গ্যাস্ট্রাইটিস পরিপাক নালির একটি অতি সাধারণ রোগ। পাকস্থলীর ভেতরের আস্তরণের প্রদাহ এবং জ্বালার কারণে এই রোগ হয়। এই প্রদাহের জন্য পেটের ওপর দিকে ব্যথা, জ্বালা, বুক জ্বালা, ঢেকুর তোলা, খাদ্য উগরানো, বমি ভাব এবং কখনো কখনো বমি হয়। মাই উপচার অবলম্বনে জানাচ্ছেন ফখরুল ইসলাম
পাকস্থলীর ভেতরের আস্তরণের (মিউকোসা) প্রদাহ বা জ্বালা হচ্ছে গ্যাস্ট্রাইটিস। সুস্থ মানুষের পাকস্থলীতে অ্যাসিড, বিভিন্ন প্রকারের এনজাইম এবং শ্লেষ্মা তৈরি হয়। গ্যাস্ট্রাইটিসের সময় শ্লেষ্মার পরিমাণ কমে যায়, ফলে নিজের তৈরি অ্যাসিডই পাকস্থলীকে আক্রমণ করে। ফলে পেটে ব্যথা এবং জ্বালা হয়। এর সঙ্গে খাবার উগরে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কখনো কখনো বমিও হয়। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং ওষুধ দিয়ে গ্যাস্ট্রাইটিসের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় করার হার খুবই বেশি।
সবার জীবনেই বিভিন্ন কারণে অন্তত একবার এই রোগ হয়। সংক্রমণ, ওষুধ, ধূমপান, মদ্যপান, চাপ এবং শরীরের প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কারণগুলো গ্যাস্ট্রাইটিস হওয়ার মূল কারণ। এই রোগ দীর্ঘস্থায়ী কিংবা তীব্র হতে পারে। যদি উপসর্গগুলো ঘন ঘন ও তীব্র হয় এবং কয়েক দিনের ভেতরে নিরাময় না হয় তখন তাকে অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রাইটিস বলা হয়। এর তুলনায় ক্রনিক গ্যাস্ট্রাইটিসের উপসর্গগুলো খুব কম বা মধ্য মাত্রার হয় এবং রোগ বছরের পর বছর চলতে থাকে।
উপসর্গ
বিভিন্ন প্রকারের গ্যাস্ট্রাইটিসের বিভিন্ন প্রকারের উপসর্গ দেখা যায়। সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলো হলো পাকস্থলী এবং বুকের মাঝখানে জ্বালা হওয়া। অনেক মানুষের কোনো উপসর্গই থাকে না, শুধু তাদের বদহজম হয়।
এ ছাড়া আরও যেসব উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে আছে পাকস্থলীতে অথবা পেটের ওপরের অংশে জ্বালা। পাশাপাশি অতিরিক্ত ঢেকুর তোলা, খাদ্যনালি বা মুখের মধ্যে খাদ্য উগরানো, পেট ফোলা, খাওয়ার পর পেট ভার, বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া। এ ছাড়া বদহজম হওয়া, ক্ষুধামান্দ্য হওয়া ও হেঁচকি ওঠা।
গ্যাস্ট্রাইটিসের কারণ এবং প্রকারের ওপর নির্ভর করে এর উপসর্গগুলোর তীব্রতা। নিম্নবর্ণিত লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। যেমন- পেটের ওপরের দিকে বা পাকস্থলীতে তীব্র ব্যথা (ছুরি মারা বা মোচড়ানোর মতো ব্যথা), রক্ত বমি (হেমাটেমেসিস), গাঢ় বা কালো রঙের মল, মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা। পাশাপাশি নিঃশ্বাসের অসুবিধা, দুর্বলতা, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
এই উপসর্গগুলো গুরুতর গ্যাস্ট্রাইটিস বা ক্ষয়কারী গ্যাস্ট্রাইটিসের ইঙ্গিত দেয়, যার জন্য জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু হওয়া প্রয়োজন।
চিকিৎসা
সৌভাগ্যবশত, সব রকমের গ্যাস্ট্রাইটিসের কার্যকরী চিকিৎসা এবং নিরাময় আছে। গ্যাস্ট্রাইটিস হওয়ার কারণ জানা গেলে তার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা করলে রোগ সেরে যায়। গ্যাস্ট্রাইটিসের চিকিৎসা তার উপসর্গ অনুযায়ী করা হয়।
এন্টাসিড: এই ওষুধে থাকে ম্যাগনেশিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়ামের লবণ, যেগুলো পাকস্থলীর অ্যাসিডকে নিষ্ক্রিয় করে ব্যথা এবং জ্বালা কমায়। তবে, এদের জন্য উদরাময় বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
