
স্ক্যাবিস (Scabies) একটি চর্মরোগ, যা এক ধরনের অতিক্ষুদ্র পরজীবী কীট Sarcoptes scabiei (সারকপটিস স্ক্যাবিই) দ্বারা হয়ে থাকে। এটি খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে এবং তীব্র চুলকানির মাধ্যমে রোগটি ধরা পড়ে। বিশ্বের নানা দেশে, বিশেষ করে গরম ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
স্ক্যাবিস কী?
স্ক্যাবিস হলো একটি সংক্রামক চর্মরোগ, যা সাধারণত চুলকানির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই রোগে আক্রান্ত হলে ছোট ছোট ফুসকুড়ি, চুলকানি এবং ত্বকে খোঁচাখুঁচির দাগ দেখা যায়। মূলত এই রোগের পরজীবী কীট ত্বকের নিচে গর্ত করে ডিম পাড়ে, ফলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে তীব্র চুলকানি শুরু হয়।
স্ক্যাবিস হওয়ার কারণ
১. পরজীবী সংক্রমণ
স্ক্যাবিসের প্রধান কারণ হলো Sarcoptes scabiei নামক পরজীবীর সংক্রমণ। এই কীটটি ত্বকের নিচে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ করে, যার ফলে চুলকানি ও ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
২. ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ
স্ক্যাবিস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। পরিবারের মধ্যে একই বিছানা বা পোশাক ব্যবহার করলে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
৩. অপরিষ্কার পরিবেশ
ঘনবসতিপূর্ণ এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বস্তি বা শ্রমিক আবাসন এলাকায় স্ক্যাবিসের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
স্ক্যাবিসের উপসর্গ
• তীব্র চুলকানি: বিশেষ করে রাতে চুলকানির তীব্রতা বেড়ে যায়।
• লাল ফুসকুড়ি: ত্বকে ছোট ছোট গুটির মতো লাল দানা হয়।
• চামড়ায় দাগ বা আঁচড়ের চিহ্ন: ঘন ঘন খোঁচাখুঁচির কারণে ত্বকে ঘা বা দাগ হয়।

অবস্থান
হাতের আঙুলের ফাঁকে, কবজি, কনুই, কোমর, নাভি, স্তনের নিচে, যৌনাঙ্গে, ও শিশুদের ক্ষেত্রে মাথা ও মুখেও হতে পারে।
স্ক্যাবিসের জটিলতা
চুলকানির কারণে ঘন ঘন চামড়া খোঁচানোর ফলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। দীর্ঘ সময় চিকিৎসা না করলে স্ক্যাবিস থেকে সেকেন্ডারি সংক্রমণ (যেমন ইমপেটিগো) হতে পারে, যা আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
চিকিৎসা
১. ঔষধ প্রয়োগ
স্ক্যাবিস নিরাময়ের জন্য নিচের ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়—
• পারমেথ্রিন (Permethrin) ৫% ক্রিম: এটি সবচেয়ে কার্যকর এবং নিরাপদ চিকিৎসা। গোসল করে শুকনো শরীরে মাথা ছাড়া পুরো শরীরে লাগিয়ে রাতে রেখে পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলতে হয়।
• ইভারমেকটিন (Ivermectin) ট্যাবলেট: গুরুতর বা বারবার আক্রান্ত রোগীদের জন্য মুখে খাওয়ার এই ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
• সালফার মলম: শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
• অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট: চুলকানি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
২. পরিবারের সকল সদস্যের চিকিৎসা
একজন আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি। নাহলে সংক্রমণ বারবার ফিরে আসতে পারে।
৩. ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস পরিষ্কার করা
জামাকাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো উচিত।
প্রতিরোধের উপায়
১. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
দেহ ও ব্যবহৃত পোশাক সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশুদের নিয়মিত গোসল করানো ও নখ ছোট রাখা উচিত।
সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত। একই বিছানা বা পোশাক ব্যবহার না করা উত্তম।
৩. পরিবার ও আশপাশের লোকদের সচেতন করা
স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয়, সে বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার।
৪. বারবার সংক্রমণ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
যদি বারবার স্ক্যাবিস হয়, তবে তা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিশেষ পরামর্শ
• শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিসের লক্ষণ একটু আলাদা হতে পারে। মুখে বা মাথায় ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে, যা বড়দের মধ্যে সাধারণ নয়।
• গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দিতে হলে নিরাপদ ওষুধ বেছে নিতে হয়, যেমন সালফার মলম।
• প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষ
স্ক্যাবিস একটি অতি সাধারণ কিন্তু বিরক্তিকর সংক্রমণ, যা সহজে ছড়ায় এবং দ্রুত চিকিৎসা না করলে জটিলতায় রূপ নিতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই রোগ পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য। বিশেষ করে পরিবার ও সমাজ পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ালে স্ক্যাবিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই চুলকানির মতো সাধারণ লক্ষণকে অবহেলা না করে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।