ঢাকা ২ শ্রাবণ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৩:২৩ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

গত সংখ্যার পর

উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে মোহিনী ও আরেফিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করতেন। সেখানেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটাও একটা বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে। মোহিনী বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ক্লাস করতে পারতেন না। সেই সময়ে আরেফিন তাকে নোট দিয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। এতে মোহিনী ভালো রেজাল্ট করেন। আরেফিন নিজেও মেধাবী ছাত্র। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মোহিনী এর বিনিময়ে তাকে কিছু উপহার দিতে চান। বললেন, ‘তুমি যে উপকার করলে তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। তার পরও আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। তুমি আমার কাছে কী চাও? তুমি যা চাইবে আমি সম্ভব হলে তাই দেব। মন থেকে বলবে।’ মোহিনীর এই বন্ধুত্ব-কৃতজ্ঞতায় আরেফিন যে তাকেই চেয়ে বসবেন তা তিনি নিজেও কখনো চিন্তা করেননি, ভাবেনওনি। আরেফিন জানতেন মোহিনীকে চাওয়া বা পাওয়া কোনো সহজতর বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ দুজনের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে ব্যাপকতর অসমতা। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোহিনী ঢাকা শহরের ধনী পরিবারের সন্তান। তার সামাজিক সম্মান মর্যাদা অনেক উচ্চস্তরের। অরেফিনের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে এর বিপরীত। আরেফিন দরিদ্র্য পরিবারের সন্তান। তার পরিবারে তিনিই একমাত্র পড়ালেখা করেন। পরিবারে আয়-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আরেফিন টিউশনি করে নিজের পড়ালেখো করেন এবং পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠান। সেই টাকাতেই তাদের সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়। আরেফিন ‘গোবরে পদ্মফুল’। এ কথার যথার্থ যুক্তিও রয়েছে। গ্রামের অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র একটি পরিবার থেকে আরেফিনের মতো একটা মেধাবী ছেলের জন্ম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন- এটা সহজতর বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব একটি ব্যাপার। গোবরে পদ্মফুল যেমন অকল্পনীয়, এরকম হতদরিদ পরিবারে আরেফিনের মতো মেধাবী সন্তানের জন্মও অকল্পনীয়। যখন সত্যিই বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে তখন তা যথার্থভাবেই ‘গোবরে পদ্মফুল’-এর সঙ্গে তুল্য হয়ে ওঠে। এক কথায় যা অবিশ্বাস্য। মোহিনী এটা জানতেন। আরেফিনের শুধুই অরেফিন- এর বাইরে আরেফিনের আর কিছু নেই। এরকম অবস্থায় আরেফিনের চাওয়াকে গ্রহণ করা তার জন্য কতটা কঠিন, তাও তিনি জানতেন। তার অভিজাত পরিবার যে এটা সহজেই গ্রহণ করবে না, মানবে না- সে বিষয়েও তিনি স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতেন। ফলে আরেফিন যখন তাকেই চেয়েছেন উপহারস্বরূপ, তখন সেই চাওয়াকে যেমন উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, আবার গ্রহণ করাও সহজ হয়ে ওঠে না। যখন পারিবারিক এ সিদ্ধান্তে একদমই অমত- অরাজি, তখন কৃতজ্ঞ-মোহিনী মা-বাবাকে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কি পরিবারকে বিয়ে করব নাকি আরেফিনকে? পরিবার দেখার দরকার নেই। তোমরা আরেফিনকে দেখ।’ বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার অদম্য এ উচ্চারণ মানবিকতা ও কৃতজ্ঞতার চরমতম প্রকাশ। একই সঙ্গে সমাজজীবনে ধনী-গরিবের যে শ্রেণিবৈষম্য, তা তিনি ভেঙে সমান্তরালে এসে দাঁড়াতে চেয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন ধনী-গরিবের যে বৈষম্য, সেই বৈষম্য দূর করে ভালোবাসায়-মনুষ্যত্বে-মানবিকতায় মানুষ হয়ে ওঠাটাই বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিবারের অমতে আরেফিনকে জীবনে গ্রহণ করে শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমান্তরালে দাঁড়িয়েছিলেন- যেখানে আভিজাত্য নয়, মানুষই বড়, মনুষ্যত্বই বড়। মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর হলো ভালোবাসা। সেটিকেই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে, উদার মানসিকতায়, প্রেমের গহিন শক্তিতে, ভালোবাসার ঔদার্যে গ্রহণ করেছিলেন। আরেফিনকে গ্রহণের ভেতর দিয়েই তিনি চিরাচরিত আত্মম্ভরিতাপূর্ণ এ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন।

আরেফিন মোহিনীকে চেয়েছেন। পেয়েছেন। সমস্যা তৈরি হয়েছে তার মানসিকতায়। তিনি মোহিনীকে চরমভাবে ভালোবাসলেও নিজেকে সমসময় অযোগ্য ভেবে নিজের ভেতর নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। দাম্পত্যজীবনে অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। মোহিনীর ভেতর অজস্র প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছেন, কখনো নিজের আত্মসমালোচনায়, কখনো আরেফিনের সঙ্গে কথা বলে, বোঝাপড়া করে। মোহিনী কখনই আরেফিন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারেননি। আরেফিনের মদ খাওয়া, রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে দরোজায় পাশে পড়ে থাকা- এতকিছুর পরও মোহিনী কখনই আরেফিনকে ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। কখনো ক্ষোভ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে, আবার নিজেকে বুঝিয়েছেন, নিজেই আরেফিনকে স্পষ্টত বলেছেন, ‘আজ আমরা খোলামেলা আলোচনা করব। এতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা থাকতে পারবে না।’ মোহিনী আলোচনা করেছেন। আরেফিন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কথা দিয়েছেন আর কখনো এরকম হবে না। তার পরও কথা ঠিক রাখেননি।  মোহিনী আরেফিনকে কাছে বসিয়ে বলেছেন, ‘তুমি সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি যা করতে বলেছি তার উল্টোটা করেছ। আমি যা অপছন্দ করি তাই তুমি করো। এর কারণ কী তুমি বলো তো? খোলাখুলি বলো। একটি শব্দও মিথ্যা বলবে না। আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো আমাদের এখনই শোধরাতে হবে। তা না হলে অনেক বড় সমস্যা হবে। বিয়ে যখন করেছি তখন একটা সুন্দর আনন্দময় সংসার আমি করতে চাই।’ এটা শোনার পরে আরেফিনও নিজের চরম সত্যটাকেই বলেছেন মোহিনীকে, ‘তোমার সঙ্গে তুলনা করলে আমার অবস্থা তোমার এক শ ভাগের এক ভাগ। আমার সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটে। তুমি কী পছন্দ করো আর কী অপছন্দ করো তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় থাকি। তুমি কীসে মন খারাপ করো, আর কীসে রাগ করো তা বুঝতে পারি না।... ভয়ের কারণে তোমাকে ঠিকমতো আদরও করতে পারি না।’ আরেফিনের কথা শুনে মোহিনী তাকে বলেছেন, ‘জীবনটা কয়দিনের বলো! তোমাকে ভালোবেসেছি বলেই তো তোমাকে বিয়ে করেছি।... শপথ করো, আমাকে কোনো কিছু গোপন করবে না। যা ভালো লাগে খুলে বলবে।’ আরেফিন সম্মতি জানায়। আরেফিন প্রমিজ করে আর কখনো মোহিনীকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু আরেফিন কথা রাখেনি। মোহিনী তাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তাকে ত্যাগ করার কথা কখনো ভাবেননি। বরং তার প্রতি আরও মমত্ব বেড়েছে, তার জন্য তিনি অস্থির হয়েছেন। বিশেষ করে যখন তিনি শুনেছেন আরেফিন চীনে যাচ্ছেন অফিসের দায়িত্বে। অথচ তাকে আগে থেকে কিছুই বলেননি। এটা মোহিনী মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে নিজের বাসা ছেড়ে বাবা-মার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। আরেফিন চীনে গিয়ে মোহিনীকে ফোন করলেও রাগে ক্ষোভে কষ্টে ফোন রিসিভি করেননি। কিন্তু যখন বাবার কাছে জানতে পারলেন, চীনের হুবেতে ব্যাপকভাবে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। টিভি নিউজেও সেটা দেখলেন মোহিনী। এ সংবাদে ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি হয় মোহিনীর ভেতর। আরেফিনের জন্য তার ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। আরেফিনের মোবাইলে ফোন করেও আরেফিনকে তিনি পাননি। করোনা এদিকে আঘাত হানে বাংলাদেশেও। মানুষের জীবনযাপন-জীবিকা সবকিছু বদলে যায়। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকরির অনিশ্চয়তা, মানুষ আত্মীয়-স্বজনহীন একা হয়ে পড়ে। পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন এক নতুন জীবন হয়ে ওঠে মানুষের। সেই জীবনে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু বাস্তবে ভয়াবহ কঠিনে রূপ নেয়। মৃত্যু-আতঙ্ক নগরীতে মোহিনী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। খাদ্য-অর্থ সহযোগিতা নিয়ে- অফিসের কোনো কর্মচারীকে ছাঁটাই না করে, বরং তাদের পাশে থেকেছেন সাধ্যমতো। মানবিক এক মোহিনীকে আমরা লক্ষ্য করি। যদিও মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া জন্মগতভাবেই তিনি পেয়েছেন। তার বাবা মোহসীন আহমেদ ও মা আনোয়ারা বেগম দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে সব সময় সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এসব প্রচারে তিনি বিব্রতবোধ করেন। মোহিনীও ঠিক তাই। একবার তার সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ করা হলে তিনি খুশি হননি, বরং নিজের ভেতর একরকম বিব্রত হয়েছেন। বাবা কী ভাববেন! 

মোহিনী করোনায় আরেফিনের মৃত্যুর খবর জেনে স্তব্ধ হয়ে যান। সবকিছু থেকে নিজেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে রাখেন কয়েকদিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়েছে আরেফিনের লাশ আসবে বিমানবন্দরে। তিনি বিমানবন্দরে যেতে পারবেন, বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখতে পারবেন। কিন্তু তার মুখ দেখা যাবে না কোনোভাবেই। তার পরও তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছেন আরেফিনের সম্মানে, ভালোবাসায়। বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখেছেন কষ্টগুলোকে বুকে ভারী পাথরের মতো চেপে রেখে। আরেফিনকে হারিয়ে মোহিনী পাথর হয়ে গেছেন। কান্নাও তিনি ভুলে গেছেন- ‘কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হতে পারতেন তিনি।’ কিন্তু কান্না এখন তার জন্য এক কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। বরং নিজেকে তিনি আত্ম-প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করেন- কেন আরেফিনের ওপর অত রাগ করেছিলেন! কেন বাসা ছেড়ে চলে এসেছিলেন! আত্ম-অপরাধবোধে ও আত্মসমালোচনায় জর্জরিত হতে থাকেন।  

মোহিনী বাক্সবন্দি আরেফিনকে দেখে গাড়ি নিয়ে বের হতেই আর এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন। একজন বৃদ্ধ লোক সন্তান হারানোর বেদনায় বিলাপ করছেন, পথচারীরা ঘিরে আছেন তাকে। পথচারীরা সন্তান হারানো বৃদ্ধ বাবাকে কী সান্ত্বনা দেবেন। অসহায় চোখে তাকে দেখছেন, ঘিরে আছেন। মোহিনী কী ভেবে গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে বৃদ্ধলোকটির কাছে এগিয়ে যান। বৃদ্ধলোকটাকে প্রশ্ন করেন, তার ছেলের লাশ কোন দেশ থেকে এসেছে? ছেলের কী নাম? বৃদ্ধ লোকটির নাম-ঠিকানা জানতে চান। সব জেনে তিনি যখন বুঝলেন ইনি আরেফিনের বাবা। স্তম্ভিত হয়ে পড়েন মোহিনী- ‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।’  এখানেও মোহিনী নিজের আবেগ সংযত রাখতে চেষ্টা করেন। আরেফিনের বাবা আলী আকবরকে নিজের গাড়িতে করে অফিসে নিয়ে যান। অফিস দেখে আলী আকবর কল্পনার সঙ্গেও মেলাতে পারেন না। 
চলবে...

অক্ষয়কুমার দত্তের বিশ্ববীক্ষা ও প্রার্থিত শোভনোদ্যান

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৩ পিএম
অক্ষয়কুমার দত্তের বিশ্ববীক্ষা ও প্রার্থিত শোভনোদ্যান
অক্ষয়কুমার দত্ত

অক্ষয়কুমার দত্ত জন্মেছিলেন আজ থেকে ২০৫ বছর আগে, ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই। মৃত্যুবরণ করেন ১৮৮৬ সালের ১৮ মে অর্থাৎ ১৪০ বছর আগে। সাড়ে ছয় দশকের আয়ুষ্কালে তিনি এমন কিছু দিয়ে গেছেন যার অনেককিছু ছিল আমাদের জন্য একেবারেই ‘প্রথম’। তাই তো মৃত্যুর প্রায় দেড় শ বছর পরও তার প্রসিদ্ধি নিয়ে আজও আলোচনা হচ্ছে।

এই ‘প্রথম’গুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে নজর দিতে হবে তার বেড়ে ওঠা ও বিকশিত হওয়ার পরিমণ্ডলের দিকে। এমনকি তার পরিবর্তিত চিন্তাবিশ্ব শেষ পর্যন্ত কী রূপ পরিগ্রহ করল সেদিকে আলোকপাত করলেও বের হয়ে আসবে তার বিশ্ববীক্ষার ধরন। পাওয়া যাবে তার প্রার্থিত বাংলার রূপ-কাঠামো।

শুরুটা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির মাধ্যমে। তার পর ১৮৪২ সালে নিজস্ব উদ্যাগে বের করেন দিগ্দর্শন নামের স্বল্পায়ুর মাসিক পত্রিকা। পরের বছর থেকে ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার প্রথমদিককার অণুপ্রেরণার উৎস। ১৮৪৩ সালের প্রথমদিকে যারা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। কয়েক বছর পর তিনি প্রভাবিত হন ইউরোপীয় দর্শন দ্বারা। বিশেষ করে ফরাসি দর্শন তার ওপর খুবই প্রভাব বিস্তার করে। ফ্রান্সিস বেকন, যিনি বলেছিলেন, জ্ঞানই শক্তি- তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। তার চিন্তাধারার ওপর আরও প্রভাব বিস্তার করেন আরেক ফরাসি দার্শনিক অগুস্ত কোত। ফলে তিনি অনুভব করেন প্রথাগত হিন্দুধর্ম থেকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কোনো রূপ-কাঠামো এর ভেতরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আর তা করতে না পারলে এ সমাজ পেছনেই পড়ে থাকবে। তিনি তখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজের প্রধানতম বীজ বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দিলেন। আর এর আলোকেই এ সমাজের মুক্তি কিংবা আলোর দিকে যাত্রা সম্ভব বলে মনে করলেন। লিখলেন ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ (দুই খণ্ড)। 

এভাবে তার হাত দিয়ে বের হয়ে এল এমন সব বস্তু, যা এ সমাজের জন্য ছিল একেবারেই প্রথম এবং সেগুলোর মধ্যে নিহিত ছিল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের সব উপাদান। আজও আমরা সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আক্ষেপের বিষয় হলো- শত বছরেরও অধিক আগে তিনি যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর সে সমাজ বিনির্মাণের জন্য যা যা বর্জন করতে বলেছিলেন আর যা যা গ্রহণ ও চর্চা করতে বলেছিলেন তার সিকিভাগও আমরা করিনি।

