
টাইফয়েড জ্বর হলো স্যালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) নামের ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট একটি জীবনঘাতী সংক্রমণ। এটি সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ায়। শরীরে প্রবেশের পর ব্যাকটেরিয়াটি দ্রুত গুণে বেড়ে রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো শরীরে সংক্রমণ ঘটায়।
শহরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে টাইফয়েডের প্রকোপ বাড়ছে। একই সঙ্গে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ার ফলে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে এমন এলাকাগুলিতে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
উপসর্গ ও শনাক্তকরণ
টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই বাস করে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও অন্ত্রনালিতে এই জীবাণু অবস্থান করে। সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে— দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ জ্বর, ক্লান্তি, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। কিছু রোগীর শরীরে লালচে র্যাশও দেখা যেতে পারে। মারাত্মক সংক্রমণে জটিলতা বেড়ে যায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে টাইফয়েড নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যায়।
বিস্তার, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ও আক্রান্তের হার
উন্নত জীবনমান ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে টাইফয়েডের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে এটি এখনো আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে বসবাসরত জনগোষ্ঠী বিশেষত শিশুরা এই রোগে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
টাইফয়েড জ্বর সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য, তবে অনেক অঞ্চলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ (antimicrobial resistance) দেখা যাওয়ায় চিকিৎসা জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
অনেক সময় রোগের উপসর্গ চলে যাওয়ার পরও ব্যক্তি দেহে জীবাণু বহন করতে থাকেন এবং মলদ্বারের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। তাই চিকিৎসাকালে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি —
• চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা।
• টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া।
• যতক্ষণ না রোগ পুরোপুরি নিরাময় হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের জন্য খাবার তৈরি বা পরিবেশন না করা।
• চিকিৎসা শেষে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুনরায় জীবাণু পরীক্ষা করানো।
টিকা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
টাইফয়েড প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো: নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা, খাদ্য প্রস্তুতকারীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, এবং টাইফয়েড টিকাদান।
বর্তমানে WHO অনুমোদিত দুটি টাইফয়েড কনজুগেট টিকা (Typhoid Conjugate Vaccine) রয়েছে, যা ৬ মাস বয়স থেকে ৪৫ বা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে একবার ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া যায়। এর পাশাপাশি দুটি পুরনো ধরনের টিকাও কিছু দেশে ব্যবহার হয়।
• দুই বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের জন্য ইনজেকশনভিত্তিক টিকা।
• ছয় বছর বা তার বেশি বয়সীদের জন্য মুখে খাওয়ার ক্যাপসুল-আকারের টিকা।
এগুলোর কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কম এবং দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা নিশ্চিত করে না, তাই মাঝে মাঝে বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হয়। WHO অনুমোদিত নতুন কনজুগেট টিকাগুলো বর্তমানে টাইফয়েড-প্রবণ দেশগুলোর শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত করা হচ্ছে।
ভ্রমণকারীদের জন্য পরামর্শ
টাইফয়েড-প্রবণ অঞ্চলে ভ্রমণকারীদের জন্য ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম হলেও নিরাপদ খাদ্য, পানীয় ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি। নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করলে নিরাপদ থাকা সম্ভব:
• সবসময় ভালোভাবে রান্না করা ও গরম খাবার গ্রহণ করুন।
• কাঁচা দুধ ও দুধজাত পণ্য পরিহার করুন। কেবল পাস্তুরিত বা ফুটানো দুধ পান করুন।
• নিরাপদ পানি ছাড়া বরফ গ্রহণ করবেন না।
• সন্দেহজনক পানির ক্ষেত্রে ফুটিয়ে বা নির্ভরযোগ্য জীবাণুনাশক দিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করুন।
• টয়লেট ব্যবহারের পর, পশুপাখি বা খামারের পশুর সংস্পর্শে আসার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
• কাঁচা ফল ও সবজি ভালোভাবে ধুয়ে অথবা খোসা ছাড়িয়ে খান।
টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ হলেও বিশ্বজুড়ে এর প্রকোপ এখনো মারাত্মক। উন্নত স্যানিটেশন, নিরাপদ পানি, জনসচেতনতা এবং টিকাদানই পারে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে।
সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)