প্রকৃতিতে বিষাক্ত এবং নির্বিষ উভয় ধরনের সাপ রয়েছে। বিষাক্ত সাপ তার বিষ দিয়ে শিকার করতে, নিজেকে রক্ষা করতে এবং খাবার হজম করতে ব্যবহার করে। প্রতি বছর আমাদের দেশে সাপের দংশনে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। শহরের চেয়ে গ্রামে সাপের দংশনে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। বিষধর সাপের দংশনে মৃত্যুর অন্যতম কারণ সচেতনতার অভাব, সঠিক চিকিৎসার অভাব বা চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হওয়া। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ওয়েবসাইট অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফখরুল ইসলাম
একেক প্রজাতির সাপ একেক ধরনের বিষ বহন করে, যা মানুষের শরীরে বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে। যেমন-
সাইটোটক্সিনস: দংশন স্থানে ফোলাভাব থাকে এবং টিস্যুর ক্ষতি করে।
হেমোরেজিনস: রক্তনালিগুলোকে আক্রমণ করে।
নিউরোটক্সিন: স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। ফলে পক্ষাঘাত দেখা দেয়।
মায়োটক্সিন: মাংসপেশি ভেঙে দেয়।
আক্রমণের সময় প্রাথমিকভাবে বিষাক্ত এবং নির্বিষ সাপের দংশনের মধ্যে পার্থক্য যদি করতে না পারেন, তাহলে সব দংশনকেই গুরুতর হিসেবে ধরতে হবে। কারণ বিষাক্ত সাপের দংশনের পরে চিকিৎসায় যেকোনো বিলম্বের ফলে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।
সাপের দংশনের লক্ষণগুলো কী কী?
কোন ধরনের সাপ দংশন করেছে তার ওপর ভিত্তি করে সাপের দংশনের লক্ষণ পরিবর্তিত হয়। নির্বিষ সাপের ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থান হালকা ফোলা থাকতে পারে। এ ছাড়া ত্বকের রঙের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন- লালভাব বা গাঢ় রং দেখা দিতে পারে। দংশনের জায়গায় রক্তপাত হতে পারে।
বিষধর সাপের দংশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে আক্রান্ত স্থানে দংশনের চিহ্ন এবং ক্ষত। এ ছাড়া দংশন স্থানে অথবা শরীরজুড়ে ব্যথা। তবে সব বিষধর সাপের দংশনে ব্যথা হয় না। এ ছাড়া ত্বকের রং পরিবর্তন হতে পারে। হতে পারে অতিরিক্ত ঘাম। বমি বমি ভাব এবং বমি হতে পারে। মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং ঝাপসা দৃষ্টি হতে পারে। মুখের স্বাদ পরিবর্তন হতে পারে।
মারাত্মক বিষধর সাপের দংশনের গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্তপাত, যা বন্ধ হয় না। নিম্ন রক্তচাপ, দ্রুত হৃৎস্পন্দন এবং দুর্বল পালস। শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া। মুখ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দুর্বলতা, মোচড়ানো এবং অসাড়তা। মারাত্মক ফোলা।
সাপের দংশনে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ
রোগীর যদি সাপের দংশনে অ্যালার্জি থাকে তবে তিনি অ্যানাফিল্যাকটিক শকে যেতে পারেন। তখন তার মধ্যে বিষধর সাপের দংশনের লক্ষণগুলো ছাড়াও, অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে আছে গলা শক্ত হওয়া, জিহ্বা ফোলা এবং কথা বলতে অসুবিধা। ফ্যাকাশে ত্বকের রং। অবিরাম কাশি এবং শ্বাসকষ্ট।
রোগ নির্ণয় এবং পরীক্ষা
চিকিৎসক রোগীর লক্ষণগুলো পর্যালোচনা করে সাপের দংশন নির্ণয় করে থাকেন। ক্ষতচিহ্ন দেখে ডাক্তার সাপের দংশন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষা করে রোগীর শরীরে বিষ আছে কি না, তা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
নির্বিষ সাপের দংশনের চিকিৎসা
নির্বিষ সাপের দংশনের চিকিৎসা হলো ক্ষতের সঠিক যত্ন। এর মধ্যে আছে সাবান এবং পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার করা। এরপর ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে নেওয়া। আক্রান্ত এলাকাটি যদি ফুলে যায়, পুঁজ হয় বা ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে সেটা চিকিৎসককে জানাতে ভুলবেন না।
বিষাক্ত সাপের দংশনের চিকিৎসা
বিষাক্ত সাপের দংশনের চিকিৎসা হলো অ্যান্টিভেনম নেওয়া। অ্যান্টিভেনম হলো এক ধরনের অ্যান্টিবডি থেরাপি, যা রোগীর শরীরে বিষের প্রভাব কমিয়ে দেয়। ইনজেকশন হিসেবে রোগীর বাহুতে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। দংশনের পর যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টিভেনম নিতে হয়। যেহেতু অ্যান্টিভেনমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তাই রোগীকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।
সাপের দংশনের প্রাথমিক চিকিৎসা
সাপের দংশনকে একটি জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তাই সাপ দংশন করলে প্রথমেই সাহায্যের জন্য জরুরি নাম্বারে কল করে পরিস্থিতি জানাতে হবে এবং অ্যাম্বুলেন্স চাইতে হবে। রোগীকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে হবে। আশপাশে থাকা লোকদের জানাতে হবে যে, এখানে একটি সাপ আছে এবং এটি একজনকে দংশন করেছে। এরপর রোগীকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এসে শুইয়ে দিন। শরীরে আঁটসাঁট পোশাক থাকলে ঢিলে করে দিন। বেল্ট, গয়না, ঘড়ি ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন। সাবান পানি দিয়ে দংশনের জায়গাটি আলতো করে ধুয়ে ফেলুন। ক্ষতটি পরিষ্কার, শুকনো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন। দংশনের আশপাশের ত্বকে কোনো ফোলাভাব বা পরিবর্তন দেখা গেলে নোট করে নিন। এরপর দ্রুততম সময়ে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
যা করা যাবে না
সাপ দংশন করলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। এ সময় রোগীকে শান্ত রাখুন। সাপকে হত্যা করতে বা ধরতে তার পেছনে পেছনে যাবেন না। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার সাপ দংশনের আশঙ্কা থাকে। সাপ মরে গেলেও বিষ ছাড়তে পারে। রোগীর ক্ষত কাটাছেঁড়া করা যাবে না। মুখের সাহায্যে বিষ বের করার চেষ্টা করা যাবে না। ক্ষতস্থানে আরাম পেতে বরফ প্রয়োগ করবেন না বা পানি ঢালবেন না। এ সময় অ্যালকোহল পান করা যাবে না। ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় অর্থাৎ চা কফি পান করা যাবে না। আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিনের মতো ব্যথা-উপশমকারী ওষুধ খাওয়া যাবে না।
চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অ্যান্টিভেনমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো সিরাম সিকনেস ডিজিজ। অ্যান্টিভেনম পাওয়ার ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এটি ঘটতে পারে। রোগী যদি নিম্নলিখিত উপসর্গগুলোর মধ্যে কোনোটি অনুভব করেন তবে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যেমন- ত্বকে ফুসকুড়ি ও চুলকানি। হাত-পায়ের সংযোগে ব্যথা। জ্বর। ফোলা লিম্ফ নোড।
সুস্থ হতে কত সময় লাগে
সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হতে কতটা সময় লাগবে, তা নির্ভর করে সাপের বিষের ধরনের ওপর। গড়ে ভালো বোধ করতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। কিছু রোগীর নিরাময়ের জন্য অন্যদের চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকবেন, যাতে ডাক্তাররা তার রক্তচাপ এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এরপর নিরাময় শেষ করতে বাড়িতে ফিরে যেতে পারেন।
কলি