
কান আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি শুধু শ্রবণের মাধ্যম নয়, বরং ভারসাম্য রক্ষার সাথেও জড়িত। কানের ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই একটি মোম জাতীয় পদার্থ তৈরি হয়, যাকে আমরা সাধারণত “ইয়ারওয়াক্স” বা কানের ময়লা বলি। এটি মূলত শরীরের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা – ধুলাবালি, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থকে কানের ভিতরে প্রবেশ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু অনেক সময় এই ময়লা জমে গিয়ে অস্বস্তি, কম শোনা বা সংক্রমণের কারণ হতে পারে। তখন প্রয়োজন হয় নিরাপদ উপায়ে এটি পরিষ্কার করার।
এখানে কানের ময়লা পরিষ্কারের বিভিন্ন উপায়, কী করবেন, কী করবেন না এবং কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কানের ময়লা কেন তৈরি হয়?
কানের অভ্যন্তরে থাকা গ্রন্থি থেকে একপ্রকার তেলতেলে পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা কানের খালি জায়গা ও চুলের কোষের সঙ্গে মিশে তৈরি করে মোম। এই মোমের কাজ হলো:
• ধুলো, জীবাণু ও পোকামাকড়ের প্রবেশ ঠেকানো।
• কানের চামড়াকে আর্দ্র রাখা।
• কানের অভ্যন্তরীণ ত্বককে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।
সাধারণত কানের ময়লা নিজে থেকেই শুকিয়ে পড়ে এবং চিবানো, কথা বলা বা হাঁটার সময় ধীরে ধীরে বাইরে চলে আসে।
কানের ময়লা পরিষ্কারের নিরাপদ উপায়
ক) হালকা গরম পানির ব্যবহার
গোসল করার সময় হালকা গরম পানির প্রবাহ দিয়ে কানের বাইরের অংশ ধুয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে কানের ভেতরে জোরে পানি ঢোকানো উচিত নয়।
খ) কটন বল বা টিস্যু
কানের বাইরের অংশ (ear lobe ও outer canal) পরিষ্কার করতে ভেজা কটন বল বা টিস্যু ব্যবহার করুন। তবে কানের ভেতরে প্রবেশ করবেন না।
গ) অলিভ অয়েল বা বেবি অয়েল
কানে কয়েক ফোঁটা হালকা গরম অলিভ অয়েল বা বেবি অয়েল দিয়ে ৫-১০ মিনিট শুয়ে থাকুন। এটি ময়লাকে নরম করে, ফলে তা সহজে বাইরে চলে আসে।
ঘ) ওভার-দ্য-কাউন্টার ইয়ার ড্রপস
ফার্মেসিতে পাওয়া যায় এমন করমোকসোল (carbamide peroxide) ড্রপস বা মোম নরম করার ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যবহারের নিয়ম ভালোভাবে পড়ে নিন।
ঙ) সিরিঞ্জ বা বাল্ব সিরিঞ্জ (Bulb Syringe)
ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে হালকা গরম পানি ব্যবহার করে সিরিঞ্জ দিয়ে কানের ভেতরে ধীরে ধীরে পানি ঢেলে ময়লা ধোয়া যেতে পারে। তবে এটি সঠিক পদ্ধতিতে করতে হবে।
কী করবেন না
কটন বাড ব্যবহার
আমরা অনেকেই অভ্যাসবশত কটন বাড কানে ঢুকিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। কিন্তু এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে ময়লা ভেতরে ঠেলে গিয়ে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি ছিঁড়ে যেতে পারে।
পিন, মেচতা বা কাঠি
কোনো রকম ধাতব বস্তু, পিন বা কাঠি দিয়ে কানের ময়লা পরিষ্কার করতে যাওয়া উচিত নয়। এটি সংক্রমণ, রক্তপাত এবং স্থায়ী শ্রবণহানির কারণ হতে পারে।
ঘন ঘন পরিষ্কার
যারা অতিরিক্ত কানের পরিচ্ছন্নতার প্রতি আগ্রহী, তারা প্রায়শই কানের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে ফেলেন। কানের ময়লা যদি সমস্যা না করে, তাহলে সেটিকে না ছোঁয়াই ভালো।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে আপনি নিজে কিছু না করে সরাসরি একজন ENT (Ear, Nose, Throat) বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিন:
• কানে ব্যথা।
• তীব্র চুলকানি।
• শোনা কমে যাওয়া।
• কানে বাজ বা আওয়াজ (Tinnitus)।
• কানের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বা তরল পদার্থ নিঃসরণ।
• জ্বর ও মাথা ঘোরা।
ডাক্তার সাধারণত মাইক্রোসাকশন, কিউরেট ব্যবহার বা স্যালাইন ওয়াশ করে কানের ময়লা নিরাপদে অপসারণ করেন।
কিছু অতিরিক্ত পরামর্শ
▶ শিশুদের কানের ময়লা পরিষ্কারে সাবধানতা আরও বেশি দরকার। বাচ্চার কানে ময়লা থাকলে বাড়িতে কিছু না করে ডাক্তারকে দেখান।
▶ কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন ব্যবহার করলে তা পরিষ্কার রাখুন, কারণ এতে ময়লা জমে সংক্রমণ হতে পারে।
▶ কানে এলার্জি বা একজিমার সমস্যা থাকলে কানের ত্বক সহজেই সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে ময়লা পরিষ্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সবশেষ
কানের ময়লা শরীরের স্বাভাবিক একটি রক্ষণাত্মক উপাদান। এটি নিজে থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাই অপ্রয়োজনীয়ভাবে কানের ভেতর ঢুকে পরিষ্কারের চেষ্টা না করে বরং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। অসুবিধা হলে অবশ্যই একজন কান, নাক ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ।