মাঙ্কিপক্স, যাকে এমপক্সও বলা হয়, এটি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট গুটিবসন্তের মতো একটি রোগ। আফ্রিকার বেশির ভাগ অঞ্চলে রোগটি দেখা যায়। তবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও রোগটি হতে দেখা যাচ্ছে। মাঙ্কিপক্স হলে জ্বর, ঠাণ্ডা ও ফ্লু-এর মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া শরীরের বেশির ভাগ এলাকায় ফুসকুড়ি হয়, যা পরিষ্কার হতে কয়েক সপ্তাহ সময় নিতে পারে। মাঙ্কিপক্স সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়। আমেরিকার স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্লেভারল্যান্ড ক্লিনিক অবলম্বনে লিখেছেন ফখরুল ইসলাম
মাঙ্কিপক্স সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া এটি প্রাণী থেকেও মানুষের দেহে আসতে পারে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের দুটি প্রকার রয়েছে। প্রথমটি মধ্য আফ্রিকান ক্লেড-১ এবং দ্বিতীয়টি পশ্চিম আফ্রিকান ক্লেড-২। বর্তমান বিশ্বে মাঙ্কিপক্সের যে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তা ক্লেড-২-বি দ্বারা সৃষ্ট। এটি পশ্চিম আফ্রিকান ক্লেডের একটি উপপ্রকার।
মাঙ্কিপক্সের উৎপত্তি কোথায়?
মাঙ্কিপক্স রোগটি কয়েক দশক ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে। তবে এটি মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও হতে দেখা গেছে। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে, একজন মার্কিন বাসিন্দার মধ্যে মাঙ্কিপক্সের একটি কেস পাওয়া গেছে, যিনি নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। তারপর ২০২২ সালে ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ আফ্রিকার বাইরের অঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ ও উপসর্গ কী কী?
মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পরে লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েক দিন বা সপ্তাহ পার হয়ে যেতে পারে। মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত জ্বর। এ ছাড়া শরীরে ফুসকুড়ি থাকতে পারে। ফোলা লিম্ফ নোড, ঠাণ্ডার সমস্যা, মাথাব্যথা, পেশি ব্যথা ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
আক্রান্তের পর শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এগুলোয় ব্যথা থাকতে পারে। ফুসকুড়িগুলো ধীরে ধীরে ফোস্কায় পরিণত হয়, যা পুঁজে ভরে যায়। শেষ পর্যন্ত, ফোস্কাগুলো শুকিয়ে যায় এবং পড়ে যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। রোগীর মুখ, হাত, পা, লিঙ্গ, যোনি এবং মলদ্বারে ফুসকুড়ি হতে পারে।
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীদের সবার মধ্যে সব ধরনের লক্ষণ দেখা দেয় না। কারও মধ্যে শুধু একটি ফুসকুড়ি হতে পারে। অনেকের মধ্যে ফ্লুর মতো উপসর্গ, সঙ্গে ফুসকুড়ি হতে পারে। কিছু রোগীর একেবারেই ফুসকুড়ি নাও থাকতে পারে।
মাঙ্কিপক্স যেভাবে ছড়ায়
যখন কেউ ভাইরাসবাহী প্রাণী বা ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে তখন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারেন। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মধ্যে এটা ছড়ায়। কেউ যদি সংক্রমিত ব্যক্তির ঘা, স্ক্যাবস, নিশ্বাস-প্রশ্বাস অথবা লালার সংস্পর্শে আসে তবে তার মধ্যে রোগটি দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ পরিস্থিতি যেমন- আলিঙ্গন, চুম্বন বা যৌন আচরণ করে তাহলেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে ভাইরাসটি বীর্য বা যোনি তরলের মাধ্যমে ছড়ায় কি না, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা এখনো নিশ্চিত নন। সুস্থ ব্যক্তি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা দূষিত সামগ্রী যেমন পোশাক, বিছানা, জুতার সংস্পর্শে এসেও মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারেন।
পশু থেকে ব্যক্তির মধ্যেও মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ ঘটে। যেমন- কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে অথবা সংক্রমিত পশুর রক্ত, শারীরিক তরল বা পক্সের ক্ষত (ঘা) এর সঙ্গে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে।
কীভাবে মাঙ্কিপক্স নির্ণয় করা হয়?
যেহেতু মাঙ্কিপক্স বিরল, সেহেতু প্রথম দেখায় একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী সমস্যাটিকে হাম বা চিকেনপক্সের মতো অন্যান্য ফুসকুড়ি অসুস্থতা হিসেবে সন্দেহ করতে পারেন। তবে ফোলা লিম্ফ নোড সাধারণত অন্যান্য পক্স থেকে মাঙ্কিপক্সকে আলাদা করে।
মাঙ্কিপক্স শনাক্ত করতে ডাক্তার রোগীর খোলা ঘা (ক্ষত) থেকে টিস্যুর নমুনা নেন। তারপর পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পরীক্ষার (জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং) জন্য ল্যাবে পাঠান। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস বা রোগীর ইমিউন সিস্টেম যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তা পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করা যায়।
মাঙ্কিপক্স কি নিরাময়যোগ্য?
মাঙ্কিপক্স সাধারণত একটি স্ব-সীমিত রোগ (চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়)। এটি দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে রোগ নির্ণয়ের পরে ডাক্তার রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে উপসর্গগুলো উপশম করার চেষ্টা করেন। সাধারণত রোগীর ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ এবং সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিকাশ হলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, মাঙ্কিপক্সের জন্য বর্তমানে অনুমোদিত কোনো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই।
কীভাবে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধ করবেন?
মাঙ্কিপক্সের টিকা নিয়ে রোগটি থেকে নিরাপদে থাকা যায়। টিকা ছাড়া মাঙ্কিপক্সের বিস্তার রোধে অন্যান্য উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে সংক্রমিত প্রাণীদের (বিশেষ করে অসুস্থ বা মৃত প্রাণী) সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। বিছানাপত্র এবং ভাইরাস দ্বারা দূষিত অন্যান্য উপকরণ স্পর্শ না করা। পশুর মাংস বা অংশ আছে এমন সব খাবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রান্না করা। সাবান পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া। ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। কনডম এবং ডেন্টাল ড্যাম ব্যবহারসহ নিরাপদ যৌন অভ্যাস করা। এমন মাস্ক পরা, যা অন্যের আশপাশে থাকাকালীন মুখ এবং নাক ঢেকে রাখে। ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যত্ন নেওয়ার সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) ব্যবহার করা।
অন্যান্য তথ্য
মাঙ্কিপক্স সেরে উঠতে সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ সময় নেয়। এটি বিরল রোগ, কিন্তু কখনো কখনো মারাত্মক আকারে দেখা দেয়। মাঙ্কিপক্স ছাড়াও নিউমোনিয়া এবং মস্তিষ্কে সংক্রমণ (এনসেফালাইটিস) অথবা চোখের সমস্যা (জটিলতা) দেখা দিতে পারে, যা জীবন সংহারি।
কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?
রোগীর মধ্যে যদি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো বিকাশ করে, তবে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা। এ ছাড়া ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তি বা স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে অসুবিধা, কথা বলতে বা চলাফেরা করতে অসুবিধা হওয়া। পাশাপাশি চেতনা হারানো ও খিঁচুনির মতো লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
কলি