ঐতিহ্যের গন্ধ যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে না গিয়ে থাকা কঠিন। আর সেটি যদি হয় টেরাকোটা দ্বারা নির্মিত, তবে তো কথাই নেই! এমনই এক টেরাকোটার ঐতিহ্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির। আর কান্তজীর মন্দিরের নাম এলেই তার সঙ্গে যে আরেকটি নাম জড়িয়ে থাকে তা হলো নয়াবাদ মসজিদ। দুটো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানই একই দিনে ভ্রমণ করা যায়। তাই একদিন পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়লাম এই ঐতিহ্যবাহী দুটি নিদর্শন দেখতে।
কান্তজীর মন্দির
কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর জেলার অনেক পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। অনেকে এটিকে কান্তনগর, আবার কেউ কেউ এই মন্দিরকে কান্তজিউ মন্দিরও বলে থাকেন। তবে মন্দিরের 'নবরত্ন' নামটি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। এটি নবরত্ন মন্দির নামে পরিচিত ছিল। কারণ, তিন তলাবিশিষ্ট এই মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। কান্তজীর মন্দির ১৮ শতকে নির্মিত একটি চমৎকার ধর্মীয় স্থাপনা। এটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন।
১৭২২ সালে তার মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটির চূড়াগুলো ভেঙে যায়। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। ওপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়।
মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে। এ মন্দিরের অনিন্দ্য স্থাপনাশৈলী সব দর্শনার্থীর মতো আমাকেও খুব মুগ্ধ করেছে।
নয়াবাদ মসজিদ
নয়াবাদ মসজিদ কান্তজীর মন্দিরের কাছেই অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এ মসজিদ দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহারোল উপজেলার নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঢেঁপা নদী। এই মসজিদটি ১.১৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। জনমুখে কথিত আছে যে, কান্তজীর মন্দির যে শ্রমিকরা নির্মাণ করেছিলেন, তারা মুসলিম ধর্মের অনুসারী ছিলেন।
তখন তারা রাজার কাছে নামাজ কায়েমের জন্য একটি স্থান চান। রাজা রামনাথ রায় তাদের ১.১৫ বিঘা জমি দিয়ে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন। শ্রমিকরা কান্তজীর মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ মসজিদও নির্মাণ করতে থাকেন। যদিও এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। লোকমুখে এসব কথা প্রচলিত হয়ে আসছে। তবে মসজিদে প্রবেশের প্রধান দরজার ওপর স্থাপিত ফলক হতে জানা যায়, নয়াবাদ মসজিদ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালে ২ জ্যৈষ্ঠ, ১২০০ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৭৯৩ সালে) নির্মাণ করা হয়। সে সময় জমিদার ছিলেন রাজা বৈদ্যনাথ। যিনি ছিলেন দিনাজপুর রাজপরিবারের সর্বশেষ বংশধর। এলাকার অধিবাসীদের থেকে জানা যায় যে, ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে কান্তজীর মন্দির তৈরির কাজে আগত মুসলিম স্থপতি ও কর্মীরা এই মসজিদটি তৈরি করেন। তারা পশ্চিমের কোনো দেশ থেকে এসে নয়াবাদে বসবাস শুরু করেন এবং নামাজ আদায়ের জন্য এই মসজিদটি তৈরি করেন।