ব্রিটিশ-শাসিত ওই সময়ের পাঠ-মাধ্যম ছিল ইংরেজি। তিনিই প্রথম অনুভব করলেন মাতৃভাষার পাঠ-মাধ্যম ছাড়া যথার্থ ধারণা প্রাপ্তি কিংবা জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। ফলে বিকাশও সম্ভব নয়। ১৮৪১ সালে প্রকাশ পেল বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানগ্রন্থ ভূগোল যা সাধারণ মানুষের জন্য ছিল খুব সহজবোধ্য। এরপর ১৮৫৬ সালে বের হলো তার আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ পদার্থবিদ্যা। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়, তখন থেকেই আলোচনার তুঙ্গে ছিল। চৌম্বাকর্ষণ, বাষ্পীভবন ঘনীভবন, কাঠিন্য, স্থিতিস্থাপকতা, ঘাত, গতি, আগ্নেয়গিরি, মেরু ইত্যকার শব্দ ও শব্দবন্ধ যেগুলো ইতিপূর্বে ভিনভাষায় পড়তে হতো তা তিনি বাংলায় রূপান্তর করে সহজরূপে ব্যাখ্যা করলেন। ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার যে শব্দগুলো আজ আমরা ব্যবহার করি তার সত্তর শতাংশ অক্ষয়কুমারের দেওয়া।  

পরিবার ও সমাজের মধ্যে স্থিতিশীলতার জন্য ভালোবাসাময় শক্তিশালী বন্ধনের প্রয়োজন। এ অনুভব থেকে তিনিই প্রথম তাগিদ দেন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও বার্ধক্যবিবাহ রোধের। পরিবারের শক্ত বন্ধনের জন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রীর সমমনোভাব, প্রয়োজন নারীশিক্ষার, সন্তান ও বাবা-মার প্রতি কর্তব্য ইত্যাদির মতো বিষয়। প্রথাগত ধর্ম পালনের মাধ্যমে পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের চেয়ে পরোপকারকেই তিনি সেই মোক্ষলাভের উপাদান মনে করতেন। 

ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনায় সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে তিনি প্রচলন করেছিলেন বাংলার। বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের গোড়ায় সংস্কৃতই মূল- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের এরকম সংস্কৃতপ্রীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এসব দাবির অসারতা প্রমাণ করতে তিনি একাই পালন করেছেন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। নিজের বই বিক্রির উপার্জিত অর্থে তিনি তার বাসভবনে গড়ে তুলেছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, যা এই বাংলায় ব্যক্তিগত প্রথম সংগ্রহশালা। যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারের জন্য আর কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছেন। প্রমাণ করে ছেড়েছেন এগুলোর অসারতা। শুভ-অশুভ সময় নিয়ে তৎকালীন ধারণামতে যা ছিল, তার নিরর্থকতাও প্রমাণ করেছেন। 

নারীশিক্ষার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বেগম রোকেয়ার নাম সর্বজনবিদিত হলেও এর প্রয়োজনীয়তা তিনিই প্রথম অনুভব করেছিলেন এবং প্রারম্ভ হয়েছিল তার হাতেই। বিধবা বিবাহের নায়ক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম সর্বাগ্রে প্রচারিত হলেও একই বছরে জন্ম নেওয়া অক্ষয়কুমার ছিলেন তার সবচেয়ে বড় সারথী। ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কলকাতা থেকে হুগলি জেলায় স্থানান্তরিত হলে ওই সময় বক্তৃতায় একক বিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রয়োজনীতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। ডেভিড হেয়ারের স্মরণসভায় রীতি ভেঙে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। প্রাচীন পাঠ্যক্রম ভেঙে তিনি যে পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব করেছিলেন আজও আমাদের দেশে তা চলমান। 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ নৈতিক অবস্থানের কারণে তিনি উইলিয়ম গর্ডন ইয়ং-এর দেওয়া লোভনীয় চাকরি- শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টরের পদ গ্রহণ করেননি। ছিলেন উদ্ভিদপ্রেমিক। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু স্থান থেকে দুর্লভ বৃক্ষচারা সংগ্রত করে সুপরিকল্পিত একটা বাগান করে তার নাম দিয়েছিলেন শোভনোদ্যান।

আসলে তিনি এ বাংলাকেই দেখতে চেয়েছিলেন বিশ্ববীক্ষায় উজ্জ্বল শোভনোদ্যান হিসেবে।

বই আলোচনা মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৪০ পিএম
মোস্তফা কামালের বিষাদ বসুধা: কালের যাত্রায় দালিলিক শিল্পকর্ম
বিষাদ বসুধা

গত সংখ্যার পর

শিল্পপতিরা পত্রিকা বের করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু সাংবাদিকরা সেটা জেনেও সেই হীনস্বার্থেই ব্যবহৃত হন। মূলত শিল্পপতিদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত তারা। শাহবাজ খানের কাছে একজন সম্পাদক আসিফ আহমেদ যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন, যেভাবে তার ন্যায়সঙ্গত কোনো যুক্তিই গ্রহণ না করে, কর্মচারী ছাঁটাইয়ের শক্ত শর্ত অনিবার্য করে তোলে, সেখানে আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিরূপায় হয়ে পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। লেখক আলোর নিচের কঠিন এক অন্ধকারকে পাঠকের সমানে উপস্থাপন করে মহৎ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। সত্যধারণ ব্যতিত কখনো কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না, সত্যকে অস্বীকার করে বা সত্যকে না দেখার ভান করে কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হলে কখনোই তা মহৎ শিল্পকর্মের মর্যাদা লাভ করে না। মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য শিল্পীকেও সত্যসাধক হতে হয়, বুকে হিম্মত থাকতে হয়। 

মোস্তফা কামাল ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাসে সত্য ধারণের হিম্মত দেখাতে পেরেছেন। কারণ তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিক। তার জন্য এই সত্য প্রকাশ আরও কঠিন। সেই কঠিনকে তিনি জয় করেছেন। আর সে কারণেই কালের যাত্রাই উপন্যাসটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। শিল্পদ্যোক্তারা নিজের পত্রিকার সংবাদকর্মীদের কর্পোরেট অফিসের কর্মচারী ব্যতীত অন্যকিছুই ভাবেন না। যে কারণে আসিফ আহমেদের মতো একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সম্পাদককেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে পারেন। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত দেখা না করে তাকে ফিরিয়েও দিতে পারেন। তাদের বিবেকে এগুলো কোনো কাজ করে না। তাদের কাছে মূলত অর্থ বিবেচ্য, সম্মানবোধ নয়। অথচ আসিফ আহমেদ অসম্ভবরকমের ধৈর্য্য নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এখানে আমরা নানাভাবে অপচয় বন্ধ করে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে আনতে পারি। সেটা করলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। দাম্ভিক শাহবাজ খানের মাথায় একটাই- চিন্তা লোক ছাঁটাই করা, কোনো টাকা দিতে পারবেন না। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বকেয়া কোটি কোটি টাকা তাও পরিশোধ করবেন না। করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও শাহবাজ খান সম্পূর্ণভাবে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনিই আবার মোহিনীর জন্মদিনে ফুল পাঠিয়েছেন। অদ্ভুত ভয়ানক ও বীভৎস চরিত্রের শাহবাজ খান রূপশ্রী বান্ধবী মোহিনীর জন্মাদিন মনে রাখেন এবং ফুল পাঠান। অথচ পুরো দেশে তখন করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসংকট প্রবলভাবে। নিজের পত্রিকার লোকজন তখন অনিশ্চয়তায় ভাসছেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই শ্রেণির শিল্পপতিদের কাছে সাধারণ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই স্পর্শ করে না। বরং সুযোগ পেলে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েই আনন্দ লাভ করেন। শাহবাজ খান সেই নির্মম সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের শিল্পপতিরা এখনো যে সাংবাদিকদের নিছক কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, কঠিন এই সত্য উপন্যাসটিতে আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কারণে আসিফ আহমেদ আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

এ পদত্যাগে তার বুকের পাঁজর কতটা ভেঙেছে, কতটা ব্যথিত হয়েছেন, তা সহজেই অনুধাবন করা যায় লেখকের ভাষায়, ‘আসিফ আহমেদ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। দীর্ঘদিন ধরে অনেক যত্নে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেটি তাকে আজ ছেড়ে যেতে হবে। গভীর এই মর্মবেদনা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। তিনি চলে গেলে যদি সবার চাকরি থাকত তাহলেও তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। তিনি চলে যাওয়ামাত্রই ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে। কতজন যে চাকরি হারাবে কে জানে!’ এখানে খুব সহজেই আসিফ আহমেদের হৃদয়ের যন্ত্রণাদগ্ধ রক্তক্ষরণ অনুভব করা যায়, একই সঙ্গে শাহবাজ খানের হীন-মানসিকতার স্বরূপটিও সহজেই চিনে নিতে পারি। একদিকে তিনি নিজের পত্রিকার লোকজনকে করোনায় মহাবিপদে ঠেলে দিচ্ছেন, আর একদিকে তিনি ঘুমের ভেতর ‘মোহিনী’কে ডাকছেন। মোহিনী তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একসময় মোহিনীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। বন্ধুত্বে যতটুকু মানায় ততটুকুই থেকেছেন। মাঝে দীর্ঘ যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ নতুন করে সেই সম্পর্ক তাজা হয়ে ওঠে। তা অনেকটাই শাহবাজ খানের কারণেই। এটি আরও বেশি প্রাণ পায় শাহবাজ খান যখন জানতে পারেন আরেফিন মারা গেছেন। আগ্রহ অগ্নিতে রূপ নেয়। সেটা তার ঘুমের ভেতরও দখল নেয়। শাহবাজ খান অসংখ্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, এ নিয়ে পরিবারে স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে তার প্রকট সমস্যা। তার চারিত্রিক এই ত্রুটি নীলিমা খান মেনে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে রাগে-ক্ষোভে অপমানে শাহবাজ খানকে ছেড়ে চলে যান তিনি। শাহবাজ খানের মধ্য দিয়েই লেখক সমাজের উঁচুস্তরের একশ্রেণির মানুষের দুর্গন্ধভরা কদর্য রূপ অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উন্মোচিত করেছেন।

