ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

মৃত্তিকার ঘ্রাণ

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম
আপডেট: ৩০ মে ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
মৃত্তিকার ঘ্রাণ
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুদ

অরুণোদয়ের আগেই উদয় পালের বাড়িতে মৃত্তিকায় তৈরি বাসনকোসন পোড়ানোর ভাটার হাপর জ্বলছে। পালবাড়ির বড় ছেলে রাতুল পাল আর ছেলের বউয়ের ঘুম ভেঙেছে সবার আগে। পালবাড়ির ভেতরে ছোট্ট একটা মন্দির। সেখানে বসে উদয় পালের স্ত্রী মিনতি পাল প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় শিঙা বাজায়। আজও শিঙা বাজাচ্ছে। বড় ছেলের বউ রেণুকা পাল জ্বলন্ত ভাটার হাপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। করাত কলের গুঁড়ো আর খড়ি যখন একসঙ্গে জ্বলে তখন ভাটার হাপরে দপ্ দপ্ শব্দ হয়। শব্দটা বুকে এসে লাগে রেণুকার। রতন পালের সঙ্গে এক বছর আগে পরিণয় সূত্রে এ বাড়িতে এসেই মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে রেণুকা। সময় সময় রতন পালের ওপর খুব রাখ হয় রেণুকার। সে ভাবে, লোকটা একেবারেই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে করতে সেও মাটির মতো সর্বংসহা হয়ে গেছে। এত কটু কথা কই, এত বকাঝকা করি তবুও উচ্চবাচ্য করে না। ঘরে আর দুই দিন পরেই লোকটা বলেছিল, শোনো রেণু, মাটি আর সুতা দুটোই নরম। মাটির সঙ্গে কাজ করতে গেলে ধৈর্য থাকতে হয়, মাটির মতো নরম হতে হয়। সুতার সঙ্গে একই আচরণ করা লাগে। একটু টান লাগলেই সুতা ছিঁড়ে যায়। কুমার আর তাঁতিদের ধৈর্যহারা হলে চলে না। রাগও মাটি করতে হয়। সেদিন থেকেই বুঝে গেছি লোকটার স্বভাব। মানুষ নরম হয়, তাই বলে এত নরম হয়! 

রতন ভাটার হাপরে খড়ি দিচ্ছে। রেণুকার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। দইয়ের মালসা, ঢাকুন, ঢোকসা, হাঁড়িপাতিল পোড়াচ্ছে রতন। বোশেখ মাসে ভাটা বন্ধ থাকে। ভাটায় আগুন জ্বলে না। তার পর বৃষ্টির সময় ঠিকমতো কাজ করা যায় না। শীতকালটা কাজের উপযোগী সময়। এ সময় এঁটেল মাটির অভাব হয় না। মাটি ক্রয় করা, তা কেটে এনে মাটির টিবি বানিয়ে জমা রাখা। এ সময় রাতদিন কাজ করতে হয়। বোশেখ আসার আগেই কলস, কয়েলদানি, খোলা-বালেন, কোলা, মাটির ব্যাংকসহ নিত্যব্যবহার্য বাসনকোসন তৈরি করে ঘরে মজুত করে রাখা লাগে। রেণুকা বাড়িতে আসার পর রতনের শনৈ শনৈ উন্নতি হচ্ছে। রেণুকা ফুলদানি, রঙিন মাছ, খেলনা পুতুল, কলমদানিসহ নানারকম মাটির জিনিস তৈরি করতে পারে। রেণুকার প্রতি পরিবারের সবাই খুশি। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। শ্বশুরবাড়িতে রেণুর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তার কথামতো সবকিছু হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি রেণুর কথার বাইরে কিছু করে না। এক বছরে সবার মন জয় করে শ্বশুরবাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে।
রতন অনেকক্ষণ পর রেণুকার দিকে নেত্রপল্লব ফেরালো। রেণুকে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রতন বলল, কিছু কবা-

-কী কব? তুমি কি কথা কও। বোবার সঙ্গে থাকতি থাকতি বোবা হয়ে যাচ্ছি।

-কাম করব না কতা কব। গত কয় মাসে কী কষ্টই না গেল। এঁটেল মাটি কিনে বাড়িতি আনা, টিবি বানানো, মাটি ছেনা, চড়কায় তোলা, জিনিসপত্র বানানো, কত্ত কাম।
-তুমি বিয়ে করিছিলে ক্যা, কও তো?

-কী সব আবোল-তাবোল কতা কচ্ছ। তুমার কোনোটার কমতি আছে?
-তোমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই মাটির সঙ্গে আছি। মাটির গন্ধ নিয়ে আছি। মাটি নিয়ে খেলছি। তুমিও তো মাটিরই, তোমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি না। তোমাকে নিয়ে খেলার সময় দিলে কই?

-বাব্বা, ভালোই তো কতা শিখিছ। সামনের বোশেখে তুমাক সময় দিব। বোশেখ মাস বিয়ের মাস। দেখতি দেখতি এক বছর হতে চলল। কী খুশি তো?
-তুমি আমাক সময় দিবা, তুমি তো কাঁচা খড়ির মতো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাও।

-আঘাত দিয়ে কথা কচ্ছ রেণু। তুমাক ভালোবাসি। জানের মিদি রাখি। তুমি আমন কতা কলি বাঁচপো না রেণু।
রেনু এগিয়ে গিয়ে রতনের ঘেমে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, 
-আরে বাপু টোকা দিয়ে দেখলাম। মন খারাপ করিছ। ইতিউতি চেয়ে রতনের কপালে আলতো করে চুমো খেল রেণু।

