
সাহিত্য ও শিল্পমনা মানুষের জন্য হুমায়ূন আহমেদ এক তীব্র আবেগের নাম। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান কখনোই ম্লান হবে না। প্রকৃতিপ্রেমী এই কথাসাহিত্যিক গত শতকের নব্বইর দশকে গাজীপুরে ‘নুহাশপল্লী’ নামে এক গ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হুমায়ূনপ্রেমী দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশপল্লী ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
একজন সাহিত্য ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হিসেবে সবসময়ই ইচ্ছে ছিল নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ি ‘নুহাশপল্লী’তে ঘুরতে যাব। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণের দিন ঘনিয়ে এল। ঢাকায় বসবাসরতদের একদিনের ভ্রমণের জন্য নুহাশপল্লী বেশ উপযুক্ত একটি স্থান। ৭ সিটবিশিষ্ট একটি হাই এইস গাড়ি ভাড়া করে সকাল ৭টায় আমরা রওনা হলাম রাজধানীর গ্রিনরোড থেকে। উত্তরা-টঙ্গীর জ্যামে কিছুক্ষণ বাড়তি সময় লাগল।
সকাল ৯টা নাগাদ আমরা নুহাশপল্লীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। সকালের নাশতা সেরে আবার গাড়িতে বসলাম। গ্রাম আর বনজঙ্গল পেরিয়ে ২০ মিনিট পর আমাদের গাড়ি নুহাশপল্লীতে গিয়ে থামল। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন নেচে উঠল।
গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে নুহাশপল্লীর প্রধান ফটক। ফটকের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে নিলাম। ভেতরে প্রবেশ করার পরই চোখে পড়ে সামনে হুমায়ূন আহমেদের একটি ফ্রেস্কো। তার পেছনে একটি বাংলো। নুহাশপল্লীতে এলে হুমায়ূন আহমেদ সেই বাংলোতে থাকতেন। বাংলোর সামনে ছোট্ট একটি সুইমিংপুল এবং মা ও শিশুর ভাস্কর্য।
যত

দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, বিভিন্ন ধরনের ফলজ, বনজ আর ঔষধি গাছের সমাহার। দেখে চোখ আর মন উভয়ই শীতল হয়ে যায়। সবুজ মাঠের ওপর ছয়টি চেয়ার আর দুটি টেবিল পাতা। হুমায়ূন আহমেদ এসব চেয়ারে বসে গাছের ছায়ায় অসংখ্য দুপুর কাটিয়েছেন। টিনের ছাউনি দেওয়া চারপাশ খোলা এক জায়গায় দাবার কোর্ট বসানো। তিনি দাবা খেলতে পছন্দ করতেন। সেই ভাবনা থেকেই কিংবা স্মৃতি ধরে রাখতে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মাঠের বিভিন্ন গাছের সঙ্গে হ্যামোক টাঙিয়ে রাখা। দর্শনার্থীরা হ্যামোকে শুয়ে শুয়ে মনের আনন্দে দোল খায়।
চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি কাঁঠাল গাছ। তাতে প্রচুর কাঁঠাল ধরে আছে। লিচু গাছে লিচু পেকে লাল রং ধারণ করে আছে। খেজুর গাছগুলোয় খেজুর পেকেছে। জামরুল গাছে ধরেছে মজাদার জামরুল ফল। আম গাছে ধরেছে আম। নুহাশপল্লীতে আগত দর্শনার্থীরা সেসব ফল পেড়ে খাচ্ছে। এসবে যেন তাদের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

‘বৃষ্টিবিলাস’ নামে রয়েছে আরেকটি বাংলো। সেখানে কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। একসময় সেখানে শিল্পীদের নিয়ে শিল্পচর্চা করতেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধায়করা থাকেন এবং বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় দর্শনার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করে থাকেন। প্রতিটি কক্ষে রয়েছে ওয়াশরুম। দর্শনার্থীরা চাইলে সেই ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া বাইরেও পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা কয়েকটি ওয়াশরুম রয়েছে। বৃষ্টিবিলাসের পাশে রয়েছে কয়েকটি দোলনা। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেলে দর্শনার্থীরা সেখানে বসতে কিংবা দোল খেয়ে নিতে পারেন।
গাছপালা দেখতে দেখতে আরেকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মৎস্যকন্যা ও রাক্ষসের ভাস্কর্য। তার কাছেই রয়েছে আরও একটা ছোট্ট শিশুর ভাস্কর্য; যেন শিশুটি মন খারাপ করে আছে। একটু সামনেই দিঘি লীলাবতী। নামফলকে চোখ আটকে গেল। সেখানে দিঘির নামের সঙ্গে লেখা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াত মেয়ে লীলাবতী যে আমৃত্যু তার নয়নে, মনে বেঁচে ছিলেন, এ যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দিঘির দুই প্রান্তে সান বাঁধানো ঘাট, বটের ছায়া, কাঠগোলাপ ফুলের সমাহার। হেঁটে হেঁটে অন্য পাড়ে গেলাম।
সেখানে দুটি দোলনা রাখা। দোলনায় বসে দোল খেলাম। দোলনা থেকে সামনে দৃষ্টি মেললেই চোখে পড়ে ‘ভূত বিলাস’। দুই কক্ষবিশিষ্ট ওই বাংলোর বারান্দা দিঘির অভিমুখে। সেখানে বসে চা খেতে খেতে নিশ্চয়ই কখনো বৃষ্টি দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এপার ওপার হওয়ার জন্য সেই বাংলোর পাশ ঘেঁষে আগে বাঁশের সাঁকো ছিল। এখন আর নেই।
ক্ষুধার তাড়নায় দিঘির পাড় থেকে চলে এলাম বৃষ্টিবিলাসে। গল্প জুড়ে দিলাম নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধানে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে। একজন জানালেন, তিনি ২৫ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। কথায় কথায় হুমায়ূন আহমেদের অনেক স্মৃতিচারণা করলেন। তিনি জানালেন এক মজার তথ্য, হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীতে এলেই নাকি বৃষ্টি হতো। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বৃষ্টির এমনই নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা যখন জানতেন, তিনি নুহাশপল্লীতে আসবেন, ধরেই নিতেন যে বৃষ্টি হবে।
মজাদার দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো আমাদের সামনে। দুই রকমের ভর্তা, টমেটোর চাটনি, সালাদ, মুরগির মাংস, ডাল আর সাদা ভাত। একদম তাদের হাতের রান্না করা সতেজ খাবার। খেতে খেতে আরও গল্প হলো। তারা জানালেন, যখন হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন, অনেক মজা হতো। তিনি সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন।
সময়ঘড়িতে বিকেল নেমে এল। আমরা মাঠের লিচুগাছের ওপর ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে বসলাম, ছবি তুললাম। আবারও পুরো মাঠ ঘুরে বেড়ালাম, গাছপালা দেখলাম। আমাদের দলের কয়েকজন খেজুর বাগানে ক্রিকেট খেলল। নুহাশপল্লীতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো, এখানে একটা লাইব্রেরি থাকা উচিত ছিল; যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সব বই থাকবে। এও মনে হলো, নুহাশপল্লীর আরও একটু যত্ন আর সংস্কার করা জরুরি।
সন্ধ্যা নামার মুখে মন কেমন করা বিষণ্নতা নিয়ে মাঠের এক কোণে হুমায়ূন আহমেদের সমাধিতে গেলাম। সেখানে গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার নামছে। আলো জ্বেলে দেওয়া হলো। আমরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সন্ধ্যা ৭টায় নুহাশপল্লী থেকে বের হয়ে এলাম। বনজঙ্গল পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। গাজীপুর চৌরাস্তায় সন্ধ্যার নাশতা সেরে নিলাম। ঢাকায় পৌঁছাতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করার দরুন তবু সময় অনেকটা বেঁচে গেল। একটা সুন্দর দিনের স্মৃতি নিয়ে আমরা ফিরে গেলাম যে যার গন্তব্যে।
যেভাবে যাবেন: রাজধানীর মহাখালী বা গুলিস্তান থেকে ওই রুটে বিভিন্ন বাস চলাচল করে। যেমন- ঢাকা পরিবহন, সম্রাট লাইন, রাজদূত পরিবহন ইত্যাদি। সেসব বাসে গাজীপুরের হোতাপাড়া নেমে সিএনজি বা অটোরিকশায় নুহাশপল্লী যেতে পারবেন। এ ছাড়া গণপরিবহন ব্যবহার করতে না চাইলে ব্যক্তিগতভাবে মাইক্রোবাস বা হাইএইস ভাড়া করেও যেতে পারেন।
টিকিট মূল্য এবং সময়সূচি: নুহাশপল্লী সারা বছরই খোলা থাকে। কোনো সাপ্তাহিক বন্ধ নেই। প্রতিদিন সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বিশেষ অনুরোধে আরও কিছুক্ষণ থাকা যেতে পারে। টিকিট মূল্য ১২ বছরের ঊর্ধ্বে জনপ্রতি ২০০ টাকা। তবে বছরে দুদিন ১৩ নভেম্বর ও ১৯ জুলাই অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে সবার জন্য প্রবেশ মূল্য ও খাবার ফ্রি।
যেখানে থাকবেন: নুহাশপল্লীতে থাকার ব্যবস্থা নেই। তবে গাজীপুরে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। চাইলে সেখানে থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে নুহাশপল্লী ছাড়াও আশপাশে আরও কিছু জায়গা ভ্রমণ করে নিতে পারেন।
যা খাবেন: সকাল ও সন্ধ্যার নাশতা নুহাশপল্লীতে পৌঁছানোর একটু আগেই মেইন রোডের পাশের কোনো হোটেল থেকে খেয়ে নিতে পারেন। নিরিবিলি হোটেলের খাবারের মান বেশ ভালো। দুপুরের খাবার নুহাশপল্লীর ভেতরেই খেয়ে নিতে পারেন।
সতর্কতা: ঘুরতে গিয়ে কোনো প্লাস্টিক বা ময়লা-আবর্জনা বাইরে কিংবা পর্যটন স্পটে ফেলবেন না। এমন কোনো আচরণ করবেন না যাতে অন্য দর্শনার্থীদের কোনো সমস্যা হয়।
কলি