
ডায়াবেটিস বা মধুমেহ হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী (ক্রনিক) রোগ, যেখানে শরীরে রক্তের গ্লুকোজ (চিনি) মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এর মূল কারণ হলো ইনসুলিন হরমোনের উৎপাদন কমে যাওয়া বা শরীরে ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ না করা। ইনসুলিন হলো একটি হরমোন যা অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হয় এবং রক্তের গ্লুকোজকে কোষে প্রবেশ করিয়ে শক্তিতে পরিণত করতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস প্রধানত তিন ধরনের হয়—
• টাইপ ১ ডায়াবেটিস: শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ ধ্বংস করে ফেলে।
• টাইপ ২ ডায়াবেটিস: শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করে না।
• জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস: গর্ভাবস্থায় কিছু নারীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ
ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে দেখা দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দ্রুতও লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষণ হলো—
• প্রচণ্ড পিপাসা অনুভব করা: রক্তে অতিরিক্ত চিনি থাকার কারণে শরীর পানির প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে সারাক্ষণ তৃষ্ণা অনুভূত হয়।
• ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া: শরীর অতিরিক্ত চিনিকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দিতে চায়, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, বিশেষ করে রাতে।
• অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগা: গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ না করায় শরীর শক্তির অভাব অনুভব করে এবং বারবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
• ওজন কমে যাওয়া: যথেষ্ট খাবার খাওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ ওজন কমে যেতে পারে, বিশেষ করে টাইপ ১ ডায়াবেটিসে।
• অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা: কোষে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ না পৌঁছানোর ফলে শরীরে শক্তির ঘাটতি হয়, যা ক্লান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
• দৃষ্টির সমস্যা: উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের লেন্সের আকৃতি পরিবর্তিত হয়, ফলে ঝাপসা দেখা যেতে পারে।
• ক্ষত ধীরে ভালো হওয়া: রক্তের উচ্চ চিনি মাত্রা ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়া ধীর করে দেয়। ফলে সামান্য কাটাছেঁড়াও অনেক দিন স্থায়ী হয়।
• ত্বক ও মুখের সংক্রমণ: বিশেষ করে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ সহজেই হতে পারে।
• হাত-পা অবশ বা ঝিনঝিনে অনুভব করা: স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণে এমন অনুভূতি হয়।

কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন?
• পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে।
• ওজন বেশি হলে বা স্থূলতা থাকলে।
• উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে।
• কম শারীরিক পরিশ্রম করলে।
• গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ইতিহাস থাকলে।
• ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে।

কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে ডায়াবেটিস হয়েছে?
শুধুমাত্র উপসর্গ দেখে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করতে হয়। যেমন—
▶ ফাস্টিং ব্লাড সুগার টেস্ট (উপবাস অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা)।
৮ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে রক্তের গ্লুকোজ মাপা হয়। ১২৬ মি.গ্রা./ডেসি.লি. বা তার বেশি হলে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।
▶ ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT)
নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে রক্তের চিনি মাপা হয়। ২০০ মি.গ্রা./ডেসি.লি. বা বেশি হলে ডায়াবেটিস নিশ্চিত।
▶ HbA1c (গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন টেস্ট)
গত ২-৩ মাসের গড় রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করে। ৬.৫% বা তার বেশি হলে ডায়াবেটিস বলে গণ্য করা হয়।
▶ র্যান্ডম ব্লাড সুগার টেস্ট
দিনে যেকোনো সময় রক্তের গ্লুকোজ মাপা হয়। ২০০ মি.গ্রা./ডেসি.লি. বা বেশি হলে এবং লক্ষণ উপস্থিত থাকলে ডায়াবেটিস নির্ধারণ করা হয়।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর উপায়
যদি আপনি মনে করেন যে আপনি ঝুঁকিতে আছেন বা লক্ষণ অনুভব করেন, তবে কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি—
• নিয়মিত ব্যায়াম করুন। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম।
• স্বাস্থ্যকর খাবার খান। কম চিনি, কম চর্বি, বেশি শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার।
• ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
• ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন।
• নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করুন।
• মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন।

শেষ কথা
ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক। শুরুতে খুব বেশি লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে। তাই ঝুঁকির মধ্যে থাকলে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো জরুরি। সময়মতো শনাক্ত হলে জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনে এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সতর্কতা ও সচেতনতাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার মূল চাবিকাঠি।