
চোখ ও মনের শীতলতা আনার জন্য সবুজের সান্নিধ্য সবাই চায়। একটুখানি গ্রামীণ পরশ, সবুজের স্নিগ্ধতা, কোলাহলবিহীন জীবনের সন্ধানে ছুটে চলতে চায় সবাই। কিন্তু আটপৌরে জীবনে মেলে না সব। অবারিত সবুজের মধ্যে একটুখানি প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে মানুষ বের হয় তার চেনা গণ্ডি ছেড়ে। জুন মাসে অফিসে কাজের খুব চাপ গিয়েছে।
তাই প্রাণ ভোরে নিশ্বাস নিতে ট্যুর গাইড বঙ্গভ্রমণের সঙ্গে ভাসমান পেয়ারাবাগান ঘোরার পরিকল্পনা করে নিলাম।
ভাসমান বাজারের কথা শুনলেই থাইল্যান্ড, ইতালি কিংবা ভারতের পানির ওপর ভেসে চলা কোনো বাজারের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশের ভেতরেই যে একই রকম আকর্ষণীয় ভাসমান বাজার রয়েছে সে গল্প কয়েক বছর আগেও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা ছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই বাজারের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার সকাল বেলাতেই বঙ্গভ্রমণ থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো রাত ৭টার আগেই পৌঁছাতে হবে সদরঘাটে যদি ডেকে রাত্রি যাপন করতে চাই। আমি বললাম এত আগে কেন? লঞ্চ তো রাত ১০টায় ছাড়বে?
এখন প্রশ্ন, তিন ঘণ্টা আগে কেন আসতে বলা হলো? কারণ ডেকে কারও স্থান নির্ধারণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে স্থান দখল করার মাধ্যমেই রাত কাটাতে হবে। অফিসের কাজ শেষ করেই বাসায় গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। যান্ত্রিক নগরীর ধুলোমাখা শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সদর ঘাটে এসে পৌঁছালাম। সাড়ে ৭টার পরে যখন সদরঘাট পৌঁছালাম, তখন মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে রাত কাটানোর জন্য তেমন ভালো কোনো জায়গা আমি পাচ্ছি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের জন্য নির্ধারিত লঞ্চে উঠে বঙ্গভ্রমণের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হলো- তখন জানতে পারলাম যে ব্যাপারটা আসলে ততটাও গুরুতর নয়। উল্লেখ্য, বঙ্গভ্রমণে শিপলু ভাই আরও আগে পৌঁছে আমাদের দলের সবার জন্য প্রয়োজনীয় স্থান হিসেব করে একটি সুবিধাজনক এলাকা দড়ি বেঁধে দখল করে রেখেছিলেন। ওই সীমানার ভেতরে আবার আমরা ব্যাগ দিয়ে আরও সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের স্থান দখল করে রাখি। নির্ধারিত সময়ে অ্যাডভেঞ্চার ০৯ বরিশাল পানে যাত্রা শুরু করল। এটি আমার প্রথম লঞ্চ যাত্রা।
ডেকে রাত্রিযাপন করে নদীপথ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই নতুন। তবে ফেরার পথে রাতে কেবিনের টিকিট কাটাই। কারণ পরদিন সকালে ঢাকা ফিরেই অফিসে যোগ দিতে হবে। সারা দিনের ধকল শেষে রাতের ঘুম খুব জরুরি ছিল। পূর্ণিমার রাত আমাদের তরি এগিয়ে চলছে। রাত ১১টার দিকে আমাদের রাতের খাবার দেওয়া হলো। গরম গরম ভাত সঙ্গে ডাল, সবজি, পোয়া মাছ। পূর্ণিমার রাতে ডেকে বসে খাবার খাওয়ার অনুভূতিই অন্যরকম। যাই হোক পেটপূজা শেষ করে নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলাম। না বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আমার মতো বাকি সবার অবস্থা একই। রীতিমতো ঘরের আমেজে বিছানা গুছিয়ে ঘুমাতে যাওয়া প্রতিটি মানুষ নিজেদের পানির বোতলটি জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। মোটামুটি সবাই একইভাবে ঘুমিয়েছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম ডেকে ঘুমোনোর অভ্যাস যাদের আছে, তাদের পক্ষেও পর্যাপ্তভাবে ঘুমানো সম্ভব নয়।
