
কিডনি স্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক শনাক্তকরণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৩ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। এবারের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আপনার কিডনি কি সুস্থ? তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করুন। কিডনি স্বাস্থ্য রক্ষা করুন’, যা কিডনি রোগ গুরুতর হওয়ার আগেই শনাক্ত করার জন্য সক্রিয় স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ অথবা স্থায়ীভাবে কিডনি অকেজো বর্তমান বিশ্বের অসংক্রামক রোগ বা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান রোগ। সারা বিশ্বে বর্তমানে ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর ২.৪ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং ১.৭ মিলিয়ন মানুষ আকস্মিক কিডনি রোগে মারা যান। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০ জনে একজন কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে আবার পুরুষের তুলনায় নারীর এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি। তাদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০-৪৫ হাজার রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যাচ্ছে এবং ৩০-৩৫ হাজার রোগী স্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছেন। এই আড়াই কোটি কিডনি রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই রোগ বংশগত হতে পারে। সাধারণত নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি দেখা যায়।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ কী?
সাধারণত একজন ব্যক্তির তিন মাস বা তার অধিক সময় ধরে যদি কিডনি অকেজো থাকে, রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি থাকে, প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন যায়, প্রস্রাবের অ্যালবুমিনের মাত্রা (ACR/অ্যালবুমিন ক্রিয়েটিনিন রেশিও) বেশি থাকে, কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে কিডনির ক্ষতি হয়েছে এমন দেখা যায় অথবা eGFR ৬০ মিলির নিচে থাকে, তা হলে তার দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ অথবা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হয়েছে, এটা বলা হয়ে থাকে।
কারণ কী কী?
দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ।
বংশগত কিডনি রোগ- পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ, অ্যালপর্ট সিন্ড্রোম।
ক্রনিক গ্লোমারুলোনেফ্রাইটিস অথবা দীর্ঘস্থায়ীভাবে কিডনির ঝিল্লির প্রদাহ।
ক্রনিক ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস (যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাচ্ছেন, তাদের হয়)।
দুই কিডনির রক্তনালি বন্ধ হয়ে গেলে বা বাইল্যাটারাল রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস।
বাইল্যাটারাল অবসট্রাক্টিভ ইউরোপ্যাথি অথবা দুই কিডনির প্রস্রাব বের হওয়ার নালি বন্ধ হয়ে গেলে।
ওবেসিটি অথবা অত্যধিক ওজন।
লক্ষণগুলো কী কী?
ক্ষুধা মান্দ্য, খাদ্যে অরুচি।
বমি বমি ভাব হওয়া অথবা বমি হওয়া।
অত্যধিক দুর্বলতা বোধ করা।
রক্তস্বল্পতা।
উচ্চ রক্তচাপ।
রাতে বারবার প্রস্রাবের জন্য ঘুম থেকে ওঠে যাওয়া।
প্রস্রাবে ফেনা যাওয়া।
গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া।
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া।
পায়ে পানি আসা।
শ্বাসকষ্ট হওয়া।
বুকে ব্যথা।
সারা শরীরে চুলকানি হওয়া।
খিঁচুনি হওয়া।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
চিকিৎসা ও পথ্য
বাড়তি লবণ ও লবণাক্ত খাবার গ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
ফলের মধ্যে আপেল, পেয়ারা, নাশপাতি, আনারস, পাকা পেপে খেতে পারবেন। অন্যান্য ফল খেতে পারবেন না। কামরাঙা ও বিলিম্বি খাওয়া নিষেধ।
প্রোটিনের পরিমাণ কমাতে হবে। সারা দিনে ৪০-৫০ গ্রাম।
পানির পরিমাণ সাধারণত ১ লিটার, ২৪ ঘণ্টায়। পায়ে পানি না থাকলে পানি বাড়ানো যাবে।
ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিক খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাবার খাবেন আর সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ডায়াবেটিক কিডনি রোগীদের সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ এম্পাগ্লিফ্লোজিন। অবশ্য যাদের প্রস্রাবে ইনফেকশন অথবা ক্রনিক সিস্টাইটিস আছে, তাদের এ ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
প্রেশার থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রেশার নিয়ন্ত্রণ ও প্রোটিন যাওয়া কমানোর জন্য কার্যকরী ওষুধ এসিই ইনহিবিটার (ACEI) অথবা এআরবি (ARB)।
এ ছাড়া নন-স্টেরডাল এমআরএ (মিনারেলো কর্টিকয়েড রিসেপ্টার এন্টাগোনিস্ট) ব্যবহার করা হয়ে থাকে ডায়াবেটিক কিডনি রোগের চিকিৎসায়।
রক্তস্বল্পতার জন্য রক্ত তৈরি হওয়ার ইঞ্জেকশন দিতে হবে, আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ট্যাবলেট খাওয়া যাবে না।
ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে।
প্রতিদিন আধাঘণ্টা হাঁটতে হবে।
একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব ওষুধের পরিমাণ ও ধরন ঠিক করে নিতে হবে এবং ডিজিজ প্রগ্রেশান আটকাতে ওষুধ খেতে হবে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
কিডনি রোগপ্রতিরোধ করতে হলে ছোটবেলা থেকেই খাদ্যাভ্যাস ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে।
একজন মানুষের যত কেজি ওজন, দৈনিক তত গ্রাম প্রোটিন খাওয়া উচিত। এর বেশি প্রোটিন খাওয়া কিডনির জন্য ক্ষতিকর।
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ৩.৫-৪ লিটার পানি পান করা উচিত।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতি ওজন অথবা ওবেসিটি থেকে কিডনি অকেজো হতে পারে।
লবণাক্ত খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত তেল ও চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত।
প্রতিদিন অন্ততপক্ষে আধাঘণ্টা হাঁটতে হবে।
যাদের বংশে কিডনি রোগ আছে এবং যাদের ডায়াবেটিস অথবা উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের বছরে অন্তত দুইবার কিডনির পরীক্ষা (S. Creatinine, eGFR, Urine R/E, Urine for ACR/Urine for Microalbumin, USG of KUB region) করাতে হবে।
ব্যথানাশক ওষুধ যতদূর সম্ভব পরিহার করতে হবে। অথবা ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেবন করতে হবে।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে বলতে আমরা বুঝি, যখন HbA1c-এর মাত্রা ৬%-এর মধ্যে থাকে। এই পরীক্ষা প্রতি ৪ মাস পরপর করাতে হবে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে বলতে আমরা বুঝি, যখন প্রেশার ১২০/৮০ থাকে।
কিডনির সমস্যা থাকলে হার্টের সমস্যা হতে পারে। আবার হার্টের সমস্যা থাকলে কিডনির সমস্যা হয়। তাই এই দুই রোগ থাকলে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা