
গত সংখ্যার পর
উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে মোহিনী ও আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করতেন। সেখানেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটাও একটা বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে। মোহিনী বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ক্লাস করতে পারতেন না। সেই সময়ে আরেফিন তাকে নোট দিয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। এতে মোহিনী ভালো রেজাল্ট করেন। আরেফিন নিজেও মেধাবী ছাত্র। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মোহিনী এর বিনিময়ে তাকে কিছু উপহার দিতে চান। বললেন, ‘তুমি যে উপকার করলে তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। তার পরও আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। তুমি আমার কাছে কী চাও? তুমি যা চাইবে আমি সম্ভব হলে তাই দেব। মন থেকে বলবে।’ মোহিনীর এই বন্ধুত্ব-কৃতজ্ঞতায় আরেফিন যে তাকেই চেয়ে বসবেন তা তিনি নিজেও কখনো চিন্তা করেননি, ভাবেনওনি। আরেফিন জানতেন মোহিনীকে চাওয়া বা পাওয়া কোনো সহজতর বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ দুজনের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকতর অসমতা। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোহিনী ঢাকা শহরের ধনী পরিবারের সন্তান। তার সামাজিক সম্মান মর্যাদা অনেক উচ্চস্তরের। অরেফিনের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে এর বিপরীত। আরেফিন দরিদ্র্য পরিবারের সন্তান। তার পরিবারে তিনিই একমাত্র পড়ালেখা করেন। পরিবারে আয়-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আরেফিন টিউশনি করে নিজের পড়ালেখো করেন এবং পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠান। সেই টাকাতেই তাদের সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়। আরেফিন ‘গোবরে পদ্মফুল’। এ কথার যথার্থ যুক্তিও রয়েছে। গ্রামের অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র একটি পরিবার থেকে আরেফিনের মতো একটা মেধাবী ছেলের জন্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন- এটা সহজতর বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব একটি ব্যাপার। গোবরে পদ্মফুল যেমন অকল্পনীয়, এরকম হতদরিদ পরিবারে আরেফিনের মতো মেধাবী সন্তানের জন্মও অকল্পনীয়। যখন সত্যিই বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে তখন তা যথার্থভাবেই ‘গোবরে পদ্মফুল’-এর সঙ্গে তুল্য হয়ে ওঠে। এক কথায় যা অবিশ্বাস্য। মোহিনী এটা জানতেন। আরেফিনের শুধুই অরেফিন- এর বাইরে আরেফিনের আর কিছু নেই। এরকম অবস্থায় আরেফিনের চাওয়াকে গ্রহণ করা তার জন্য কতটা কঠিন, তাও তিনি জানতেন। তার অভিজাত পরিবার যে এটা সহজেই গ্রহণ করবে না, মানবে না- সে বিষয়েও তিনি স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতেন। ফলে আরেফিন যখন তাকেই চেয়েছেন উপহারস্বরূপ, তখন সেই চাওয়াকে যেমন উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, আবার গ্রহণ করাও সহজ হয়ে ওঠে না। যখন পারিবারিক এ সিদ্ধান্তে একদমই অমত- অরাজি, তখন কৃতজ্ঞ-মোহিনী মা-বাবাকে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কি পরিবারকে বিয়ে করব নাকি আরেফিনকে? পরিবার দেখার দরকার নেই। তোমরা আরেফিনকে দেখ।’ বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার অদম্য এ উচ্চারণ মানবিকতা ও কৃতজ্ঞতার চরমতম প্রকাশ। একই সঙ্গে সমাজজীবনে ধনী-গরিবের যে শ্রেণিবৈষম্য, তা তিনি ভেঙে সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে চেয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন ধনী-গরিবের যে বৈষম্য, সেই বৈষম্য দূর করে ভালোবাসায়-মনুষ্যত্বে-মানবিকতায় মানুষ হয়ে ওঠাটাই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিবারের অমতে আরেফিনকে জীবনে গ্রহণ করে শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমান্তরালে দাঁড়িয়েছিলেন- যেখানে আভিজাত্য নয়, মানুষই বড়, মনুষ্যত্বই বড়। মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর হলো ভালোবাসা। সেটিকেই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে, উদার মানসিকতায়, প্রেমের গহিন শক্তিতে, ভালোবাসার ঔদার্যে গ্রহণ করেছিলেন। আরেফিনকে গ্রহণের ভেতর দিয়েই তিনি চিরাচরিত আত্মম্ভরিতাপূর্ণ এ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।
আরেফিন মোহিনীকে চেয়েছেন। পেয়েছেন। সমস্যা তৈরি হয়েছে তার মানসিকতায়। তিনি মোহিনীকে চরমভাবে ভালোবাসলেও নিজেকে সমসময় অযোগ্য ভেবে নিজের ভেতর নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। দাম্পত্যজীবনে অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। মোহিনীর ভেতর অজস্র প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছেন, কখনো নিজের আত্মসমালোচনায়, কখনো আরেফিনের সঙ্গে কথা বলে, বোঝাপড়া করে। মোহিনী কখনই আরেফিন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারেননি। আরেফিনের মদ খাওয়া, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে দরোজায় পাশে পড়ে থাকা- এতকিছুর পরও মোহিনী কখনই আরেফিনকে ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। কখনো ক্ষোভ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে, আবার নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজেই আরেফিনকে স্পষ্টত বলেছেন, ‘আজ আমরা খোলামেলা আলোচনা করব। এতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা থাকতে পারবে না।’ মোহিনী আলোচনা করেছেন। আরেফিন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কথা দিয়েছেন আর কখনো এরকম হবে না। তার পরও কথা ঠিক রাখেননি। মোহিনী আরেফিনকে কাছে বসিয়ে বলেছেন, ‘তুমি সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি যা করতে বলেছি তার উল্টোটা করেছ। আমি যা অপছন্দ করি তাই তুমি করো। এর কারণ কী তুমি বলো তো? খোলাখুলি বলো। একটি শব্দও মিথ্যা বলবে না। আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো আমাদের এখনই শোধরাতে হবে। তা না হলে অনেক বড় সমস্যা হবে। বিয়ে যখন করেছি তখন একটা সুন্দর আনন্দময় সংসার আমি করতে চাই।’ এটা শোনার পরে আরেফিনও নিজের চরম সত্যটাকেই বলেছেন মোহিনীকে, ‘তোমার সঙ্গে তুলনা করলে আমার অবস্থা তোমার এক শ ভাগের এক ভাগ। আমার সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। তুমি কী পছন্দ করো আর কী অপছন্দ করো তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় থাকি। তুমি কীসে মন খারাপ করো, আর কীসে রাগ করো তা বুঝতে পারি না।... ভয়ের কারণে তোমাকে ঠিকমতো আদরও করতে পারি না।’ আরেফিনের কথা শুনে মোহিনী তাকে বলেছেন, ‘জীবনটা কয়দিনের বলো! তোমাকে ভালোবেসেছি বলেই তো তোমাকে বিয়ে করেছি।... শপথ করো, আমাকে কোনো কিছু গোপন করবে না। যা ভালো লাগে খুলে বলবে।’ আরেফিন সম্মতি জানায়। আরেফিন প্রমিজ করে আর কখনো মোহিনীকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু আরেফিন কথা রাখেনি। মোহিনী তাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তাকে ত্যাগ করার কথা কখনো ভাবেননি। বরং তার প্রতি আরও মমত্ব বেড়েছে, তার জন্য তিনি অস্থির হয়েছেন। বিশেষ করে যখন তিনি শুনেছেন আরেফিন চীনে যাচ্ছেন অফিসের দায়িত্বে। অথচ তাকে আগে থেকে কিছুই বলেননি। এটা মোহিনী মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে নিজের বাসা ছেড়ে বাবা-মার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। আরেফিন চীনে গিয়ে মোহিনীকে ফোন করলেও রাগে ক্ষোভে কষ্টে ফোন রিসিভি করেননি। কিন্তু যখন বাবার কাছে জানতে পারলেন, চীনের হুবেতে ব্যাপকভাবে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। টিভি নিউজেও সেটা দেখলেন মোহিনী। এ সংবাদে ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি হয় মোহিনীর ভেতর। আরেফিনের জন্য তার ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। আরেফিনের মোবাইলে ফোন করেও আরেফিনকে তিনি পাননি। করোনা এদিকে আঘাত হানে বাংলাদেশেও। মানুষের জীবনযাপন-জীবিকা সবকিছু বদলে যায়। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকরির অনিশ্চয়তা, মানুষ আত্মীয়-স্বজনহীন একা হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন এক নতুন জীবন হয়ে ওঠে মানুষের। সেই জীবনে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু বাস্তবে ভয়াবহ কঠিনে রূপ নেয়। মৃত্যু-আতঙ্ক নগরীতে মোহিনী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। খাদ্য-অর্থ সহযোগিতা নিয়ে- অফিসের কোনো কর্মচারীকে ছাঁটাই না করে, বরং তাদের পাশে থেকেছেন সাধ্যমতো। মানবিক এক মোহিনীকে আমরা লক্ষ্য করি। যদিও মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্মগতভাবেই তিনি পেয়েছেন। তার বাবা মোহসীন আহমেদ ও মা আনোয়ারা বেগম দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে সব সময় সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এসব প্রচারে তিনি বিব্রতবোধ করেন। মোহিনীও ঠিক তাই। একবার তার সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ করা হলে তিনি খুশি হননি, বরং নিজের ভেতর একরকম বিব্রত হয়েছেন। বাবা কী ভাববেন!
মোহিনী করোনায় আরেফিনের মৃত্যুর খবর জেনে স্তব্ধ হয়ে যান। সবকিছু থেকে নিজেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে রাখেন কয়েকদিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়েছে আরেফিনের লাশ আসবে বিমানবন্দরে। তিনি বিমানবন্দরে যেতে পারবেন, বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখতে পারবেন। কিন্তু তার মুখ দেখা যাবে না কোনোভাবেই। তার পরও তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছেন আরেফিনের সম্মানে, ভালোবাসায়। বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখেছেন কষ্টগুলোকে বুকে ভারী পাথরের মতো চেপে রেখে। আরেফিনকে হারিয়ে মোহিনী পাথর হয়ে গেছেন। কান্নাও তিনি ভুলে গেছেন- ‘কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হতে পারতেন তিনি।’ কিন্তু কান্না এখন তার জন্য এক কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। বরং নিজেকে তিনি আত্ম-প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করেন- কেন আরেফিনের ওপর অত রাগ করেছিলেন! কেন বাসা ছেড়ে চলে এসেছিলেন! আত্ম-অপরাধবোধে ও আত্মসমালোচনায় জর্জরিত হতে থাকেন।
মোহিনী বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখে গাড়ি নিয়ে বের হতেই আর এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন। একজন বৃদ্ধ লোক সন্তান হারানোর বেদনায় বিলাপ করছেন, পথচারীরা ঘিরে আছেন তাকে। পথচারীরা সন্তান হারানো বৃদ্ধ বাবাকে কী সান্ত্বনা দেবেন। অসহায় চোখে তাকে দেখছেন, ঘিরে আছেন। মোহিনী কী ভেবে গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে বৃদ্ধলোকটির কাছে এগিয়ে যান। বৃদ্ধলোকটাকে প্রশ্ন করেন, তার ছেলের লাশ কোন দেশ থেকে এসেছে? ছেলের কী নাম? বৃদ্ধ লোকটির নাম-ঠিকানা জানতে চান। সব জেনে তিনি যখন বুঝলেন ইনি আরেফিনের বাবা। স্তম্ভিত হয়ে পড়েন মোহিনী- ‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।’ এখানেও মোহিনী নিজের আবেগ সংযত রাখতে চেষ্টা করেন। আরেফিনের বাবা আলী আকবরকে নিজের গাড়িতে করে অফিসে নিয়ে যান। অফিস দেখে আলী আকবর কল্পনার সঙ্গেও মেলাতে পারেন না।
চলবে...