এটি একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এর চার কোণে ১২.৪৫ মিটার x ৫.৫ মিটার আকারের চারটি অষ্টভুজ মিনার রয়েছে। দেয়ালগুলোর পুরুত্ব ১.১০ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে একটি করে জানালা রয়েছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালে মোট তিনটি মিম্বার রয়েছে, যেগুলো মসজিদের তিনটি প্রবেশ দরজা বরাবর তৈরি করা হয়েছে। মাঝের মিম্বারটি আকারে বড় (উচ্চতা ২৩০ মিটার এবং প্রস্থ ১.০৮ মিটার) এবং অপর দুটি মিম্বার একই আকারের। মসজিদটি তৈরির সময় যেসব টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কারুকার্য ব্যবহার করা হয়েছিল, তার অধিকাশংই এখন আর নেই এবং যেগুলো রয়েছে সেগুলোও সম্পূর্ণ অক্ষত নেই। এখানে বর্তমানে মোট ১০৪টি টেরাকোটা অবশিষ্ট রয়েছে।
এগুলো আয়তক্ষেত্রাকার এবং আকার ০.৪০ মিটার x ০.৩০ মিটার।
কীভাবে যাবেন
কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটি যেহেতু দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় পাশাপাশি অবস্থিত, তাই এক ভ্রমণেই এই দুটো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘুরে আসা যায়। ঢাকা থেকে আসতে হলে বাস কিংবা ট্রেন দুভাবেই আসা যায়। ঢাকা থেকে ৩০ মিনিট (ক্ষেত্রভেদে এক ঘণ্টা) পরপর বাস দিনাজপুরের উদ্দেশে ছাড়ে। নাবিল, হানিফ, শ্যামলী, এসআর পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস ঢাকা-দিনাজপুর রুটে যাতায়াত করে।
কোম্পানিভেদে বাস টিকিটের মূল্য ৭৫০-১৩০০ টাকা পর্যন্ত। বাসে যেতে সাধারণত ৮-৯ ঘণ্টা লাগে। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বর্তমানে তিনটি ট্রেন যাতায়াত করে। একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। একতা এক্সপ্রেস সকাল ১০ : ১৫, দ্রুতযান এক্সপ্রেস রাত ৮ : ০০ এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস রাত ১১ : ৩০-এ ঢাকা হতে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। শ্রেণিভেদে ট্রেনের টিকিটের মূল্য ৫৭৫-১৯৭৮ টাকা পর্যন্ত। দিনাজপুর শহরে নেমে সেখান থেকে ইজিবাইক ভাড়া করে কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটোই এক সঙ্গে ভ্রমণ করা যায়। শহর থেকে ৪০/৪৫ মিনিট সময় লাগবে যেতে।
কোথায় থাকবেন
ভালো মানের হোটেলে থাকতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে দিনাজপুরের পর্যটন মোটেলে। সেখানে প্রতি রাতের জন্য খরচ হবে ১৫০০-২২০০ টাকা। এ ছাড়াও দিনাজপুর শহরে অনেকগুলো আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল ডায়মন্ড, নিউ হোটেল, হোটেল আল রশিদ ইত্যাদি। এসবে থাকতে হলে আপনার খরচ হবে এক রাতের জন্য মাত্র ৫০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত।
কোথায় খাবেন
দিনাজপুরে অনেকগুলো ভালো মানের খাবারের হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে রুস্তম হোটেল বেশ বিখ্যাত। এখানকার গরুর মাংসের কালাভুনা আর ভাত যেন অমৃত। এ ছাড়াও ভালো মানের আরও কয়েকটি হোটেল রয়েছে। দিনাজপুরের পাবনা সুইটসের কালোজাম, দিলশাদের পাটিসাপটা, এক টাকার সিঙাড়া এসব বেশ জনপ্রিয়। দিনাজপুরে গেলে এসব খাবার খেয়ে দেখতে পারেন।
কী কী দেখবেন
দিনাজপুরে গেলে কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ তো দেখবেনই! এ ছাড়াও ঘুরে দেখতে পারেন রামসাগর, সুখসাগর, রাজবাড়ি, দীপশিখা মেটি স্কুল, নবাবগঞ্জের আশুরার বিল, বিখ্যাত লিচুবাগান কিংবা দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান (দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঈদগাহ মাঠ)।
সতর্কতা
যেহেতু কান্তজীর মন্দির এবং নয়াবাদ মসজিদ দুটোই ধর্মীয় স্থান, তাই এসব জায়গায় গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না যাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। প্রতিটি ধর্মের মানুষের কাছে তাদের উপাসনালয় একটি পবিত্র এবং সর্বোচ্চ স্থান। তাই এসব জায়গায় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে ভ্রমণ করতে হবে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।
কলি