যুগ যুগ ধরে ডাবের পানি একটি জনপ্রিয় প্রাকৃতিক পানীয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং ইলেক্ট্রোলাইট থাকে। বহু দেশে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশ্বে সর্বাধিক ডাব উৎপন্ন হয় ইন্দোনেশিয়ায়। তার পরে আছে ফিলিপাইন এবং ভারতবর্ষ। বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই ডাব পাওয়া যায়। মাইউপচার অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফারজানা আলম
ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং নানাবিধ খনিজ পদার্থ যেমন- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস থাকে। ইউএসডিএ পুষ্টি তথ্যভাণ্ডার অনুযায়ী ১০০ মিলিলিটার ডাবের পানিতে ২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ০.৩০ গ্রাম আমিষ, ৬.৯৭ গ্রাম শ্বেতসার, ৬.৩৬ গ্রাম চিনি, ৬ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম, ২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ৬ মিলিগ্রাম ফসফোরাস, ১৭৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৫.৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্যের উপকারে ডাবের পানি
দেহের আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে: শারীরিক পরিশ্রমের পর দেহের আর্দ্রতা বৃদ্ধি করতে ডাবের পানি পান করা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। পরিশ্রম করার সময় দেহ থেকে যে পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায়, ডাবের পানি তা পূরণ করে। ফলে ক্লান্তি দূর হয়।
বৃক্কে পাথর জমা প্রতিরোধ করে: ডাবের পানি দেহ থেকে টক্সিন বের করে দেয় এবং বৃক্কতে জমতে দেয় না। দেখা গিয়েছে যে, ডাবের পানি বৃক্কতে পাথর জমাতে বাধা দেয় এবং পাথরের সংখ্যা কম রাখে।
ত্বকের উপকার: প্রদাহ এবং ইউভি রশ্মির ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে ডাবের পানি সবচেয়ে কাছের বন্ধু। প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ধর্ম থাকায় ত্বকের সংক্রমণ এবং বয়সের প্রাথমিক ছাপ পড়াকে প্রতিরোধ করে।
দাঁতে গর্ত হওয়া প্রতিরোধ করে: ডাবের পানিতে থাকে লউরিক অ্যাসিড, যেটি একটি ফ্যাটি অ্যাসিড। লউরিক অ্যাসিডের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ আছে। ফলে দাঁতে গর্ত করা ব্যাকটেরিয়াগুলোর বিকাশ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে দাঁত খারাপ হওয়া প্রতিরোধ করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: শরীরের স্বাভাবিক বিপাক ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট ফ্রি র্যাডিক্যালগুলো অস্থিতিশীল অণু। অধিক পরিমাণে এই সক্রিয় অক্সিজেন দেহের কোষগুলোর ক্ষতি করতে পারে এবং অক্সিডেটিভ চাপ তৈরি করতে পারে। অত্যধিক পরিমাণে অক্সিডেটিভ চাপ তৈরি হলে দেহ নানা রকমের অসুখের শিকার হতে পারে। যেমন- কর্কট রোগ, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এবং ডায়াবেটিস।
গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। ফলে অক্সিডেটিভ চাপ সৃষ্টি হতে বাধা দেয়। এতে রয়েছে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, ক্যাফেইক অ্যাসিড এবং বিভিন্ন ধরনের ফেনোলিক যৌগ, যেগুলো ফ্রি র্যাডিকেলগুলোকে দেহ থেকে বের করে দেয়। একটি প্রিক্লিনিক্যাল পরীক্ষা দেখাচ্ছে যে, ডাবের পানিতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকরভাবে দেহের রক্তচাপ, রক্তের গ্লুকোজ, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা এবং ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা হ্রাস করে এবং দেহের স্বাভাবিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে।
ত্বকের উপকার: সাধারণ সংক্রমণ, দূষণ এবং ক্ষতিকারক ইউভি রশ্মির বিরুদ্ধে দেহের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো ত্বক। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের অবস্থা যেমন- চর্ম রোগ, গায়ে ছোপ পড়া এবং ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিকেল থেকে ত্বককে রক্ষা করা জরুরি। গবেষণা দেখিয়েছে যে, ডাবের পানি গায়ে ছোপ পড়া হ্রাস করতে পারে।
কেশ পরিচর্যা: ডাবের পানি চুলের পক্ষে খুবই উপকারী। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে ডাবের পানি চুল পড়া এবং চুলের অকালপক্বতা নিবারণ করে। গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, চুলে ডাবের পানি দিলে চুলের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। এ ছাড়া চুলে থাকে ক্যাপ্রাইলিক অ্যাসিড, যার অ্যান্টি-ফাঙ্গাল গুণ আছে। তাই চুলের খুসকি প্রতিরোধ করতে পারে।
উচ্চ কোলেস্টেরল: রক্তে অধিক পরিমাণে চর্বি থাকলে সেই অবস্থাকে হাইপারলিপিডেমিয়া বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা বা ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন- হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি। প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম এবং অ্যাস্করবিক অ্যাসিড উপস্থিত থাকলে চর্বির ওপরে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেখা গেছে, ডাবের পানি মোট কোলেস্টেরল (টিসি) এবং খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা হ্রাস করে এবং ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) মাত্রা বৃদ্ধি করে।
ডায়াবেটিস: দীর্ঘসময় ধরে হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে অত্যধিক পরিমাণে গ্লুকোজ থাকা) হলে তাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। ডাবের পানির হাইপোগ্লাইসেমিক (রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম করা) ধর্ম আছে। প্রাণীদের নিয়ে করা একটি গবেষণা দেখাচ্ছে যে, ডাবের পানি রক্তের গ্লুকোজ এবং গ্লাইকোসাইলেটেড হেমোগ্লোবিনের মাত্রা হ্রাস করতে পারে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কোনো কিছুরই অতিরিক্ত ভালো নয়। যদিও ডাবের পানি স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী, তবুও এর কিছু খারাপ প্রভাব এবং অসুবিধা আছে।
হাইপারক্যালেমিয়ার: উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম হাইপারক্যালেমিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। সুস্থ হৃদয় এবং পেশির জন্য পটাশিয়ামের সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রয়োজন। অত্যধিক পরিমাণে ডাবের পানি পান করলে দেহে পটাশিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে হৃদ-স্পন্দনের তালে বিপজ্জনক এবং মারাত্মক পরিবর্তন আসতে পারে।
রক্তচাপ হ্রাস: ডাবের পানি রক্তচাপ হ্রাস করে। তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য এটি উপকারী। কিন্তু যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কম, তারা ডাবের পানি পরিহার করবেন। কারণ এটি রক্তচাপকে আরও নামিয়ে আনতে পারে।
ডাবের পানি পানে সতর্কতা
ডাবের পানিতে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে। ফলে কিডনি রোগীদের জন্য ডাবের পানি ক্ষতির কারণ হতে পারে। ঠাণ্ডা ও সর্দির রোগী, অ্যালার্জির রোগীদেরও ডাবের পানি পানে সতর্ক থাকতে হবে।
কলি