আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস
মানসিক চাপ, বর্তমান সময়ে গুরুত্ব না দেওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর রোগগুলোর একটি। মানসিক চাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে, জীবননাশের চিন্তাভাবনাও করে থাকেন অনেকেই। চলুন জেনে নিই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছু উপায়। মাই উপচার অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফারজানা আলম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গবেষণামতে, ২০১৯ সালে প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জন মানসিক রোগে ভুগছে। ২০২০ সাল থেকে কোভিড-১৯ সমস্যার কারণে এই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে ভুগছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা অন্যান্য মানসিক চাপজনিত রোগে আক্রান্ত।
শুধুই কি প্রাপ্তবয়স্করাই? না, এই তালিকায় রয়েছে কিশোর-কিশোরীরাও। বিএমজি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে জানা যায়, বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশের মাঝেই মানসিক চাপ সংক্রান্ত লক্ষণ দেখা গেছে। আর মানসিক চাপের উপসর্গ মিলেছে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
মানসিক চাপ কী?
মানসিক চাপ হলো এক ধরনের মানসিক পরিস্থিতি যেখানে ব্যক্তির চাহিদা ও ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সাধারণ অর্থে বলা যায়, আমরা যখন কোনো কাজ করতে যাই, তখন সেটার পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে যখন করতে না পারি তখন মানসিকভাবে চাপ অনুভব করি।
মানসিক চাপের কারণে একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে করে সে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। মানসিক চাপ একেকজনের জন্য একেক রকম হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ব্যক্তি তার চাকরি হারানোর কারণে মানসিক চাপের শিকার হতে পারেন। এক্ষেত্রে তার মধ্যে অনিদ্রা, উদ্বেগ এবং হতাশার মতো অনুভূতির ছাপ লক্ষণীয় হবে। অন্যদিকে, একজন মা তার সন্তানের অসুস্থতার কারণে মানসিক চাপের শিকার হতে পারে। এই চাপের ফলে সে নিরাশ, ভীত এবং হতাশ বোধ করতে পারে।
এক্ষেত্রে দেখা যায় একেকজনের পরিস্থিতি অনুযায়ী মানসিক চাপের লক্ষণগুলোয় ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। তবে সবার প্রথমেই যেটা বুঝতে হবে তা হলো মানসিক চাপের কারণ। এবার সেটাই জেনে নেওয়া যাক।
মানসিক চাপের কারণ
এই পর্যায়ে জানব ঠিক কী কী কারণে একজন মানুষ মানসিক চাপে ভুগতে পারে। উল্লেখ্য যে, সবার জন্য সবগুলো কারণ একত্রে পরিলক্ষিত হবে বিষয়টা এরকম না। এক্ষেত্রে কারও কম-বেশি হতে পারে। সাধারণত, সব মানসিক চাপ মূলত দুটি কারণে হয়ে থাকে। ১) অভ্যন্তরীণ কারণ ও ২) বাহ্যিক কারণ। সে কারণগুলোর বিস্তারিত জেনে নিন।
অভ্যন্তরীণ কারণ
দুশ্চিন্তা থেকে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
হীনম্মন্যতা বা নিজেকে ছোট করে দেখার জন্য হতাশা সৃষ্টি হয়, যা মানসিক চাপের কারণ।
বিষণ্নতা মনকে খারাপ করে ফেলে, যা মানসিক চাপ বাড়ায়।
অন্যান্য শারীরিক কারণ, যেমন- মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধা হ্রাস, ওজন হ্রাস-বৃদ্ধি ইত্যাদি।
বাহ্যিক কারণ
পারিবারিক সম্পর্কের মন্দ অবস্থা ও কলহ।
কর্মক্ষেত্র বা অতিরিক্ত কাজের চাপ।
বেকারত্বের দুশ্চিন্তা।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা।
সম্পর্কজনিত চাপ (বিচ্ছিন্ন, সম্পর্কের অবনতি, ঝগড়া)।
মানসিক চাপের লক্ষণ
মানসিক চাপ কমানোর উপায় সম্পর্কে জানার আগে এর লক্ষণগুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে। এজন্য আমরা তিনটি মাধ্যম লক্ষ করতে পারি। এগুলো হলো- শারীরিক লক্ষণ, মানসিক লক্ষণ ও আচরণগত লক্ষণ। একটু বিস্তারিত জানা যাক।