প্রোটোন-পাম্প ইনহিবিটারস: এই রকমের ওষুধগুলো পাকস্থলীতে অ্যাসিডের উৎপাদন হ্রাস করে। এতে উপসর্গগুলো কমে যায় এবং জ্বালা ও প্রদাহের উপশম হয়। এই ধরনের কয়েকটি ইনহিবিটার হলো প্যান্টোপ্রাজোল, ওমিপ্রাজোল, রাবেপ্রাজোল এবং এসোমিপ্রাজোল।
এইচ টু ব্লকার্স: এই রকমের ওষুধগুলো পাকস্থলীতে অ্যাসিডের উৎপাদন হ্রাস করে কিন্তু এরা প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটারগুলোর চেয়ে কম কার্যকরী। এই রকমের কয়েকটি ওষুধ হলো-র্যানিটিডিন, নিজাটিডিন এবং ফ্যামোটিডিন।
অ্যান্টিবায়োটিক: যে ব্যাকটেরিয়াগুলো বিশেষত এইচ পাইলোরি, সংক্রমণ করে পাকস্থলীর আস্তরণের ক্ষতি করে, এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সেই ব্যাকটেরিয়াগুলোর বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে এবং তাদের ধ্বংস করে। এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর উদাহরণ হচ্ছে এমোক্সিসিলিন, মেট্রোনিডাজোল অথবা ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতির সম্মিলন করে এবং সঙ্গে জীবনধারার পরিবর্তন করে গ্যাস্ট্রাইটিসের চিকিৎসা করা হয়।
জীবন ধারার ব্যবস্থাপনা
স্বাভাবিক জীবনধারার ওপর গ্যাস্ট্রাইটিসের প্রভাব আছে। বিশেষত তীব্র গ্যাস্ট্রাইটিসের ক্ষেত্রে জীবন ধারার পরিবর্তন প্রয়োজন যাতে জটিলতা না হয়, কারণ শুধু ওষুধ যথেষ্ট নয়। গ্যাস্ট্রাইটিসের জন্য জীবন ধারার যে সামান্য পরিবর্তন প্রয়োজন হয় তা হলো-
খাবার পরিকল্পনা: নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বারবার অল্প করে খাবার খাওয়া ভালো। কারণ একসঙ্গে অনেকটা খাবার খেলে পেটে অ্যাসিডের উৎপাদন বেশি হয়। এ ছাড়া পাকস্থলীর ধারণক্ষমতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিক খাদ্য পেটে গেলে উগরানোর সম্ভাবনা থাকে। অধিকন্তু, দুবার খাদ্যগ্রহণের মধ্যে সময়ের অধিক তফাৎ থাকায় অ্যাসিডের উৎপাদন হতে পারে, যা পাকস্থলীর আস্তরণের আরও ক্ষতি করতে পারে।
প্রোবায়োটিকসের ব্যবহার: অন্ত্রের স্বাভাবিক জীবাণুগুলোর বৃদ্ধিতে প্রোবায়োটিকগুলো সহায়তা করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগের উপশম হয়। কিন্তু এগুলো পাকস্থলীর অ্যাসিডের ক্ষরণ রোধ করে না। দই এবং বাটার মিল্ক হলো প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিক। এগুলো খেলে সমস্যার সমাধান হয়।
মদ্যপান পরিত্যাগ: মদ পাকস্থলীর ভেতরের আস্তরণের ক্ষতি করে।
ধূমপান পরিত্যাগ: ধূমপান আরেকটি অভ্যাস যা পাকস্থলীতে অ্যাসিডের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে।
মসলাযুক্ত খাদ্য পরিহার করা: মসলাযুক্ত এবং ঝাল খাদ্য পাকস্থলীতে অ্যাসিড উৎপাদন করে ভেতরের আস্তরণের ক্ষতি করে।
ব্যথার ব্যবস্থাপনা: অন্যান্য বিকল্প ব্যথা হ্রাস করার উপায়গুলো বা ওষুধগুলো পাকস্থলীতে অ্যাসিডের ক্ষরণ হ্রাস করতে সাহায্য করে।
ওজনের ব্যবস্থাপনা: ওজন হ্রাস করতে পারলে বা বি-এম-আইয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে গ্যাস্ট্রাইটিসের তীব্রতা হ্রাস করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া খাদ্যের সঙ্গে ফল, সবজি এবং গোটা শস্য গ্রহণ করলে পাকস্থলীর উপকার করে।
মানসিক চাপের ব্যবস্থাপনা: মানসিক চাপের কারণেও পাকস্থলীতে অ্যাসিড বেশি তৈরি হয়। চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে যোগ ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং ধ্যান করা খুব উপকারী।
মেহেদী