তার বিশেষ পছন্দের কাজ করতে করতে, দাঁত দিয়ে সেই এন্ডির চাদরটাকে একটু একটু করে ছেঁড়া --এটা ছিল সত্যজিৎ রায়ের একটা বিশেষ রকমের মুদ্রা দোষ। এভাবে অল্প দিনেই একটা চাদর নষ্ট হয়ে যেত। তাই বড়বাজার থেকে বিজয়া রায়, তার জন্য একেবারে গাঁটরি ধরে এন্ডির চাদর কিনে আনতেন।
অমন পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ সত্যজিৎ রায়। তিনি কিন্তু যখন শিশুদের সঙ্গে মিশতেন, তখন তার এই ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্যের দিকটা কোথায় যেন হারিয়ে যেত। শিশু মনস্তত্ত্বের কতখানি গভীরে একজন মানুষ গেলে পরে এটা সম্ভব তা আমরা বুঝি তার শিশুতোষ লেখাগুলো পড়ে। এজন্যই হয়তো সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে শিশুতোষ রচনাগুলি সৃষ্টি করা যে সম্ভব হয়েছিল- সেগুলো খুব গভীরভাবে পড়লেই আমরা বুঝতে পারি।
কিন্তু যে কথাটা বারবার মনে হয়, একটি শিশুর সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে তার মনকে বোঝার যেভাবে চেষ্টা করতেন সত্যজিৎ- এমনটা বোধহয় তুলনা চলে তার আত্মীয়া লীলা মজুমদার বা অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। শিশু সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে শিশু মনস্তত্ত্বের যে অনুভূতিটাকে আত্মস্থ করতে হবে- এই বোধের অনুসরণের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ বেশ কিছুটা হাতে-কলমে প্রয়োগের ধারণাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই একজন শিশুর অভিভাবকরা যখন খানিকটা মর্যাদা সম্মান এবং ভয় থেকে তাদের মানিক দাকে একটু দূরে দূরে থেকে নিরীক্ষণ করছেন, তখনই তার সন্তানরা যে কি অবলীলায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাটা খুব শক্ত হয়ে যায়। শিশুদের কাছে তিনি ছিলেন এক পরম বন্ধু।