-1747296286.jpg)
হিটস্ট্রোক (Heatstroke) হলো একটি শারীরিক অবস্থা, যা শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে। সাধারণত এটি ঘটে দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় থাকা বা গরম আবহাওয়ায় শারীরিক পরিশ্রম করার কারণে। তাপজনিত আঘাতের কয়েকটি স্তর রয়েছে, যার মধ্যে হিটস্ট্রোক সবচেয়ে গুরুতর। এটি ঘটে যখন শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা তার বেশি হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
হিটস্ট্রোক হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। চিকিৎসা করা না হলে এটি দ্রুত মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, কিডনি এবং পেশির ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসা বিলম্বিত হলে এই ক্ষতি আরও বাড়ে, যা মারাত্মক জটিলতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
উপসর্গসমূহ
হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
• শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা: শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১০৪°F (৪০°C) বা তার বেশি— তাপঘাতের প্রধান চিহ্ন।
• মানসিক অবস্থার পরিবর্তন: বিভ্রান্তি, উত্তেজনা, অস্পষ্ট বাক্য বলা, খিটখিটে মেজাজ, প্রলাপ বকা, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হয়ে পড়া।
• ঘামের ধরনে পরিবর্তন: গরম আবহাওয়াজনিত তাপঘাতে ত্বক গরম ও শুষ্ক লাগে। তবে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে হিটস্ট্রোক হলে প্রচুর ঘাম হতে পারে।
• বমি ভাব ও বমি: অসুস্থ বোধ করা বা বমি হতে পারে।
• লাল ত্বক: শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে।
• দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস: শ্বাস দ্রুত ও হালকা হতে পারে।
• দ্রুত হৃদস্পন্দন: শরীর ঠাণ্ডা রাখতে হৃৎপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
• মাথাব্যথা: তাপঘাতে মাথা ধরতে বা ব্যথা করতে পারে।
কারণসমূহ
হিটস্ট্রোক নানা করণে ঘটতে পারে। এর মধ্যে আছে—
গরম পরিবেশে থাকা: ‘নন-এক্সারশনাল (ক্ল্যাসিক) হিটস্ট্রোক’-এ গরম পরিবেশে থাকলে শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এটি সাধারণত দীর্ঘসময় গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার সংস্পর্শে থাকলে ঘটে। বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
শারীরিক পরিশ্রম: ‘এক্সারশনাল হিটস্ট্রোক’ ঘটে যখন গরমে অতিরিক্ত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। যেকোনো বয়সী মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষত যাদের গরমে অভ্যাস নাই।
এ ছাড়া ঘাম শুকাতে না পারার মতো ভারী পোশাক পরা, অ্যালকোহল পান, যা শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং পর্যাপ্ত পানি পান না করার ফলে পানিশূন্যতা হওয়া থেকেও হিটস্ট্রোক হতে পারে।
ঝুঁকির কারণ
হিটস্ট্রোক যে কারও হতে পারে, তবে কিছু কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়-
• বয়স: শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হয় না। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের স্নায়ুতন্ত্র কম কার্যকর হয়। উভয় বয়সেই পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কম থাকে।
• গরমে পরিশ্রম: গরমে সামরিক প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা (যেমন- ফুটবল বা দীর্ঘ দৌড়) হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
• হঠাৎ গরমে অভ্যস্ত হওয়া: গরমে অভ্যস্ত না হলে, যেমন গ্রীষ্মের শুরুতে বা গরম জায়গায় ভ্রমণের সময় হিটস্ট্রোকের আশঙ্কা বেশি থাকে। অভ্যস্ত হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।
• এয়ার কন্ডিশন না থাকা: ফ্যান সাময়িক স্বস্তি দেয়, তবে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় কুলিংয়ের জন্য এয়ার কন্ডিশন সবচেয়ে কার্যকর।
• ওষুধ: কিছু ওষুধ শরীরের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যেমন- রক্তনালি সঙ্কোচক, বিটা ব্লকার, ডায়িউরেটিকস, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিকস।
• স্টিমুল্যান্ট ড্রাগ: ADHD-এর জন্য দেওয়া ওষুধ ও অবৈধ ড্রাগ যেমন অ্যামফেটামিন ও কোকেইন হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
• স্বাস্থ্য সমস্যা: দীর্ঘস্থায়ী হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা, স্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা অতীতে তাপঘাতের ইতিহাস থাকলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
জটিলতা
হিটস্ট্রোকের কারণে শরীর দীর্ঘসময় গরম থাকলে কিছু গুরুতর সমস্যা হতে পারে—
• প্রয়োজনীয় অঙ্গের ক্ষতি: দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মস্তিষ্ক বা অন্যান্য অঙ্গ ফুলে স্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
• মৃত্যু: যথাযথ ও সময়মতো চিকিৎসা না পেলে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন
• আপনি যদি সন্দেহ করেন কেউ তাপঘাতে আক্রান্ত, তা হলে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নিন। ৯৯৯ বা স্থানীয় জরুরি সেবায় কল করুন।
• চিকিৎসক না আসা পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা নিন।
• তাকে ছায়াযুক্ত বা ঘরের ভিতরে নিয়ে যান।
• অতিরিক্ত কাপড় খুলে ফেলুন।
• যেভাবেই হোক শরীর ঠাণ্ডা করুন— ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো, ঠাণ্ডা পানির ঝরনায় দাঁড় করানো, গার্ডেন হোস দিয়ে পানি ছিটানো, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে স্পঞ্জ করা, ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে ফ্যান চালানো, মাথা, গলা, বগল এবং কুঁচকিতে বরফ বা ভেজা তোয়ালে রাখা ইত্যাদি।
প্রতিরোধ
হিটস্ট্রোক পূর্বানুমানযোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধে নিচের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করুন—
• ঢিলেঢালা ও হালকা পোশাক পরুন। যেমন- লিনেন, সিল্ক, সুতি বা হেম্প।
• সূর্যের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে টুপি, সানগ্লাস এবং এসপিএফ ১৫ বা তার বেশি সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। প্রতি দুই ঘণ্টায় একবার করে লাগান।
• পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যাতে শরীর ঘাম ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
• কিছু ওষুধের কারণে তাপজনিত সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।
• গরমে কখনো কাউকে পার্ক করা গাড়িতে ফেলে রাখবেন না। বিশেষ করে শিশুদের।
• সবচেয়ে গরম সময়ে বিশ্রাম নিন, পানি পান করুন এবং সম্ভব হলে সকালের দিকে কাজ বা ব্যায়াম করুন।
• গরমে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হোন; নতুন জায়গায় গেলে বা গরমে অভ্যস্ত না থাকলে সময় দিন।
• ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সতর্ক থাকুন। গরমে ব্যায়াম বা ক্রীড়া কর্মসূচিতে অংশ নিলে সেখানে চিকিৎসা সহায়তা থাকা উচিত।
সূত্র: মায়োক্লিনিক