
সংবাদপত্রজগতে মোস্তফা কামাল সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তাঁর ঈর্ষণীয় পদচারণা ও সাফল্য। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণা, উপন্যাস, গল্প, সায়েন্স ফিকশন, কিশোর উপন্যাস, শিশুতোষ, রঙ্গব্যঙ্গ এবং মোটিভেশনাল বই মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২০-এর অধিক।
দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা যেমন ভারতের আনন্দ পাবলিশার্স, নেশন প্রেস, সাহিত্যম, লন্ডনের অলিম্পিয়া পাবলিশার্স থেকে তাঁর বই বের হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়ে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে তাঁর রচিত সাহিত্যকর্ম প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেছেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যকে যাঁরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এবং রাখছেন- মোস্তফা কামালের নামটিও সেখানে যুক্ত হয়েছে।
তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গবেষণার দিকে যদি নজর দিই, দেখা যাবে সেখানে বৈচিত্র্যময় বিষয়ের সমাহার। তিনি যেমন বাঙালি ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়েও। পানিসম্পদের সমস্যা, পরিবেশ সমস্যা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মতো বহুবিধ বিষয় সেখানে স্থান পেয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দশের অধিক।
তাঁর উপন্যাসের দিকে যদি তাকাই, দেখা যাবে সেখানেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এবং ব্যাপক বিস্তৃত এর জমিন। প্রায় ৫০টি উপন্যাসের জনক তিনি। যেখানে রয়েছে জননীর মতো উপন্যাস। যা দ্য মাদার নামে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত হয়ে লন্ডনের অলিম্পিয়া পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মায়াবতী, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় একা মেয়েটি, নন্দিনী, তুমি কোথায়, জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রী কাহিনী, পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি, আমি কবি, মানবজীবন, চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট, পারমিতার সুখ-দুঃখ, কবি ও একজন নর্তকী, পোড়ামাটির ঘর, জোসনা ও জোনাকিরা- তালিকা খুব দীর্ঘ।
আর নামকরণের মধ্যেই তাঁর বিচিত্র বিষয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট। কবি নজরুলের জীবনী নিয়ে লিখেছেন অনবদ্য উপন্যাস দেবো খোঁপায় তারার ফুল।
বিশ্বযুদ্ধের পর গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্তকর ঘটনা কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব, এর প্রভাব ও মানবসমাজে এর অভিঘাত নিয়ে লিখেছেন ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাস। একটি অদৃশ্য উপাদান কীভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলে দিল, সমাজ ও রাষ্ট্রের কত কী তছনছ করল, আলোড়িত করল, বিপর্যস্ত করল- সেই অভিঘাতের সাহিত্যিক-উৎস হয়ে উঠেছে বিষাদ বসুধা।
খেলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে মহানবি (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও ইয়াজিদের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনা মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে বিধৃত ও স্বীকৃত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই প্রতারণামূলক যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত এখনো বিদ্যমান। মুসলিম বিশ্ব এখনো দ্বিধাবিভক্ত। এখনো ওই ঘটনা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় ব্যথিত ও কাতর হয়ে যায়।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে তিনি লিখেছেন উপন্যাস ‘কারবালা উপাখ্যান’। কঠোর পরিশ্রম করে নির্ভেজাল ইতিহাসের আলোকে মোস্তফা কামাল লিখেছেন এ উপন্যাস। সাধারণের পক্ষ্যে যা কঠিন, লেখক তা সহজ করে দিয়েছেন। অপতথ্য আর অর্ধসত্যের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন এ সময়ে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা এ উপন্যাসকে তাই সময়ের সঠিক দিশারি বলা যেতে পারে।
ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি ঈর্ষণীয় পর্যায়ে সিদ্ধহস্ত। সেগুলো পাঠ করলে একজন মোস্তফা কামালের কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও শিল্পের প্রতি একাগ্রতার পরিচয় পাওয়া যায়।
গল্পকার হিসেবেও তাঁর অবদান ও উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বালিকা বউ, নির্বাচিত প্রেমের গল্প, ভাসানীর উত্থানপর্ব, বীরাঙ্গনার লড়াই উল্লেখযোগ্য।
সায়েন্স ফিকশনও তিনি লিখে চলেছেন। উল্লেখযোগ্য ক্লোনমামা, ক্লোন নাম্বার টেন, মিরাকুলাস, বিজ্ঞানী লীরা ও জীবন্ত কংকাল, বিমান রহস্য, অপার্থিব প্রভৃতি।
ফটকুমামা তাঁর কিশোর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এ সিরিজের অনেক কিশোর উপন্যাস বের হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ফটকুমামা খুব জনপ্রিয় এক নাম।
শিশুতোষ রচনায় তাঁর পক্ষপাত ভূতের প্রতি। ভূত নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি শিশুতোষ বই বের হয়েছে। যেমন পাগলাভূত, বোকাভূত, দুষ্ট ভূতের দল। ব্যঙ্গ রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। পাগল ছাগল ও গাধাসমগ্র খুব জনপ্রিয় এক ব্যঙ্গ সিরিজ। এ সিরিজের নয়টি বই বের হয়েছে। লিখেছেন মোটিভেশনাল বই স্বপ্নবাজ। রয়েছে রহস্য উপন্যাস কাটামুণ্ডু রহস্য।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন তিনি দৈনিক সংবাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে। এরপর তিনি প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক, চিফ রিপোর্টার ও বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন।
দৈনিক কালের কণ্ঠে উপসম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এরপর ঢাকাপ্রকাশ২৪.কম-এর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
বর্তমানে তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক খবরের কাগজ-এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত জীবনে তিনি শীর্ষ দৈনিকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্পর্শকাতর ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করেছেন; যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আফগানিস্তানে যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতি, নেপালে রাজতন্ত্রবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড এবং শ্রীলঙ্কায় তামিল গেরিলাসংকট কভার করে প্রতিবেদন ও নিবন্ধ লিখেছেন। এছাড়া,দৈনিক কালের কণ্ঠে সময়ের প্রতিধ্বনি ও রঙ্গব্যঙ্গ নামে দুটি কলাম নিয়মিত লিখতেন।
একজন মোস্তফা কামাল আসলে একজন নন- তিনি বহুজন। একজন সফল সম্পাদক। একজন প্রাবন্ধিক-গবেষক। একজন ঔপন্যাসিক। একজন গল্পকার। একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক। একজন কিশোর ঔপন্যাসিক। একজন শিশুতোষ লেখক। একজন ব্যঙ্গ রচয়িতা। একজন মোটিভেশনাল লেখক। একজন কলাম লেখক। এসব বহুজনের সমষ্টিই একজন মোস্তফা কামাল।
এতসব পৃথক সত্তাকে ভারসাম্যে রেখে সমানতালে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখে চলা সহজ কথা নয়। একজন মোস্তফা কামাল সে কাজটিই করে চলেছেন। একের ভেতরে বহু এবং বহুজন মিলিয়ে এক- মোস্তফা কামাল যেন তার সঠিক উদাহরণ।
তাঁর এসব সৃষ্টিসত্তা আরও শিল্পমণ্ডিত হোক ও চলমান থাকুক। ৩০ মে তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে অশেষ শুভকামানা জানাই।