শারীরিক লক্ষণ: যখন মানসিক চাপ অনুভব করবেন তখন বিভিন্ন লক্ষণ পরিলক্ষিত হতে পারে। এর মধ্যে আছে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ঘুমের অসুবিধা, বমি বমি ভাব, বদহজম হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া অথবা কমে যাওয়া, নিজের মধ্যে অস্বস্তিবোধ করা এবং অসুস্থতায় ভোগা।
মানসিক লক্ষণ: মানসিক চাপ যখন তীব্র হয় তখন সাধারণত এই বিষয়গুলো ঘটতে পারে। যেমন- উদ্বেগ, ভয়, বিরক্তি ভাব, অল্পতেই রাগ, হতাশা, নিঃসঙ্গতা অনুভব, অসহায় বোধ করা, অনিশ্চয়তায় ভোগা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসুবিধা হওয়া।
আচরণগত লক্ষণ: প্রায় দেখা যায়, মানসিক চাপে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ এমন হয়ে থাকে। যেমন ধূমপান করা, অ্যালকোহল বা ড্রাগ ব্যবহার, অতিরিক্ত খাওয়া কিংবা খাওয়া কমিয়ে দেওয়া, রাতে ঘুম না হওয়া, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সমাজ থেকে নিজেকে আড়াল করা।
তাছাড়া ব্যক্তির স্বভাব অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই এই লক্ষণগুলোর বাইরেও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় কিংবা লক্ষণগুলো অল্প কিংবা বেশি পরিলক্ষিত হতে পারে।
মানসিক চাপ কমানোর কার্যকরী উপায়
এই লক্ষণ যদি কারও মধ্যে থাকে কিংবা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে কেউ যায়, সেক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর উপায় সম্পর্কে জেনে পদক্ষেপ নেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আসুন তবে জেনে নিই মানসিক চাপ কমানোর উপায় সম্পর্কে।
ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করা
আমরা যার যার ধর্ম অনুসরণ করতে পারি। যিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা যাকে আমরা নির্দ্বিধায় নিজের মনের সব কথা বলতে পারি। ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের দিক থেকে আমরা প্রার্থনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যার কথা সৃষ্টিকর্তাকে জানানোর মাধ্যমে নিজের ভেতর প্রশান্তি নিয়ে আসতে পারি। যে সমস্যাগুলোর জন্য মানসিক চাপ অনুভব হচ্ছে, প্রার্থনার মাধ্যমে সেগুলো থেকে মুক্তি চাইতে পারি।
কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিন, হাঁটতে বেরিয়ে পড়ুন
অতিরিক্ত কাজের চাপে যখন অবসাদ চলে আসে, মানসিক চাপ অনুভব হয় তখন কিছু সময়ের জন্য সবকিছু থেকে বিরতি নিন। এক্ষেত্রে হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে। ড. মনিক টেলো বলেন, ‘যদি খুব বেশি চাপ অনুভব করেন তবে প্রকৃতির কাছে চলে যান।’ তিনি আরও বলেন, দ্রুত হাঁটা কিংবা একটু বাইরে যাওয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করা দ্রুত চাপ কমাতে সক্ষম।
রিল্যাক্সিং ব্রেথ ‘৪-৭-৮’ মেথড অনুসরণ করুন
৪-৭-৮ মেথড কিংবা রিল্যাক্সিং ব্রেথ পদ্ধতি অনুসরণ করে দ্রুত ঘুমানো ও মানসিক চাপ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তি পাওয়া যায়। ড. অ্যান্ড্রু ওলসন ২০১২ সালে তার বই ‘দ্য ওয়ান মিনিট মেড’-এ এই পদ্ধতিটি প্রকাশ করেন।
যেভাবে করবেন: আরামদায়ক অবস্থান নিন। পিঠ সোজা করে চেয়ারে বসুন বা বিছানায় শুয়ে পড়ুন। এবার আপনার জিভের ডগা ওপরের ঠোঁটের ঠিক পেছনে রাখুন। নাক দিয়ে ৪ সেকেন্ডের জন্য গভীর শ্বাস নিন। তারপর ৭ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস ধরে রাখুন। মুখ দিয়ে ৮ সেকেন্ডের জন্য ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। এই চক্রটি চারবার পুনরাবৃত্তি করুন।
পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটান
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে হিউম্যান বডিতে কর্টিসোল নামক হরমোন নিৎসৃত হয়, যা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পোষা প্রাণীর মধ্যে কুকুর ও বিড়ালের সঙ্গে থাকলে মানুষের একাকিত্ব ও অবসাদ কমে বলে ধারণা করা হয়। এক্ষেত্রে যদি আপনার নিজস্ব পোষাপ্রাণী হয় তবে খুব ভালো, তবে যদি না থাকে তবে আশপাশের প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটান, তাদের খাওয়ানোর মাধ্যমে মানসিক চাপ কমবে।
ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বিরতি নিন
আধুনিক সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসে হারিয়ে যাওয়াও ডিপ্রেশনের অন্যতম কারণ। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ ও ভয়াবহ এলগরিদমের কারণে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। ফলে নিজের কাজের প্রতি মনোনিবেশ নষ্ট হয় আর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
প্রিয় মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
মানসিক চাপ কমানোর উপায় হিসেবে প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো খুব কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা, বন্ধুত্ব ও পারিবারিক বন্ধন মানসিক চাপ কমায়। বিশ্বস্ত বন্ধু কিংবা আপন মানুষের সঙ্গে সমস্যার কথা খুলে বললে ধীরে ধীরে মাথা থেকে চাপ কমে আসে। নিজেকে খুব হাল্কা অনুভব করতে পারবেন। তাই আপনার প্রিয় মানুষদের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরুন, তাদের শরণাপন্ন হোন।
ভ্রমণে বের হন
মানসিক চাপ কমানোর আরেকটি ভীষণ কার্যকরী উপায় হলো ভ্রমণ করা। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে আমাদের মন সতেজ থাকে, নতুন নতুন মানুষ বিষয় ও মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলে আমরা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারি।
যারা ভ্রমণপিপাসু, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত। তাই আপনিও যদি মানসিক চাপ কমাতে চান তাহলে সারা দিনের কর্মব্যস্ততা, সাংসারিক কাজের মাঝেও কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য সময় বের করুন। যতটা সম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি ঘুরতে যান।
যোগব্যায়াম করুন
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষার জন্য খুব প্রাচীন ও সর্বস্বীকৃত উপায় হলো ইয়োগা বা যোগব্যায়াম। কয়েক ধরনের যোগব্যায়াম রয়েছে। এগুলোর ভূমিকা ভিন্ন হলে তারা একত্রে আপনাকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে।
যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখতে প্রাণায়াম, দুশ্চিন্তা দূর করতে ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে মেডিটেশন, শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে উত্তরাসন (Standing Forward Pose) করতে পারেন। যোগব্যায়াম করার সবচেয়ে উত্তম সময় হলো সূর্যাস্তের সময়। এ ছাড়া বিকেলে বা সন্ধ্যায়ও এটি করা যেতে পারে।
চুইংগাম চাবান
আপনি কাজের মধ্যে নানানভাবে অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছেন? মাথায় বিভিন্ন দুশ্চিন্তা ভর করে? এই সমস্যা এড়ানোর একটা উপায় হলো চুইংগাম চিবানো। চুইংগাম চিবানোর সময় আমাদের মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। ফলে কাজে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া যায়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি বেশ কার্যকর। ফলে কোনো বিষয় সহজেই আমাদের ব্রেইনের শর্ট-টার্ম মেমোরিতে সংরক্ষিত হয়।
পছন্দের কাজ করুন
ব্যক্তিভেদে ছোট-বড় এমন অনেক কাজ রয়েছে যেগুলো করলে ভেতর থেকে ভালো লাগা কাজ করে। এটা হতে পারে গান শোনা, বই পড়া, খেলাধুলা করা, মুভি দেখা, ঘুরতে যাওয়া। যখন এই কাজগুলোর মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা ভালো লাগা কাজ করবে। তাই মানসিক চাপ অনুভব করলেই তাৎক্ষণিক ব্রেক নিন এবং পছন্দের কাজ শুরু করুন।
মেহেদী আল মাহমুদ