রেণুকার চুমো পেয়েও খুশি ছড়াল না রতনের বিষণ্ন মুখে। করুণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো রেণুকার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল রতন। ভাবনারা এসে মাথার ভিতর নাড়া দিতে লাগল। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সংসারের হাল ধরা। সেই শুরু। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর পড়া হয়নি। ছোট ভাইটি বিএ পাস করেছে। সে এখন চাকরি করে। বাইরে থাকে। ছোট বোনটা এসএসি পাস করেছে। চাকরিজীবী পাত্রের সঙ্গে বিয়েও হয়েছে। মা সুস্থ থাকলেও বাবাকে দেখতে তার সময় চলে যায়। সংসারের কাজকর্ম করে মাটির কজে সাহায্য করতে হয় রেণুকাকে। তারও কষ্টের অন্ত নেই। সত্যি তো, এক বছরে একদিনের জন্যও রেণুকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়িতে কাজের চাপ দেখে শ্বশুরও রেণুকাকে না নিয়ে ফিরে গেছে।

দুপুরের পর ভাটায় খড়ি দেওয়া বন্ধ হলে রতন উঠে স্নানের জন্য বাড়ির পাশে নিস্তরঙ্গ ডাকুয়া নদীতে চলে গেল। রেণুর খোঁচামারা কথা শুনে রতন আর কথা বলছে না। রেণুর মনটা ভাটায় পোড়ানো কলসের মতো পোড়ে। উপায়ান্তর না দেখে রেণুও রতনের পেছন পেছন নদীতে গেল। রেণু ভাবে- কাজপাগল লোকটাকে কথার ঘায়ে কষ্ট দিলাম। সাধারণত দুপুরের পরে নদীর ঘাটে স্নান করতে যায় কুমারপাড়ার লোকেরা। এখন ফাঁকা ঘাট। রতনের গা ঘেঁষে বসে রেণুকা। তার পর ভগ্নকণ্ঠে বলে, আরে আমি তো তুমার সঙ্গে ইয়ারকি করতিছিলাম। 

রেণুকার কথা না শোনার ভান করে স্রোতহীন মজা ডাকুয়ার স্বচ্ছ জলের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকল রতন।

মুহূর্তে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রতনকে মোহিত করার ক্ষমতা রেণুকা রাখে। সে কেয়া সাবান দিয়ে রতনের মুখ, মাথা ঘষতে লাগল। এর আগেও এ কাজ অনেকবার করেছে রেণুকা। বুক-পিঠে সাবান ঘষতে গিয়ে দুষ্টুমি করে ও। হেসে ফেলে রতন। রতনের প্রাণময় হাসিতে খুশি ছড়ালো রেণুকার মুখে।

রেণুকা রতনের মুখের ওপর মুখ রেখে বলল, ভাটার হাপর ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে। দেখলে তো তোমাকে ঠাণ্ডা করে ফেললাম কত অল্প সময়ে।

-আবারও উল্টাপাল্টা কতা কচ্ছ। তুমি আমার চেয়ে বেশি লেখাপড়া জানো ঠিক আছে। দশ ক্লাস পড়িছ। কিন্তু তুমার ঢাকনা দেওয়া কতা বুঝার ক্ষমতা আমার আছে।

সত্যি বলছি। আমি খারাপ অর্থে কিছু বলিনি। তুমি যা বোঝ তা ঠিক নাও হতে পারে। চলো এরপর থেকে আর কোনো 
খুনসুটি নয়।

স্নান সেরে ওরা ডাকুয়া নদীর কূলে ওঠে। রতন আগে, পেছনে রেণু হাঁটছে। রতন বলে, রেণু তুমি সামনে যাও। আমি পেছনে হাঁটি।
-কেন?

-তুমাক দেখতি দেখতি যাই। আর শোনো, আমার দাদু অনেক দিন বেঁচে ছিল। দাদু মজার মজার গল্প করত। কত রকম গল্প। দাদির গল্প বেশি বেশি করত। দাদি তাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। দাদু কইত, কাঁচা মাটির এক রকম গন্ধ, হাত-পা দিয়ে ছেনার পর মাটির এক রকম গন্ধ আর পোড়ালি হয় এক রকম গন্ধ। মাটি ছেনার পর যে গন্ধ মাটি দিয়ে বের হয় সেই গন্ধ নাকি যৈবতী মাটির গন্ধ। ভাটায় ওঠার আগে নাকি মাটির শরীরে যৌবন আসে। গন্ধ ছড়িয়ে যায়। দাদা এসব কতা কইত। এসব কতা বিশ্বাস করো রেণু।
তুমি সবকিছুই বোঝ, শুধু পালবধূর মন বুঝতে পার না। মাটির এত গন্ধের খবর রাখো, ঘরের মাটির খবর রাখো না। দাদার মতো যৈবতী মাটির গন্ধ ভালোবাসতে পারলে না। 

ওদের গা ঘেঁষে প্রতিবেশী মালতি দাদি নদীতে যাওয়ার পথে ভাঙা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, তুরা হচ্চিস পালপাড়ার রাধা-কৃঞ্চ। তোরে দেখে আমার প্রাণডা আইটাই করে, তোর দাদার কতা মনে পড়ে। বুঝলি রেণুবালা, তোর দাদাও রতনের মতো নরম মানুষ ছিল।

-তুমি কী করে বুঝলে রতন নরম মানুষ?

-এই ছেড়ি, পঞ্চাশ বছর পুরুষ মানুষ নিয়ে কাটালাম, আর নরম-গরম বুঝিনে।

এবার যাও, স্নান করগে। কথা বাড়াল না রেণু। ওরা দ্রুত হাঁটা ধরল বাঁশবাগানের সরু পথ দিয়ে।

শুক্লাদ্বাদশী। ঘুম নেই রতনের চোখে। একদিকে রেণুর কথার ঝাল, অন্যদিকে পাড়শি দাদির টিপ্পনি। রতনের মনটা মর্মপীড়ায় বিষণ্ন। বাঁশবাগনে রাত জাগা পাখির করুন আর্তনাদ। মধ্য রাত হবে হয়তো। রতন ভাবে, সকালবেলা ভাটার পোড়ানো মাল নামাতে হবে। ঘরে সাজাতে হবে। বেঁচে যাওয়া মাটির ঢিবি পলিথিন দিয়ে ঢাকতে হবে। চৈত্র মাসের আজ উনত্রিশ দিন। দুই দিন পর থেকে হাতে কাজও নেই। এখন শুধু মালপত্র বিক্রির পালা। বোশেখে ধান ঘরে উঠলি কৃষকরা ধান দিয়ে খোলা-বালেন, ঢাকুন-ঢোকসা কেনে। সারা দিন খাটুনির পর চোখের পাতা এক সময় জোড়া লাগে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রতন। রতন স্বপ্ন পরাবৃত। ও দেখে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ঘরের রোয়াকে পত্রাসনের ওপর বসে আছে। পাশে কেউ নেউ। ঘোমটায় ঢাকা তার মুখ। তার চারপাশে হাঁড়ি-কলসির ভাঙা খাপরার কুচি। খাপরার কুচি নিয়ে কী করছে মেয়েটি? রতন মেয়েটির মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। ঘোমটা সরে গেল মেয়েটির মাথা থেকে। পেছনে মুখ করে বসা মেয়েটি। কেশবতী মেয়েটির মাথার কেশগুচ্ছ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে রেণুকা বিছানায় নেই। মেয়েটি কী রেণু! বলদেব এসে ভর করে রতনের মাথায়। উদ্বেলিত সে। উজবুকের মতো ও উঠে মেয়েটিকে জাপটে ধরতে গেলে মেয়েটিই উঠে রতনকে জাপটে ধরে। উচ্ছল মেয়েটির তুলোর মতো শরীরের মধ্যে রতন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। ভয়ে রতন চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে শব্দে ঘুম ভাঙে রেণুর। রতনকে বুকের সঙ্গে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- অমন করছ কেন? কী হয়েছে তুমার? রেণুকা রতনকে এমনভাবে আদর করতে থাকে যেন সে শক্তি ফিরে পায়। গভীর ধ্বনি দ্বারা নিনাদিত রেণু। মন্দ্রিত সে। মন্দাকিনীর জলে ভিজে যায় জমিন। অতিশয় আনন্দিত সে। রসোদ্গারের স্মৃতি ভুলে যায় রতন। রতনও সাহসী সুকানি হয়ে ওঠে। এখন সে রূপোন্মাদ। উর্বর মাটিতে ফসল রোয়াতে তৎপর হয়ে ওঠে ও।

কতক্ষণ পর রেণু আলুলায়িত কেশদামে কবরী বাঁধতে বাঁধতে আদরণীয় কণ্ঠে রতনের দিকে স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে বলল, অনুভব করতে পারছ, মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে ভাটার চিমনিও ঠাণ্ডা হয়েছে গো। চলো এবার গা শীতল করা ডাকুয়ার জলে যাই। পবিত্র হয়ে ভাটার মালপত্র নামিয়ে ঘরে তুলি।

বিস্ময়াবিভূত রতন রেণুর অত্যুজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানো, স্বপ্নে দেখা ওই সুন্দরী মেয়েটি আমাকে দৈবশক্তি দান করে গেছে।

-তুমি কী বলছ এসব! ওরে বলদ, তোমার স্বপ্নে দেখা ওই নাগরী মেয়েটি তো আমিই ছিলাম।

ঘোর কাটে না রতনের। অপ্সরীর মতো দেখতে স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তার চোখের সামনে ছায়া হয়ে মন্দ্র মাতাল নাচতে থাকল।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম
বিষাদ বসুধা

গত সংখ্যার পর

শিল্পপতিরা পত্রিকা বের করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা সেটা জেনেও সেই হীনস্বার্থেই ব্যবহৃত হন। মূলত শিল্পপতিদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত তারা। শাহবাজ খানের কাছে একজন সম্পাদক আসিফ আহমেদ যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন, যেভাবে তার ন্যায়সঙ্গত কোনো যুক্তিই গ্রহণ না করে, কর্মচারী ছাঁটাইয়ের শক্ত শর্ত অনিবার্য করে তোলে, সেখানে আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিরূপায় হয়ে পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। লেখক আলোর নিচের কঠিন এক অন্ধকারকে পাঠকের সমানে উপস্থাপন করে মহৎ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। সত্যধারণ ব্যতিত কখনো কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না, সত্যকে অস্বীকার করে বা সত্যকে না দেখার ভান করে কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হলে কখনোই তা মহৎ শিল্পকর্মের মর্যাদা লাভ করে না। 

মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য শিল্পীকেও সত্যসাধক হতে হয়, বুকে হিম্মত থাকতে হয়। মোস্তফা কামাল ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাসে সত্য ধারণের হিম্মত দেখাতে পেরেছেন। কারণ তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিক। তার জন্য এই সত্য প্রকাশ আরও কঠিন। সেই কঠিনকে তিনি জয় করেছেন। আর সে কারণেই কালের যাত্রাই উপন্যাসটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। শিল্পদ্যোক্তারা নিজের পত্রিকার সংবাদকর্মীদের কর্পোরেট অফিসের কর্মচারী ব্যতীত অন্যকিছুই ভাবেন না। যে কারণে আসিফ আহমেদের মতো একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সম্পাদককেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে পারেন। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত দেখা না করে তাকে ফিরিয়েও দিতে পারেন। তাদের বিবেকে এগুলো কোনো কাজ করে না। তাদের কাছে মূলত অর্থ বিবেচ্য, সম্মানবোধ নয়। অথচ আসিফ আহমেদ অসম্ভবরকমের ধৈর্য্য নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এখানে আমরা নানাভাবে অপচয় বন্ধ করে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে আনতে পারি। সেটা করলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। দাম্ভিক শাহবাজ খানের মাথায় একটাই- চিন্তা লোক ছাঁটাই করা, কোনো টাকা দিতে পারবেন না। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বকেয়া কোটি কোটি টাকা তাও পরিশোধ করবেন না। করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও শাহবাজ খান সম্পূর্ণভাবে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনিই আবার মোহিনীর জন্মদিনে ফুল পাঠিয়েছেন। অদ্ভুত ভয়ানক ও বীভৎস চরিত্রের শাহবাজ খান রূপশ্রী বান্ধবী মোহিনীর জন্মাদিন মনে রাখেন এবং ফুল পাঠান। 

অথচ পুরো দেশে তখন করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসংকট প্রবলভাবে। নিজের পত্রিকার লোকজন তখন অনিশ্চয়তায় ভাসছেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই শ্রেণির শিল্পপতিদের কাছে সাধারণ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই স্পর্শ করে না। বরং সুযোগ পেলে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েই আনন্দ লাভ করেন। শাহবাজ খান সেই নির্মম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের শিল্পপতিরা এখনো যে সাংবাদিকদের নিছক কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, কঠিন এই সত্য উপন্যাসটিতে আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কারণে আসিফ আহমেদ আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ পদত্যাগে তার বুকের পাঁজর কতটা ভেঙেছে, কতটা ব্যথিত হয়েছেন, তা সহজেই অনুধাবন করা যায় লেখকের ভাষায়, ‘আসিফ আহমেদ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেক যত্নে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেটি তাকে আজ ছেড়ে যেতে হবে। গভীর এই মর্মবেদনা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। তিনি চলে গেলে যদি সবার চাকরি থাকত তাহলেও তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। তিনি চলে যাওয়ামাত্রই ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে। কতজন যে চাকরি হারাবে কে জানে!’ এখানে খুব সহজেই আসিফ আহমেদের হৃদয়ের যন্ত্রণাদগ্ধ রক্তক্ষরণ অনুভব করা যায়, একই সঙ্গে শাহবাজ খানের হীন-মানসিকতার স্বরূপটিও সহজেই চিনে নিতে পারি। একদিকে তিনি নিজের পত্রিকার লোকজনকে করোনায় মহাবিপদে ঠেলে দিচ্ছেন, আর একদিকে তিনি ঘুমের ভেতর ‘মোহিনী’কে ডাকছেন। মোহিনী তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একসময় মোহিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বন্ধুত্বে যতটুকু মানায় ততটুকুই থেকেছেন। মাঝে দীর্ঘ যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ নতুন করে সেই সম্পর্ক তাজা হয়ে ওঠে। তা অনেকটাই শাহবাজ খানের কারণেই। এটি আরও বেশি প্রাণ পায় শাহবাজ খান যখন জানতে পারেন আরেফিন মারা গেছেন। আগ্রহ অগ্নিতে রূপ নেয়। সেটা তার ঘুমের ভেতরও দখল নেয়। শাহবাজ খান অসংখ্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, এ নিয়ে পরিবারে স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে তার প্রকট সমস্যা। তার চারিত্রিক এই ত্রুটি নীলিমা খান মেনে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে অপমানে শাহবাজ খানকে ছেড়ে চলে যান তিনি। শাহবাজ খানের মধ্য দিয়েই লেখক সমাজের উঁচুস্তরের একশ্রেণির মানুষের দুর্গন্ধভরা কদর্য রূপ অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উন্মোচিত করেছেন।

করোনাকালীন চিকিৎসাব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটিকে আরও বড় সত্য করে প্রতিষ্ঠিত করেছে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবায় যখন পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, স্বার্থমন্ত্রী চাকরি রক্ষা করতে সাহেদ করিমের ফাঁদে পা দেন। সাহেদ করিম নিয়মিত টিভি টক শ করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ দামিনামি ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি। এসব দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে নিজের ত্রাণকর্তা ভেবে বসেন। এবং করোনা টেস্টের অনুমতির চুক্তি করেন সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে।  সাহেদ করিম এখানে পুরো দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কোনোরকম করোনা টেস্ট না করে রিপোর্ট দিতে থাকেন। মানুষ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। জনমন থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের মনে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে সাহেদ করিমের প্রতারণা। এরকম অসংখ্য প্রতারণা ও দুর্নীতি খবরে যখন টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা সয়লাব হয়ে ওঠে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। পারিবারিকভাবেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সাহেদ করিমকেও তিনি আর পাশে পান না। তিনি মন্ত্রী হয়ে সাহেদ করিমের অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভনে নিজেকে অসহায় ভেবেছেন, তার কথাতেই তার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহেদ করিমের সঙ্গে যখন প্রথম প্রথম কথা হতো, তাকে যখন টাকা ও ক্ষমতার গল্প শোনাতেন, তিনি বিস্মিত হতেন। আর বিস্ময়ের ভেতরেই নিজের মনের ভেতর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সাহেদ করিম চলে যাওয়ার পরে প্রবল ক্ষমতাধর এই মন্ত্রী সাহেদ করিমকে নিয়ে ভাবেন, একটা হাসপাতালের মালিক! তার কত টাকা! এই দেশে টাকা থাকলে কি না হয়! আমি ঘোড়ার ডিমের মন্ত্রী। আমাকে কেউ পোছেও না। উল্টো মানুষের গালমন্দ! মিডিয়ায় উল্টাপাল্টা রিপোর্ট। মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হলো! না, কিছু ভালো লাগে না।’ তার এই ভাবনার ভেতর গণমানুষের স্বার্থের কল্যাণকামী কোনো ভাবনা নেই, করোনা থেকে দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করবে সেই চিন্তা নেই, শুধু আছে নিজের হীনস্বার্থপরতার কথা, আছে সাহেদ করিমের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যর্থতার ভাবনা। এক অসম্ভব ব্যক্তিস্বার্থলোভী ঠুনকো এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তার পদত্যাগের জোরালো দাবিতেও তিনি নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছেন। মানুষের জীবন রক্ষা নয়, যে কোনো উপায়েই হোক মন্ত্রিত্ব রক্ষা করাই তার কাছে বড়। এবং তিনি সেটাই করেছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনাকালীন এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত ভেঙে পড়েছিল। নানাভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেবা পায়নি। বড় হাসাপাতালে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা হয়নি। টাকার বাণিজ্য চলেছে। রোগী না থাকলেও আইসিইউ ভাড়া করে রাখত একশ্রেণির ধনীরা, কখনো তাদের পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাদের সেবার জন্য। কোনো সভ্য দেশে এটা ভাবা যায়! অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিয়ে পরিবারের আপনজনরা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, ভর্তি করাতে পারেননি, সেবা পাননি। পথে পথেই মৃত্যু হয়েছে বহু রোগীর। এই কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভর্তি করলেও অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে, অক্সিজেন না দিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলা দেওয়া হয়েছে। 

চলবে...

 

কারাগার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৩ পিএম
কারাগার
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

কেরানির পোস্টে চাকরি করতেন কফিল উদ্দিন। অফিস থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কী তার অপরাধ, তিনি নিজেও জানতেন না। তবে চারদিকের পরিবেশ যে অশান্ত, তা টের পান। ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগের পর জেল থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে এসে প্রথম যে মুখটি তার মনে পড়ল তা হলো তার ছেলের মুখ। বিয়ের পর প্রায় পাঁচ বছর নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। একটা সন্তানের জন্য ভয়াবহ হাহাকার ছিল তার। ফলে এই পাঁচ বছর যে বা যারা যা পরামর্শ দিয়েছেন তাই মাথায় সমাদরে নিয়েছিলেন। কবিরাজি থেকে শুরু করে তাবিজ-তুম্বা, ঝাড়ফুঁক কিছুই বাদ যায়নি। অবশেষে একদিন তার স্ত্রী সুখবরটা দেন। কিন্তু বিধি যদি আপনাকে নিয়ে পরিহাস করে আপনি যা চাইবেন ঠিক সেভাবে পাবেন না। ছেলেটি জন্ম নিল প্রতিবন্ধী হয়ে। তবুও তো বাবা হতে পেরেছেন। আনন্দে আটখানা তিনি। কোলেকাঁখে নিয়ে ঘুরতেন। নিজ হাতে খাওয়াতেন। রাতে বুকের ওপর নিয়ে শুতেন। পেশাব-পায়খানা নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। প্রতি বছর প্রতিবেশীদের নিয়ে হইহুল্লোড় করে তার জন্মদিন পালন করতেন। বিষণ্ন বিকেল। ছেলের মুখ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

কানাগলির ভেতর একটা টিনশেড বাসায় পুত্রপরিজনসহ থাকেন তিনি। দুটো ছোট্ট রুম। সারাক্ষণ ঝুপঝুপ অন্ধকার। বারান্দা বলতে কিছু নেই। এ রকম গুমোট পরিবেশও তাকে অনাবিল আনন্দ এনে দেয় যখন তিনি ছেলের সঙ্গে হাতিঘোড়া নিয়ে খেলায় মত্ত থাকেন। সেই খেলনাগুলো প্রায় নষ্ট ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। ছেলের কথা ভেবে ফুটপাত থেকে একটা নতুন হাতি কিনলেন। হাতি সাধারণত কালো রঙের হয়; কিন্তু এই হাতিটা বেশ রংচঙা। ঘোড়া-ট্রেনও কিনতে মন চাইছিল, কিন্তু তার পকেট তাকে সাবধান করে। অগত্যা অপূর্ণতা নিয়েই বাসায় ফিরলেন। দরজা ভেজানো ছিল। বাইরে থেকে বউয়ের নাম ধরে গলা ফাটালেন; কিন্তু সাড়া মিলছিল না। কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হলো। আস্তে করে দরজা ঠেললেন। জংধরা টিনের দরজা। ক্যাঁ-কোঁ শব্দ করে হাট হয়ে গেল। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে মুখটা শুকিয়ে গেল তার। খোঁজাখুঁজি করলেন। ছেলেটাকে খাটের নিচে পেশাব-পায়খানার ওপর নিথর পড়ে থাকতে দেখে তার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে বেরিয়ে এল চিৎকার। বউয়ের নাম ধরে আবারও ডাকলেন। বউ থাকলে তো! ছেলেকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করলেন। তার কপালে-শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলেন বেঁচে আছে তো! প্রাণের স্পর্শ পেলেন, কিন্তু তাপমাত্রা অনেক। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। কোলে উঠিয়েই ত্বরিত মহল্লার ডাক্তারখানায় গেলেন। 

