ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১) জন্ম সিরাজগঞ্জে ১৮৮০ সালে। কবি ঔপন্যাসিক ও রাজনীতিবিদ।
গ্রামের পাঠশালা স্থানীয় জ্ঞানদায়িনী মধ্য ইংরেজি স্কুল এবং সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হলেও নিজের চেষ্টায় সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মনীতি, সমাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কংগ্রেসে যোগদান এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু এ বিতর্কে বাংলাভাষার পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে (১৯১৯-১৯২৩) সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ দল গঠিত হলে তাতে যোগদান করেন। অনলস্রাবী সাহিত্যসৃষ্টি ও জ্বালাময়ী বক্তৃতাদানের জন্য কয়েকবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মূলত মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী লেখক। বাঙালি মুসলমানদের রচনায় ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর প্রথম কাব্য ‘অনল-প্রবাহ’ নির্জীব জাতির কানে ঘুম ভাঙানিয়া মন্ত্র উচ্চারণ করেন।
কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর উদাত্ত আহ্বানে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সাড়া জেগেছে। ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি মুসলমানের কানে তিনি শুনিয়েছেন অভয় জীবন-মন্ত্র। অজ্ঞানতা ও নৈরাশ্যের অন্ধকারে জ্বালিয়েছেন আশার অম্লান আলোকবর্তিকা। আত্মা যে অজেয়, জীবন যে চিরজয়ী- এ প্রাণপ্রদ বাণী বিঘোষিত হয় তার অনলবর্ষী লেখনীতে। বাংলার প্রীতপল্লি ও নগরীতে তার উদ্দীপনাময় বাণীর প্রভাব অনুভূত হয়। এ দেশের মুসলমানকে সবল মনুষ্যত্বের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি নানা সদনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তার সম্পাদিত মাসিক ‘নূর’ ও সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সাহিত্য-প্রচারের সঙ্গে সমাজ-জীবনের পুনর্গঠনের স্বপ্ন রূপ লাভ করে। তার অপূর্ব বাগ্মিতা-গুণে আপামর-সাধারণের মনে হীনম্মন্যতা বোধ দূরীভূত হয়ে প্রবল কমৌষণার সৃষ্টি হয়।
ইসমাইল হোসেন শিরাজী সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদীর ‘সমাজ ও সংস্কারক’ পুস্তকখানি তার হস্তগত হয়। তাতে প্রাচ্যের অগ্নিপুরুষ সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফঘানির ঘটনাবহুল অসামান্য জীবন ও স্বাধীন ‘সর্বতন্ত্রবাদের’ আদর্শ যেরূপ বলিষ্ঠ ও অগ্নিময় ভাষায় বিবৃত হয়েছে, তা কিশোর শিরাজীর মনে অপরিমাণ উন্মাদনার সৃষ্টি করে। তার ধারণা হয় যে, এ দেশে শিক্ষালাভ করে প্রকৃত জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়া যাবে না; তাই তিনি তুরস্ক গমনের সংকল্প করেন। ১৮৯৫ সালের আগস্ট মাসে গোপনে গৃহত্যাগ করে কলকাতায় ‘ইসলাম-প্রচারক’ অফিসে উপস্থিত হন। পত্রিকার সম্পাদক মুন্শী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ কিশোর শিরাজীর সংকল্প দেখে বিস্ময়বোধ করেন; কিন্তু তুরস্কে প্রেরণের সাধ্যায়াত্ত ছিল না।
অতঃপর শিরাজী ব্যর্থ মনোরথে গৃহে ফিরে আসেন এবং পড়াশোনায় মনোযোগ দেন। তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখন বিখ্যাত ধর্মবক্তা মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ্ সিরাজগঞ্জের এক মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করেন; সে সভায় শিরাজী পাঠ করেন ‘অনল-প্রবাহ’ নামে একটি উদ্দীপনাময় কবিতা। কবিতাটি শুনে মুনশী মেহেরউল্লাহ এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি নিজ ব্যয়ে ১৩০৬ সালে তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ‘অনল-প্রবাহ’ কাব্যের অগ্নিবাণী ভাবের তীব্রতা ও ভাষার ওজস্বিতা গুণে সমাজের সর্বত্র এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করে। ‘অনল-প্রবাহ’ ১৯০৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে সরকার বাজেয়াপ্ত করে, এবং তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অতঃপর তিনি কলকাতায় গিয়ে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হো-র আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালতে তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন ব্যারিস্টার বি সি চ্যাটার্জি। কিন্তু বিচারে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তার প্রতি দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, অর্থাভাবে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করা সম্ভব হয়নি। ফলে দীর্ঘ দণ্ডভোগের পর ১৯১২ সালের ১৪ মে তিনি কারামুক্ত হন। তার ‘কারা-কাহিনী’ পরবর্তীকালে মাসিক ‘সাধনা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯১২ সালের ১৮ অক্টোবর বলকানের ক্ষুদ্র শক্তি চতুষ্টয় রাশিয়া ও ব্রিটেনের প্ররোচনায় তুরস্ক আক্রমণ করে। তুরস্কের সেই বিপদের দিনে ডাক্তার মোখতার আহমদ আনসারির নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট গঠিত হয় এবং তুরস্কে ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল মিশন’ প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই মিশনের বঙ্গীয় প্রতিনিধি রূপে শিরাজী বোম্বাই থেকে জাহাজযোগে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। সেই জাহাজে বসেই তিনি কবিতা রচনা করেন
হে অসীম নীল সিন্ধু! হে অনন্ত লীলার আকর!
