
মানিক মিয়া নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে ইতিহাস, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে এই কৃতী আপসহীন সাংবাদিকের নাম আপন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে যুক্ত হয়ে আছে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন গণমানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। জনমুক্তির প্রশ্নে নিবেদিতপ্রাণ অঙ্গীকারবদ্ধ পেশাজীবী। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। তীক্ষ্ণ, শাণিত কলাম ছিল অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়। গত শতাব্দীর তৎকালীন ’৫০ ও ’৬০-এর দশকে ইত্তেফাক সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। সেসব আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রত্যয়দীপ্ত অংশ হয়ে আছে।
মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায়। দীর্ঘ আয়ু পাননি, বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৮ বছর। ১ জুন তার মৃত্যুদিন। ইন্তেকাল করেন ১৯৬৯ সালে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ছয় দফা আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরের নেপথ্য কুশলী ছিলেন এই ক্ষণজন্মা সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। সরকারি রোষানলে কয়েক দফা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ইত্তেফাকের প্রকাশনা ও প্রেস কয়েকবার বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই ইতিহাস জানা আজকের প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য জরুরি। এটা প্রয়োজন নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্যই। নিজস্ব শেকড় উপেক্ষা করার পরিণতি মঙ্গলজনক হয় না।
তার কলাম বা উপ-সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’। ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থাকাকালেই তিনি কলাম লেখা শুরু করেন মোসাফির ছদ্মনামে। সেই কলামের নাম ছিল ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’। সাধুভাষায় ক্ষুরধার, ব্যঙ্গনিপুণ ছিল সেসব লেখা। গণসচেতনতা সৃষ্টি, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নিরন্তর লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ, প্রাণিত হওয়ার প্রশ্নে তা ছিল টনিক বা সঞ্জীবনীর মতো। সেই তির্যক লেখা কেমন ছিল? একটু নমুনা তো লাগবেই বোঝার জন্য।
পাকিস্তান আমলে বন্যা মোকাবিলায় শাসক মুসলিম লীগ সরকারের ব্যর্থতার সাহসী সমালোচনা করেছেন তিনি। লিখেছেন, “...আমেরিকার টেনেসি নদীর বাঁধ নির্মাণ করিয়া দেশের সম্পদকে পূর্ণ ব্যবহার করিয়া শুধু বন্যা রোধ করে নাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং জমির ফলন বৃদ্ধি করিয়া দেশের সম্পদকে পূর্ণ ব্যবহার করিয়া আজ এতো বড় প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হইয়াছে। সেখানে গডের দুর্নাম কেউ শোনে না। আর আমরা যারা আল্লার খাস বান্দা বলিয়া দাবি করি, তাদের এখানে দোষগুলি সব আল্লার, ভালো যেটুক, সেটুকু মুসলিম লীগের।... ব্যর্থতার বোঝা আল্লার ঘাড়ে আর ব্যর্থতার প্রতিবাদ করিলে আল্লার বান্দার উপর নামিয়া আসে ‘নিরাপত্তা আইন’ এই তো লীগের খেলা! আমি বিশ্বাস করি, পাকিস্তানে কোনো যোগ্য জনকল্যাণকর গণ-সরকার প্রতিষ্ঠিত হইলে এক বছরের মধ্যে প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলা হইতে দেশকে রক্ষা করা যাইতে পারে।”
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ ও গণসচেতনতামূলক লেখালেখির সূচনাপর্ব ছিল আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত ‘ইত্তেহাদ’-এ। আবুল মনসুর আহমদের জবানিতে জানা যাক কেমন ছিল মানিক মিয়ার বৈশিষ্ট্য- “...রাজনীতিতে ছিলেন তিনি শহীদ সোওরাওয়ার্দীর সাগরিদ। তাঁরই অনুপ্রেরণায় মানিক মিয়া সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সোহরাওয়ার্দীর দেশপ্রেম, রাজনৈতিক আদর্শবাদ, দুর্জয় সাহস, অমিত তেজ, বেপরোয়া ত্যাগ, স্বচ্ছ চিন্তা, সরল যুক্তি, কুশল প্রকাশভঙ্গি এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা সবই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।”
