
জলাতঙ্ক রোগের কারণ হলো রেবিস ভাইরাস (Rabies virus)। এই ভাইরাস সাধারণত সংক্রমিত প্রাণীর লালা বা লালাগ্রন্থির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এটি প্রধানত কামড়, আঁচড় বা সংক্রমিত প্রাণীর লালা মানুষের ক্ষত বা শ্লেষ্মা ঝিল্লির সংস্পর্শে এলে ছড়ায়।
জলাতঙ্ক রোগের প্রধান কারণ
▶ সংক্রমিত প্রাণীর কামড়: জলাতঙ্ক ভাইরাস সাধারণত কুকুর, বিড়াল, বাদুড়, শিয়াল, নেউল ইত্যাদি প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমিত প্রাণীর কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
▶ লালার সংস্পর্শ: যদি সংক্রমিত প্রাণীর লালা মানুষের চোখ, নাক, মুখ বা কোনো খোলা ক্ষতের সংস্পর্শে আসে, তাহলেও জলাতঙ্ক হতে পারে।
▶ বাদুড়ের সংস্পর্শ: কিছু ক্ষেত্রে বাদুড়ের লালা বা কামড়ের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণের পর কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস সময় নেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণ কয়েক দিনের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। লক্ষণগুলো মূলত দুটি পর্যায় বিভক্ত।
১. প্রাথমিক লক্ষণ (Prodromal Phase): এই পর্যায়ে সাধারণ ফ্লু-এর মতো লক্ষণ দেখা দেয়:
▶ জ্বর
▶ মাথাব্যথা
▶ শরীরে ব্যথা বা দুর্বলতা
▶ গলা ব্যথা
▶ বমি বমি ভাব বা বমি
▶ অস্থিরতা বা উদ্বেগ
▶ কামড় বা আঁচড়ের জায়গায় চুলকানি, জ্বালা বা অস্বস্তি

২. নিউরোলজিক্যাল লক্ষণ (Neurologic Phase):
এই পর্যায়ে ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং লক্ষণগুলো আরও গুরুতর হয়। এটি দুটি রূপে দেখা দিতে পারে:
ক) উত্তেজিত বা ফিউরিয়াস রূপ (Furious Rabies):
▶ পানি দেখে ভয় (হাইড্রোফোবিয়া): পানি পান করতে গেলে গলার পেশিতে খিঁচুনি এবং ব্যথা হয়।
▶ বাতাস দেখে ভয় (এরোফোবিয়া): বাতাসের সংস্পর্শে অস্বস্তি বা ভয়।
▶ অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ: মুখ দিয়ে লালা ঝরা।
▶ আক্রমণাত্মক আচরণ: উত্তেজনা, অস্থিরতা বা হ্যালুসিনেশন।
▶ পেশিতে খিঁচুনি এবং অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা।
খ) পক্ষাঘাত বা প্যারালাইটিক রূপ (Paralytic Rabies):
▶ পেশি দুর্বলতা এবং পক্ষাঘাত (প্রথমে কামড়ের জায়গা থেকে শুরু হয়)।
▶ কোমা এবং ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
চিকিৎসা
জলাতঙ্ক (Rabies) রোগের কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই। জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। একবার লক্ষণ প্রকাশ পেলে রোগী সাধারণত বাঁচে না। তাই প্রতিরোধ ও প্রাথমিক চিকিৎসাই একমাত্র উপায়।
জলাতঙ্ক সংক্রমণের পর করণীয় (PEP - Post Exposure Prophylaxis)
যদি জলাতঙ্ক আক্রান্ত কোনো প্রাণী কামড়ায়, আঁচড় দেয় বা লালা লাগিয়ে দেয়, তাহলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে।
▶ ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন (আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে)।
▶ আক্রান্ত জায়গাটি অন্তত ১৫-২০ মিনিট ধরে প্রচুর পানি ও সাবান দিয়ে ধুতে হবে।
▶ অ্যান্টিসেপ্টিক বা ৭০% অ্যালকোহল/পোভিডোন-আয়োডিন লাগান।
▶ ক্ষতস্থান চেপে বা সেলাই করা যাবে না।
▶ দ্রুত হাসপাতালে যান।
▶ যত দ্রুত সম্ভব জলাতঙ্কের টিকা (Rabies Vaccine) নিতে হবে।
▶ যদি ক্ষত গভীর হয় বা মাথা, ঘাড়, মুখের কাছে হয়, তবে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (RIG) নিতে হবে।

জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা
ক. আক্রান্ত হওয়ার পর: ৪-৫ ডোজ টিকা দেওয়া হয় (০, ৩, ৭, ১৪ এবং কখনো ২৮ দিনে)। যদি গুরুতর কামড় হয়, তবে Rabies Immunoglobulin (RIG) প্রথম দিনেই দিতে হয়।
খ. আক্রান্ত হওয়ার আগে: যাদের ঝুঁকি বেশি (যেমন- পশু চিকিৎসক, বন্যপ্রাণী কর্মী), তারা ৩ ডোজ (০, ৭ ও ২১ বা ২৮ দিন) নিতে পারেন।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধের উপায়
▶ পোষা কুকুর ও বিড়ালকে নিয়মিত জলাতঙ্ক টিকা দিন।
▶ অপরিচিত কুকুর, বিড়াল বা বন্য প্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
▶ কামড় বা আঁচড় লাগলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
সতর্কতা ও প্রতিরোধই একমাত্র বাঁচার উপায়, কারণ জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।