কার-প্রেম আকর্ষণে উচ্ছ্বসিত তোমার অন্তর!
অসীম নীলাম্বু মাঝে তরঙ্গের মরি কী নর্তন!
কী মহা বিচিত্র লীলা, মরি! কিবা ভীম আস্ফালন!
কতকাল হতে জুটি গাহিতেছে সংগীত মহান,
কী গভীর ভাবপূর্ণ, মুগ্ধ যাহে কবির পরাণ।
[তুরস্ক-ভ্রমণ। প্রথম খণ্ড]
তার ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ (১৯১৩) পুস্তকে তিনি সেই সফর-কাহিনি সরস ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বলকান শক্তিপুঞ্জের অত্যাচার, তুর্কি বাহিনীর বিপর্যয়, রণক্ষেত্রের অবস্থা, নব্য তুর্কিদলের জয়লাভ প্রভৃতি প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন;
‘মুসলমানের জাতীয়তা, মুসলমান ব্যতীত আর কিছুই হইবে না। সমস্ত জগতের মুসলমান এক, ধর্ম এক, স্বার্থ এক, চিন্তা এক, কর্ম এক, ইসলামের এই মহা-ঐক্যের বন্ধনে সমস্ত নবীন যুবককে প্রমত্ত করিতে হইবে।’
১৯১৩ সালের ১৫ জুলাই তিনি ভূমধ্যসাগরের পথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে তিনি পূর্ণোদ্যোমে সমাজের ও সাহিত্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৪ সালের সেপ্টম্বরে তার ‘স্পেন-বিজয়’ কাব্য প্রকাশিত হয়। তার কাব্যে রয়েছে বিশাল হৃদয়ের ছায়াপাত, কল্পনার প্রসার প্রকৃতির রূপ-বর্ণনা হৃদয় স্পর্শী। স্পেন-বিজয় কাব্যে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরও রচনা করেন ‘মহাশিক্ষা-কাব্য’ যা কারবালা কাহিনির পটভূমিকায় রচিত, ইসলামের সাম্য ও গণতন্ত্রের আদর্শ প্রচার উদ্দেশ্য হলেও স্থানে স্থানে কবিত্বের স্ফূরণ বেশ মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছে। ১৯১৫ সালে তার সংগীত-সঞ্জিবনী’ প্রকাশিত হয়। এতে ৩৩টি গান স্থান পেয়েছে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘প্রেমাঞ্জলি’, এখানে ১২৮টি গীতিকবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র অনুসরণে তিনি ‘প্রেমাঞ্জলি’ রচনা করেছিলেন।
১৯১৯ সালে তিনি মাসিক ‘নূর’ বের করেন। তাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ছোটগল্প ‘মেহের-নিগার’, ‘ঘুমের-ঘোরে’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর যুগ্ম সম্পাদনায় নব-পর্যায়ে সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ প্রকাশিত হতো। তাতে শিরাজী ‘আত্মত্যাগ ও জাতীয় উন্নতি’, ‘জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার প্রয়োজন’, ‘ভারতের বর্তমান অবস্থা ও মুসলমানের কর্তব্য’, ‘ইসলাম ও আত্মোৎসর্গ’, ‘স্বজাতি-প্রেম’, ‘বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয়’, ‘শিল্প-সংগঠন ও জাতীয় জীবন’, ‘নারীশক্তির উদ্বোধন ও জাতীয় জীবন’, ‘ইতিহাস-চর্চার আবশ্যকতা’, ‘প্রাণের মূর্চ্ছনা’ প্রভৃতি বহু মূল্যবান প্রবন্ধ ও রাজনীতিক অধিকারের আদর্শ প্রত্যয়ের আগুনে দীপ্তমান।
এ উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভের জন্য সেদিন শিরাজী যে পথনির্দেশ করেছিলেন, সে পথেই প্রশস্ত বলে তার সমাজের লোকেরা কালক্রমে বুঝতে পারে এবং সে পথে অগ্রসর হয়েই তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই জাতীয় আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু শিরাজী চেয়েছিলেন ইসলাম-সম্মত প্রজাতন্ত্র-প্রথা এবং জ্ঞানালোকিত মুক্ত চিত্ত; তিনি তাতেই দেখেছিলেন মুক্তির পূর্ণতা ও মনুষ্যত্বের মহিমার স্বপ্ন।