ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

অভিশপ্ত মেস

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ০৪:০২ পিএম
অভিশপ্ত মেস
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

কলেজে পড়ার হয়তো কোনো পথই ছিল না সিরাজের। তবু ও বহু কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে কলেজের রঙিন গণ্ডিতে প্রবেশ করল। পড়াশোনায় সে খারাপ নয়। তবে সংগীত এবং আবৃত্তি তার প্রতিভার দুটি দিক।

কলেজ থেকে বারো মাইল দূরে এক ঝোপঝাড়ে ভরা কাদামাটির গ্রামে সিরাজের বাড়ি। বাড়ির অবস্থা এককালে ভালোই ছিল। বর্তমানে গ্রাম্য রাজনীতিতে সে অসহায়।

দুই দাদা ও দুই বৌদির কাছে বিধবা ভাগের মা এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে, যেন বিশাল সমুদ্রের জলে মুখ বের করে মৃত্যুর চিন্তায় ব্যস্ত। কূল নেই। ভরসা নেই। ভরসা শুধু সহায়-সম্বলহীন সিরাজ শেখ।

সকাল থেকে ছেলে পড়িয়ে বাসে করে রোজ কলেজে আসে সিরাজ। বড়ই কষ্ট। কিন্তু কী করবে। রাজনীতির দাপট!
ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে প্রাণ জুড়ানো হাওয়া। কখনো কখনো শুষ্ক বালিয়াড়ি ঝড়। ফাঁকা মাঠে বিরাট প্রাসাদ। সাঁইথিয়া অভেদানন্দ কলেজ।
গ্রামের ছেলে শহরের ছেলেদের সঙ্গে খুব একটা মিশতে পারে না। অবশ্য সে চেষ্টাও করে না। কোনোরকমে পাস করে ছোটখাটো একটা চাকরিই তার লক্ষ্য।

ভর্তির পর বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। আসে সরস্বতী পুজো। ঠিক হয়েছে জলসা হবে। ক্লাসে ক্লাসে পড়েছে নোটিস।
সিরাজের ক্লাসের, অর্থাৎ এগারো ক্লাসের ছাত্রী শবরী ভালো গান করে। তার রবীন্দ্র সংগীতে অনেকেই মুগ্ধ। তার গানে মুগ্ধ পিন্টুও! পিন্টু শবরীর কাছে প্রস্তাব রাখে। রিকশা থেকে শবরী নামতেই পিন্টু বলে- কী শবরী নাম দেবে না?
-কীসে?
-কেন রবীন্দ্রসংগীতে।
-ফাংশানটা কবে?
-সরস্বতী পুজোর পরদিন।
-আমার ইচ্ছে নেই।
-কেন তোমার অত সুন্দর গলা। গলার অবমাননা করছ!
-আমার গান কবে শুনলেন?
-কেন যুব-উৎসবে।
-আমি রাতে এসে গাইতে পারব না।
-কেন তোমার অসুবিধা কী?
-বলতে পারছি না।

শবরী ধীরে ধীরে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ক্লাসের দিকে এগোতে থাকে। পিন্টুও পিছু পিছু ক্লাসে ঢোকা মাত্রই মেয়েরা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। পিন্টু কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে, তোমরা হাসছ কেন? হাসছ কেন?
শবরী রেগে ওঠে, বলে আমি গান গাইব না আপনার কিছু বলার আছে!
পিন্টুর মুখ লাল হয়ে যায়। বন্ধুদের কাছে সে হেরে যায়। ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়।
সিরাজ কিন্তু সুযোগ খোঁজে। পিন্টু ক্লাস থেকে বেরোতেই তার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। পিন্টু নাক সিটকিয়ে বলে- আরে গেঁয়ো ভূত কী গাইবে!

পিন্টুর নাকসিটকানিতে সিরাজ হতাশ হলেও মরিয়া হয়ে বলে একবার চান্স দিন না।

পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রাজকুমার, সে অবশ্য সিরাজকে আশ্বাস দেয়। সিরাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বৈদ্যুতিক আলোয় জমকালো স্টেজে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পায় সিরাজ। ভরাট গলায় গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ভরা থাক ভরা থাক’, মুগ্ধ হয়ে যায় কলেজের ছেলেমেয়েরা, চমকে ওঠে শবরী, কারণ সে কলেজের সেরা গাইয়ে। কিন্তু সিরাজের গলা তার চেয়ে অনেক ভালো।

গোপন তারে তারে টান পড়ে সিরাজের। তবে সে বড় লাজুক, লড়াকু নয়। মৃদু ইশারা সৃষ্টি হয় চোখের কোণে কোণে, মুখে লজ্জার ভাব থাকলেও সিরাজ একটু মরিয়া হয়ে ওঠে।

সেদিন ক্লাসের মধ্যে দারুণ হইচই পড়ে যায়, ডায়েরি থেকে শবরীর রঙিন ফটো চুরি হয়ে যায়। শবরীর মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে, সব মেয়ের মধ্যে বেশ উদ্বেগের ভাব। শবরী যাদের সন্দেহ করে তাদের মধ্যে সিরাজ পড়েনি। কারণ একটা গ্রাম্য নিরীহ বালক কি কোনোদিন শহরে জাঁদরেল মেয়ের ছবি চুরি করতে পারে। একটা রহস্যের জাল ছড়িয়ে পড়ে সারা কলেজে। সিরাজ কলেজের আনন্দের স্বাদ পায়। সে পড়াশোনায় অসুবিধার জন্য বাসে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। এবং নেতাজী পল্লিতে একটা মেসে নিজের স্থান করে নেয়। কয়েকটি ছেলেকে পড়িয়ে যা আয় হয় তাই তার সম্বল, তবে তা থেকে মাকেও কিছু পাঠাতে হয়। মেসের সঙ্গী বলতে সমরেশ’দা সংগীতশিল্পী, সপ্তম আচার্য কাপড় ব্যবসায়ী আর বিমান বাবু রিটায়ার্ড অফিসার, সবাই সংস্কারমুক্ত, জাতিভেদ নেই, তিনজনেই খুব অভিজ্ঞ। মানুষকে ঘৃণা করার কোনো মানসিকতা তাদের নেই।

