
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-মা মাটি মাতৃভূমির সমার্থক। যে মা হাসতে হাসতে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রিয় পুত্রকে উৎসর্গ করতে পারেন- তাঁর তুলনা তিনি নিজে। এমন মা ইতিহাসে বিরল। আমি আমার নিজের মায়ের কথা জানি, আমি যুদ্ধে যাব একথা শুনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ তিনি নিজের সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে নিজেও সেই যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ছিলেন। যুদ্ধের সময় তার প্রতিদিনের ডায়েরি পড়ে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য গাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রেখে তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে সেই অস্ত্র পৌছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এটা কতবড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তবু তিনি বিন্দুমাত্র জীবনের পরোয়া করেনননি। স্বাধীনতার জন্য তিনি স্বামী সন্তান হারিয়েছেন তারপরও তিনি থেমে থাকেননি।
স্বাধীনতার পর শহীদ রুমির সহযোদ্ধারা তাকে মায়ের আসনে অধিষ্ঠিত করে। সবাই তাকে মা বলে সম্বোধন করে। সেই থেকে তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধার মা। শহীদ জননী বলে তিনি অভিষিক্ত হন।
জাহানারা ইমাম মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। সেখান থেকে বি এ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। বিখ্যাত স্থপতি শরিফুল আলম ইমামের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দেশ বিভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে। ১৯৬১ সালে এমএ পড়াকালীন ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ছয় মাস আমেরিকা কাটান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এম এ পাস করেন ঢাকা বিশ^ব্যিালয় থেকে।
শিক্ষক হিসেবে কর্মময় জীবনের প্রথম কাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা [১৯৬২-১৯৬৬], বুলবুল একাডেমি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা [১৯৬২-১৯৬৬] এবং ঢাকা টিচার ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক [১৯৬৬-১৯৬৮] হিসেবে তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত হয়।
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক বিশৃংখলার সুযোগ নিয়ে এদেশে রাজাকাররা নতুন করে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ষড়যন্ত শুরু করলে তিনি আবার নতুন মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। গড়ে তোলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ‘ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি’। তারপর ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে গঠিত হয় ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি।
গৌরবময় স্বাধীনতা দিবসকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিচারের জন্য। এর আগ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত কোন আন্দোলন ছিল না। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সেই গণআদালত থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
স্বাধীনতার পর তার লেখালিখি জীবনের শুরু। ১৯৮৬ সালে তার বিখ্যাত যুদ্ধকালীন ডায়েরি ‘একাত্তুরের দিনগুলি’ ধারাবাহিক ভাবে সাপ্তাহিক ‘সন্ধানী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে তখনই সাধারণ পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় লেখাটি। অনেকে তখনই লেখাটিকে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। ধারাবাহিক লেখাটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকের বিপুল চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। এই লেখাটি দিয়েই সাহিত্যাঙ্গণে তিনি ব্যাপক আলোচনায় চলে আসেন। অনেক বোদ্ধা সমালোচক তাঁর ‘একাত্তুরের দিনগুলি’কে স্বাধীনতার জীবন্ত ইতিহাস বলে উল্লেখ করেছেন।
তার গ্রন্থসমূহ- শিশুসাহিত্য- গজকচ্ছপ [১৯৬৭], সাতটি তারা ঝিকিমিকি [১৯৭০], বিদায় দেমা ঘুরে আসি [১৯৮৯]। অনুবাদগ্রন্থ- জাগ্রত ধরিত্রী [১৯৬৮], তেপান্তরের ছোট্ট শহর [১৯৭১] ও নদীর তীরে ফুলের মেলা [১৯৬৬]। মুক্তিযুদ্ধ- বীরশ্রেষ্ঠ [১৯৮৫], ও একাত্তুরের দিনগুলি [১৯৮৬]। অন্যান্য গ্রন্থ- অন্যজীবন [১৯৮৫], জীবন মৃত্যু [১৯৮৮], শেক্সপিয়রের ট্রাজেডি [১৯৮৯], নিঃসঙ্গ পাইন [১৯৯০], নাটকের অবসান [১৯৯০], বুকের ভেতর আগুন [১৯৯০], দুই মেরু [১৯৯০], প্রবাসের দিন গুলি [১৯৯২], ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস [১৯৯১] ও বাংলা উচ্চারণ অভিধান [যৌধভাবে সম্পাদিত]।
১৯৮১ সালে তার শরীরে মরণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ে। এতবড় ঘাতক ব্যাধি ক্যানসার নিয়েও তিনি পাহাড়ের মতো অবিচল ছিলেন। মরণব্যধি ক্যানসার তাকে কাবু করতে পারেনি। তার শরীরে বাসা বাঁধা ক্যানসার নিয়ে তিনি লিখেছেন অসাধারণ গ্রন্থ ‘ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস’।
সেখানে তিনি শারীরিক কষ্ট তুলে ধরে তার মনোবলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা অনেক মানুষের কথা জানি যাদের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ার পর তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে জাহানারা ইমাম ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার দৃঢ় মনোবলের কারণে ক্যানসারকে তিনি জয় করে সামাজিক আন্দোলন এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও নিয়েজিত থেকেছেন।
তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ হলো লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারে ‘লিটল হাউস’। তিনি অনেকগুলো পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশ লেখক সমিতি পুরস্কার- ১৯৮৮, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ১৯৯১, স্বাধীনতা পুরস্কার- ১৯৯৭ ও রোকেয়া পদক- ১৯৯৮।
অনেক জঞ্জালের মধ্যে মাঝে মাঝে আমাদের আকাশের দুএকটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই নক্ষত্র চিনতে আমরা ভুল করি। আমরা ভুল মানুষকে নিয়ে মেতে থাকি। আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে চিনতে ভুল করেছি। না হলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা মাথায় নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে কেন? হে শ্রদ্ধাভাজন শহীদ জননী, তোমার অভাগা সন্তানদের তুমি ক্ষমা করো। আমরা তোমার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি।