
ঊনবিংশ পর্ব
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও বেশ সতর্ক। এ সতর্কতার অংশ হিসেবে সরকার দুই দেশের সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। বিজিবিকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে, যাতে সীমান্ত দিয়ে কেউ আসা-যাওয়া করতে না পারে। কিন্তু এ নির্দেশনা কেউ মানছে না। আসলে দুই দেশের দীর্ঘ চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেওয়া উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের জন্যই কঠিন। সেই সুযোগটাকেই মানুষ কাজে লাগাচ্ছে। তারা সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ছে। কোথাও কোথাও দুই পক্ষকে ঘুষ দিয়ে মানুষ দেশে ঢুকছে বলে অভিযোগ আছে। এরাই নিয়ে আসছে ডেলটা ভেরিয়েন্ট। আর এরাই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়েছে। খুলনা, রাজশাহী অঞ্চলে মৃত ও আক্রান্তের হার ভারতের মতোই বাড়ছে। এ খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে সরকার মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা প্রচার-প্রচারণা করছে। তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
মোহিনী টেলিভিশনের খবর দেখার জন্য রিমোর্ট হাতে নেন। টিভিতে নিউজ চ্যানেলগুলো সার্চ করতে থাকেন। কোন চ্যানেলে কী খবর দিচ্ছে তা দেখেন। একাত্তর টিভির সর্বশেষ খবরে বলা হয়, সারা দেশে ডেলটা ভেরিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সরকার কঠোর লকডাউন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
সময় টিভি প্রচার করছে বিশেষ বুলেটিন। তারাও বলছে, ডেলটা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় সরকার কঠোর লকডাউন দেওয়ার কথা ভাবছে। ইন্ডিপেন্ডেন্টও একই
ধরনের খবর দিচ্ছে।
মোহিনী এবার টিভি বন্ধ করে বিছানার ওপর কিছুক্ষণ বসে রইলেন। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। নানারকম দুশ্চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছে। এতদিন মোহিনী খুব বেশি চিন্তা করেনি। আজ কেন জানি মাথায় চিন্তা ঢুকেছে। তিনি বিছানা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করেছেন। মনে মনে তিনি বললেন, আবার যদি লকডাউনের ঘোষণা দেয় তাহলে আবার বিরাট ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়! না, কিছুই ভালো লাগছে না।
মোহিনী মোবাইল হাতে নিয়ে অফিসের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললেন। কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে আবার বিছানায় বসলেন। মোবাইল হাতে নিয়ে নিজের ফেসবুকে চোখ বোলাতে শুরু করলেন। প্রতিদিন দেখা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড বোঝার জন্য তিনি মাঝে-মধ্যে ফেসবুকে ঢোকেন। হঠাৎ শাহবাজ খানের সঙ্গে একটি মেয়ের অন্তরঙ্গ ছবি দেখে চমকে ওঠেন। মেয়েটির নাম রুবিনা। সে ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রী। মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে শাহবাজ খানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে।
মোহিনী মনে মনে ভাবেন, এসব আমি কী দেখছি! এইটুকু একটা মেয়ের সঙ্গে এমন কাণ্ড শাহবাজ করতে পারল! ছি! ছি ছি! আমি তো ভাবতেই পারছি না; এটা কী করে সম্ভব! মেয়েটি তার কেপ্ট ছিল! তাকে সে লাখ টাকার বাসায় রাখত! হায় খোদা! আমি কোন দেশে আছি! এই ছেলে আমার বন্ধু! না না! হতে পারে না। কিছুতেই না।
মোহিনী বিছানা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারী করেন। ঘরের এ মাথা ও মাথা হাঁটেন। তার কিছুই ভালো লাগছে না। বড় বেশি অস্থির লাগছে। শাহবাজ খানের ওপর তার ঘৃণার পাহাড় জমতে শুরু করে। তিনি মনে মনে বলেন, ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নয়; আর কোনো যোগাযোগ নয়! ও যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে কোনোরকম সুযোগ দেওয়া হবে না। আমার অফিসে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এ রকম চরিত্রের একটা ছেলে আমার বন্ধু ছিল! ভাবতেই অবাক লাগছে। আসলেই মানুষ চেনা বড় কঠিন! কার ভেতরে কী আছে তা বোঝা মুশকিল।
মোহিনী দেরি না করে তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারিকে
ফোন দিয়ে বললেন, শাহনাজ শোন, শাহবাজ খানের কথা মনে আছে?