করোনাকালীন চিকিৎসাব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটিকে আরও বড় সত্য করে প্রতিষ্ঠিত করেছে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবায় যখন পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, স্বার্থমন্ত্রী চাকরি রক্ষা করতে সাহেদ করিমের ফাঁদে পা দেন। সাহেদ করিম নিয়মিত টিভি টক শ করেন। দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ দামিনামি ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি। এসব দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাকে নিজের ত্রাণকর্তা ভেবে বসেন। এবং করোনা টেস্টের অনুমতির চুক্তি করেন সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে।  সাহেদ করিম এখানে পুরো দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কোনোরকম করোনা টেস্ট না করে রিপোর্ট দিতে থাকেন। মানুষ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। জনমন থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের মনে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে সাহেদ করিমের প্রতারণা। এরকম অসংখ্য প্রতারণা ও দুর্নীতি খবরে যখন টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা সয়লাব হয়ে ওঠে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। পারিবারিকভাবেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সাহেদ করিমকেও তিনি আর পাশে পান না। তিনি মন্ত্রী হয়ে সাহেদ করিমের অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভনে নিজেকে অসহায় ভেবেছেন, তার কথাতেই তার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহেদ করিমের সঙ্গে যখন প্রথম প্রথম কথা হতো, তাকে যখন টাকা ও ক্ষমতার গল্প শোনাতেন, তিনি বিস্মিত হতেন। আর বিস্ময়ের ভেতরেই নিজের মনের ভেতর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সাহেদ করিম চলে যাওয়ার পরে প্রবল ক্ষমতাধর এই মন্ত্রী সাহেদ করিমকে নিয়ে ভাবেন, একটা হাসপাতালের মালিক! তার কত টাকা! এই দেশে টাকা থাকলে কি না হয়! আমি ঘোড়ার ডিমের মন্ত্রী। আমাকে কেউ পোছেও না। উল্টো মানুষের গালমন্দ! মিডিয়ায় উল্টাপাল্টা রিপোর্ট। মন্ত্রী হয়ে কী লাভ হলো! না, কিছু ভালো লাগে না।’ তার এই ভাবনার ভেতর গণমানুষের স্বার্থের কল্যাণকামী কোনো ভাবনা নেই, করোনা থেকে দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করবে সেই চিন্তা নেই, শুধু আছে নিজের হীনস্বার্থপরতার কথা, আছে সাহেদ করিমের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যর্থতার ভাবনা। এক অসম্ভব ব্যক্তিস্বার্থলোভী ঠুনকো এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তার পদত্যাগের জোরালো দাবিতেও তিনি নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছেন। মানুষের জীবন রক্ষা নয়, যে কোনো উপায়েই হোক মন্ত্রিত্ব রক্ষা করাই তার কাছে বড়। এবং তিনি সেটাই করেছেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনাকালীন এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত ভেঙে পড়েছিল। নানাভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেবা পায়নি। বড় হাসাপাতালে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা হয়নি। টাকার বাণিজ্য চলেছে। রোগী না থাকলেও আইসিইউ ভাড়া করে রাখত একশ্রেণির ধনীরা, কখনো তাদের পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাদের সেবার জন্য। কোনো সভ্য দেশে এটা ভাবা যায়! অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিয়ে পরিবারের আপনজনরা হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, ভর্তি করাতে পারেননি, সেবা পাননি। পথে পথেই মৃত্যু হয়েছে বহু রোগীর। এই কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভর্তি করলেও অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে, অক্সিজেন না দিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলা দেওয়া হয়েছে। করোনাকালীন চিকিৎসাসেবার কঠিন ভয়াবহ করুণ চিত্র লেখক মোস্তফা কামাল অত্যন্ত নির্মোহভাবে সাহসিকতার সঙ্গে শিল্পদক্ষতায় তুলে ধরে দায়বোধের পরিচয় দিয়েছেন, একই সঙ্গে একটি উপন্যাসে সমকালভাবনা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি ‘বিষাদ বসুধা’ উপন্যাসে ধারণ করেছেন।

চলবে...

এতকাল পরে আজ জানলাম...

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
এতকাল পরে আজ জানলাম...
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

আমি তার কথা ভুলেই গেছিলাম, মনে রাখার কোনো কারণ ছিল না। 
এক পাড়াতেই বেড়ে ওঠা, দেখা হয়েছে কদাচিৎ, ভদ্রতাবশত কেমন আছেন?
অতটুকুই কুশল বিনিময়, আটকায়নি চোখে চোখ, হাসি তো দূরের কথা।
কোনো এক বসন্ত উৎসবে চারুকলায় হয়েছিল দেখা, দু’জনের 
হাঁটাহাঁটি একা একা, ভাববাচ্যে দু’জনের একই প্রশ্ন, একা-ই?
মাঝখানে কেটে গেছে আড়াই যুগ, এতকাল পরে দেখা রাঙামাটির সুবলং 
ঝরনায় এসে, স্বামী ভদ্রলোক সাদামাটা, উদার মানসিকতার।
আমাকে দেখে তার সে কী উচ্ছ্বাস! মনে হলো কত জনমের পরিচিত যেন
আমরা, স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সোজা-সাপটা বলেই ফেলল, 
জানো উনাকেই ভালোবাসতাম, কখনো বলতে পারিনি।
স্বামী ভদ্রলোকও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে হ্যাঁ, জানেন ভাই, 
বিয়ের রাতেই আপনার কথা বলেছে নীলা আমাকে।
ভাষা হারিয়ে ফেলি ক’মিনিট।

বিকেলে প্যাদা টিং টিংয়ে চায়ের টেবিলে আবার মুখোমুখি, স্বামী ভদ্রলোক 
ইচ্ছে করেই ওয়াশরুমের দোহাই দিয়ে দু’জনকে কথা বলার সুযোগ করে 
দিলেন, বুঝতে পারলাম।

দূরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, এদিকটায় নেই। উঁচু পাহাড় থেকে নিরলসভাবে 
ঝরে পড়ছে বৃষ্টির পানি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দু’জন দু’জনকে দেখছি। 
কত কথা পড়া হয়ে যাচ্ছে দু’চোখের ভাষায়। অথচ কথা হচ্ছে না আমাদের।
স্বামী আসছে, দূর থেকে দেখে তার মুখ থেকে বেরুল, আমি কিন্তু সত্যিই 
আপনাকে ভালোবাসতাম, এরপর অস্ফূট স্বরে শেষ কথাটা বলল, এখনও।
দূরে ঝিরিঝিরি ঝরছে বরষার বৃষ্টি।

আমার স্ত্রী নয়না ডিভোর্স লেটার দেয়ার আগে একটা চিরকুটে লিখেছিল, 
তোমাকে তোমাদের পাড়ার একজন ভালোবাসতো, জানতে?
উত্তর জানা ছিল না সেদিন, নয়না কি তা হলে সন্দেহ করত আমাকে?

