
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অনেক দেশেই প্রতিবছর বজ্রপাতে বহু মানুষ আহত ও নিহত হন। বিশেষ করে বর্ষাকাল ও গ্রীষ্মকালে বজ্রপাতের প্রকোপ বেড়ে যায়। বজ্রপাত সাধারণত অতিবেগুনী বিকিরণ ও উচ্চ তাপমাত্রার মাধ্যমে মানবদেহে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। অনেক সময় মানুষ তাৎক্ষণিক মারা যায়, আবার অনেক সময় আহত হলেও সঠিক চিকিৎসা না পেলে জটিলতা দেখা দেয়। তাই বজ্রপাতে আহত হলে কী করতে হবে তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বজ্রপাত কীভাবে ক্ষতি করে?
বজ্রপাত হলো প্রকৃতির বিদ্যুৎ নির্গমন প্রক্রিয়া, যা মেঘের ভেতর বা মেঘ থেকে ভূমিতে নির্গত হয়। এতে প্রায় ৩০,০০০ কেলভিন পর্যন্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়, যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। বজ্রপাত সরাসরি দেহে আঘাত হানলে বা কাছাকাছি কোথাও বিদ্যুৎ বিস্ফোরিত হলে শরীরে তড়িৎ প্রবাহিত হয়, যা মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে।
.jpg)
বজ্রপাতে আহত হলে করণীয় পদক্ষেপসমূহ
১. প্রথমে নিশ্চিত করুন আহত ব্যক্তি জীবিত কি না
বজ্রপাতের ফলে অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে অচেতন হয়ে পড়ে। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস ও নাড়ি পরীক্ষা করুন। যদি হৃদস্পন্দন না থাকে বা শ্বাস না চলে, তবে দ্রুত CPR (কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন) শুরু করুন। যদি আপনি প্রশিক্ষিত না হন, তাহলে যতদূর পারেন চেষ্টা করুন এবং দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা চান।
২. স্থানীয় ঝুঁকি থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনুন
আহত ব্যক্তি যদি এখনো খোলা জায়গায় থাকে, তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনুন। বজ্রপাত একাধিকবার একই স্থানে হতে পারে। ধাতব বস্তু বা ভেজা মাটি থেকে তাকে সরিয়ে শুকনো স্থানে রাখুন।
.jpg)
৩. প্রাথমিক চিকিৎসা দিন
• পোড়ার ক্ষত: বজ্রপাতের ফলে অনেক সময় ত্বকে পুড়ে যাওয়ার মতো দাগ পড়ে বা আসলেই পুড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্ষতস্থান পরিষ্কার রাখুন। পোড়া স্থানে বরফ বা ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করুন। তবে সরাসরি বরফ ঘষবেন না।
• স্নায়ু ও পেশীর ক্ষতি: অনেক সময় হাত-পা অবশ হয়ে যায় বা কাঁপুনি হয়। রোগীকে শান্ত থাকতে বলুন এবং অপ্রয়োজনীয় নড়াচড়া থেকে বিরত রাখুন।
• অচেতনতা ও মানসিক বিভ্রান্তি: বজ্রপাতের ফলে মাথায় আঘাত লেগে মস্তিষ্কে সমস্যা হতে পারে। আহত ব্যেক্তির যদি কথা বলতে সমস্যা হয়, বিভ্রান্ত হয় বা স্মৃতি হারায়, তবে চিকিৎসককে দ্রুত জানান।
৪. রক্তপাত হলে নিয়ন্ত্রণ করুন
খোলা ক্ষত থেকে রক্ত বের হলে পরিষ্কার কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে চাপ দিয়ে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করুন। ক্ষতস্থান ওপরে তুলে ধরলে রক্তপাত কমে।
৫. জীবনরক্ষাকারী সহায়তা নিন
যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিন। বজ্রপাতে চোখে না পড়া অনেক অভ্যন্তরীণ ক্ষতি হতে পারে, যা চিকিৎসক ছাড়া নির্ণয় করা কঠিন।
.jpg)
হাসপাতালে চিকিৎসা কীভাবে হয়?
হাসপাতালে সাধারণত নিম্নোক্ত চিকিৎসাগুলো দেওয়া হয়:
• ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG) করে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা।
• সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করে মস্তিষ্ক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতি যাচাই।
• স্নায়ু ও মাংসপেশির ফাংশন টেস্ট।
• পোড়া স্থান ড্রেসিং, অ্যান্টিসেপ্টিক ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ।
• ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড ব্যবস্থাপনা।
.jpg)
বজ্রপাতের পর দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা
বজ্রপাত থেকে বেঁচে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে রোগীর স্নায়ু, চোখ, কান ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে আছে—
• স্মৃতিভ্রষ্টতা বা মনোযোগের অভাব।
• হঠাৎ ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি।
• চোখে ঝাপসা দেখা বা শ্রবণশক্তি হ্রাস।
• হতাশা, বিষণ্নতা বা প্যানিক অ্যাটাক।
এই সমস্যাগুলোর জন্য ফলো-আপ চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং দরকার হতে পারে।
সতর্কতামূলক পরামর্শ
বজ্রপাতের সময় যেখানে থাকবেন না—
• খোলা মাঠ, ধানক্ষেত বা উঁচু স্থান।
• নদী বা পুকুরে গোসল করা।
• মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার।
• গাছের নিচে বা খোলা ছাদে আশ্রয় নেওয়া।
যেখানে থাকবেন—
• পাকা ভবনের ভিতরে।
• ধাতব বস্তু থেকে দূরে।
• জানালা-দরজা বন্ধ করে নিরাপদ আশ্রয়ে।
.jpg)
উপসংহার
বজ্রপাত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সচেতনতা এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে অনেক প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। বজ্রপাতে কেউ আহত হলে ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াই জীবন রক্ষার প্রধান উপায়।