মরতে মরতে বেঁচে গেছে! আর কয়েক ঘণ্টা দেরি করলেই শেষ! আপনারা মানুষ? এরকম ধমক ও ছেলের পরিষেবা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। প্রতিবেশীর কাছে শুনলেন, দুই দিন আগে থেকে মহিলা লাপাত্তা। একজন তরুণী ইতস্তত বোধ করলেও বলতে বাধ্য হলো, ভাবিকে এক যুবকের সঙ্গে রিকশায় দেখেছে সে। মাথাটা চক্কর দিল তার। এ জন্য দায়ী তিনি নিজে। কারাগারে যাওয়ার কয়েক মাস আগে বউকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলেন। মোবাইল পাওয়ার পর বউ সন্তান তো বটেই, খাওয়া-নাওয়া পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। টিকটক, ইউটিউব, চ্যাটিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত সে। বউকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন তিনি; তাই এসব বিষয় আমলে নেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। চোখে ঘোর অমানিশা। কী করবেন, দিশা পাচ্ছিলেন না। কারণ, এ প্রতিবন্ধী ছেলেকে কে দেখভাল করবে? কে তার দায়িত্ব নেবে? জেলে যাওয়ার কারণে চাকরিটা আছে কি না, সে চিন্তাও তার মাথায় কুটকুট করে কামড়াল। পরদিন, ছেলেকে কাঁধে নিয়ে অফিসে গেলেন। তার বস একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাপোর্টার। ভিন্নমতালম্বীদের সহ্য করতে পারেন না। তাকে বাইরে বসিয়ে রেখে বকেয়া পাওনা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শীতল মেজাজে ‘সরি’ বলেই তার পর্ব শেষ করলেন।

আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। একদিকে সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধ, আরেকদিকে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। একটা ছোটখাটো চাকরির জন্য অফিসের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। কতিপয় নোংরা মানুষের দুয়োধ্বনি ছাড়া কপালে কিছুই জুটল না। বেকারত্বের অভিশাপ যখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, ঠিক সে সময় তার এক বন্ধু এগিয়ে এলেন। তিনি স্টকমার্কেটের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। তবে ভাগ্যবান; যে স্টকেই বিনিয়োগ করেছেন, সেখান থেকেই প্রফিট ঘরে তুলেছেন। চাকরিবাকরি না করেও তার সংসার দিব্যি চলে। তার পরামর্শে যা সঞ্চয় ছিল, তা স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ করলেন। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কয়েকদিন হাউসে ঘুরলেন। শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকল তার স্টকের দাম। বাড়তে বাড়তে দেড় মাসের মধ্যে দ্বিগুণ। তার বন্ধু তাকে বেচার পরামর্শ দিলেন; কিন্তু তিনি কর্ণপাত করলেন না। ভয়ংকর লোভে পড়লেন। তার স্বপ্নের শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটাল। যে ছেলেকে ভালোমতো সময় দিতে পারেন না, মনের খুশিতে তাকে আদরযত্নে ভরিয়ে দিলেন। ছেলের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন টাকাটা তিন গুণ হলেই ইন্ডিয়ায় যাবেন। ভালো ডাক্তারের অধীনে তার চিকিৎসা করাবেন। এমনকি তার দেখভালের জন্য বেবিসিটার পর্যন্ত রাখবেন। তার কথার অর্থ ছেলে বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে তার গালে দুষ্টামি করে চিমটি কাটেন, মাথা ধরে ঝাঁকুনি দেন। 

কিন্তু তিনি যে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খাবেন, তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না; কারণ, স্টকমার্কেটে তার অভিজ্ঞতা জলে না নেমেই গভীরতা মাপার মতো। তার সুহৃদ বন্ধু আবারও তাকে বিক্রির পরামর্শ দিলে এবার তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন। ভাবলেন, তার বন্ধু তার ভালো চায় না। চাইলে এরকম জোরজবরদস্তি করে? ইচ্ছে করেই বন্ধুকে এড়িয়ে চললেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই মার্কেটে ধস। ব্যাপক দরপতন। যা বিনিয়োগ করেছিলেন, তা তলানিতে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব। স্বপ্ন চুরমার। মানসিক টানাপোড়েনে ধূমপান বাড়িয়ে দিলেন। একের পর এক সস্তা সিগ্রেট। সিগ্রেট কেনার পয়সা না পেলে যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। অ্যাশট্রে-তে জমানো ছাইভষ্ম হাতের তালুতে ঢেলে খেয়ে ফেলতেন। তাতেও স্বস্তি না মিললে রাস্তায় নামতেন। আটআনা, একটাকার মুদ্রা যা-ই কুড়িয়ে পেতেন, তা দিয়ে বিড়ি কিনতেন। কিন্তু ছেলের মুখে কী তুলে দেবেন? বিড়ি? নাহ! খাবার কিনতে পয়সা লাগে। যে বন্ধুটিকে সবচে’ কাছের ভাবতেন, তার কাছেও যেতে পারছেন না, কারণ, তিনি তার কথা শোনেননি। ধারদেনা করে কিছুদিন চললেন, তার পর আটকে গেলেন; একেবারে কাদায় গরুর গাড়ি আটকে যাওয়ার মতো। চোখে সরষে ফুল। অন্ধকার খাদে তার পৃথিবী যেন কঠিন গদ্যময়। চোখের নিচে কালি, গণ্ডদেশে কালশিটে। উসকোখুসকো চুল ক্রমশ জটার দিকে ধাবিত। তোবড়ানো মুখে চাপদাড়ি। সময়ের আগেই বয়সের ভারে বেশ ন্যুব্জ। হঠাৎ এতটাই পরিবর্তন, তাকে দেখলে পরিচিতরাও ভিড়মি খান। বিড়বিড় করেন, এই মানুষটার হলো কী!

বাড়িভাড়া দিতে না পারায় মালিক ঘনঘন দরজার কড়া নাড়েন। এই সামনের মাসে দেব, এক জায়গায় টাকা আটকে আছে, এসব কাকুতি-মিনতিতেও বাড়িঅলার মন গলে না। বাড়িছাড়ার তাগাদা দেন। এদিকে পাওনাদাররাও কম কীসে! হুমকির পর হুমকি। ফলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হোন। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার এবং তাদের বসবাস যেখানে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। পালিয়ে বেড়ানোই উত্তম। ডাস্টবিন থেকে খাদ্য-অখাদ্য কুড়িয়ে খান। ছেলেকেও খাওয়ান। প্রায়শ দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররা যে কসাই, বিনেপয়সায় কে তাদের চিকিৎসা করবে! পরিস্থিতি ভয়ানক নাজুক। কখনো খিদের কামড় সহ্য করতে না পেরে আমজনতার কাছে হাত পাতেন; কিন্তু তাদের করুণালাভে ব্যর্থ হোন। মাথা চুলকান। বুঝতে পারেন মাথাটা অকামের জঞ্জাল হয়ে উঠেছে। ভালো বুদ্ধি কাজ করে না। উপায়ান্তর না পেয়ে ছেলেকে রেললাইনের ধারে ফুটপাতের ওপর শুইয়ে দেন। তার পর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন: ভাই, কিছু সাহায্য করেন। লাশটাকে দ্যাশে নিতে চাই। কিন্তু সেখানেও বাগড়া। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে তাকে উঠিয়ে দেয়। জীবনযুদ্ধে এতটাই পর্যুদস্ত, এতটাই অসহায় রাগে-ক্ষোভে চরম বিরক্তিতে ছেলেকে নর্দমায় ফেলে দেন। পেছন ফিরে আর তাকান না। চলে আসেন খানিকদূর। হোক না প্রতিবন্ধী; হাজার হলেও ঔরসজাত। বুকটা ধড়ফড় করে, হৃৎপিণ্ড মোচড় দেয়, পা টলমল করে। পিতৃত্বের অমোঘ টানে আবার ফিরে আসেন নর্দমার কাছে। দেখেন, ছেলেটা মরেনি। দেহটা কাদার মধ্যে ডুবে গেলেও মাথাটা ওপরে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। যেন কারও দিকে তাকিয়েছিল সে। ছেলের আকুতিভরা নিষ্পাপ মুখ দেখার পর তার মৃতপ্রায় চোখদুটো ছলছল করে উঠল। এক পা-দু পা করে নিচে নেমে ছেলেকে টেনে তুললেন। তার পর বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বুক ফেটে কান্না আসছিল তার, কিন্তু কেঁদে কী লাভ? কান্না পাথরচাপা দিয়ে ছেলেকে কাঁধে নিলেন। 

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন শহরের একপ্রান্তে। কোথায় তার গন্তব্য, জানেন না তিনি। হৃদয়হীন সমাজে আঘাত পেতে পেতে তার মস্তিষ্ক পচে গেছে, গলে গেছে, তবুও সেখান থেকে বোধের চারা গজাল; আচ্ছা, ছেলেটাকে যদি তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! পরক্ষণে ভাবলেন, যে মা তার বিকলাঙ্গ সন্তানের চিন্তা না করে স্বীয় সুখের আশায় পরপুরুষের সঙ্গে গৃহত্যাগ করতে পারে, তার হৃদয় কতটা দয়াদ্র! এবার স্ত্রীকে না, নিজেকেই দোষারোপ করে তার ভাবনাকে গুরুত্ব দিলেন। শুনেছেন, এদিকেই তার প্রাক্তন স্ত্রী কোনো না কোনো বাড়িতে তার স্বামীর সঙ্গে থাকে। কীভাবে তাকে খুঁজে পাবেন, এলোমেলো ভাবনাগুলো হঠাৎ শিস দিল। তার প্রাক্তন স্ত্রীর এক বান্ধবী অনেক আগেই তার বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিল। সে মোতাবেক বাড়িটা হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। তখন প্রায় সন্ধ্যে। কাকতালীয়ভাবে সেই বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রকাণ্ড লোহার গেট। দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দরজার ওপর উপর্যুপরি ধাক্কাতে থাকেন। ধাক্কানোর শব্দ পৌঁছে যায় অন্দরমহল অবধি। এক সময় দরজা খোলেন এক ভদ্রমহিলা। কিন্তু তিনি তাদের দেখামাত্র বিপদ আঁচ করে দড়াম করে দরজা বন্ধ করেন তাদের মুখের ওপর। অপমান কী জিনিস, তা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। ভগ্ন হৃদয়ে সরে এসে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু ছেলেটা খিদের কারণে কুকুরের বাচ্চার মতো কুঁইকুঁই আওয়াজ তুলছিল। তার পেটও রাক্ষসে আচরণ করছিল। ছেলেকে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে হোটেলে খাবার চুরি করতে গেলেন। ধরা খেয়ে বেধড়ক পিটুনি। হোটেলবয়রা তাকে পুলিশে দিল। পুলিশের হাত-পা ধরেও যখন থানা থেকে ছাড়া পাচ্ছিলেন না, তখন মলমূত্র ত্যাগ করে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়ালেন। বমি করতে করতে পুলিশ অবশেষে গরাদের দরজা খুলে দিল। 