জি ম্যাম।
সে যেন আর কখনো আমার অফিসে ঢুকতে না পারে। অফিসের সিকিউরিটিদের এখনই বলে রাখ। বলবে, সে আমাদের অফিসে নিষিদ্ধ! এটা আমার নির্দেশ।
শাহনাজ কথা না বাড়িয়ে শুধু বলল, জি ম্যাম।
মোহিনীর সঙ্গে কথা বলা শেষ করেই শাহনাজ অফিসের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান মেজর (অব.) খোরশেদকে ফোন দিয়ে বলল, আপনাকে একটা অতি জরুরি নির্দেশনা দিচ্ছি। এটা আমার ব্যক্তিগত কোনো নির্দেশনা নয়। ম্যামের নির্দেশনা।
কী বলেন তো!
আপনি এখনই আপনার সিকিউরিটির লোকদের বলে দেন, শাহবাজ খান আমাদের অফিসে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সে যেন কোনোভাবেই আমাদের অফিসে ঢুকতে না পারে!
তাই! আপনি ঠিক বলছেন তো?
অবশ্যই। ম্যাম এই মাত্র আমাকে ফোনে জানালেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
শাহনাজ জানে, মোহিনীর খুব কাছের বন্ধু শাহবাজ খান। কিছুদিন আগেও তারা অফিসে বসে একসঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করেছেন। দুপুরের খাবার খেয়েছেন। হোটেল ওয়েস্টিন থেকে শাহবাজ খানের পছন্দের খাবার আনা হয়েছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটল?
শাহনাজ মনে মনে ভাবে, আমাদের অফিসে শাহবাজ খানকে নিষিদ্ধ করার কারণ কী তার নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা! এ ছাড়া আর কী! তার মানে ম্যাম ফেসবুক দেখেন! নাকি এসব খবর পত্রিকায় দিয়েছে!
শাহনাজ পত্রিকা পড়ে না। সে দুনিয়াদারির কোনো খোঁজ রাখে না। ফেসবুকে যে খবর পায় সেটাই তার কাছে অনেক বড়। সে মনে করে, অনেক বড় ঘটনাও পত্রিকাওয়ালারা ফাঁস করে না। গোপন রাখে। কিন্তু ফেসবুক তা ফাঁস করে দেয়। তার মানে সাংবাদিকদের কাজ সাংবাদিকরা করছেন না। তাই সাংবাদিকতার কাজটা দেশের মানুষ করছেন! শাহবাজ খানের খবরটি দেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। অথচ পত্রিকায় খবরটি নাকি প্রকাশই করেনি! ফেসবুকে কতকিছু বের হচ্ছে। শাহনাজ অনেক আগেই অনেককিছু জেনেছে। শাহবাজ খানকে নিয়ে ফেসবুকে যে মুখরোচক অনেক গল্প বের হয়েছে তা সে পড়েছে। শাহবাজ খানের সঙ্গে একটি মেয়ের অনেক অন্তরঙ্গ ছবি দেখেছে। ফেসবুক তার প্রিয় জায়গা। সুযোগ পেলেই সে ফেসবুকে সময় কাটায়। নানা মুখরোচক খবর তার কাছে পাওয়া যায়। তার যদি চাকরি না থাকত তাহলে হয়তো সে পেশা হিসেবে নিজের পরিচয় দিত ফেসবুক অ্যাক্টিভিটস।
শাহনাজের এ দুর্বলতার দিক সম্পর্কে মোহিনী খুব ভালো করেই জানেন। তিনি যদি শাহবাজ খানের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতেন তাহলেই সে ইতিহাস বলা শুরু করত। দশ মিনিট সময় ধরে সে ইতিহাস বলত। সেটা এড়ানোর জন্যই মোহিনী সংক্ষেপে নিজের কথা বলে ফোন ছেড়েছেন। ফোন ছাড়ার পর শাহনাজের চৈতন্য হলো। বিস্ময়ের সঙ্গে সে বলল, আরে! ম্যাম আমার কাছে কিছুই জানতে চাইলেন না! ম্যাম কি সব জানেন!
মোহিনীর ঘরে ঢুকে আনোয়ারা বেগম বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে মোহিনী! কোনো সমস্যা?
না মা। তেমন কিছু না।
তোকে কতক্ষণ ধরে ডাকলাম; কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না!
তাই! তুমি ডাকছিলে? আমি শুনতে পাইনি। আসলে আমার মনটা ভালো নেই মা!
হ্যাঁ, দুনিয়াদারিতে যেসব কাণ্ড শুরু হয়েছে! তাতে মন ভালো রাখার উপায় আছে?
ঠিক বলেছ। কী সব উদ্ভট কাণ্ডকীর্তি দেখছি! মাথা ঠিক রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ রে মা; নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?
নতুন মানে, সব সময়ই তো কিছু না কিছু ঘটছে।
চলবে...