ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত একটি সাধারণ ব্যাধি। পরজীবী প্লাসমোডিয়ামের কারণে এটি ছড়ায়। মশা এই রোগ বহন করে থাকে। সারা বিশ্বে মানুষের মারণরোগের মধ্যে এটি অন্যতম। মাই উপচার ওয়েবসাইট অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফখরুল ইসলাম
ম্যালেরিয়া কী
প্রতিবছর ম্যালেরিয়ার কারণে ৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সমীক্ষা বলছে, ম্যালেরিয়ার কারণে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একটি করে শিশুর মৃত্যু হয়। এই রোগের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং সুদূর ৬০০০ বিসিতেও একই ধরনের জ্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্লাসমোডিয়ামের পাঁচটি প্রজাতি ম্যালেরিয়া ছড়ায়- পি ফ্যালসিপেরাম, পি ভাইভ্যাক্স, পি ওভালে, পি কোলেস এবং পি ম্যালারিয়ে। মেয়ে অ্যানোফিলিস মশা (যা হচ্ছে রোগের বাহক বা ভেক্টর) মানুষকে কামড়ালে পরজীবীটি সংক্রমিত হয়। একবার পরজীবীটি মানুষের রক্তে প্রবেশ করলে তা বেড়ে ওঠে এবং যকৃতে তার বৃদ্ধি হতে শুরু করে এবং তারপর এটি লোহিত রক্তকণিকা আক্রমণ করে তাদের ধ্বংস করে।
ম্যালেরিয়ার উপসর্গ
ম্যালেরিয়ার উপসর্গ দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা আছে- সরল এবং জটিল বা প্রবল।
সরল ম্যালেরিয়ার উপসর্গ: সরল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে ম্যালেরিয়ার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সব উপসর্গই দেখা যায়, কিন্তু এসব উপসর্গের সঙ্গে জটিল সংক্রমণের উপসর্গগুলো থাকে না এবং শরীরের প্রধান অঙ্গগুলোর ক্ষতি হয় না।
সরল ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা না হলে তা জটিল আকার ধারণ করে। যে ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তার জটিল ম্যালেরিয়া হতে পারে। ম্যালেরিয়ার উপসর্গ ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা থাকে এবং একদিন অন্তর এই উপসর্গ ফিরে ফিরে আসে। পরজীবীর প্রকৃতির ওপর এই উপসর্গগুলো পরিবর্তিত হতে পারে, কোনো কোনো সময়ে মিশ্র উপসর্গও দেখা যায়।
সরল ম্যালেরিয়ার উপসর্গ: কাঁপুনির সঙ্গে শীত ভাব। খুব বেশি জ্বর, মাথাব্যথা এবং বমি। কম বয়সী রোগীদের তড়কা হতে পারে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়া এবং ক্লান্তি এবং অবসন্ন বোধ।
জটিল ম্যালেরিয়ার উপসর্গ: জটিল ম্যালেরিয়ায় যেসব উপসর্গ দেখা যায় তাতে বোঝা যায় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জটিল ম্যালেরিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ হলো জ্বর এবং কাঁপুনি। জেগে থাকা এবং সচেতনতা হ্রাস পাওয়া থেকে অচেতনতার সমস্যা। উপুড় হয়ে শোবার ইচ্ছা (বুক নিচে করে শোয়া)। গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া, শ্বাস নেওয়ার অসুবিধা। ক্লান্তি এবং সাধারণ দুর্বলতা। জন্ডিসের চিহ্ন, যেমন- চোখের সাদা অংশ এবং নখ হলুদ হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের রং অতিরিক্ত হলুদ বর্ণ হয়ে যাওয়া। চিকিৎসা না হলে জটিল ম্যালেরিয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ম্যালেরিয়ার উপসর্গের সঙ্গে সাধারণ ফ্লু বা ভাইরাল জ্বরের উপসর্গের মিল আছে এবং যারা আগে আক্রান্ত হননি, তাদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় সমস্যা থাকে।
ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা
ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধের নানা প্রকারভেদ আছে। সেগুলো হলো:
টিস্যু স্কিজন্টিসাইডস: যকৃতে অবস্থানকারী পরজীবীর ওপরে এই ওষুধ কাজ করে এবং তাদের বৃদ্ধি রোধ করে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা শুধু এই ওষুধে হয় না। কারণ যখন পরজীবীর বৃদ্ধি হয় এবং তারা লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করতে শুরু করে দেয়, তখনই ম্যালেরিয়ার উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গ দেখার আগে কার্যত সংক্রমণের উপস্থিতি বুঝতে পারা অসম্ভব।
পুনরায় আক্রমণের জন্য টিস্যু স্কিজন্টিসাইডস: পরজীবীদের কিছু যকৃতে উপস্থিত থাকতে পারে, যা পুনরায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটাতে পারে, তাদের ওপর এই ওষুধ কাজ করে।
ব্লাড স্কিজন্টিসাইডস: পরজীবীদের রক্তের ফর্মের ওপর এই ওষুধগুলো কাজ করে এবং এগুলো হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধ।
গেমিয়োটোসাইটোসাইডস: এই ওষুধগুলো রক্তে উপস্থিত প্রজননক্ষম পরজীবীদের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং যেসব মশা আক্রান্ত রোগীদের কামড়ায়, তাদের সাহায্যে সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করে। এই শ্রেণিভুক্ত কিছু ওষুধ সব শ্রেণির ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে আর অন্যগুলো কিছু পরজীবীর ওপর কার্যকর থাকে।
স্পোরোন্টোসাইডস: এই ওষুধগুলো মশার মধ্যে সিস্ট গঠন এবং সংক্রমণ রোধ করে।
যুগ্ম থেরাপি: বিভিন্ন ওষুধ একযোগে ব্যবহার করে ম্যালেরিয়ার কার্যকর চিকিৎসা করা সম্ভব, যেগুলো একসঙ্গে যকৃতে এবং রক্তে উপস্থিত পরজীবীদের ওপর কাজ করে এবং সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধ করে। এই প্রক্রিয়াটি হলো, একযোগে দুটি অথবা তার বেশি ওষুধ ব্যবহার- যেগুলো পরজীবীদের বিভিন্ন অংশকে নিষ্ক্রিয় করে। এ ধরনের চিকিৎসা করলে চিকিৎসার সময় কম হয় এবং প্রতিরোধী পরজীবীদের বৃদ্ধির আশঙ্কা কমায়।
সংক্রমণের প্রকৃতি কী রকম, সংক্রমণ কতটা প্রবল, রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি এবং রোগের ওপর একযোগে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের পন্থা নির্ভর করে।
যেসব ব্যক্তি পি ফ্যালসিপেরামে আক্রান্ত, তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরীক্ষণ এবং পরীক্ষা করতে হবে। কারণ এটি অপেক্ষাকৃত কঠিন সংক্রমণ এবং ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কোনো প্রসূতি সংক্রমিত হলে তাকে বিভিন্ন ওষুধ সম্মিলিতভাবে দিতে হবে। কারণ কিছু ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্রসূতিদের পক্ষে নিরাপদ নয়। চিকিৎসকদের দেখতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃগী, হৃদরোগ, রেনাল ফেলিওর এবং চর্মরোগের ইতিহাস আছে কি না। কারণ এসব রোগীর ক্ষেত্রে হয় বিভিন্ন ওষুধ সম্মিলিতভাবে দিতে হবে, নাহলে বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ দিতে হবে।
কলি