সমরেশবাবু সিরাজকে খুবই ভালোবাসে। তবে সিরাজের মনের কথা হয় বিমানবাবুর সঙ্গে, বিমানবাবুর সঙ্গে সম্পর্কটাও মধুর করে নিয়েছে। বিমানবাবুকে সে দাদু বলে।
বিমানবাবু কথায় কথায় বলে- কী হে প্রেমের থলিটা একটু দূরে ফেলে দাও।
সিরাজ মুচকি হাসে।
-তোমার এ কী ধরনের ভালোবাসা, কথা নেই শুধু ইশারা।
-বড় কঠিন ভালোবাসা দাদু।
-কঠিন কী হে, বড় বেদনাদায়ক।

চারজনের মেসের নাম ‘অভিশপ্ত মেস’। কেউই সংসার ধর্মে জড়িত হতে পারেনি।
প্রত্যেকের ফেলে আসা জীবন বড় বেদনাদায়ক। বিমানবাবুর পেনশনে চলে। সমরেশবাবু সংগীতের শিক্ষক, আর আচার্যবাবু কাপড়ের বোঝা নিয়ে স্টেশনে বসে থাকে। দুঃখের আঘাতে দুঃখ বিতাড়িত, শ্যামলা যৌবনের লেশ নেই এতটুকু। তাই মেসের নাম ‘অভিশপ্ত মেস’।

সিরাজের সব কথা, ভিতরের আন্দোলন- সবকিছুই সবাই জেনে ফেলে। সমরেশবাবু অবশ্য শবরীর সংগীতের শিক্ষক। সিরাজ একথা জানতে পারলে একটা মৃদু হাসি বেরিয়ে আসে। সমরেশবাবুর পেছন ধরে, সমরেশবাবুও বলে আমার সঙ্গে শবরীদের বাড়ি চল, তবে একটা কথা কি জানিস, ওরা সরকার পরিবারের মেয়ে। বিরাট বড় লোক, ওর প্রত্যাশা করা বৃথা। তারপর ওর বোধ হয় বিয়ে হচ্ছে একজন বড় বাস্তুকারের সঙ্গে।
-বাস্তুকার! কিছুটা শুনেছি,... আমি কোনো আশা নিয়ে যেতে চাই না।
-তাহলে?
-কারণ আমি তো বিধর্মী।
-সিরাজ। দেখাবার হলে বুকটা খুলে দেখাতাম তোকে।
-বুঝি সমরেশদা সবই বুঝি। কিন্তু ভালোবাসার অধিকার তো আমার আছে।

সন্ধ্যার পর রাস্তায় লাইট জ্বলে ওঠে। দুজনে বেরিয়ে পড়ে। শবরীদের বাড়িতে সমরেশবাবুর খুবই খাতির। শবরী সিরাজকে দেখে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। পর্দার আড়াল থেকে দুটো জ্বলন্ত চোখ এসে পড়ে সিরাজের ওপর। সিরাজের মুখের ওপর নীরবতার ছাপ। মলিনতার আলপনা, তার ওপর আবার রক্তের দাগ পড়ে যায় যখন শবরীর মা হাসতে হাসতে এসে বলে শবরীর বিয়ে ২৭শে বৈশাখ।

সমরেশবাবুর মুখ থেকে কৃত্রিম হাসি বেরিয়ে আসে। সিরাজের পরিচয় জিজ্ঞেস করে শবরীর মা। পরিচয়ে তার মুখটা একটু কুঁচকে যায়, জলখাবারের তেমন উৎসাহ দেখায় না। সিরাজ সম্পর্কে অনেক কথাই সমরেশবাবু বলে। কিন্তু শবরীর মা চুপচাপ শুনে যায়।

সমরেশবাবু বেশিক্ষণ বসে না, শবরীকে ডেকে আজ একটু কাজ আছে কাল আসব বলে বেরিয়ে পড়ে। শবরীর চঞ্চল চোখ দুটো পড়ে সিরাজের দিকে। তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে, অতঃপর শবরী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সিরাজের পদক্ষেপ গুনতে থাকে।

সিরাজ গ্রাম থেকে ধাক্কা খেয়ে শহরে পেল যন্ত্রণা।

সারা রাতের ঘুম তার হারিয়ে যায়। শবরীর রঙিন বাঁধানো ছবিটা টাঙিয়ে রেখেছে ঠিক আয়নার পাশে। শুয়ে শুয়ে মুখ দেখে আয়নায়, পাশে শবরীর ছবি। সিরাজ রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম নেই। মুখের ছবি পড়ে আয়নার চোখ দুটো শবরীর ছবিতে। সে আপন মনে বলে ওঠে- শবরীর জীবনে কত আনন্দ কত সুখ ফুটে উঠবে।
ফুলশয্যার রাত হয়ে উঠবে কত সুন্দর। শবরী একজনের কোলে ঢলে...
বিছানা থেকে উঠে বসে, দেওয়ালের মাঝ থেকে কোনো কথা আসে না। নীরব ঘরে শুধু নাইট বাল্বটা জ্বলতে থাকে।
সমরেশবাবু বলে ওঠে- কিছু খেলি না, রাত জাগিস না। মনকে বোঝা।

সিরাজ নিজেকে ঠিক বোঝাতে পারে না। সে নিজেকে নিয়ে যেতে চায় এক অন্ধকারময় পৃথিবীতে। সেও চলে যেতে চায় শবরীর সঙ্গে। শুধু পাশে পাশে থেকে ভালোবেসে নিজেকে শেষ করতে। তাই সে স্বপ্ন দেখে শবরী যেখানে থাকবে সেই ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার কলোনি। সিরাজ-এর ২৭শে বৈশাখের পর এভাবে দিন কাটতে থাকলে মেসের সবাই বলে- তোর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তুই শেষ হয়ে যাবি। উত্তরে শুধু বলে, শেষ তো হয়ে গেছি। শেষ হওয়ার আর কিছু নেই।

অভিশপ্ত মেসকে বিদায় দিয়ে তাই বেরিয়ে পড়ে ব্যান্ডেলের দিকে। সম্বল কাঁধে একটা ব্যাগ। সংকল্প সেখানে প্রাইভেট পড়িয়ে খাবে। মেসের তিনজনের চোখে জল আসে। কারণ তাদের জীবনও অভিশপ্ত। ফেলে আসা জীবনের কথা মনে পড়ে তাদের।
শবরীর বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে সিরাজ উপস্থিত হয় ব্যান্ডেলে। এ প্রান্ত  থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘোরে একটু বাসস্থানের জন্য। অবশ্য শবরীর ঠিকানা বের করতে দেরি হয়নি। সেটা সে জোগাড় করেছিল সমরেশবাবুর মাধ্যমে।

তপ্ত রোদের বেলায়। পড়ন্ত বিকালে ঘোরে এখানে-সেখানে। অবশেষে এক কামারের বাড়িতে আশ্রয় চায়। কামারের বাড়িতে দুজন সদস্য। কামার নিবারণ কর্মকার এবং তার স্ত্রী সনকা।
প্রথমে বিফল হলেও আশ্রয় একটু জোগাড় করে। কারণ কামারের স্ত্রী জাতিতে ছিল মুসলমান। এখন কর্মকার। সিরাজ তার কাছে জাতি লুকোয় না। সহানুভূতির আলিঙ্গনে টানে সিরাজকে-
কোথায় বাড়ি?
-সাঁইথিয়া।
-সাঁইথিয়া।

সনকা যে মেয়েটির বাড়িতে কাজ করে তার বাড়িও সাঁইথিয়া। অবশ্য সে জানে সনকা হিন্দু। সনকা অবশ্য সিরাজকে তার পূর্ব ইতিহাস বলে না। সনকা কাউকেই বলেনি সেও বিতাড়িত।

সনকার সন্দেহ জাগে। সিরাজকে সব সময়েই উদাসীন দেখে। সে নিজের মতো করেই খাওয়ায়। বকে। উপদেশ দেয়। অবশ্য সিরাজ সনকাকে তার সমস্ত কথা না বলেও পারেনি। খুলে বলেছে। সনকার সহানুভূতি সিরাজকে মুগ্ধ করে।
সনকা কথায় কথায় শবরীকে বলে- সাঁইথিয়া থেকে একটা ছেলে এসেছে।
-সাঁইথিয়া থেকে? কী নাম?
-সিরাজ সেখ।
-সিরাজ! কিন্তু ও যে মুসলমান।
-তাতে কী আছে। মানুষ তো।
-সনকা।
শবরীর চোখ দুটো স্থির হয়ে যায়। যেন শবরী ঝাঁপ দিয়ে একটু এগিয়ে যেতে চায়।
-ভালো গান জানে।
-তাই।
-কবিতা পড়ে খুবই সুন্দর। আমাকে খুবই খাতির করে। বড় মায়াবী।
শবরী কোন কথা বলে না। বলে তাড়াতাড়ি কাজ করে নে। আমি একটু বাজারে যাব।

সনকা কাজ করে বাড়ি ফেরে। বেশ রাত। নিবারণ তাসের আড্ডায়। সিরাজ একটা লণ্ঠন জ্বেলে চুপ করে বসে আছে। চোখের সামনে তার দুটি রূপ, এক ভাগের মা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। বেকার। ভূমি পরিত্যক্ত। অন্যদিকে প্রেয়সী। দুইয়ের মাঝখানে একটা চাবুক মারতে সে চায়।
-বৌদি একটু জল দেবে।
-কেন দেব না। জলের গেলাস এনে বলে- আজ তোমার কথা হচ্ছিল। তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে।
-না বৌদি আর নয়।
-কেন তোমার আবার কী হলো।
-কিছু না। আমার ভালোবাসার মূল্য দিতে চায়।
-কী মূল্য দেবে?

মৃদু হাসে। সমরেশদা বলেছিল আমাদের এক সেকেন্ডের জীবনকে আমরা নিয়ে যাই পঞ্চাশ বছর। একশ বছরে। শুধু মায়ার টানে। কিন্তু এক সেকেন্ডেও তো শেষ করা যায়।
-সমরেশদা কে?
-আমার গুরু।
-তুমি হতাশ হয়ো না। কত মেয়ে পাবে।
-না বৌদি তা হলে ভালোবাসার মূল্য কোথায়?
-তুমি ভুল করো না।

রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত সনকা। সিরাজ ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সনকা চিৎকার করে ওঠে। পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। নিবারণ হতভম্ব হয়ে যায়। সনকা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাড়ার লোকেরা তাড়াতাড়ি দেহটা পুড়িয়ে দেয় শ্মশানে নিয়ে গিয়ে। সনকার মধ্যে পোড়াতে দ্বিধা থাকলেও সে কিছু বলতে পারে না।
সনকা ব্যাগ খুলে দেখে শবরীর একটা রঙিন ছবি এবং একটি চিঠি-

শ্রীচরণেষু বৌদি,
আমার মৃত্যুর পর পারলে শবরীর হাতে চিঠিটা তুলে দেবে। এবং বলবে কলেজ জীবন হতে একটা অপদার্থ ছেলে যে ভালোবাসা বুকের মধ্যে বহন করে চলেছিল তার আজ চির সমাপ্তি। ভালোবাসার মূল্য ভোগের মধ্যে মাপা যায় না। শবরীকে সুখে থাকতে বলো। তুমি প্রণাম নিও।
ইতি-
সিরাজ

পরের দিন কাজ করতে গিয়ে সনকা চিঠিটা এবং ফটো দেখায়। অবশ্য সে নিবারণকে কোনো কথা বলেনি। শবরী ফটোটা দেখে বলে-এ ফটো আমার কলেজে চুরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মারা গেল কেন।
-কী জানি। চোখের জল মোছে।
শবরীর বুকের ভিতর একটা বিরাট ঝড় ওঠে। সে তার স্বামীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা তুমি তো বিদেশি সভ্যতায় মানুষ। তোমাকে একটা কথা বলব,
এক শ’বার বল।
-এখন যদি কেউ আমাকে ভালোবাসে, আমার কী করা উচিত?
-সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
-তুমি হলে কী করবে?
-ভালোবাসা গভীর হলে নিশ্চয়ই বিয়ে করব।
-জান আমাকে একজন গভীরভাবে ভালোবাসত। সে কাল শেষ হয়েছে শুধু আমার জন্যই।
শবরীর স্বামী নিতাই বাবু বলে- এর জন্য দায়ী কে?
-আমি। কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে...।
-কিন্তু বিয়ের আগে?
-ভালোবাসাটা ছিল নীরব। শুধু ইশারার, কথায় নয়।
-যন্ত্রণাময় ভালোবাসা। উচ্চ সভ্যতায় প্রিয়, বিয়েটা কোন ফ্যাক্টর নয়।
-তুমি কি মন থেকে বলছ?
-তা হয়তো নয়। তবে একটা সমাজের কথা বলছি। যেখানে জিজ্ঞাসার কোনো প্রয়োজন নেই।

