ত্বকের সাধারণ একটি সমস্যা শ্বেতি রোগ, যাতে ত্বক বা চর্ম সাদা হয়ে যায়। তবে সব সাদা ত্বকই কিন্তু শ্বেতি নয় এবং এটি প্রাণঘাতী বা ছোঁয়াচেও নয়। যে কারও শ্বেতি হতে পারে, যার আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশেই রয়েছে। হেলথ লাইন অবলম্বনে লিখেছেন ফারজানা আলম
ত্বকে থাকে ‘মেলানোসাইট’ নামের এক ধরনের কোষ। এই কোষ দেহে একটি রঞ্জক পদার্থ তৈরি করে, যার নাম ‘মেলানিন’। মেলানিন শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের ত্বক, চোখ ও চুলের রং নির্ধারণ করে থাকে।
সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে। যাদের চামড়া কালো, তাদের ত্বকে সহজে ক্যানসার হয় না এই মেলানিনের জন্য।
এ জন্য বলা যায়, যাদের ত্বক কালো তাদের ত্বক ভালো। সাদা ত্বকে ঝুঁকি বেশি।
দেহে জীবাণু প্রবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাকে ধ্বংস করে দেয় মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম। তবে মজার ব্যাপার হলো, শরীরের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই মেলানিন সৃষ্টিকারী কোষ মেলানোসাইটকে চিনতে পারে না। বাইরের কোনো শত্রু মনে করে তাকে আক্রমণ করে বসে এবং ধ্বংস করে দেয়।
এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে মেলানিন নামের অতি প্রয়োজনীয় এই কালো রঞ্জক পদার্থের স্বল্পতা দেখা দেয়। তখন ত্বকের কোষগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় অথবা মারা যায়। আর এ থেকেই শ্বেতির মতো রোগের সূত্রপাত হয়। সহজ কথায়, শ্বেতি রোগ হলে ত্বক প্রয়োজনীয় মেলানিন হারায়।
কারণ
ম্যালাসেজিয়া ফারফার নামের এক ধরনের ছত্রাক শ্বেতি রোগের জন্য দায়ী। এই ছত্রাক আক্রান্ত স্থানে তৈরি করে অ্যাজালাইক অ্যাসিড, যা ত্বকের রং নির্ধারক উপাদান পিগমেন্ট খেয়ে ফেলে। ফলে ওই স্থানটি সাদা বর্ণ ধারণ করে। ত্বকের এই রং পরিবর্তন হওয়াকে বলে পিটেরেসিস ভার্সিকালার। এ ছাড়া মানসিক চাপ, রোদে ত্বক বেশি পুড়ে যাওয়া বা সানবার্ন ইত্যাদি পরিবেশগত প্রভাব, ফাঙাল ইনফেকশন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, বংশগত কারণ (৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে) ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়।
কাদের হয়
যে কারও শ্বেতি রোগ হতে পারে, তবে ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের বেশি হয়। যাদের ডায়াবেটিস ও হাইপার থাইরয়েড রয়েছে, তাদের হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগ বেশি হয়। শ্বেতি রোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন-
শরীরের যেকোনো স্থানেই এই ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। তবে সাধারণত মুখ, বুক, পিঠ, হাতে ও পায়ে এর সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
মুখ, চোখ, হাত-পায়ের আঙুলের চারপাশের রং লোপ পেতে পারে (অ্যাকরাল ভেটিলিগো)।
আবার কারও ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন স্থানে অল্প পরিসরে সাদা হতে পারে (সেগমেন্টাল ভিটিলিগো)।
লক্ষণ
এই রোগের কিছু উপসর্গ থাকে। যেমন-
প্রথম দিকে চামড়ার রং সাদা বা বিবর্ণ হয়ে যায়। পাশাপাশি চুলকানিও থাকতে পারে।
শরীরের যেসব স্থানে শ্বেতি হয়, সেসব জায়গার লোমগুলোও সাদা হয়ে যায়।
সাধারণত শরীরের যেকোনো একদিকে (ডান বা বাঁ দিকে) হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
শ্বেতি হলে বা অন্য কোনো কারণে চামড়া সাদা হয়ে গেলে সহজে বোঝা যায়। একে চিহ্নিত করতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে। যেমন-