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস বইছে, সে বাতাসের খামে নয়নার সেদিনের 
প্রশ্নের উত্তর পাঠিয়ে দিলাম, ‘আজ জানলাম, ভালোবাসতো কেউ।’

 

মেলানকলিক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
মেলানকলিক
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

এভাবে কি ফুরায় সব আয়োজন
নির্জনের কাছে শুধু
দু’হাত পেতেছি 
সব শুরুয়াত দিলাম তাঁকে
উড়ে গেছে, পুড়ে গেছে দিন 
স্তব্ধ বিকেল
বিষণ্ণ মেঘলা দুপুর
আঁচল খুলে দেয়…

রোজ হারিয়ে যাই
                     রোজনামচায়…

 

ইসমাইল হোসেন শিরাজী ও তার সাহিত্য-প্রতিভা

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম
আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৩ পিএম
ইসমাইল হোসেন শিরাজী ও তার সাহিত্য-প্রতিভা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১) জন্ম সিরাজগঞ্জে ১৮৮০ সালে। কবি ঔপন্যাসিক ও রাজনীতিবিদ। 

গ্রামের পাঠশালা স্থানীয় জ্ঞানদায়িনী মধ্য ইংরেজি স্কুল এবং সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হলেও নিজের চেষ্টায় সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মনীতি, সমাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কংগ্রেসে যোগদান এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু এ বিতর্কে বাংলাভাষার পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে (১৯১৯-১৯২৩) সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ দল গঠিত হলে তাতে যোগদান করেন। অনলস্রাবী সাহিত্যসৃষ্টি ও জ্বালাময়ী বক্তৃতাদানের জন্য কয়েকবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মূলত মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী লেখক। বাঙালি মুসলমানদের রচনায় ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর প্রথম কাব্য ‘অনল-প্রবাহ’ নির্জীব জাতির কানে ঘুম ভাঙানিয়া মন্ত্র উচ্চারণ করেন। 

কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর উদাত্ত আহ্বানে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সাড়া জেগেছে। ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি মুসলমানের কানে তিনি শুনিয়েছেন অভয় জীবন-মন্ত্র। অজ্ঞানতা ও নৈরাশ্যের অন্ধকারে জ্বালিয়েছেন আশার অম্লান আলোকবর্তিকা। আত্মা যে অজেয়, জীবন যে চিরজয়ী- এ প্রাণপ্রদ বাণী বিঘোষিত হয় তার অনলবর্ষী লেখনীতে। বাংলার প্রীতপল্লি ও নগরীতে তার উদ্দীপনাময় বাণীর প্রভাব অনুভূত হয়। এ দেশের মুসলমানকে সবল মনুষ্যত্বের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি নানা সদনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তার সম্পাদিত মাসিক ‘নূর’ ও সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সাহিত্য-প্রচারের সঙ্গে সমাজ-জীবনের পুনর্গঠনের স্বপ্ন রূপ লাভ করে। তার অপূর্ব বাগ্মিতা-গুণে আপামর-সাধারণের মনে হীনম্মন্যতা বোধ দূরীভূত হয়ে প্রবল কমৌষণার সৃষ্টি হয়।

ইসমাইল হোসেন শিরাজী সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদীর ‘সমাজ ও সংস্কারক’ পুস্তকখানি তার হস্তগত হয়। তাতে প্রাচ্যের অগ্নিপুরুষ সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফঘানির ঘটনাবহুল অসামান্য জীবন ও স্বাধীন ‘সর্বতন্ত্রবাদের’ আদর্শ যেরূপ বলিষ্ঠ ও অগ্নিময় ভাষায় বিবৃত হয়েছে, তা কিশোর শিরাজীর মনে অপরিমাণ উন্মাদনার সৃষ্টি করে। তার ধারণা হয় যে, এ দেশে শিক্ষালাভ করে প্রকৃত জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়া যাবে না; তাই তিনি তুরস্ক গমনের সংকল্প করেন। ১৮৯৫ সালের আগস্ট মাসে গোপনে গৃহত্যাগ করে কলকাতায় ‘ইসলাম-প্রচারক’ অফিসে উপস্থিত হন। পত্রিকার সম্পাদক মুন্শী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ কিশোর শিরাজীর সংকল্প দেখে বিস্ময়বোধ করেন; কিন্তু তুরস্কে প্রেরণের সাধ্যায়াত্ত ছিল না। 

অতঃপর শিরাজী ব্যর্থ মনোরথে গৃহে ফিরে আসেন এবং পড়াশোনায় মনোযোগ দেন। তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখন বিখ্যাত ধর্মবক্তা মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ্ সিরাজগঞ্জের এক মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করেন; সে সভায় শিরাজী পাঠ করেন ‘অনল-প্রবাহ’ নামে একটি উদ্দীপনাময় কবিতা। কবিতাটি শুনে মুনশী মেহেরউল্লাহ এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি নিজ ব্যয়ে ১৩০৬ সালে তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ‘অনল-প্রবাহ’ কাব্যের অগ্নিবাণী ভাবের তীব্রতা ও ভাষার ওজস্বিতা গুণে সমাজের সর্বত্র এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করে। ‘অনল-প্রবাহ’ ১৯০৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে সরকার বাজেয়াপ্ত করে, এবং তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অতঃপর তিনি কলকাতায় গিয়ে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হো-র আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালতে তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন ব্যারিস্টার বি সি চ্যাটার্জি। কিন্তু বিচারে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তার প্রতি দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, অর্থাভাবে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করা সম্ভব হয়নি। ফলে দীর্ঘ দণ্ডভোগের পর ১৯১২ সালের ১৪ মে তিনি কারামুক্ত হন। তার ‘কারা-কাহিনী’ পরবর্তীকালে মাসিক ‘সাধনা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। 

১৯১২ সালের ১৮ অক্টোবর বলকানের ক্ষুদ্র শক্তি চতুষ্টয় রাশিয়া ও ব্রিটেনের প্ররোচনায় তুরস্ক আক্রমণ করে। তুরস্কের সেই বিপদের দিনে ডাক্তার মোখতার আহমদ আনসারির নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট গঠিত হয় এবং তুরস্কে ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল মিশন’ প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই মিশনের বঙ্গীয় প্রতিনিধি রূপে শিরাজী বোম্বাই থেকে জাহাজযোগে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। সেই জাহাজে বসেই তিনি কবিতা রচনা করেন 

হে অসীম নীল সিন্ধু! হে অনন্ত লীলার আকর!
কার-প্রেম আকর্ষণে উচ্ছ্বসিত তোমার অন্তর!
অসীম নীলাম্বু মাঝে তরঙ্গের মরি কী নর্তন!
কী মহা বিচিত্র লীলা, মরি! কিবা ভীম আস্ফালন!
কতকাল হতে জুটি গাহিতেছে সংগীত মহান, 
কী গভীর ভাবপূর্ণ, মুগ্ধ যাহে কবির পরাণ। 
[তুরস্ক-ভ্রমণ। প্রথম খণ্ড]

তার ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ (১৯১৩) পুস্তকে তিনি সেই সফর-কাহিনি সরস ভাষায় বর্ণনা করেছেন। বলকান শক্তিপুঞ্জের অত্যাচার, তুর্কি বাহিনীর বিপর্যয়, রণক্ষেত্রের অবস্থা, নব্য তুর্কিদলের জয়লাভ প্রভৃতি প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন;
‘মুসলমানের জাতীয়তা, মুসলমান ব্যতীত আর কিছুই হইবে না। সমস্ত জগতের মুসলমান এক, ধর্ম এক, স্বার্থ এক, চিন্তা এক, কর্ম এক, ইসলামের এই মহা-ঐক্যের বন্ধনে সমস্ত নবীন যুবককে প্রমত্ত করিতে হইবে।’  

১৯১৩ সালের ১৫ জুলাই তিনি ভূমধ্যসাগরের পথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে তিনি পূর্ণোদ্যোমে সমাজের ও সাহিত্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৪ সালের সেপ্টম্বরে তার ‘স্পেন-বিজয়’ কাব্য প্রকাশিত হয়। তার কাব্যে রয়েছে বিশাল হৃদয়ের ছায়াপাত, কল্পনার প্রসার প্রকৃতির রূপ-বর্ণনা হৃদয় স্পর্শী। স্পেন-বিজয় কাব্যে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরও রচনা করেন ‘মহাশিক্ষা-কাব্য’ যা কারবালা কাহিনির পটভূমিকায় রচিত, ইসলামের সাম্য ও গণতন্ত্রের আদর্শ প্রচার উদ্দেশ্য হলেও স্থানে স্থানে কবিত্বের স্ফূরণ বেশ মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছে। ১৯১৫ সালে তার সংগীত-সঞ্জিবনী’ প্রকাশিত হয়। এতে ৩৩টি গান স্থান পেয়েছে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘প্রেমাঞ্জলি’, এখানে ১২৮টি গীতিকবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র অনুসরণে তিনি ‘প্রেমাঞ্জলি’ রচনা করেছিলেন। 

১৯১৯ সালে তিনি মাসিক ‘নূর’ বের করেন। তাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ছোটগল্প ‘মেহের-নিগার’, ‘ঘুমের-ঘোরে’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর যুগ্ম সম্পাদনায় নব-পর্যায়ে সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ প্রকাশিত হতো। তাতে শিরাজী ‘আত্মত্যাগ ও জাতীয় উন্নতি’, ‘জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার প্রয়োজন’, ‘ভারতের বর্তমান অবস্থা ও মুসলমানের কর্তব্য’, ‘ইসলাম ও আত্মোৎসর্গ’, ‘স্বজাতি-প্রেম’, ‘বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয়’, ‘শিল্প-সংগঠন ও জাতীয় জীবন’, ‘নারীশক্তির উদ্বোধন ও জাতীয় জীবন’, ‘ইতিহাস-চর্চার আবশ্যকতা’, ‘প্রাণের মূর্চ্ছনা’ প্রভৃতি বহু মূল্যবান প্রবন্ধ ও রাজনীতিক অধিকারের আদর্শ প্রত্যয়ের আগুনে দীপ্তমান।    

এ উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভের জন্য সেদিন শিরাজী যে পথনির্দেশ করেছিলেন, সে পথেই প্রশস্ত বলে তার সমাজের লোকেরা কালক্রমে বুঝতে পারে এবং সে পথে অগ্রসর হয়েই তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই জাতীয় আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু শিরাজী চেয়েছিলেন ইসলাম-সম্মত প্রজাতন্ত্র-প্রথা এবং জ্ঞানালোকিত মুক্ত চিত্ত; তিনি তাতেই দেখেছিলেন মুক্তির পূর্ণতা ও মনুষ্যত্বের মহিমার স্বপ্ন।