কারণ সারা রাত আলো জ্বলতেই থাকে, আর কোনো না কোনো হকারের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। সারা রাত মেঘে ঢাকা পূর্ণিমার চাঁদ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর গান বাজনার মাঝে রাত কীভাবে পার হয়ে যায় টের পাইনি। ভোর ৪টা বাজার আগেই লঞ্চের ভেঁপু বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে আমরা ঘাটে পৌঁছে গেছি। লঞ্চঘাট থেকে নেমেই আমরা চেপে বসলাম লেগুনাতে। গন্তব্য স্বরূপকাঠি ঘাট। সকালবেলার মিষ্টি হাওয়া খুব ভালো লাগছিল। ঘাটে আসার পর আমাদের সাতক্ষীরা মিষ্টি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো নাশতা খাওয়ানোর জন্য। গরম গরম লুচি, সবজি ভাজি, ডাল এক অন্য রকম রসায়ন।
সঙ্গে যোগ হলো সবেমাত্র কড়াই থেকে নামানো হালকা গরম মিষ্টি। পেটপূজা শেষ করে আমরা ট্রলার ভাড়া করে এগিয়ে যেতে লাগলাম আটঘর, কুড়িয়ানা খালের দিকে। আমাদের নৌকা এগিয়ে যেতে লাগল অপরূপ সন্ধ্যা নদী পাড়ি দিয়ে। নদীর দুই ধারের জনজীবন উপভোগ করছিলাম আমরা। পানিতে ভরপুর খালে ভাসছে ছোট ছোট নৌকা। তাতে বোঝাই করা আছে বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারা। খালের পাড় ঘেঁষে নোঙর করা আছে অপেক্ষাকৃত বড় মহাজনী নৌকাও। পাইকাররা ছোট নৌকায় ঘুরে ঘুরে পণ্য দেখছেন। আবার পেয়ারার নমুনা নিয়ে চাষিরা চলে যাচ্ছেন খালের পাড়েই আড়তে। দরদাম হচ্ছে। বিক্রি শেষে নৌকা খালি করে চাষিরা বাড়ির পথ ধরছেন। ফলের এই বিকিকিনি ঘিরে পুরো এলাকা এখন জমজমাট।
আমাদের মাঝি জানালেন আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নেই হয় পেয়ারার আসল কেনাবেচা। বাগানমালিকরা নৌকায় করে পেয়ারা নিয়ে আসেন।
ভীমরুলি, আটঘর আর কুড়িয়ানা- তিনটি জায়গায় বসে ভাসমান পেয়ারার বাজার। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় বড় ইঞ্জিন বোট নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে পেয়ারা কিনেন। পেয়ারা কেনা হয় নৌকা হিসেবে কিংবা মণ হিসেবে। এই হাটগুলো ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে পেয়ারার ভরা মৌসুম জুলাই থেকে আগস্টের শুরু পর্যন্ত। পুরো নদীপথেই অসংখ্য সেতুর দেখা মেলে- কোনোটি বাঁশের তৈরি, কোনোটি কংক্রিটের। কিছু কিছু সেতু এত নিচু ছিল যে ট্রলারের ছাদে শুয়ে পরে আমাদের নিজেদের মাথা সুরক্ষিত করতে হয়েছিল।
নদীপথে চলতে চলতেই চোখে পড়ল অসংখ্য পেয়ারা ও আমড়াবাগান। কিছু কিছু আমড়া গাছের ডাল এত নিচু ছিল যে তা আমাদের ট্রলারের ওপর রীতিমতো হাতের নাগালে চলে আসে। এবার আমরা ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ২০ টাকার বিনিময়ে পেয়ারা বাগানে প্রবেশ করলাম। চারদিকে পাখির কিচির মিচির ডাক। নাম না জানা পাখি উড়ে যাচ্ছিল চোখের সামনে দিয়ে। বাগানে ঢোকার পর দেখলাম চারদিকে শুধু পেয়ারা আর পেয়ারা।
এত পেয়ারা আমি কল্পনাতেও কোনো দিন ভাবিনি। আমাদের ডিঙ্গি নৌকার মাঝি নিরুপম দা বাগানের গহীনে আমাদের নিয়ে চলছেন। বাগানের মালিক ও তার স্ত্রী ছোট ছোট নৌকায় চড়ে খুব যত্নসহকারে পেয়ারা পাড়ছেন, আর নৌকা বোঝাই করছেন। আমি ১টা পেয়ারা চাওয়া মাত্রই প্রায় ৫ কেজি ফ্রিতে দিয়েছেন। এই মানুষগুলো অসম্ভব ভালো। এই ভিমরুলির প্রায় ৯৫ শতাংশ লোক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। চারপাশ দেখতে দেখতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় কীভাবে যে কেটে গেল টের পেলাম না। পেয়ারার পাশাপাশি কাঁচকলা ও লেবুও এখানে পাইকারি হিসেবে বিক্রি হচ্ছিল।
কলি