
মানবদেহে প্রতিটি কোষে ক্রোমোজম থাকে ৪৬টি। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেহকোষে ২১তম ক্রোমোজমে একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজম থাকে, যাকে ‘ট্রাইসমি ২১’ বলা হয়। এই অতিরিক্ত ক্রোমোজমটির কারণে বিশেষ কিছু শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি নিয়ে ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম হয়। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে জন ল্যাংডন ডাউন নামে এক ব্যক্তি এটি আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই এটি ডাউনস সিনড্রোম বা শুধু ডাউন সিনড্রোম বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্থান পায়। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৫ জন ডাউন শিশু জন্ম নেয় এবং দেশে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার ডাউন শিশু জন্মায়।
ডাউন সিনড্রোমের প্রকারভেদ
ডাউন সিনড্রোম তিন প্রকার।
ট্রাইসোমি২১: সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের রোগী দেখা যায়। এদের শরীরের প্রতিটি কোষে ক্রোমোজোম ২১ এর তিনটি কপি থাকে।
ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিনড্রোম: এই অবস্থা প্রায় ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ঘটে। এই সিন্ড্রোমে ক্রোমোজোম ২১-এর অংশ অন্য ক্রোমোজোমের সঙ্গে সংযুক্ত (ট্রান্সলোকেটেড) হয়ে যায়।
মোজাইক ডাউন সিনড্রোম: প্রায় ১ শতাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, যেখানে কিছু কোষে ক্রোমোজোম ২১-এর তিনটি কপি থাকে, অন্যদের সাধারণত দুটি কপি থাকে।
ঝুঁকি
মায়ের বয়স ২০ বছরের কম বা ৩৫ বছর বেশি হলে এর ঝুঁকি বাড়ে। বয়স যত বেশি হবে, শিশুর ডাউনস সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে। যেমন ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। অন্যদিকে কোনো মায়ের আগে একটি ডাউন শিশু থাকলে পরবর্তী সময়ে ডাউন শিশু হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বাবা-মা ত্রুটিযুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের সন্তানও ডাউন শিশু হতে পারে। যদি বাহক বাবা হন তবে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে ৩ শতাংশ আর মা হলে তা বেড়ে হয়ে যায় ১২ শতাংশ।
গর্ভাবস্থায় শনাক্তকরণ
পরীক্ষার মাধ্যমে জন্মের আগেই শিশুর ডাউন সিনড্রোম আছে কি না তা আশঙ্কা করা যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে মায়ের পেটে ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ শিশু ডাউন শিশু হিসেবে জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্রনিওনিকভিলাস স্যামপ্লিং করা প্রয়োজন হয়। তবে ক্রোমোজম পরীক্ষাই এ রোগ নিশ্চিতকরণের একমাত্র উপায়।
লক্ষণ ও জটিলতা
যেসব শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো হলো-
- শরীরের মাংসপেশি শক্তিশালী না হওয়া বা মাংসপেশিতে স্বাভাবিক শিশুদের মতো জোর না থাকা। একে মাংসপেশির শিথিলতা বলে এবং শিশু নরম তুলতুলে হয় যাকে ফ্লপি বেবি বলে।
- দুই চোখের বাইরের কোনা বাঁকাভাবে ওপরের দিকে উঠে থাকা।
- তাদের হাতের তালু জুড়ে একটি রেখা থাকতে পারে।
- নাক চ্যাপ্টা।
- কান ছোট ও নিচু।
- জিব বের হয়ে থাকা।
- জন্মের সময় শিশুর ওজন ও উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকা। ডাউন সিনড্রোম আক্রান্তদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও সক্ষমতায় এবং বিভিন্ন মাত্রার বুদ্ধিমত্তা ও অক্ষমতা থাকে। এ ছাড়া, ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত অনেক শিশুর বিভিন্ন শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে। যেমন-
- জন্মগত হৃদরোগ।
- অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা।
- শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির বৈকল্য।
- থাইরয়েডের ত্রুটিপূর্ণ ক্রিয়া।
- অধিক সংক্রমণের আশঙ্কা।
- ঘাড়ের হাড়ের সমস্যা।
- রক্তের রোগ।
কিছু শিশুর এর কোনোটিই হয় না, আবার কাউকে এর কয়েকটি ভোগ করতে হয়।
শিশুর যত্ন
ডাউন সিনড্রোমের কোনো প্রতিকার নেই। তবে পরিচর্যার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সঠিক যত্ন, পুষ্টিকর খাবার, স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি এবং ফিজিক্যাল থেরাপি দিলে ডাউন সিনড্রোম শিশুরা অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতো পড়ালেখা করে স্বনির্ভর হতে পারে। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি শারীরিক সমস্যা থাকে বলে এদের নিয়মিত শিশু বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরীক্ষা করাতে হয়।
মনে রাখুন
সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে হরমোনজনিত জটিলতাসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে এই শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।
মা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ করা উচিত।