শবরীর চোখ দুটো স্থির হয়ে যায়। নষ্ট-পচা সমাজের ছবি দেখতে থাকে। অনেক দূরে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে দৃষ্টি। শবরী আঁতকে ওঠে, চিতার আগুনের ছাই নিয়ে মুছে দিতে চায় সিঁদুর। সহিষ্ণুতা সতীত্বের বুকে হানে পদাঘাত। শবরী স্বপ্ন দেখে ভাঙার, স্বপ্ন দেখে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছল সমাজের যেখানে কোনো বাধা নেই, যেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। যে সমাজ শুধু মানুষের।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম
বিষাদ বসুধা

গত সংখ্যার পর

শিল্পপতিরা পত্রিকা বের করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা সেটা জেনেও সেই হীনস্বার্থেই ব্যবহৃত হন। মূলত শিল্পপতিদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত তারা। শাহবাজ খানের কাছে একজন সম্পাদক আসিফ আহমেদ যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন, যেভাবে তার ন্যায়সঙ্গত কোনো যুক্তিই গ্রহণ না করে, কর্মচারী ছাঁটাইয়ের শক্ত শর্ত অনিবার্য করে তোলে, সেখানে আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিরূপায় হয়ে পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। লেখক আলোর নিচের কঠিন এক অন্ধকারকে পাঠকের সমানে উপস্থাপন করে মহৎ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। সত্যধারণ ব্যতিত কখনো কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না, সত্যকে অস্বীকার করে বা সত্যকে না দেখার ভান করে কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হলে কখনোই তা মহৎ শিল্পকর্মের মর্যাদা লাভ করে না। 

মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য শিল্পীকেও সত্যসাধক হতে হয়, বুকে হিম্মত থাকতে হয়। মোস্তফা কামাল ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাসে সত্য ধারণের হিম্মত দেখাতে পেরেছেন। কারণ তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিক। তার জন্য এই সত্য প্রকাশ আরও কঠিন। সেই কঠিনকে তিনি জয় করেছেন। আর সে কারণেই কালের যাত্রাই উপন্যাসটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। শিল্পদ্যোক্তারা নিজের পত্রিকার সংবাদকর্মীদের কর্পোরেট অফিসের কর্মচারী ব্যতীত অন্যকিছুই ভাবেন না। যে কারণে আসিফ আহমেদের মতো একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সম্পাদককেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে পারেন। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত দেখা না করে তাকে ফিরিয়েও দিতে পারেন। তাদের বিবেকে এগুলো কোনো কাজ করে না। তাদের কাছে মূলত অর্থ বিবেচ্য, সম্মানবোধ নয়। অথচ আসিফ আহমেদ অসম্ভবরকমের ধৈর্য্য নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এখানে আমরা নানাভাবে অপচয় বন্ধ করে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে আনতে পারি। সেটা করলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। দাম্ভিক শাহবাজ খানের মাথায় একটাই- চিন্তা লোক ছাঁটাই করা, কোনো টাকা দিতে পারবেন না। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বকেয়া কোটি কোটি টাকা তাও পরিশোধ করবেন না। করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও শাহবাজ খান সম্পূর্ণভাবে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনিই আবার মোহিনীর জন্মদিনে ফুল পাঠিয়েছেন। অদ্ভুত ভয়ানক ও বীভৎস চরিত্রের শাহবাজ খান রূপশ্রী বান্ধবী মোহিনীর জন্মাদিন মনে রাখেন এবং ফুল পাঠান। 

অথচ পুরো দেশে তখন করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসংকট প্রবলভাবে। নিজের পত্রিকার লোকজন তখন অনিশ্চয়তায় ভাসছেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই শ্রেণির শিল্পপতিদের কাছে সাধারণ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই স্পর্শ করে না। বরং সুযোগ পেলে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েই আনন্দ লাভ করেন। শাহবাজ খান সেই নির্মম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের শিল্পপতিরা এখনো যে সাংবাদিকদের নিছক কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, কঠিন এই সত্য উপন্যাসটিতে আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কারণে আসিফ আহমেদ আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ পদত্যাগে তার বুকের পাঁজর কতটা ভেঙেছে, কতটা ব্যথিত হয়েছেন, তা সহজেই অনুধাবন করা যায় লেখকের ভাষায়, ‘আসিফ আহমেদ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেক যত্নে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেটি তাকে আজ ছেড়ে যেতে হবে। গভীর এই মর্মবেদনা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। তিনি চলে গেলে যদি সবার চাকরি থাকত তাহলেও তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। তিনি চলে যাওয়ামাত্রই ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে। কতজন যে চাকরি হারাবে কে জানে!’ এখানে খুব সহজেই আসিফ আহমেদের হৃদয়ের যন্ত্রণাদগ্ধ রক্তক্ষরণ অনুভব করা যায়, একই সঙ্গে শাহবাজ খানের হীন-মানসিকতার স্বরূপটিও সহজেই চিনে নিতে পারি। একদিকে তিনি নিজের পত্রিকার লোকজনকে করোনায় মহাবিপদে ঠেলে দিচ্ছেন, আর একদিকে তিনি ঘুমের ভেতর ‘মোহিনী’কে ডাকছেন। মোহিনী তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একসময় মোহিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বন্ধুত্বে যতটুকু মানায় ততটুকুই থেকেছেন। মাঝে দীর্ঘ যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ নতুন করে সেই সম্পর্ক তাজা হয়ে ওঠে। তা অনেকটাই শাহবাজ খানের কারণেই। এটি আরও বেশি প্রাণ পায় শাহবাজ খান যখন জানতে পারেন আরেফিন মারা গেছেন। আগ্রহ অগ্নিতে রূপ নেয়। সেটা তার ঘুমের ভেতরও দখল নেয়। শাহবাজ খান অসংখ্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, এ নিয়ে পরিবারে স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে তার প্রকট সমস্যা। তার চারিত্রিক এই ত্রুটি নীলিমা খান মেনে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে অপমানে শাহবাজ খানকে ছেড়ে চলে যান তিনি। শাহবাজ খানের মধ্য দিয়েই লেখক সমাজের উঁচুস্তরের একশ্রেণির মানুষের দুর্গন্ধভরা কদর্য রূপ অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উন্মোচিত করেছেন।

করোনাকালীন চিকিৎসাব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটিকে আরও বড় সত্য করে প্রতিষ্ঠিত করেছে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবায় যখন পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, স্বার্থমন্ত্রী চাকরি রক্ষা করতে সাহেদ করিমের ফাঁদে পা দেন। সাহেদ করিম নিয়মিত টিভি টক শ করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ দামিনামি ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি। এসব দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে নিজের ত্রাণকর্তা ভেবে বসেন। এবং করোনা টেস্টের অনুমতির চুক্তি করেন সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে।  সাহেদ করিম এখানে পুরো দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কোনোরকম করোনা টেস্ট না করে রিপোর্ট দিতে থাকেন। মানুষ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। জনমন থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের মনে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে সাহেদ করিমের প্রতারণা। এরকম অসংখ্য প্রতারণা ও দুর্নীতি খবরে যখন টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা সয়লাব হয়ে ওঠে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। পারিবারিকভাবেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সাহেদ করিমকেও তিনি আর পাশে পান না। তিনি মন্ত্রী হয়ে সাহেদ করিমের অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভনে নিজেকে অসহায় ভেবেছেন, তার কথাতেই তার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহেদ করিমের সঙ্গে যখন প্রথম প্রথম কথা হতো, তাকে যখন টাকা ও ক্ষমতার গল্প শোনাতেন, তিনি বিস্মিত হতেন। আর বিস্ময়ের ভেতরেই নিজের মনের ভেতর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সাহেদ করিম চলে যাওয়ার পরে প্রবল ক্ষমতাধর এই মন্ত্রী সাহেদ করিমকে নিয়ে ভাবেন, একটা হাসপাতালের মালিক! তার কত টাকা! এই দেশে টাকা থাকলে কি না হয়! আমি ঘোড়ার ডিমের মন্ত্রী। আমাকে কেউ পোছেও না। উল্টো মানুষের গালমন্দ! মিডিয়ায় উল্টাপাল্টা রিপোর্ট। মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হলো! না, কিছু ভালো লাগে না।’ তার এই ভাবনার ভেতর গণমানুষের স্বার্থের কল্যাণকামী কোনো ভাবনা নেই, করোনা থেকে দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করবে সেই চিন্তা নেই, শুধু আছে নিজের হীনস্বার্থপরতার কথা, আছে সাহেদ করিমের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যর্থতার ভাবনা। এক অসম্ভব ব্যক্তিস্বার্থলোভী ঠুনকো এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তার পদত্যাগের জোরালো দাবিতেও তিনি নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছেন। মানুষের জীবন রক্ষা নয়, যে কোনো উপায়েই হোক মন্ত্রিত্ব রক্ষা করাই তার কাছে বড়। এবং তিনি সেটাই করেছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনাকালীন এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত ভেঙে পড়েছিল। নানাভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেবা পায়নি। বড় হাসাপাতালে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা হয়নি। টাকার বাণিজ্য চলেছে। রোগী না থাকলেও আইসিইউ ভাড়া করে রাখত একশ্রেণির ধনীরা, কখনো তাদের পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাদের সেবার জন্য। কোনো সভ্য দেশে এটা ভাবা যায়! অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিয়ে পরিবারের আপনজনরা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, ভর্তি করাতে পারেননি, সেবা পাননি। পথে পথেই মৃত্যু হয়েছে বহু রোগীর। এই কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভর্তি করলেও অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে, অক্সিজেন না দিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলা দেওয়া হয়েছে। 

চলবে...

 

কারাগার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম
কারাগার
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

কেরানির পোস্টে চাকরি করতেন কফিল উদ্দিন। অফিস থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কী তার অপরাধ, তিনি নিজেও জানতেন না। তবে চারদিকের পরিবেশ যে অশান্ত, তা টের পান। ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগের পর জেল থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে এসে প্রথম যে মুখটি তার মনে পড়ল তা হলো তার ছেলের মুখ। বিয়ের পর প্রায় পাঁচ বছর নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। একটা সন্তানের জন্য ভয়াবহ হাহাকার ছিল তার। ফলে এই পাঁচ বছর যে বা যারা যা পরামর্শ দিয়েছেন তাই মাথায় সমাদরে নিয়েছিলেন। কবিরাজি থেকে শুরু করে তাবিজ-তুম্বা, ঝাড়ফুঁক কিছুই বাদ যায়নি। অবশেষে একদিন তার স্ত্রী সুখবরটা দেন। কিন্তু বিধি যদি আপনাকে নিয়ে পরিহাস করে আপনি যা চাইবেন ঠিক সেভাবে পাবেন না। ছেলেটি জন্ম নিল প্রতিবন্ধী হয়ে। তবুও তো বাবা হতে পেরেছেন। আনন্দে আটখানা তিনি। কোলেকাঁখে নিয়ে ঘুরতেন। নিজ হাতে খাওয়াতেন। রাতে বুকের ওপর নিয়ে শুতেন। পেশাব-পায়খানা নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। প্রতি বছর প্রতিবেশীদের নিয়ে হইহুল্লোড় করে তার জন্মদিন পালন করতেন। বিষণ্ন বিকেল। ছেলের মুখ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

কানাগলির ভেতর একটা টিনশেড বাসায় পুত্রপরিজনসহ থাকেন তিনি। দুটো ছোট্ট রুম। সারাক্ষণ ঝুপঝুপ অন্ধকার। বারান্দা বলতে কিছু নেই। এ রকম গুমোট পরিবেশও তাকে অনাবিল আনন্দ এনে দেয় যখন তিনি ছেলের সঙ্গে হাতিঘোড়া নিয়ে খেলায় মত্ত থাকেন। সেই খেলনাগুলো প্রায় নষ্ট ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ছেলের কথা ভেবে ফুটপাত থেকে একটা নতুন হাতি কিনলেন। হাতি সাধারণত কালো রঙের হয়; কিন্তু এই হাতিটা বেশ রংচঙা। ঘোড়া-ট্রেনও কিনতে মন চাইছিল, কিন্তু তার পকেট তাকে সাবধান করে। অগত্যা অপূর্ণতা নিয়েই বাসায় ফিরলেন। দরজা ভেজানো ছিল। বাইরে থেকে বউয়ের নাম ধরে গলা ফাটালেন; কিন্তু সাড়া মিলছিল না। কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হলো। আস্তে করে দরজা ঠেললেন। জংধরা টিনের দরজা। ক্যাঁ-কোঁ শব্দ করে হাট হয়ে গেল। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল তার। খোঁজাখুঁজি করলেন। ছেলেটাকে খাটের নিচে পেশাব-পায়খানার ওপর নিথর পড়ে থাকতে দেখে তার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে বেরিয়ে এল চিৎকার। বউয়ের নাম ধরে আবারও ডাকলেন। বউ থাকলে তো! ছেলেকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করলেন। তার কপালে-শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলেন বেঁচে আছে তো! প্রাণের স্পর্শ পেলেন, কিন্তু তাপমাত্রা অনেক। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। কোলে উঠিয়েই ত্বরিত মহল্লার ডাক্তারখানায় গেলেন। 

মরতে মরতে বেঁচে গেছে! আর কয়েক ঘণ্টা দেরি করলেই শেষ! আপনারা মানুষ? এরকম ধমক ও ছেলের পরিষেবা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। প্রতিবেশীর কাছে শুনলেন, দুই দিন আগে থেকে মহিলা লাপাত্তা। একজন তরুণী ইতস্তত বোধ করলেও বলতে বাধ্য হলো, ভাবিকে এক যুবকের সঙ্গে রিকশায় দেখেছে সে। মাথাটা চক্কর দিল তার। এ জন্য দায়ী তিনি নিজে। কারাগারে যাওয়ার কয়েক মাস আগে বউকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলেন। মোবাইল পাওয়ার পর বউ সন্তান তো বটেই, খাওয়া-নাওয়া পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। টিকটক, ইউটিউব, চ্যাটিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত সে। বউকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন তিনি; তাই এসব বিষয় আমলে নেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। চোখে ঘোর অমানিশা। কী করবেন, দিশা পাচ্ছিলেন না। কারণ, এ প্রতিবন্ধী ছেলেকে কে দেখভাল করবে? কে তার দায়িত্ব নেবে? জেলে যাওয়ার কারণে চাকরিটা আছে কি না, সে চিন্তাও তার মাথায় কুটকুট করে কামড়াল। পরদিন, ছেলেকে কাঁধে নিয়ে অফিসে গেলেন। তার বস একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাপোর্টার। ভিন্নমতালম্বীদের সহ্য করতে পারেন না। তাকে বাইরে বসিয়ে রেখে বকেয়া পাওনা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শীতল মেজাজে ‘সরি’ বলেই তার পর্ব শেষ করলেন।

আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। একদিকে সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধ, আরেকদিকে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। একটা ছোটখাটো চাকরির জন্য অফিসের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। কতিপয় নোংরা মানুষের দুয়োধ্বনি ছাড়া কপালে কিছুই জুটল না। বেকারত্বের অভিশাপ যখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, ঠিক সে সময় তার এক বন্ধু এগিয়ে এলেন। তিনি স্টকমার্কেটের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। তবে ভাগ্যবান; যে স্টকেই বিনিয়োগ করেছেন, সেখান থেকেই প্রফিট ঘরে তুলেছেন। চাকরিবাকরি না করেও তার সংসার দিব্যি চলে। তার পরামর্শে যা সঞ্চয় ছিল, তা স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ করলেন। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কয়েকদিন হাউসে ঘুরলেন। শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকল তার স্টকের দাম। বাড়তে বাড়তে দেড় মাসের মধ্যে দ্বিগুণ। তার বন্ধু তাকে বেচার পরামর্শ দিলেন; কিন্তু তিনি কর্ণপাত করলেন না। ভয়ংকর লোভে পড়লেন। তার স্বপ্নের শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটাল। যে ছেলেকে ভালোমতো সময় দিতে পারেন না, মনের খুশিতে তাকে আদরযত্নে ভরিয়ে দিলেন। ছেলের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন টাকাটা তিন গুণ হলেই ইন্ডিয়ায় যাবেন। ভালো ডাক্তারের অধীনে তার চিকিৎসা করাবেন। এমনকি তার দেখভালের জন্য বেবিসিটার পর্যন্ত রাখবেন। তার কথার অর্থ ছেলে বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে তার গালে দুষ্টামি করে চিমটি কাটেন, মাথা ধরে ঝাঁকুনি দেন। 

কিন্তু তিনি যে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খাবেন, তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না; কারণ, স্টকমার্কেটে তার অভিজ্ঞতা জলে না নেমেই গভীরতা মাপার মতো। তার সুহৃদ বন্ধু আবারও তাকে বিক্রির পরামর্শ দিলে এবার তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন। ভাবলেন, তার বন্ধু তার ভালো চায় না। চাইলে এরকম জোরজবরদস্তি করে? ইচ্ছে করেই বন্ধুকে এড়িয়ে চললেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই মার্কেটে ধস। ব্যাপক দরপতন। যা বিনিয়োগ করেছিলেন, তা তলানিতে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব। স্বপ্ন চুরমার। মানসিক টানাপোড়েনে ধূমপান বাড়িয়ে দিলেন। একের পর এক সস্তা সিগ্রেট। সিগ্রেট কেনার পয়সা না পেলে যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। অ্যাশট্রে-তে জমানো ছাইভষ্ম হাতের তালুতে ঢেলে খেয়ে ফেলতেন। তাতেও স্বস্তি না মিললে রাস্তায় নামতেন। আটআনা, একটাকার মুদ্রা যা-ই কুড়িয়ে পেতেন, তা দিয়ে বিড়ি কিনতেন। কিন্তু ছেলের মুখে কী তুলে দেবেন? বিড়ি? নাহ! খাবার কিনতে পয়সা লাগে। যে বন্ধুটিকে সবচে’ কাছের ভাবতেন, তার কাছেও যেতে পারছেন না, কারণ, তিনি তার কথা শোনেননি। ধারদেনা করে কিছুদিন চললেন, তার পর আটকে গেলেন; একেবারে কাদায় গরুর গাড়ি আটকে যাওয়ার মতো। চোখে সরষে ফুল। অন্ধকার খাদে তার পৃথিবী যেন কঠিন গদ্যময়। চোখের নিচে কালি, গণ্ডদেশে কালশিটে। উসকোখুসকো চুল ক্রমশ জটার দিকে ধাবিত। তোবড়ানো মুখে চাপদাড়ি। সময়ের আগেই বয়সের ভারে বেশ ন্যুব্জ। হঠাৎ এতটাই পরিবর্তন, তাকে দেখলে পরিচিতরাও ভিড়মি খান। বিড়বিড় করেন, এই মানুষটার হলো কী!

বাড়িভাড়া দিতে না পারায় মালিক ঘনঘন দরজার কড়া নাড়েন। এই সামনের মাসে দেব, এক জায়গায় টাকা আটকে আছে, এসব কাকুতি-মিনতিতেও বাড়িঅলার মন গলে না। বাড়িছাড়ার তাগাদা দেন। এদিকে পাওনাদাররাও কম কীসে! হুমকির পর হুমকি। ফলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হোন। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার এবং তাদের বসবাস যেখানে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। পালিয়ে বেড়ানোই উত্তম। ডাস্টবিন থেকে খাদ্য-অখাদ্য কুড়িয়ে খান। ছেলেকেও খাওয়ান। প্রায়শ দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররা যে কসাই, বিনেপয়সায় কে তাদের চিকিৎসা করবে! পরিস্থিতি ভয়ানক নাজুক। কখনো খিদের কামড় সহ্য করতে না পেরে আমজনতার কাছে হাত পাতেন; কিন্তু তাদের করুণালাভে ব্যর্থ হোন। মাথা চুলকান। বুঝতে পারেন মাথাটা অকামের জঞ্জাল হয়ে উঠেছে। ভালো বুদ্ধি কাজ করে না। উপায়ান্তর না পেয়ে ছেলেকে রেললাইনের ধারে ফুটপাতের ওপর শুইয়ে দেন। তার পর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন: ভাই, কিছু সাহায্য করেন। লাশটাকে দ্যাশে নিতে চাই। কিন্তু সেখানেও বাগড়া। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে তাকে উঠিয়ে দেয়। জীবনযুদ্ধে এতটাই পর্যুদস্ত, এতটাই অসহায় রাগে-ক্ষোভে চরম বিরক্তিতে ছেলেকে নর্দমায় ফেলে দেন। পেছন ফিরে আর তাকান না। চলে আসেন খানিকদূর। হোক না প্রতিবন্ধী; হাজার হলেও ঔরসজাত। বুকটা ধড়ফড় করে, হৃৎপিণ্ড মোচড় দেয়, পা টলমল করে। পিতৃত্বের অমোঘ টানে আবার ফিরে আসেন নর্দমার কাছে। দেখেন, ছেলেটা মরেনি। দেহটা কাদার মধ্যে ডুবে গেলেও মাথাটা ওপরে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। যেন কারও দিকে তাকিয়েছিল সে। ছেলের আকুতিভরা নিষ্পাপ মুখ দেখার পর তার মৃতপ্রায় চোখদুটো ছলছল করে উঠল। এক পা-দু পা করে নিচে নেমে ছেলেকে টেনে তুললেন। তার পর বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বুক ফেটে কান্না আসছিল তার, কিন্তু কেঁদে কী লাভ? কান্না পাথরচাপা দিয়ে ছেলেকে কাঁধে নিলেন। 

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন শহরের একপ্রান্তে। কোথায় তার গন্তব্য, জানেন না তিনি। হৃদয়হীন সমাজে আঘাত পেতে পেতে তার মস্তিষ্ক পচে গেছে, গলে গেছে, তবুও সেখান থেকে বোধের চারা গজাল; আচ্ছা, ছেলেটাকে যদি তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! পরক্ষণে ভাবলেন, যে মা তার বিকলাঙ্গ সন্তানের চিন্তা না করে স্বীয় সুখের আশায় পরপুরুষের সঙ্গে গৃহত্যাগ করতে পারে, তার হৃদয় কতটা দয়াদ্র! এবার স্ত্রীকে না, নিজেকেই দোষারোপ করে তার ভাবনাকে গুরুত্ব দিলেন। শুনেছেন, এদিকেই তার প্রাক্তন স্ত্রী কোনো না কোনো বাড়িতে তার স্বামীর সঙ্গে থাকে। কীভাবে তাকে খুঁজে পাবেন, এলোমেলো ভাবনাগুলো হঠাৎ শিস দিল। তার প্রাক্তন স্ত্রীর এক বান্ধবী অনেক আগেই তার বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিল। সে মোতাবেক বাড়িটা হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। তখন প্রায় সন্ধ্যে। কাকতালীয়ভাবে সেই বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রকাণ্ড লোহার গেট। দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দরজার ওপর উপর্যুপরি ধাক্কাতে থাকেন। ধাক্কানোর শব্দ পৌঁছে যায় অন্দরমহল অবধি। এক সময় দরজা খোলেন এক ভদ্রমহিলা। কিন্তু তিনি তাদের দেখামাত্র বিপদ আঁচ করে দড়াম করে দরজা বন্ধ করেন তাদের মুখের ওপর। অপমান কী জিনিস, তা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। ভগ্ন হৃদয়ে সরে এসে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু ছেলেটা খিদের কারণে কুকুরের বাচ্চার মতো কুঁইকুঁই আওয়াজ তুলছিল। তার পেটও রাক্ষসে আচরণ করছিল। ছেলেকে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে হোটেলে খাবার চুরি করতে গেলেন। ধরা খেয়ে বেধড়ক পিটুনি। হোটেলবয়রা তাকে পুলিশে দিল। পুলিশের হাত-পা ধরেও যখন থানা থেকে ছাড়া পাচ্ছিলেন না, তখন মলমূত্র ত্যাগ করে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়ালেন। বমি করতে করতে পুলিশ অবশেষে গরাদের দরজা খুলে দিল। 