মৃত্যুর বেশ পরে মানিক মিয়ার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর’। এ ছাড়া ইত্তেফাকের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে ‘অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া’ নামের একটি গ্রন্থ (১৯৯৬)। এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মোসাফিরের ডায়েরি, বেশ কিছু ভাষণ এবং ৪৫টি কলাম। ষাটের দশকে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। সেখানে সভাপতির বক্তৃতায় বলেছিলেন, “সংবাদপত্র ব্যক্তিবিশেষের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হইলেও জনমতের প্রতিধ্বনি না করিলে সে পত্রিকা টিকিয়া থাকিতে পারে না, ইহা অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির ন্যায় ব্যবহার করা চলে না।” স্বাধীন গণমাধ্যমের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি বরাবর। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধশতকের নব্য স্বাধীন ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডিই সম্ভবত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপমৃত্যু অথবা মুমূর্ষু অবস্থা। এ অবস্থাকে বেশিদিন চলতে দেওয়া মানে একটি স্বাধীন জনসমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কাকে ত্বরান্বিত করা। তাই শুধু সংবাদপত্রসেবী হিসাবে নয় সংবাদপত্রের পাঠক, বিপুলায়তনে জনসমাজের প্রতিনিধি হিসাবেও এ ভয়াবহ আশঙ্কাকে প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশেরই সচেতন নাগরিকদের সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
মানিক মিয়ার সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ছিল নির্ভীকতা, সত্যনিষ্ঠা, গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধতা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তিনি পালন করে গেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। সামাজিক নিপীড়ন, শোষণ থেকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন আমৃত্যু। তিনি উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত বস্তুনিষ্ঠতা ও সৎ সাংবাদিকতার। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়, তখন সেই ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিরোধে পালন করেন অগ্রণী ও সাহসী ভূমিকা। তার দেওয়া ব্যানার হেডিং ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ ইত্তেফাকসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হয় সেই সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খানের লেখা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি এই লেখা। তিনি লিখেছেন,
“...মানিক মিয়ার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নামক কলাম যা তিনি লিখতেন ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে, তৎকালীন সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জনগণের মুখের ভাষার কাছাকাছি অননুকরণীয় গদ্য ছিল তাঁর অনুপম সৃষ্টি। তাঁর পরবর্তী সাংবাদিকদের মধ্যে কেউ তাঁর গদ্যভঙ্গি অনুসরণ করার সাহস দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ তাঁর বাচনভঙ্গি ব্যর্থ অনুকরণের চেষ্টা করলেও কেউ মোসাফিরের মত অনুপম গদ্য তৈরির চেষ্টা করেননি বা করতে পারেননি।
...কর্মক্ষেত্রে যারা মানিক মিয়াকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি যেমন হঠাৎ রেগে যেতেন, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন। এই বৈপরীত্য তাঁর অন্যান্য কর্মকাণ্ডেও দেখা গেছে। তিনি কম্যুনিজম বিরোধী ছিলেন, কম্যুনিস্টদের ‘লালমিয়া’ বলে ঠাট্টা করতেন, কিন্তু আবার তাদের (কম্যুনিস্টদের) অনেককেই মেধাবী বলে স্বীকৃতি দিয়ে ইত্তেফাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দিয়েছেন। তাঁর এক বিহারি ড্রাইভার ছিল। আমি মনে হয় মানিক মিয়ার ঘনিষ্ঠ কারো লেখায় পড়েছি, সেই বিহারি ড্রাইভার কী একটা অপরাধ করায় তিনি লাঠি নিয়ে রাস্তায় তাকে ধরতে দৌড়েছিলেন। আবার কিছুদিন পর ক্ষমা করে ড্রাইভারটিকে কাজে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
মানিক মিয়া ছিলেন দরিদ্রের প্রতি দয়াশীল ও সহানুভূতিপরায়ণ। তাঁর ইত্তেফাকে কাজ করা সবাইকে তিনি নিজের পরিবারের সদস্য বলে মনে করতেন। তিনি নিজে তৎকালীন বরিশাল জেলার অধিবাসী ছিলেন। বরিশালের মানুষদের প্রতি তাঁর একধরনের দুর্বলতার কথাও কেউ কেউ বলেন। কিন্তু তা কতটকু সত্য তা যাচাই করা যায়নি।...”