রোগের ইতিহাস বা বংশগত ইতিহাস। ‘উডস ল্যাম্প’ নামের যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা। ত্বকের বায়োপসি। রক্ত পরীক্ষা। চক্ষু পরীক্ষা ইত্যাদি।
চিকিৎসা
শ্বেতি রোগের চিকিৎসা বেশ সহজ। মুখে খাওয়ার ওষুধ, ছত্রাকবিরোধী কিছু মলম ছাড়াও শ্বেতির উন্নত সার্জিক্যাল চিকিৎসা বাংলাদেশেই রয়েছে, যাতে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায়। যেমন-
চিকিৎসকের পরামর্শে ‘অ্যান্টি-ফাঙাল’ বা ছত্রাকরোধী ওষুধ খেতে পারেন। এ ছাড়া ‘সিলেনিয়াম সালফাইড’ নামের শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। আক্রান্ত স্থানে শ্যাম্পু মাখিয়ে ৩০ মিনিট রেখে গোসল করে ফেলতে হয়। এভাবে সপ্তাহে দুদিন ব্যবহার করলে শ্বেতি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
‘রিক্যাপ’ মলম ব্যবহার করা যেতে পারে। সকালের দিকে শ্বেতি আক্রান্ত স্থানে রোদ লাগালেও উপকার মেলে।
ফটোথেরাপি (Narrow Band UVB and Puva) একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে সব মেলানোসাইট কোষ ধ্বংস হয়ে গেলে কোনো ওষুধ বা থেরাপিতে তেমন কাজ হয় না।
সার্জিক্যাল কিছু চিকিৎসার মধ্যে পাঞ্চ গ্রাফটিং, স্প্লিট থিকনেস, স্কিন গ্রাফটিং, ব্লিস্টার গ্রাফট ইত্যাদি অন্যতম। এসব চিকিৎসা ৬ থেকে ১৮ মাস স্থায়ী হতে পারে।
যাদের পুরো দেহের রং চলে গেছে অথবা অল্প কিছু স্থান বাকি আছে, তাদের ক্ষেত্রে বাকি রংগুলো সরিয়ে চিকিৎসা দেওয়া যায়। তবে অ্যাকরাল ভিটিলিগোর চিকিৎসা বেশ কঠিন, তখন ওসব স্থানে লোম থাকে না এবং রং ফিরিয়ে আনাটা দুরূহ হয়ে পড়ে। রং ছড়ানো শুরু হয় লোমের গোড়া থেকেই।
খাবার-দাবার
খুরমা, খেজুর, সবুজ মটরশুঁটি, শালগম, পালংশাক, মেথি, ডুমুর, সবুজ শাকসবজি, আম, পেঁয়াজ, পেস্তা, আলু, পিওর ঘি, মুলা, লাল মরিচ, শাকসবজি, আখরোট, গম ইত্যাদি খাবার শ্বেতি রোগ নিরাময়ে সহায়ক।
প্রতিরোধে করণীয়
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পেতে দিনের বেলায় পারতপক্ষে প্রখর রোদে বের না হওয়াই শ্রেয়। বাইরে বের হলে সানস্ক্রিন বা ছাতা ব্যবহার করা উচিত।
ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত, যার সান প্রটেকটিভ ফ্যাক্টল (এসপিএফ) হবে ৩০-এর ওপর।
রোদে বেরোনোর আধা ঘণ্টা আগে মুখে এবং হাত-পায়ে সানস্ক্রিনটি মেখে নিতে হবে। পরনের ব্যবহৃত কাপড় হতে হবে সামান্য মোটা প্রকৃতির, যাতে দেহে আলো প্রবেশ করতে না পারে। তবে সন্ধ্যার পর যেকোনো ধরনের কাপড় পরা যাবে।
ধূমপান, অ্যালকোহল, গুরুপাক খাবার বর্জন করা ভালো। তবে দুধ, ডিম, ছানা ইত্যাদি খাওয়া যাবে না বলে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, তা সঠিক নয়।
সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। দীর্ঘ সময় ঘামে ভেজা কাপড় বেশিক্ষণ পরে থাকা ঠিক নয়। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
যারা দীর্ঘ সময় পানিতে কাজ করেন, বিশেষ করে বাড়ির গৃহিণীরা- কাজ শেষে তাদের হাত-মুখ ভালোভাবে ধুয়ে-মুছে ফেলতে হবে, যাতে হাতের বা পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলোয় পানি জমে না থাকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে তার যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
শরীরে যেকোনো ধরনের সাদা দাগ হলে, কারও ত্বক হঠাৎ লাল বা কালো হলে, তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে বা চুলকাচ্ছে- এমন মনে হলে দ্রুত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।