ততক্ষণে একরাত একদিন পেরিয়ে গেছে। ছেলের কাছে পৌঁছে দেখলেন তার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। ছেলেকে একবার স্পর্শও করলেন না। ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলল। সোজা চলে এলেন সেই হলুদ বাড়িতে। প্রাচীর টপকালেন। শ্বাসরোধ করে হত্যা করলেন পরস্ত্রী হরণকারীকে। তার প্রাক্তন তখন পুলিশকে মোবাইল করছিল, তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তার মুখে জোর করে মোবাইল ঢুকিয়ে একপ্রান্তে সজোরে আঘাত করলেন; সঙ্গে সঙ্গে গলায় আটকে গেল মোবাইলটা। তার পর তিনি নিজেই পুলিশে ধরা দিলেন। 

জেলগেটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো এ দেশ বিবেকশূন্য মানুষদের কারাগার, আর তার জীবন একটা বিষাক্ত কারাগার।

মুগ্ধতার জ্যামিতি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫১ পিএম
মুগ্ধতার জ্যামিতি

মুগ্ধতার কোনো জ্যামিতি হয় না।
এই ঘোরে কেউ পড়লে তন্ময় লেগে থাকে প্রেম অবধি। 
একবার ভালোবাসা হয়ে গেলে মুগ্ধতাকে অনেকদিন আগের সমুদ্র ভ্রমণের মতো মনে হয়।

দীর্ঘ খরা শেষে আজকে কেমন মিহি মিহি হাওয়া বহে মনের দক্ষিণা জানালায়। 
সজলপল্লবের মুখরতা দেখে বিকেল আঁড়ি করেছে সন্ধ্যার সাথে। 
আবারও আমি থালা সাজিয়েছি জল বাতাসা দিয়ে। 
মনের একতারায় বাজছে বাউলগান।

সকালের উলঙ্গ উঠোন অপেক্ষা করছে মারুলির আধ্যাত্মিক আদরের...
অনিঃশেষ গদ্যরা বুঝে গেছে আবারও মুগ্ধতায় প্রেমের কবিতা লেখা যায়।
পাণ্ডুলিপির ভয়াবহ ভাঁজে লুকিয়ে যাক বিরহ গাঁথা। 
কেমন যেন চক্রাকারে ঘুরছে দিন,
সদ্যজাত কোন দিনের পেটে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন সূর্য। 
আসলে প্রতিটি দরজার পেছনেই সমীকরণ থাকে এই সমীকরণকে আমরা সমাধান করি ভাগ্য দিয়ে।

বসন্তের সেমিনার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫০ পিএম
বসন্তের সেমিনার

বাসস্টপ থেকে রোজ রোজ ফিরে আসি
কখনো হেঁটে আসি পূর্বজন্ম থেকে 
তারপর ট্রাফিক জ্যামের কথা লিখে রাখি নতুন জামায়।
শহরের বুকে ফেরী হয় উপকথা।

আমি জলের ওপর ভরসা রেখেছিলাম
জলের আর এক নাম কি স্তব্ধতা?
ভোকাট্টা হয়ে উড়ে গেছে আমার ঘুড়ি।
ঘুড়ি থেকে ঘোড়া- আমি ব্যস্ত নিজস্ব দৌড়ে। 

পৃথিবীর হৃদপিণ্ডে তারপরও বসন্তের সেমিনার...

একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

পড়ন্ত বিকেলে তুমি কেঁদেছিলে।
অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তোমার মনে। 
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো তফাতই খুঁজে পাচ্ছিলে না তুমি। 
কিন্তু তোমার বেঁচে থাকা দরকার। 
না, নিজের জন্য নয়। 

বিকেলটা সেই থেকে একটা জগদ্দল পাথর হয়ে বুকে চেপে আছে।

তোমার ড্রয়িংরুমে তুমি যখন ভোরে চা নিয়ে বসো
পুবের জানালা দিয়ে সকালবেলার রোদ
তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।  
তুমি স্নান করো; তোমার সৌরভের লোভে
স্বর্গ থেকে নেমে আসে কিন্নর-কিন্নরী।
তুমি শাড়ি পরো; অপ্সরীরা বৃত্ত রচনা করে 
নৃত্য করতে করতে তোমাকে দেখে।

না, তোমার পায়ে সোনার নূপুর নেই
তবু তুমি যখন নামতে থাকো, সিঁড়িগুলো
নিক্কনে শিহরিত হয়

আর তুমি যখন মাটিতে পা রাখো
তোমার বারোমেসে শিউলিগাছটা 
নিত্যদিনের অভিনব বিস্ময় নিয়ে 
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

একটা মহাযান তোমাকে তুলে নিয়ে যায়
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে। সেখানে প্রণয় আছে, রক্তপাতও আছে।
তুমি হাসো, তুমি গাও। আর লড়াই করো- যেন পরীর ফিনফিনে ডানা
বসন্তের দখিনা বাতাসে যৎসামান্য স্পন্দিত হলো। 

অশ্বমেধযজ্ঞ শেষে ঘরে ফেরো। তখন ঘরই গন্তব্য। 
তখন শরীরে ক্লান্তি, মর্মে ধুলো। 
তখন তুলোর পুতুল চালচুলোয় মেতে ওঠে।
আর তখন সংসার সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। 
রণ হুঙ্কারে মাতালের মতো টলে ওঠে সমস্ত রঙিন দেয়াল। 

তোমার নিজস্ব আলোকিত দ্বীপ
এক ফুঁৎকারে নিভে যায়। 

না, আলো অত সহজে মরে না। 
পড়ন্ত বিকেলের সেই চোখের জল বজ্রবিদ্যুৎ হয়ে ফিরে আসে

তারপর শান্তি নামে, একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর 
দিকে দিকে আলোর পুষ্প হয়ে ফুটে ওঠে তোমার সন্ততি।