ততক্ষণে একরাত একদিন পেরিয়ে গেছে। ছেলের কাছে পৌঁছে দেখলেন তার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। ছেলেকে একবার স্পর্শও করলেন না। ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলল। সোজা চলে এলেন সেই হলুদ বাড়িতে। প্রাচীর টপকালেন। শ্বাসরোধ করে হত্যা করলেন পরস্ত্রী হরণকারীকে। তার প্রাক্তন তখন পুলিশকে মোবাইল করছিল, তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তার মুখে জোর করে মোবাইল ঢুকিয়ে একপ্রান্তে সজোরে আঘাত করলেন; সঙ্গে সঙ্গে গলায় আটকে গেল মোবাইলটা। তার পর তিনি নিজেই পুলিশে ধরা দিলেন। 

জেলগেটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো এ দেশ বিবেকশূন্য মানুষদের কারাগার, আর তার জীবন একটা বিষাক্ত কারাগার।

মুগ্ধতার জ্যামিতি

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫১ পিএম
মুগ্ধতার জ্যামিতি

মুগ্ধতার কোনো জ্যামিতি হয় না।
এই ঘোরে কেউ পড়লে তন্ময় লেগে থাকে প্রেম অবধি। 
একবার ভালোবাসা হয়ে গেলে মুগ্ধতাকে অনেকদিন আগের সমুদ্র ভ্রমণের মতো মনে হয়।

দীর্ঘ খরা শেষে আজকে কেমন মিহি মিহি হাওয়া বহে মনের দক্ষিণা জানালায়। 
সজলপল্লবের মুখরতা দেখে বিকেল আঁড়ি করেছে সন্ধ্যার সাথে। 
আবারও আমি থালা সাজিয়েছি জল বাতাসা দিয়ে। 
মনের একতারায় বাজছে বাউলগান।

সকালের উলঙ্গ উঠোন অপেক্ষা করছে মারুলির আধ্যাত্মিক আদরের...
অনিঃশেষ গদ্যরা বুঝে গেছে আবারও মুগ্ধতায় প্রেমের কবিতা লেখা যায়।
পাণ্ডুলিপির ভয়াবহ ভাঁজে লুকিয়ে যাক বিরহ গাঁথা। 
কেমন যেন চক্রাকারে ঘুরছে দিন,
সদ্যজাত কোন দিনের পেটে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন সূর্য। 
আসলে প্রতিটি দরজার পেছনেই সমীকরণ থাকে এই সমীকরণকে আমরা সমাধান করি ভাগ্য দিয়ে।

বসন্তের সেমিনার

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৫০ পিএম
বসন্তের সেমিনার

বাসস্টপ থেকে রোজ রোজ ফিরে আসি
কখনো হেঁটে আসি পূর্বজন্ম থেকে 
তারপর ট্রাফিক জ্যামের কথা লিখে রাখি নতুন জামায়।
শহরের বুকে ফেরী হয় উপকথা।

আমি জলের ওপর ভরসা রেখেছিলাম
জলের আর এক নাম কি স্তব্ধতা?
ভোকাট্টা হয়ে উড়ে গেছে আমার ঘুড়ি।
ঘুড়ি থেকে ঘোড়া- আমি ব্যস্ত নিজস্ব দৌড়ে। 

পৃথিবীর হৃদপিণ্ডে তারপরও বসন্তের সেমিনার...

একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর

পড়ন্ত বিকেলে তুমি কেঁদেছিলে।
অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তোমার মনে। 
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো তফাতই খুঁজে পাচ্ছিলে না তুমি। 
কিন্তু তোমার বেঁচে থাকা দরকার। 
না, নিজের জন্য নয়। 

বিকেলটা সেই থেকে একটা জগদ্দল পাথর হয়ে বুকে চেপে আছে।

তোমার ড্রয়িংরুমে তুমি যখন ভোরে চা নিয়ে বসো
পুবের জানালা দিয়ে সকালবেলার রোদ
তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।  
তুমি স্নান করো; তোমার সৌরভের লোভে
স্বর্গ থেকে নেমে আসে কিন্নর-কিন্নরী।
তুমি শাড়ি পরো; অপ্সরীরা বৃত্ত রচনা করে 
নৃত্য করতে করতে তোমাকে দেখে।

না, তোমার পায়ে সোনার নূপুর নেই
তবু তুমি যখন নামতে থাকো, সিঁড়িগুলো
নিক্কনে শিহরিত হয়

আর তুমি যখন মাটিতে পা রাখো
তোমার বারোমেসে শিউলিগাছটা 
নিত্যদিনের অভিনব বিস্ময় নিয়ে 
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

একটা মহাযান তোমাকে তুলে নিয়ে যায়
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে। সেখানে প্রণয় আছে, রক্তপাতও আছে।
তুমি হাসো, তুমি গাও। আর লড়াই করো- যেন পরীর ফিনফিনে ডানা
বসন্তের দখিনা বাতাসে যৎসামান্য স্পন্দিত হলো। 

অশ্বমেধযজ্ঞ শেষে ঘরে ফেরো। তখন ঘরই গন্তব্য। 
তখন শরীরে ক্লান্তি, মর্মে ধুলো। 
তখন তুলোর পুতুল চালচুলোয় মেতে ওঠে।
আর তখন সংসার সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। 
রণ হুঙ্কারে মাতালের মতো টলে ওঠে সমস্ত রঙিন দেয়াল। 

তোমার নিজস্ব আলোকিত দ্বীপ
এক ফুঁৎকারে নিভে যায়। 

না, আলো অত সহজে মরে না। 
পড়ন্ত বিকেলের সেই চোখের জল বজ্রবিদ্যুৎ হয়ে ফিরে আসে

তারপর শান্তি নামে, একদিন ঠিক ঠিক শান্তি নামে তারপর 
দিকে দিকে আলোর পুষ্প হয়ে ফুটে ওঠে তোমার সন্ততি।